সময় চলিয়া যায়

আজ ছিল আমার দ্বিতীয় কন্যার প্রথম জন্মদিন। দিনটা ওদের কাছাকাছি কাটাব বলে দিনভর বাড়ি থেকে কাজ করেছি। কাজের মাঝে মাঝে শিশু কন্যার স্পর্শসুখ। ওর হাতের মুঠির মধ্যে আমার আঙুল যখন আশ্রয় পায়, মনে হয়, শুধু এই সুখটুকুর জন্য আরো হাজার জন্ম নেওয়া যায়। আজ ওর জন্মদিন। আজ ওর জন্য একটু বেশি আদর। আজ ওর সাথে একটু বেশি খেলা। মনে মনে হয়তো বা বলা – “আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার, ওগো প্রিয়।” 

সঙ্কর প্রজাতি আমরা। সকাল বেলা বাঙালি মতে পায়েস আর ওর মায়ের পরম যত্নে রান্না করা পঞ্চব্যাঞ্জন আর সন্ধেবেলা বিলিতি মতে একটু কেক। ছিমছাম একটা আনন্দের দিন। কিন্তু দিন…সে তো শেষ হয়। সন্ধ্যা আসে। রাত্রি নামে। জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে প্রতি রাতেই আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা। আজকেও ব্যতিক্রম হল না। ওর ঘুমিয়ে পড়া ছোট্ট, ভীষণ ছোট্ট শরীরটা দেখলে মনে হয় কোথা থেকে যেন একটুকরো প্রাণের কণা বসন্তের মলয় সমীরে উড়ে আমাদের মাঝে এসে পড়েছে। অনেকটা মানুষ মানুষ কিন্তু ঠিক মানুষ না। যেন একটা খেলনা মানুষ। জীবনের পরীক্ষাগারে আরও একটা ছোট্ট মডেল, আরো নতুন কিছু সম্ভাবনা। 

ওকে বিছানায় শুইয়ে দিতে এসে হঠাৎ বুকের মধ্যে ছাঁত করে উঠল। তাহলে একটা বছর ঘুরে গেল ওর জীবনের। সূর্যের বাহুলগ্না হয়ে যে ব্যালে ড্যান্স শেষ হাজার কোটি বছর ধরে করে চলেছে পৃথিবী, তার আর একটা অধ্যায় সমাপ্ত হল। সূর্যকে ঘিরে মহাশুন্যপথে পুরো এক পাক ঘুরে নিল নীলগ্রহ। ওর অজান্তেই ওর বয়স এখন এক। অসীম নিষ্ঠা ভরে এই বারো মাসে শিখে নিয়েছে অনেক কিছু। মাতৃস্তন্য পান থেকে শুরু করে উবুড় হওয়া, তারপর হামাগুড়ি দেওয়া আর সর্বশেষে টলোমলো পায়ে হাঁটতে চলার এক বছরের নিবিড় জীবনপাঠ। জীবনের রসদ প্রাণপণে ঠুসে নিচ্ছে নিজের ক্ষুদ্র শরীরে। এখন শুধুই নেওয়ার পালা। স্নেহ সঞ্চয়, জীবনের রসদ সঞ্চয়। কিন্তু দেওয়ার বেলাও আসবে। কুঁড়ি মানুষটা যে সম্ভাবনাগুলোর সমষ্টি, তার কতটা রূপায়িত হল সেটা জানার জন্য গুঁড়ি মেরে অপেক্ষা করছে মহাকাল। 

