রবিবার সকালবেলা কোথায় সদ্য ভাজা গরম মুচমুচে চিঁড়ে ভাজার মত আবহাওয়া থাকবে, কোথায় শরতের মেঘের মত হালকা খুশি ভাসবে বাতাসে, মার্চ মাসের ভোরের মত না-গরম-না-ঠান্ডা একটা ফুরফুরে মেজাজ বাড়িতে ঘুর ঘুর করবে তা না, সকাল থেকে শ্রাবণের জলদ গম্ভীর আকাশের মত হাল বাড়ির। বৃষ্টি কখন নামে তার ঠিক নেই। ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ আছে। শমীক টিভিটা খুলে দেখবে কিনা সেই নিয়ে বেশ খানিক চিন্তা করে আপাতত না দেখাই ঠিক হবে ডিসিশান নিয়েছে। মোবাইল খুলে অফিসের মেল চেক করার নাম করে ক্রিকইনফো ডট কম থেকে লেটেস্ট স্কোরটা দেখে নিচ্ছে। আর মুখটা যারপরনাই গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছে। রবিবার দুপুরে একটু কচি পাঠার ঝোল খাবে বলে কাল থেকে মনের মধ্যে কাঠবিড়ালি টাইপস হালকা খুশি তিড়িক তিড়িক করে চড়ে বেড়াচ্ছিল। সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠেই বিল্টুর দোকান থেকে নিয়েও এসেছে। কিন্তু সেই মাংসের ব্যাগ রান্নাঘরের এক কোনায় পড়ে আছে। অনাদৃত। এতক্ষনে তাদের কড়াইতে পেয়াজ টোমাটোর কার্পেটে শুয়ে গরম তেলের জাকুজিতে হট বাথ নেওয়ার কথা। ছাল ছাড়ানো নুন মাখানো অবস্থায় পড়ে আছে মাংসের আলুরা। মানে যাদের মাংসের ঝোলে সিক্ত হয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনে রসনার মধ্যে অদ্ভুত সঙ্গীত সৃষ্টি করবার কথা ছিল। বাবাই বই-এর পাতা খুলে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। শমীক জানে তার এখন এক বিন্দুও পড়ায় মন নেই। চুপচাপ বসে বাড়ির সিচুয়াশানটা জাজ করার চেষ্টা করছে। কারণ এতক্ষনে তার বারোয়ারি তলার মাঠে বল পিটতে যাওয়ার কথা। এমনকি চারপেয়ে ভুলোও কি বুঝে বেশি ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই করছে না। আর এ বাড়ির হাইকমান্ড ওরফে হোমে মিনিস্টার ওরফে শমীকের স্ত্রী, অন্তরা, গম্ভীর মুখে বসে টিভিতে কি একটা সিরিয়াল দেখছে। চোখের কোনে একটু জল শুকিয়ে আছে। শমীক আড়চোখে একবার দেখে নিয়েছে। এটা সেই সিরিয়ালটা। একটা ভীষণ ভাল বউমা সংসারের সব কাজকর্ম বিনা বাক্যব্যয়ে করে ফেলছে। শাশুরি-ননদ সকলেই তার সাথে অত্যন্ত ঢ্যামনাগিরি করলেও বউমার সাত চড়ে মুখে রা নেই। দুদিন বাদে বাদেই তাকে গয়না চুরির অপবাদ দিলেও সে শুধু মাত্র সংসারের মঙ্গল চিন্তা করে। এমন সহমর্মিতার প্রতিমুর্তি দেখলে ভগবান বুদ্ধ-ও বোধ করি লজ্জা পেতেন। এমন ক্ষমার ক্ষমতা দেখে মেজাজ চটকে গিয়ে গান্ধিজীও বোধ হয় একটি চড় কষিয়ে দিতেন বউমাটিকে – মনে মনে ভাবে শমীক। নর্মাল দিনে সে সিরিয়াল চললে পাশ থেকে টিপ্পুনি কেটে থাকে। কিন্তু আজ সিচুয়েশান খুব চাপের। কি থেকে ঝামেলা শুরু হয় তার ঠিক নেই। তাই সে ক্রিক-ইনফোতে মনোনিবেশ করে আবার।
