অমিয়র আত্মহত্যা

কাল সন্ধে থেকেই অমিয়-র মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। সন্ধেবেলা পাশের বাড়ির পরাশর কাকু এসেছিল। সাথে মিনিও। পরাশর কাকু বলল ওরা কাল-ই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওনার নাকি দিল্লি ট্রান্সফার হয়ে গেছে। একমাত্র মিনির সঙ্গই এ পাড়ায় ভাল লাগত অমিয়র। বেশ সুশ্রী আর ছিপছিপে। আর একটু শান্তশিষ্ট লাজুক মতন। ওদের দুজনের মধ্যে কত কথা হয়। লোকাল পলিটিক্স থেকে বলিউড পর্যন্ত। মিনির ওপর কেমন একটা অধিকার বোধ জন্মে গেছিল অমিয়র। এই তো সেদিন সে একটা পার্টিতে গেছিল। মিনিরাও ছিল সেখানে। অরিত্র বলে একটা হুমদো ছেলে খুব ঢলে ঢলে কথা বলছিল মিনির সাথে। একদম সহ্য হয় নি অমিয়র। পরে মিনিকে সে ঐ সব আটভাট ছেলেদের সাথে মিশতে বারণ-ও করে দিয়েছিল।  সেই মিনিরাই কিনা চলে যাবে আজ। আর কোন যোগাযোগ থাকবে না। ভেবে কাল রাতেও লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে সে।


সকালবেলা উঠে একটু গুটিসুটি মেরে বসে টিভিতে মিকি মাউস-এর একটা পর্ব দেখছিল অমিয়। কি বোকা বোকা গল্প…কোন মানে হয়? ভীষণ বিরক্তিকর। ছোটখাট বলে আমাদেরকে এরা কি ভাবে কে জানে? আনমনা হয়ে ভাবছিল অমিয়। রবিবারের সকালে ছুটির মেজাজটা ঘরের আনাচে কানাচে ফাল্গুনি হাওয়ার মত তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে।  অমিত কাকু বেরোচ্ছে বাজারে। কাকিমা চেঁচিয়ে বলছে “পাঁঠার মাংসটা দেখে নিও, গেল রোববার হাড়-ই সার ছিল। আর বুড়ো লাউ একদম আনবে না, আনলে ওটা তোমার মাথাতে ভাঙব।” প্রতি রবিবার এই এক-ই চিরাচরিত ছবি। কি বিরক্তিকর? উফফ…অমিয় আবার কার্টুনে মনোনিবেশ করে। সবে টিভিতে মিকি মিনিকে কি একটা পাকে ফেলেছে, এমন সময় অন্তুদা এসে, কথা নেই বার্তা নেই, বললো “কি মিস্টার হুলুস্থুলু, সকাল সকাল বসে বসে কার্টুন দেখা হচ্ছে। বলেই ওকে এক ঝটকায় তুলে নিয়ে সোফায় ওর জায়গাটাই দখল করে বসল। আর তারপর অমিয়কে কোলে বসিয়ে ওর গালে গাল ঘষতে লাগল। এই কোলে বসা আর গালে-গাল-ঘষা আদর একদম পছন্দ নয় অমিয়র। সেটা তাও মানা যায় কিন্তু এই হুলুস্থুলু নামটা? মোটেই পছন্দ নয় তার। সে খেলার সময় এমন কিছু হুলুস্থুলু কান্ড করে না যে তাকে হুলুস্থুলু বলে ডাকতে হবে। অন্তুদার বয়স কত আর? সাত হবে। অমিয়রও বয়স নয় নয় করে পাঁচ হয়ে গেছে। এই মাত্র দু-এক বছরের বড় দাদার এই জ্যাঠামো মোটেই সহ্য হয় না। অন্তুদা না হয় ছোটো। সে তো আর ছোটো নয়, রীতিমতো প্রাপ্ত বয়স্ক। কোল থেকে নেমে অমিয় এক ছুটে নিচের রান্না ঘরে। অনু কাকিমা মাছ ভাজছে। এই মাছ ভাজার গন্ধটা শুঁকলেই অমিয়র ভেতরটা কেমন একটা করে..খুব ভালবাসে ও মাছ ভাজা খেতে। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে গিয়ে একটা মাছ ভাজা নেওয়ার চেস্টা করেছিল। কিন্তু অনু কাকিমা দেখতে পেয়েই এমন তাড়া দিল যে ওকে তর তর করে পালাতে হল। যাক গে যাক। পরে নিশ্চয়ই একটা পাওয়া যাবে। ও তো আর আদেখলে নয়। এখন গিয়ে কোথাও খেলা-টেলা যাক। রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে অমিয় ঠাকুরঘরে এল। এটা ওর ভারি প্রিয় জায়গা। অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস আছে এখানে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে দেখার জন্য। ঠাকুরের থালা গ্লাস গুলো বেশ ছোট ছোট।