আমি ভাবি, ওর জীবনের আরো একটা বছরের সূচনা হয়ে গেল অথচ কোনো ওয়ার্নিং বেল বাজল না, কোনো ঘন্টি বাজল না, কোন মহাপ্রাণ এসে কানে কানে বলে গেল না “সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়, যে জন না বোঝে তারে ধিক, শত ধিক।” টিক টিক টিক। ঘড়ির কাঁটার অনিবার্য ঘূর্ণন যা প্রতিনিয়ত আমাদের জীর্ণ করে, আমাদের ছায়াকে দীর্ঘতর করে তার চলন এতই ধীরে যে তা বুঝতে বুঝতেই অনেক কটা গ্রীষ্ম বর্ষা শরত হেমন্ত পার করে এখন আমি জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। মহাকাল। পাহাড়ি দস্যুর মত বজ্র মুষ্টি তার অথচ ভোরের শিউলির মত নিঃশব্দ পদসঞ্চালন। আবার খুব হীনবৃত্তি নিন্দুকের মতই judgemental, ছিদ্রান্বেষী। সে চলে যাবে আপন তালে। বলবে না, “একটু তাড়াতাড়ি পা চালাও ভাই। তোমার তো সন্ধ্যা নেমে এল।” অথচ প্রতিটা মানুষকে তার শেষ স্টেশানে নামিয়ে দেবার দিনে করবে চুলচেরা বিচার। বিচার করবে যে,  সে মানুষটার লোটা কম্বল, জীবনের সঞ্চয় বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, নাকি তার সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই শ্রেয়। কালের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার গহ্বরে তাকে নিক্ষেপ করে চলে যাবে, নাকি ক্ষীণ একটা বাতি ধরে দিয়ে যাবে যাতে ভবিষ্যত তার খবর পায় – সেই বিচার। মহাকাল। জীবৎকালে নীরব সাক্ষী, মরণকালে চুলচেরা বিচারক। আমার ফেলে আসা বছরগুলোর দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে তাই বলতে ইচ্ছে করে, “সে চলে গেল, বলে গেল না। সে কোথায় গেল ফিরে এল না। সে যেতে যেতে চেয়ে গেল। কি যেন গেয়ে গেল। তাই আপন মনে বসে আছি…”। আপন মনে বসে আছি…আপন মনে বসে আছি…

আমার এই যে হাসি, এই যে কান্না, এই যে প্রেম, এই যে বিরহ, এই যে স্নেহ, এই যে ঘৃণা, এই যে রমণ ইচ্ছা, এই যে মহোত্তমের খোঁজ – জানি জানি তুমি কিছু নেবে না এ সবের। জানি তুমি আমাকে নেবে না। শুধু যে কটি ফুল ফুটিয়েছিলাম মনের উঠোনে, হে নির্দয় মহাকাল, সে ফুলের সাজি রাখবে কি তোমার অক্ষয় মালঞ্চে?

রয়েছ নয়নে নয়নে

মানুষের বেঁচে থাকার কি অদম্য আগ্রহ , কি অপ্রমিত ইচ্ছা ! এই যে আমার চেতন সত্তা, এই যে আমার আপন কক্ষপথে আমার সাথে হাত মিলিয়ে চলতে থাকা মানুষগুলো , আমার দাদা , বোন , স্ত্রী , সন্তান , বাবা , মা , মিত্রস্বজন এদের প্রতি কি অনির্বচনীয় মমত্ববোধ , এদের পাশাপাশি এদের কাছাকাছি থাকার কি হৃদয়মর্মী কাতরতা । “আমি আছি” এই বোধ – এ যেন এক ভরসাপ্রদায়ক স্বস্তিবাচন , এক অনুপম বিশ্বাস । এই যে আমি জীবনের সুমিষ্ট পয়োনিধি থেকে প্রতিনিয়ত এক পেয়ালা জল পান করছি তার কি আনন্দঘন অনুভূতি । এই যে আমি দেখছি , স্পর্শ করছি , ভালবাসছি , প্রিয়জনের সঙ্গকামনা করছি , এই যে “আমি এবং আমার” এর নামই জীবন !

