[প্রকাশিত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত দখিনা পত্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, একটি আনন্দধারা উদ্যোগ
https://anandodhara.com/wp-content/uploads/2019/03/Dakhina.pdf ]
ঠাম্মার একটা আঙুল নিজের আঙুলে জড়িয়ে নদীর বাঁধানো ঘাটটায় বসেছিল কাহিনী। তখন সবে সন্ধে নামছে। নদীর ওপারে ঐ দূরে লাল তামার চাকতির মত সূর্যটা গাছগাছালির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে আহ্লাদে আলো আর রঙের খেলায় মেতেছে। আকাশে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা মেঘখন্ডগুলোকে কখনো লাল, কখনো কমলা রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যেন কোন খেয়ালী চিত্রকর সমগ্র পরিবেশটাকে আরক্তিম করে তুলেছে। এইরকম সময়গুলোতে যেন কোন এক অদৃশ্য শক্তি মানুষকে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে যায়। ষোলো বছরের ফুটফুটে মেয়ে কাহিনী, সারাক্ষণ যার মুখে ফুলঝুরি ছোটে, সে অব্দি চুপ করে দেখছিল নদীর জলে আকাশের থেকে ঝরে পড়া সোনা আলো আর তার আবীর রঙের ঝিকিমিকি। কলকাতা থেকে কদিনের জন্য দেশের বাড়িতে দিদার কাছে এসেছে সে। তার কোমর লম্বা চুল মোটা ডাঁটো বিনুনি হয়ে তার সদ্যোদ্ভিন্ন বুকের ওপর আলগোছে পড়ে আছে। সন্ধের মৃদুমন্দ হাওয়ায় বিনুনির শেকল থেকে মুক্তি নিয়ে দু এক গুচ্ছ অবাধ্য চুল মুখের ওপর এসে পড়েছে। চোখের ওপর থেকে চুল সরাতে সরাতে কাহিনী জিগ্যেস করে উঠল
“আচ্ছা গ্র্যানি, শুনেছি, হোয়েন উ ওয়্যার এ কিড, তুমি আর তোমার গ্র্যানিও এই নদীর পাশে এসে বসতে।”
“হ্যাঁ রে। আমিও ঠিক তোর মত আমার ঠাম্মার হাত ধরে এই নদীর ধারে বসে কত বিকেল থেকে সন্ধে হতে দেখেছি। কিন্তু আজকাল আর এই নদীটাকে ঠিক চিনতে পারি না। অনেক বদলে গেছে।”
“কেন? সেই ছোটবেলা থেকে দেখছ। তাও চিনতে পারো না কেন?”
“আসলে নদীরা তো বহতা। সময়ের সাথে সাথে ওরা গতি পরবর্তন করে। ক্রমাগত রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যায়। আগে এর জল কেমন হাল্কা নীল ছিল। এখন কেমন ছাইরঙা হয়ে গেছে। ওপর থেকে জলের মধ্যে যে মাছগুলো দেখতে পাওয়া যেত তারও রঙ, আকৃতি, প্রকৃতি বদলে গেছে।”
“বহতা? ইউ মীন ফ্লোয়িং রাইট? কাম অন্ গ্র্যানি, তুমি না? মাঝে মাঝে কোন ভাষায় যে কথা বলো বুঝতেই পারি না। এনিওয়েজ, আচ্ছা একটা কথা বলো। তোমার গ্র্যানির সাথে তোমার গ্র্যানপার পারহ্যাপ্স লাভ ম্যারেজ তাই না?”
“ধুর বোকা। তখনকার দিনে এই আজকালকার মত প্রেম টেম হত না। আমরা, আমাদের মা ঠাকুমারা তোদের মত, ওই তোদের ভাষায়, আল্ট্রামডার্ন ছিল না। বুঝলি? কেন বল তো? তোর কেন মনে হল আমার দাদু ঠাকুমার প্রেম করে বিয়ে?”