ঠাকুররা যদি এত বড়, তবে তাদের খাবারের থালাগুলো এত ছোট ছোট হয় কেন কে জানে? thinking

শুনেছে ঠাকুররা নাকি অনেক বড় হয়। সারা আকাশ জুড়ে থাকে। কিন্তু ওদের খাবার থালা বাসন এত ছোট হয় কেন বোঝে না অমিয়। যাকগে যাক। সে ছোটখাট মানুষ। তাই এই ছোট ছোট থালা গ্লাস গুলো তার পছন্দের। সে প্রথমেই পেড়ে ফেলল প্রসাদ রাখার ছোট্ট থালাটা। দুটো নকুলদানা গলে আটকে ছিল। নখ দিয়ে খুঁটে খেয়ে ফেলল। নকুলদানা বেশ ভাল খেতে। কিছুক্ষণ ওটা নিয়ে খেলার পর ঠাকুরের একটা সিংহাসন ছিল সেইটা পেড়ে ফেলল। সেটাকে নিয়ে উলটে পালটে কিছুক্ষণ খেলা হল। ঠাকুরের আসনটা গলায় জড়িয়ে আর খুলে আরও খানিকক্ষণ কাটলো। এরপর বোর হয়ে গেলো। বিরক্তিটা আবার ফিরে আসছে। মিনি চলে যাবে। ছাদে যাওয়া যাক। ছাদে গিয়ে মিনিকে ডাকলে নিশ্চয়ই ও ও বাড়ির ছাদে উঠে আসবে। কিন্তু বিধি বাম! ঠাকুর ঘর থেকে বেরনোর সময় কান্ডটা ঘটল। বসার ঘরের মধ্যে দিয়ে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি। হঠাৎ করে পায়ে লেগে বসার ঘরের দরজার সামনে থাকা দামি ফুলদানিটা পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে চুরচুর। আর যায় কোথায়? অনু কাকিমা ছুটে এল। সে কি বকুনি! একটা দুটো চড়-থাপ্পড়ও পড়ল পেছনে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সবাই খারাপ। কেউ ভালবাসে না। অমিত কাকু ফিরে এসে ভাঙ্গা ফুলদানিটা দেখে তো রেগে আগুন। প্রচণ্ড বকাবকি করল। এমন কি শাস্তি স্বরুপ শোবার ঘরে এক ঘন্টা বন্ধ করে রাখলো। আর অন্তুদা ওর বকুনি দেখে কিনা পুরো সময়টা ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল? অমিয় বুঝে গেছে। সে তো এ বাড়ির ছেলে নয়। তাই। অন্তুদার পায়ে লেগে ফুলদানি ভাঙলে এই ভাবে বকতে, শাস্তি দিতে পারতো ওরা? কক্ষনো না। বলত “কতই বা বয়স। পায়ে লেগে পড়ে গেছে। ছেড়ে দাও।” অমিয় জানে অনেক ছোটবেলায় তাকে এ বাড়িতে একটা অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই থেকে সে এই বাড়িতেই আছে ছেলের মত। মুখে যতই দেখাক না কেন, এরা কখনই অমিয়কে বাড়ির ছেলে ভাবে না। সৎ ছেলে সে। তাই এত বকুনি। অন্তুদারও সৎ ভাই। তাই অমন করে হাসতে পারল সে ওর দুর্দশা দেখে। ধুৎ, এই অনাথ, আশ্রিত মার্কা জীবন বাঁচার কোন মানেই হয় না। তাও মিনি চলে যাবে আজ। জীবনের কোন মুল্যই নেই আর। কার জন্য বাঁচবে সে? কিসের জন্য বাঁচবে?  আত্মহত্যা..হ্যাঁ আত্মহত্যা-ই করতে হবে। কোন একটা সিনেমায় দেখেছিল অমিয়। আত্মহত্যা। এই তো অমিয়দের এই বাড়িটাই তেতলা। চারতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলে নিশ্চয়ই মরতে পারবে সে। রাগটা থাকতে থাকতেই করতে হবে। নয়তো মনের জোরটা পাওয়া যায় না। এখনই অন্তুদা কিম্বা অনুকাকিমা এসে আদর করে দিলে রাগটা পড়ে যাবে। দেরি করা যাবে না। ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে চার তলার ছাদে উঠে যায় অমিয়। ছাদের রেলিংটার ওপরে ওঠে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে। ওপর থেকে নিচের রাস্তাটা একবার দেখে অমিয়। কি ছোট ছোট খুদে লাগছে সব কিছু। দূর থেকে দেখলে সবই ছোট। না, এসব ভাবলে চলবে না। অনু কাকিমার মারটা মনে পড়ে। অমিত কাকুর বকুনিটা। অন্তুদার হাসি। মিনির ঢলো ঢলো মুখটা। নাহ বেঁচে থাকা অনর্থক। মরতে তাকে হবেই। চোখ বুজে নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে দেয় অমিয়। তীব্র গতিতে তার তুলতুলে শরীরটা এসে মাটি ছোঁয়। ধুপ করে একটা শব্দ। তারপর সব চুপ।