তবু এক অনিবার্য বিশ্রামের সম্ভাবনা আমাদের স্বততঃ অনুসরণ করে । মৃত্যুলোকের তমিস্রাময় ছায়া আমাদের পিছু পিছু ঘোরে সর্বদা। হঠাৎই অতর্কিতে ছুঁয়ে ফেলে প্রিয় কোনো মানুষকে । সহসা অলঙ্ঘ্য অন্ধকারে হারিয়ে যায় কোনো প্রিয় মুখ । নিত্যদিনের হাসি খেলায় তখন সে অনুপস্থিত । হৃদয়ে হৃদয়ের যোগসূত্র ছিন্ন করে তার তখন এক অনুদ্বিগ্ন অনঘ উপস্থিতি । সূর্য তবু আপন বলয়ে প্রদক্ষিণ করতে থাকে । পৃথিবী তবু নিজের কক্ষপথে ছুটতে থাকে। তবু শীত গ্রীষ্ম বর্ষা আসে । তবু পাখিদের কলকাকলিতে মুখর ভোর আসে । তবু সন্ধ্যা নামে আসন্নপ্রসবা গাভীর মত ধীরে । নবজাতক তবু ভূমিষ্ঠ হয় । আহার নিদ্রা মৈথুন হয় । তবু নির্বাচন হয় । উষ্ণ বক্তৃতা হয় । জীবন চলতে থাকে আপন ছন্দে । তার যে মৃত্যুর জন্য থামার সময় নেই !

শুধু কিছু হৃদয়ে ব্যাথা জেগে থাকে । কিছু আঁখি থেকে অশ্রুবিসর্জন হয় গোপনে একান্তে । ছোট ছোট কথা , ছোট ছোট ব্যাথা , ছোট ছোট সঙ্গসুধাকণিকা কোনো একলা দুপুরে টুকরো স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে । মহাকাল তার যাদুদণ্ড বোলাতে থাকে ক্ষতস্থানে । কালের প্রলেপ লেগে শুকোয় ঘা । সম্পর্কের যে মায়াশিকড় মাটির গভীরে বিস্তৃত হয়েছিল , যা  পুষ্ট হত রোজকার সংলাপে , রোজকার হাসি-কান্নায়-আদরে-অভিমানে সে ধীরে ধীরে শুকোতে থাকে । তবু যেন নিঃশেষ হয় না মানুষটার অস্তিত্ব । ভূমায় উড়তে থাকা ঘুড়ি যেমন ভূমির সাথে এক প্রায়-অদৃশ্য সুতো দিয়ে জোড়া থাকে , মুক্ত বিহঙ্গের মত কোনো অনাবিল আনন্দলোকে বিচরণ করতে থাকা মানুষটিও তেমন ভালবাসার এক অচ্ছেদ্য , প্রায়-অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে থাকে মর্ত্যলোকে। সুতোয় যেমন টান পড়লেই বোঝা যায় আকাশে ওই দূরে ছোট্ট কুট্টি হয়ে যাওয়া ঘুড়িটা এখনো আছে , ভোকাট্টা হয় নি , সেরকমই স্মৃতির দড়িতে টান পড়লেই বোঝা যায় মানুষটা আছে । মানুষটা আছে তার সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে , তার আপনজনেদের প্রতি স্নেহ-মমতা-ভালবাসা নিয়ে , তার সন্তানের প্রতি মঙ্গলকামনা নিয়ে , স্ত্রীয়ের স্বাস্থ্যের প্রতি উদ্বেগ নিয়ে , কোনো স্বজন কি বান্ধবের সাফল্যের গৌরব নিয়ে , কোনো অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা নিয়ে , কোনো এক সুস্থ হিংসাহীন পৃথিবীর স্বপ্ন চোখে নিয়ে ,  মানুষটা আছে – শুধু নয়নসমুখে আর নেই, নয়নের মাঝখানে সে গড়ে নিয়েছে তার চৌখুপী ঘর ।

অন্তর্জলি যাত্রা – রম্যরচনা

Thirty four friends started their journey. Only one of them returned….