“না মানে তোমার গ্র্যানি তো আই গেস বাঙালি না। তাই ভাবছিলাম।”
“ও মা। দিদিমা বাঙালি নয় কেন রে? দিব্যি নৈহাটির মেয়ে। অবাঙালি হতে যাবে কোন দুঃখে?”
“বারে তুমিই তো বলেছিলে তোমার গ্র্যানির নাম, লেট মী রিমেম্বার, কুমুদিনী। রাইট? তো সেটা তো আর বাংলা নাম নয়। ইন ফ্যাক্ট বাংলাতে এরকম কোন শব্দই নেই।”
“ধুর বোকা। কুমুদিনী একদম বাংলা শব্দ। এক ধরণের ফুল। যেমন আমার নাম কথা। তোমার মায়ের নাম যেমন করবী সেরকম।”
“রিয়েলি? উ মীন কুমুদিনী ইজ এ বেঙ্গলি ওয়ার্ড? তোমার নাম, মায়ের নাম – কথা, করবী একসেটরা বাংলা শব্দ জানি। কিন্তু কুমুদিনী?” অবিশ্বাসী চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে কাহিনী।
বিরক্তিতে মাথা নাড়েন বৃদ্ধা কথা সান্যাল। “হ্যাঁ রে। সত্যি কি দিনকাল এলো। তোরা, মানে তোদের প্রজন্ম বা তার পরের পরের প্রজন্ম, তোরা কি বাংলা ভাষাটাকে পুরোপুরি ভুলে যাবি? আজ থেকে আর একশ বছর পর ভাষাটা কি সত্যিই থাকবে? তুই তো ইংরেজি শব্দ ছাড়া এক মিনিটও কথা বলতে পারিস না। আর বাংলার অর্ধেক শব্দ অব্যবহারে অপ্রচলিত হয়ে পড়ছে দেখছি। তোর দাদুর নাম ভাস্কর। সূর্যের প্রতিশব্দ। ভাস্কর তো দূরে থাক তোরা সূর্য কথাটাই ভুলতে বসেছিস। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন হলে সেটাকে বলিস সানি ডে। কে জানে বাবা এই বাংলা ভাষাটা থাকবে তো?”
কাহিনী মুখে মিচকে ফাজিল হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে কথার গলা জড়িয়ে ধরল। গাঢ়স্বরে ডাকল “ঠাম্মা”। সে জানে গ্র্যানিকে ঠাম্মা বলে ডাকলে তার সব রাগে জল ঢালা হয়ে যায়। কথা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন “বল”।
“তোমায় কে বলেছে এগুলো ইংরেজি শব্দ। এই যে সানি ডে, লাভ ম্যারেজ, গেস যে শব্দগুলো আমি ইউজ করেছি এতক্ষণ, এগুলো তো বাংলা শব্দই ঠাম্মা।”
“আবার ফাজলামি করছিস? এগুলো কবে থেকে বাংলা শব্দ হল শুনি?”
“ধরো যদি বলি, আজ থেকে ঠাম্মি? একটা কথা বলো। আক্কেল, আসল, এলাকা, ওজন এই শব্দগুলো বাংলা তো ঠাম্মা?
“হুম”
“আর, আর আওয়াজ, আন্দাজ, আয়না, খারাপ?”
“ও মা, ওগুলো বাংলা হবে না কেন? তুই কি বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“এই ওয়ার্ডসগুলো ঠাম্মা বাংলার পার্ট ছিল না ফর ইটার্নিটি। প্রথম চারটে শব্দ আরবি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে এসেছে। পরের চারটে ফার্সী ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে এসেছে। এলাকা শব্দের আসল আরবি শব্দ ইলাকাহ, খারাপ শব্দের ফার্সী শব্দ খারাব।”
“তুই কি বলতে চাইছিস?”