মাটিতে পড়ার পর বিশ সেকেণ্ড মতো পড়ে থাকে অমিয়। হুমম, এতক্ষণে নিশ্চয়ই মরে গেছে সে। একবার উঠে দাঁড়াতে চেস্টা করলেই বোঝা যাবে। এক লাফে উঠে দাঁড়ায় অমিয়। ঠিক বুঝতে পারে না মরেছে কিনা। পরীক্ষা করতে নিজের গায়ে একটা আঁচড় কাটে। লাগছে। তবে কি সে বেঁচে আছে? নাকি মরা লোকেদেরও ব্যাথা বেদনা থাকে? বেঁচে থাকলে যন্ত্রণা হওয়া উচিত এত উঁচু থেকে পড়লে। হাতে পায়ে মাথায় সব জায়গায় ব্যাথা অনুভব করার চেস্টা করে। নাহ কোথাও কোন ব্যাথা নেই। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে সে বেঁচেই আছে।
“মরণ!!! আমার মরণ-ও নেই। বেড়ালরা বোধ হয় যমেরও অরুচি।” মনে মনে বলে অমিয়। আর ভেবে কি হবে? রাগটাও এবার বেশ পড়ে এসেছে। তাই আজ আর চেস্টা করা যাবে না। “যাইগে, মিনির সাথে একবার দেখা করে আসি। মানুষদের ফেসবুক-এর মত বেড়ালদের একটা social networking site আছে। কিটিবুক বলে। ওখানে মিনিকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। তাহলে ওর সাথে পরেও যোগাযোগ রাখা যাবে।” ল্যাজ দিয়ে গায়ের ধুলো ঝেড়ে অমিয় মিনির বাড়ির দিকে যায়। “ও হ্যাঁ, ওকে বলে দিতে হবে যেন কিটিবুকে ঐ হুমদো হুলো অরিত্রটার friend request একদম  accept না করে।” মনে মনে ভাবে সে।

সমাপ্ত

cat

18 thoughts on “অমিয়র আত্মহত্যা

  1. Swarvanu Sanyal

    Thank u thank u bondhu. 🙂 I m flattered by your kind words. Shon unhappy ending, semi happy ending-o onek story amar google drive e ache..ekta ekta kore bhabchi blog-e chari. keu na porle ki mane bol? amar jojatirjhuli bole ekta fb page-o ache. please like koris aar parle ektu choriye dis.

  2. Kamalendu Sarker

    বন্ধু দারুণ লিখেছিস, চালিয়ে যা। ক'জন পড়ল বা মন্তব্য করল, সেটা দিয়ে লেখার মান বিচার করিস না। নিজের লেখা নিজের কাছে ভাল লাগাটাই আসল সুখ।

  3. Swarvanu Sanyal

    ধন্যবাদ। একদম ঠিক কথা বলেছিস। লিখে সুখ না পেয়ে এমনি প্রশংসা পাওয়ার জন্য যে লেখা তাতে ষোল আনাই ফাঁকি…

  4. arnab dalui

    দারুন লেখা। plot টার বেশ অভিনবত্ব আছে যা পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে।

Leave a Reply