আলোর জগৎ থেকে অতি দ্রুত নেমে এসেছি এই অতলান্ত অন্ধকারে। এখানে সময় গতিহীন। এখানে সব ঘড়িদের ছুটি। শব্দের জগৎ থেকে এ জায়াগাটা শুধু একটুখানি দূর। তবু এখানে হাজার হাজার বছর ধরে জমে আছে নৈঃশব্দ। জমে আছে ভাষাহীন ভাষা। মুম্বাইয়ের এক ব্যস্ত সকালে ছুটির ঘন্টা বেজে উঠেছিলো আমার দু কামরার বরিভেলির ফ্ল্যাটে। দেবেন্দ্রদার আন্ধেরীর অ্যাপার্টমেন্টে, লোকেশের ঘাটকোপড়ের বাড়িতেও সকাল সকাল একই ব্যস্ততা। প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে, সহ্যাদ্রি ঘাটের মৌনতায় বন্ধু, সহকর্মীদের সাথে হাসি, গল্প, ঠাট্টায় কয়েকটা দিন। তারপর আবার সেই দৈনন্দিন মুখরতায় ফিরে আসা। কাকভোরে উঠে চটজলদি দাঁত মাজা, দু ঘটি জল ঢেলে নেওয়া। তারপরে জামাজুতো পরতে পরতে হোয়াটসআপ মেসেজ চেক করে নেওয়া। আসন্ন দিন তিনেকের এক্সকারশান নিয়ে আবশ্যক অনাবশ্যক টুকিটাকি কথা। একটু পরেই বাসে চেপে চৌত্রিশজন সহকর্মী পাড়ি দেবে মহাবালেশ্বর। ঘর থেকে বেরোনোর সময় আমার তিন বছরের মেয়েটা ঘুম চোখে “বাবা বাই বাই সী উ”, কচি হাতের একটা ফ্লায়িং কিস। বাসে ওঠার আগে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে সক্কলে মিলে একটা গ্রুপ পিকচার। বাসে উঠে জানলার ধারের সীট নেওয়ার জন্য হুটোপাটি। মহাবালেশ্বরের পথে বাস চালু হওয়া মাত্র সকলে সমস্বরে “গণপতি বাপ্পা মোরিয়া”। চলতে থাকা বাসে অনেকগুলো হাসি মুখ। খুচরো ইয়ার্কি, লেগ পুলিং। জানলা দিয়ে মাঝে মাঝে প্রকৃতির অতুল ঐশ্বর্য দেখতে থাকা অনেকগুলো মুগ্ধ চোখ। বৃস্টি ভেজা পশ্চিমঘাটের অনবদ্য দৃষ্টিনন্দন শ্যামলিমা। শ্যাওলা সবুজ পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বর্ষার জলে পুষ্ট হঠাৎ-চঞ্চলা ঝর্ণা। মোবাইলের ক্যামেরাতে আলোছায়ায় ধরে রাখা টুকরো স্মৃতিরা। হঠাৎই…হঠাৎই এসব কিছুর প্রয়োজন ফুরোল। সময় এল রাজার মত। হাত ধরে নিয়ে এল শব্দ থেকে নৈশব্দের এই অদ্ভুত জগতে। শুধু কিছু কথা বাকি রয়ে গেল। কিছু ইচ্ছে। বাড়িতে এখনো অপেক্ষারতা সেই খুদে বন্ধুটির সাথে আর একবার অফিস থেকে ফিরে ডাক্তার-রুগি খেলা হল না। তার কচি আঙুলগুলো নিজের আঙুলের মধ্যে ধরে আর একবার উপভোগ করা হল না সন্তান স্পর্শসুখ। ছুটির দুপুরে আমার জীবনসহচরীটির স্নানান্তে সুগন্ধি চুলের ঘ্রাণ আর একবার নেওয়া হল না।

এখানে শুধু নিশ্ছিদ্র মৌনতা। নিরন্তর শান্তি। অখণ্ড নিস্তব্ধতা। সেই খুদে প্রাণিটি হয়তো একরাশ উৎসাহ নিয়ে তার মাকে জিগেস করবে “বাবা কবে ফিরবে মা?” ওর মা চোখ মুছবে ওড়নার খুঁট দিয়ে। দুদিন, পাঁচদিন দশ দিন জিজ্ঞাসা করতে করতে আমার কন্যার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কটিও বুঝে যাবে – না। বাবা আর কোনোদিনও ফিরবে না। কিছুটা সময় লাগবে। এই নিষ্ঠুর সত্যটা ওর বুঝে নিতে কিছুটা সময় লাগবে, আর ওর মায়ের…মেনে নিতে।