“বেঙ্গলি যদি এতদিন ধরে অন্য অন্য ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে ওয়ার্ড রিসিভ করে এসেছে তবে আজ কেন তার এক্সসেপশান হবে বলো তো? দাদু তো বলে স্যাংস্কৃট এক সময়ে এত রিজিড হয়ে গেছিল যে ইট রিফিউজড টু অ্যাডপ্ট। তাই সাধারণ মানুষ স্যাংস্কৃটে নয়, প্রাকৃতে কথা বলত। স্যাংস্কৃট থেকে যায় লেখার ভাষা হিসেবে। আর স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজটা, তোমরা যেটাকে কথ্য ভাষা বলো, সেটা গ্র্যাজুয়ালি বদলাতে থাকে। আর তার ফলেই স্যাংস্কৃটের ইভেনচুয়াল ডেথ।”
“তার মানে…”
“তার মানে, ” কাহিনী ঠাম্মার গালে একটা চুমু খেয়ে বলে উঠল “ইংলিশ ওয়ার্ডগুলোকে রিজেক্ট করে নয়, অ্যাক্সেপ্ট করেই তোমার আদরের বাংলা ভাষা বাঁচবে, মাই ডিয়ার ঠাম্মি।”
“কি বলছিস? এই এত এত ইংরেজি শব্দ আমাদের শব্দ বলে মেনে নিতে হবে?”
“ওরাও নিচ্ছে ঠাম্মা। প্রতি বছর ইংরেজিতে ঢোকে ক্লোজ টু ফাইভ টু টেন ওয়ার্ডস। ইয়োগা, বাজার, জাংগল এগুলো অক্সফোর্ড ডিকশানারিতে জায়গা পেয়েছে। ট্রু দ্যাট, ইংলিশ যত ওয়ার্ড বরো করে তার থেকে বেশি ওয়ার্ড লেন্ড করে। কিন্তু তবু নিচ্ছে তো। বাংলাও কেন নেবে না? তাছাড়া কান বন্ধ করে বসে থাকলে ভাষার ইনফিল্ট্রেশান তো তুমি স্টপ করতে পারবে না ঠাম্মা? একটা ল্যাঙ্গুয়েজের পাওয়ারের কাছে আমরা ওয়ে টু উইক। সে এক নদীর মত। নিয়ম মেনে চলা তার স্বভাব নয়। কখনো তার এক জায়গায় চড়া পড়ে, শুকিয়ে যায় আবার অন্য জায়গায় সে পাড় ভেঙ্গে নতুন পথ করে নেয়। কখনো অন্যান্য শাখানদীর জলধারা এসে মেশে। সেটাকে কনটামিনেশান না ভেবে এক্সপ্যানশান ভাবলে প্রবলেম সলভ হয়ে যায়। আমাদের বাংলার বলার ভাষা আর লেখার ভাষা যদি প্রচণ্ড ডিফারেন্ট হয়ে যায়, ঠাম্মা, তবেই বাংলা ভাষার মৃত্যু হবে। তাই স্নবের মত মুখ ঘুরিয়ে বসে না থেকে চলো এই ওয়ার্ডগুলো আমরা নিজেদের শব্দ বলে গ্রহণ করে নিই। এই আমদানি করা শব্দগুলোকে লেখার জন্য প্রপার স্পেলিং ডিভাইস করি। চলো“শব্দ” আর “ওয়ার্ড”-কে আমরা সিনোনিম, তোমরা কি যেন বলো, হ্যাঁ, সমার্থক শব্দ বলে অ্যাক্সেপ্ট করে নিই। করা যায় না ঠাম্মা?”