সকাল পর্যন্ত সব ঠিক-ই ছিল। ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাবাই এর সাথে অন্তরার “দাঁতটা মাজ না রে বাঁদর। দুধটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে না” টাইপস স্নেহ সম্ভাষণে বোঝা যাচ্ছিল একটা নর্মাল দিন। বাজারে যাওয়ার সময়েও অন্তরা বলল “একদম হাড়-ওলা মাংস আনবে না। আর শোনো মেটে নিয়ো তো।” শমীক বলল “কেউই যদি হাড়-ওলা মাংষ না নেয় তাহলে মাংসের দোকানদারদের এবার থেকে জেনেটিকালি মডিফায়েড বোনলেস পাঁঠা প্রোডিউস করার কথা ভাবতে হবে”। এটা শমীকের প্রি-ডিফেন্স। সে জানে সে যতই চেষ্টা করুক না কেন ঠিক হাড়ওলা মাংসই তার কপালে জুটবে। অন্তত অন্তরার সেরকমই বক্তব্য হবে। অন্তরা নিজে গিয়ে নিয়ে আসলে মাংসের গুণমান, কোয়ালিটি ইত্যাদি ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের মত ঝকঝকে হয়ে যায় কেমন করে একটা। এই অব্দি সব ঠিক ছিল। বাজার থেকে ফিরে শুনলো কেস গড়বড়। অন্তরার তার কেটে গেছে। কেমন একটা তড়িৎপৃষ্ট মুখ। কি না সকালের ডেইলি এফ বি ডায়েট করতে গিয়ে অন্তরা দেখেছে ওর মা চন্দ্রানির এফবি স্ট্যাটাস
“শঙ্কুর পা মচকে গেছে। হাড় ভেঙ্গেছে কিনা জানা যাবে ডাক্তার দেখালে। ফীলিং স্যাড।”
শঙ্কু অন্তরার বাবার নাম। তখন থেকেই অন্তরার ভীষন দুশ্চিন্তা। দুবার ফোনও করেছে। কিন্তু মা ফোন ধরে নি। নিশ্চয়ই এখন ডাক্তার-হসপিটাল-নার্সিং হোম করছে। শমীক মনে মনে ভাবে, ভদ্রলোক আর দিন পেলেন না। থেকে থেকে এই রোব্বার সকালেই পা মচকালেন। এর জন্য মৃত পাঁঠা ওনাকে কোন দিন ক্ষমা করবে না। সোমবার কি মঙ্গল বার করে পা মচকালে বিশাল মহাভারত অশুদ্ধ হত? আর শাশুড়ি মার বলিহারি। সামান্য পা মচকেছে তাতে ঘটা করে স্ট্যাটাস আপডেট দেওয়ার দরকার কি? ডাক্তার দেখিয়ে পা ভেঙ্গেছে জেনে দিলে তাও একটা কথা ছিল। সব সময় মেয়েদের বাবা-মারাই বেশি স্মার্ট হয় কেন শামীক বোঝেনা। শত শত বার চেষ্টা করেও নিজের বাবা-মাকে স্মার্ট ফোন ধরাতে পারেনি। রোব্বার এই এগারটা নাগাদ দ্বিতীয় বার কফি খায় সে। অনেক চেষ্টা করেও কফিটা অন্তরার মত বানাতে পারে না। বিবাহোত্তর জীবন যে মেয়েরা “জিনিয়াস” হয় এটা শমীক সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করে। কিন্তু আজ অন্তরার হাতের কফি তো দুরের কথা, নিজেও যে বানাতে যাবে, সেটাতেও ভরসা পাচ্ছে না। হঠাৎ যদি “আমার বাবার পা ভেঙ্গেছে তোমার কোন মাথা ব্যাথাই নেই” শুরু করে দেয় তাহলে নিজেকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে প্রবল মাথা ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা। এই সময় বিরাট কোহলি না খেলে রাহুল দ্রাবিড় খেলাই ভাল। বল আসলেই ডট। ডট। ডট। লম্বা খেলতে হলে দু একটা ওভার মেডেন ছাড়তেই হয়।
এই সময় বিরাট কোহলি না খেলে রাহুল দ্রাবিড় খেলাই ভাল। বল আসলেই ডট। ডট। ডট। লম্বা খেলতে হলে দু একটা ওভার মেডেন ছাড়তেই হয়।
এমন সময় ফোনটা এল। অন্তরার মায়ের ফোন।
কি রে ফোন করেছিলি নাকি? দু-তিনটে কল দেখলাম
বাবা এখন কি করছে? আমি তো চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।।
কি আবার করবে? যা করে এই সময়। বিন্দাস শুয়ে আছে। আর আমার হয়ে গেছে বাঁশ।
ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছ কখন?
দেখি দু-এক দিন পরে নিয়ে যাব। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।
এখনো নাও নি? তুমি কি গো? পড়ল কি করে?
সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল। ওটা তো ওরকমই। সারাক্ষণ ফুটছে।
এই বয়সে বাবা লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। বাবার কি ভীমরতি হল নাকি?
তোর বাবা কেন নামবে? নামছিল আমার নতুন সোনামোনাটা। ও তুই বোধ হয় একে দেখিস নি। মাস খানেক আগে একদিন রাস্তায় দেখলাম ডাস্টবিন ঘাঁটছে। খেতে না পেয়ে রোগা। গায়ে ঘা। আমি তো জানিস-ই পশুপ্রেমী। এই সব দেখলেই চোখে জল চলে আসে। তা কুকুরটাকে বাড়ি আনলাম। সবে খাইয়ে, ভেটেরিনারি ডাক্তার দেখিয়ে একটু সুস্থ করে তুলেছি, আজকে দেখ না পড়ে গিয়ে পা টা মচকে বসে আছে। লেংড়ে হাঁটছে। আমার কপাল। সারা জীবন অন্যদের সেবা শুশ্রুষা করেই গেল।
ঊফফ মা। এইটা ঘটা করে এফবি আপডেট দিয়েছ?
কেন? তুই দিস না। শমীকের জন্মদিনে একই ঘরে থেকেও এফ বি তে “হ্যাপি বার্থ ডে মাই লাভ” দিস না? তুই দিলে সেটা ফেসবুক স্ট্যাটাস আর আমি দিলে আদিখ্যেতা?
আঃ মা ঝগড়া কোরো না তো! কিন্তু তুমি শেষে বাবার নামে কুকুর পুষেছ? বাবার সাথে তোমার ঝগড়া-টগড়া এইভাবে পাবলিক করার কোন দরকার ছিল?
বাবার নামে কেন পুষতে যাব? ওই নামের একটা মানুষকে সামলাতেই সারা জীবন হিমসিম খেয়ে গেলাম। আবার আর একটা? আমি পাগল নাকি? ওর নাম তো রেখেছি বঙ্কু। আমাদের ছেলের মতই তো। তাই তোর বাবার নামের সাথে মিলিয়েই রাখলাম।
ঊফফ মা। তুমি না? মানে কিছু বলার নেই। তাহলে এফবি তে দিয়েছ কেন শঙ্কুর পা ভেঙ্গে গেছে বোধ হয়।
ও শঙ্কু লিখেছি বুঝি। ওটা বঙ্কু হবে। এই ফোনটাও বলিহারি? আগে ব্যাবহার করা ওয়ার্ড ফট করে রিপ্লেস করে দেয়।
অন্তরা মায়ের সাথে আরও কিছু ঝগড়া করে ফোন রাখল। মুখে হাসি ফুটেছে। টিভিতে তখন সেই সুপারলক্ষী বৌটি পরাধীন ফ্রান্সের সেই কিংবদন্তী কৃষককন্যা জোন অব আর্ক-এর মত তার শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কোন এক দুষ্টু লোককে শাস্তি দিতে যুদ্ধ যাত্রা করেছে। রিমোটের একটা বাটনের আঘাতে সে ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে যায়। অন্তরা এবার রান্নাঘর মুখো। শমীক স্পষ্ট দেখতে পায় ব্যাগ-এর মধ্যে থাকা মাংসের টুকরোর মুখ উজ্জল হয়। মনে হচ্ছে দুটো-আড়াইটের মধ্যে মাংসের ঝোলটা দাঁড়িয়ে যাবে। বাবাইও সুযোগ বুঝে বলে ওঠে “মা আমি খেলতে যাই?” ভুলো লাফিয়ে সোফায় উঠে রাজার বেটা ঘুগনিওলার মত বসে পড়ে। শমীকও রিমোটটা নিয়ে টিভিটা চালিয়ে ফেলে। ম্যাচের বাকিটা এবার আরাম করে সোফায় বসে টিভিতেই দেখা যাবে। কোহলি ততক্ষণে পিটিয়ে ম্যাচটাকে প্রায় মেরে এনেছে।
Osadharon lekhoni… Thik har chhara pathar mangser motoi lobhonio ebong suswadu. Ebong genetically modified chinta bhabna. Hahaha.
জেনেটিক নয় ঠিক
লেখাটা সাংসারিক
কল্পনা গল্প না স্মৃতি…
প্রিয় পাঠিকা রীতি
জানবেন যযাতির প্রীতি।
Loilam priti… Boro sukho Smriti.
Rakhibo jotone… Lekhoni Joto…
Dhonyo hoilo pathikar pran… Bole jai Apatoto…