 

https://timesofindia.indiatimes.com/city/pune/at-least-10-killed-as-bus-plunges-200-feet-deep-into-gorge-in-raigad/articleshow/65175833.cms

আঠেরোর শুভেচ্ছা

দেখতে দেখতে একটা বছর ঘুরে গেল আবারও
কেমন কাটলো? দুই শুন্যি সতের?
যযাতির ঝুলির বছর কাটলো…মন্দ না তা ভালই
পাঠকের ভালবাসায় ভিজে যযাতি জমকালোই।
সংগে থাকুন, তুলুন গাছে গল্পগরু স্বেচ্ছায়
আঠেরো সাল হেসে কাটুক যযাতির শুভেচ্ছায়।।

যযাতির ঝুলির প্রথম পোষ্ট হয়েছিল ৩১ শে জানুয়ারী, ২০১৭। অতএব যযাতির ঝুলি এখনো এক বছর পূর্ণ করে নি। এর মধ্যেই যযাতির ঝুলি পাঠকদের অভুতপূর্ব ভালবাসা পেয়েছে। জুন কিম্বা জুলাই-এর গোড়ার দিকে ব্লগস্পট থেকে ওয়ার্ডপ্রেসে নিয়ে আসা হয়েছিল যযাতির ঝুলি। এর মধ্যেই শুধু ওয়ার্ডপ্রেসে যযাতির ঝুলি ভিজিট করেছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি পাঠক-পাঠিকা। অর্থাৎ কিনা ব্লগস্পটের ভিজিট আর ওয়ার্ডপ্রেসের ভিজিট যোগ করলে দশ হাজার পেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। অফিসিয়াল ফেসবুক শেয়ার বাটন বলছে বেশিরভাগ লেখাই শতাধিক বার শেয়ার হয় এফ-বি তে। পঞ্চাশের ওপর ডাইরেক্ট ফলোয়ার আছে। এফ-বি পেজ ফলো করেন সহস্রাধিক।

যে সকল সুধী পাঠক ও পাঠিকারা যযাতির ঝুলিকে এত ভালবাসা দিলেন তাদের সকলকে যযাতির তরফ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং নতুন বছরের শুভেচ্ছা। যযাতির এই সামান্য প্রচেষ্টায় আপনাদের উৎসাহই একমাত্র পাথেয়। আশা করি আগামী দিনেও আপনারা পাশে থাকবেন। যযাতির ঝুলির লেখায় মন্তব্য করে ভুল-ঠিক ধরিয়ে দেবেন। কি ধরণের লেখা পড়তে আগ্রহী সে বিষয়ে যযাতিকে ফিডব্যাক দেবেন। সর্বোপরি আপনি যদি ব্লগটিকে ডাইরেক্ট ইমেল সাবস্ক্রাইব করতে চান সাইড বারে কি বটম বারে তার সুযোগ পাবেন। ভয় নেই – মাসে দু থেকে তিনটে পোস্টই করা হয়। একগাদা বস্তাপচা লেখা আপনার মেলবক্সে পাঠিয়ে বিরক্ত করা হবে না কোনদিনও – এটা যযাতির প্রতিশ্রুতি। আর যদি নিতান্তই তা না করতে চান যযাতির ঝুলির ফেসবুক পেজে জুড়ে যান কিম্বা আর-এস -এস ফীড সাবস্ক্রাইব করুন যাতে নতুন পোস্টের খবর পেতে পারেন। যদিও যযাতি চায় তার ফেসবুক পেজের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে।

এইরকমই অকৃত্রিম ভালবাসার সাথে নতুন বছরেও সঙ্গে থাকুন যযাতির ঝুলির। আর সঙ্গে থাকুন মানুষের – ধর্ম-জাতি-বর্ণ বিভেদ ভুলে :-)। আমি, আপনি, আমরা সবাই সাহিত্যচর্চা করি এই আশা নিয়ে যে একদিন সমস্ত বিভেদ, অসূয়া ভুলে মানুষ ঈশ্বর হবেই। যাই হোক, আপনাদের জন্য ঝুলি থেকে কোয়ালিটি গল্প, কবিতা, রম্যরচনা, স্মৃতিকথা বেরোবে নিয়মিত। আবারও বলি নিয়মিত লেখা দেওয়া হবে কিন্তু ঘন ঘন দেওয়া হবে না কারণ যযাতির ঝুলি এত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে যে লেখার গুণগত মান নিয়ে সচেতন থাকা আবশ্যিক। তাই ইচ্ছে হলে ইমেল কি আর-এস-এস ফীড সাবস্ক্রাইব করতেই পারেন। স্প্যাম করা হবে না।