“কথাটাতে তোর যুক্তি আছে।”
“যুক্তি আছে। আমি লজিকাল কথাই বলছি। এই যে আমি লজিকাল ওয়ার্ডটা ইউজ করলাম, লিখতে গেলে কেন এর বাংলা ট্রান্সলেশান মনে করতে মাথার চুল ছিঁড়ব? লজিকাল ওয়ার্ডটা বহু ব্যাবহারে এখন আমাদেরই শব্দ হয়ে গেছে। লেখার ভাষা আর বলার ভাষার মধ্যে প্যারিটি থাকতে হবে, সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আমি অলরেডি বেঙ্গলি নভেলের অনেক শব্দ বুঝতে পারি না। কারণ প্রচলিত ইংলিশ শব্দ ব্যাবহার না করে তার অভিধান স্বীকৃত বাংলা শব্দ ইউজ করা হয়। এটা তো একধরনের ইউজলেস শভিনিজম বা তোমার ডিকশানে যাকে বলে অপ্রয়োজনীয় বিদগ্ধতা। তুমি এই নদীটাকে চিনতে পারো না বললে না? যদি চিনতে পারার জন্য এই নদীটার পাড় ধরে ধরে শক্ত বাঁধ দিয়ে নদীটাকে বদলাতে না দিতে তবে কে বলতে পারে হয়তো নদীটা শুকিয়ে যেত, আমরা নদীটা দেখতেই পেতাম না। তোমার সাথে নদীটার পাড়ে বসে এই সানসেটটা দেখতেই পেতাম না। তাই বলি কি…বাংলা ভাষার সো কলড ফ্ল্যাগ বিয়ারার বা ধ্বজাধারীদের বলো যে ভাষাটাকে এক্সপ্যান্ড করতে দিতে। এই নতুন শব্দগুলোকে বাঙলারই শব্দ বলে স্বীকৃতি দিতে। কথা দিচ্ছি আমার ঠাম্মির ভাষাকে আমি, আমরা মরতে দেব না। অনেক বকে ফেলেছি। এবারে আমার সুইট ঠাম্মি আমার এই গালে, হ্যাঁ ঠিক এইখানে, একটা কিসি দিয়ে দাও তো।”
কাহিনীর দৃষ্টিকোণটা দেখে অশীতিপর বৃদ্ধা কথার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বাংলা ভাষা বাঁচবে। তার আদরের নাতনি কাহিনীর, কাহিনীদের হাত ধরেই বাঁচবে। বিদেশী শব্দ গ্রহণ করে ওরা বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। ওরা ওদের মাতৃভাষা, মাদার টাঙকে মরতে দেবে না। পরম আদরে চুমু খান তিনি তার চোখের মণি নাতনিটিকে।
ঠাকুমা-নাতনি, কথা ও কাহিনী, অনেকক্ষণ গললগ্ন হয়ে থাকে। ততক্ষণে গোধূলির আলোর খেলা মিলিয়ে গিয়ে সন্ধে নেমেছে। নদী সংলগ্ন গাছগুলো স্থির হয়ে কোন সুগম্ভীরের ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছে। ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে কাহিনী বলে ওঠে “ঠাম্মা এই রিভারটার নাম কি বলেছিলে?”
“এটা তো একটা ছোট নদী। সেরকম কোনো নাম নেই। আমাদের এই লক্ষীকান্তপুরে এটাকে সবাই ভাসা নদী বলে। অন্য গ্রামে অন্য নাম।”
ইয়ার্কির লেশমাত্র নেই এমন একটা গাঢ়, প্রায়-অচেনা স্বরে কাহিনী বলে ওঠে “গ্র্যানি আমার মনে হয় লোকমুখে নদীটার নাম ভাসা হয়ে গেছে। নদীটার আসল নাম বোধ হয় ছিল “ভাষা”।”
কথা চোখ তুলে নদীটার দিকে তাকান। যেন এক নতুন আঙ্গিকে দেখতে পান নদীটিকে। তারপর অপলক দৃষ্টিতে নাতনির দিকে চেয়ে থাকেন আর তার ঘন ঝালর চুলের মধ্যে বিলি কাটতে থাকেন।
Oshadharon legeche. Ei golpo ti na purota na porle to jantei portam na . Je ek ta nodir name bhasa .
Thank You!