নীল তিমি

ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে পড়তে গিয়ে জানলাম যে যারা ডিপ্রেসড ইন্ডিভিজুয়াল বা নৈরাশ্যবাদী, সেরকম টিন এজাররা স্বাভাবিক কারণেই এই নীল তিমির খপ্পরে সবচেয়ে সহজে পড়ছে। গেমের আবিষ্কারকদের জীবন দর্শন হল এই যে এইসব নিরাশাবাদীরা এমনিই পৃথিবীর কোন কাজে আসে না। তো এদের শুরুতেই খরচা করে দিলে পৃথিবীর এবং মানুষ জাতির আখেরে লাভ। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত যুক্তিহীন মত কিন্তু পড়তে পড়তে হঠাত মনে হল এই মানুষ জাতির ইতিহাসে এই গেম বের হওয়ার অনেক আগে থেকেই, সভ্যতার আদি লগ্ন থেকেই এইরককম একটা প্রকাণ্ড নীল তিমি তার অদৃশ্য হাঁ নিয়ে ঠায় বসে আছে। যতক্ষণ তোমার এই সমাজকে, এই পৃথিবীকে কিছু দেওয়ার আছে, ততক্ষণই ওই আগ্রাসী হাঁ থেকে তোমার নিস্তার। যেদিন তোমার দেওয়া শেষ সেই দিনই ওই নীল তিমির প্রকাণ্ড জঠর গহ্বরের পথে তোমার মহাপ্রস্থান। এই সর্বগ্রাসী নীল তিমিই রোজ আমাদের প্রেরণা দেয়, রোজ আমাদের তাড়না দেয় নতুন কিছু করার। নিজেকে নতুন করে চেনার। সিন্দাবাদের মত জাহাজে করে নিজেরই মনের সাগরের বন্দরে, বন্দরে, কুলে, উপকূলে ঘুরে মনি, মুক্তো, রত্ন সংগ্রহ করে এনে এই সংসারকে শুল্ক স্বরূপ সবটুকু দিতে হবে। যেদিনই তোমার জাহাজের পাল ছিঁড়বে কি হাল ভাঙবে বা গতি হবে রুদ্ধ সেই মুহুর্তেই সেই নীল তিমির বিশাল হাঁয়ের মধ্যে তলিয়ে যাবে তুমি তোমার বিকল জাহাজ সমেত। সমাজরূপী সেই নিষ্ঠুর ট্রেজারার গুনে গেঁথে মেপে রেখে দেবে তোমার সবটুকু সঞ্চয়। “সোনার তরী” কবিতায় এমনটাই বলতে চেয়েছেন কবিবর। তবু আজ এই ব্লু হোয়েল গেম আমায় এক নতুন আঙ্গিকে চেনাল এই অদৃশ্য অথচ সর্বগ্রাসী নীল তিমিটিকে। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ভার্চুয়াল নীল তিমিটাকে তো মারার সর্বতো প্রকার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ওই চিরন্তন নীল তিমিটার নিরন্তর ভয় যেটা আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়, ফসল ফলিয়ে বেড়ায় সেটার বেঁচে থাকা বোধ হয় খুব জরুরী। ওই নীল তিমিটার আগ্রাসন থেকে বাঁচতেই তো আবিষ্কার আগুন, চাকা, ষ্টীম ইঞ্জিন, মাধ্যাকর্ষণ, আপেক্ষিকতাবাদ। পশু থেকে মানুষকে মানুষ করেছে এই নীল তিমি। একদিন এই নীল তিমিই হিংসা, ঘৃণা, কলুষ আর যত মিথ্যা জৌলুস কেড়ে নিয়ে মানুষকে দেবতা বানাবে। মানুষ ঈশ্বর হওয়ার আগে বোধ হয় ওই নীল তিমিটার হাঁ থেকে নিস্তার নেই।  

সুখ

এইখানে আজ আমি থাকি। এইখানে কাটে এই বিনিদ্র রজনী একাকি। এইখানে একান্তিকে আমার এই ভাঙ্গা মন্দির। চারিদিকে তুলেছি এক নিশ্ছিদ্র প্রাচীর। বাইরে হিংস্র উরগদের জান্তব চিৎকার। এই আঙিনাতে বসে শুনতে পাই না আর। চোখে শুধু এক স্বপ্ন লেগে থাকে – একদিন নির্জন বনবীথিকার কোনো বাঁকে ফুটবে পলাশ আর ফুটবে রক্ত কিংশুক। লাজুক পাপড়ি গুলো যেন কোনো কিশোরীর আনত চিবুক। গাছের পাতার ফাঁকে এক ফালি সোহাগি রোদ্দুর বলে যাবে “বিশ্বাসে মিলায় সুখ…..তর্কে বহুদূর।”

বিশ্বায়ান এসে কেড়ে নিয়ে গেছে সব রুপকথাদের। যা কিছু সুশীল, সুললিত, যা কিছু যত্নলালিত তার কঙ্কালের ওপরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি আমরা আর আমাদের অতৃপ্ত প্রেতাত্মারা। চোখে শুধু ঘৃণা, অবিমিশ্র ঘৃণা – বামেদের ডানেদের প্রতি, ডানেদের বামেদের প্রতি, বিশ্বাসীদের অবিশ্বাসীদের প্রতি, অবিশ্বাসীদের বিশ্বাসীদের প্রতি। ক্লান্ত নগর, তোমার ইঁট, কাঠ, সিমেন্টও বুঝি আমাদের থেকে বেশি প্রানবন্ত আজ। তারাও বুঝি উপহাস করে আমাদের এই মৃত অস্তিত্বকে।

জীবন খাতার

সব ব্যক্তিগত মুহূর্ত বাজারি হয়েছে ফেসবুকের পাতায়

আর বাজারি হয়েছে আমার সুন্দরী কবিতারা

নিয়ন লাইটের আলোয় ঝলমলে শাড়ি পরে আমার দেওয়ালে দাঁড়ায়

আর লাইক খোঁজে তারা

শ্বাসকষ্ট

পৃথিবীর তাবড় তাবড় পরিবেশবিদদের ডেকে আনা হয়েছে। সাত দিনের চিন্তন শিবির খোলা হয়েছে। বিষয় পরিবেশ দুষণ নিয়ন্ত্রণ করা। পরিসংখ্যান বলছে গত এক সপ্তাহে কোটি কোটি ভারতবাসী শ্বাসকষ্টে ভুগছে। দু চারটে শ্বাসকষ্টে মৃত্যুর খবর-ও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর সত্যতা যাচাই করা যায় নি। কিন্তু হঠাৎ কি করে বাতাসে এতটা দুষণ এল তার কারণটা খুঁজে বের করতে বড় বড় বিজ্ঞানীরা শক্ত শক্ত অঙ্ক কষছে আর দাঁড়ি চুলকোচ্ছে। ওজোন স্তরেই কি ছিদ্র হল না কি ফসিল ফুয়েল পোড়ানোর জন্য বাতাসে কার্বন কণার পরিমাণ বৃদ্ধি সেই নিয়ে জোরদার তর্ক লেগেছে। কেউ কেউ ম্যাটল্যাব সিমুলেশান বানিয়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাব প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করছে। কেউ বা হ্যাডুপ ব্যাবহার করে একটা বিগডাটা ডাটাবেসে-এ বিশ্বের শেষ এক হাজার বছরের আবহাওয়া আর জলবায়ুর ডাটা ফীড করে হিউমিডিটি লেভেল-এর ওপর প্রেডিক্টিভ অ্যানালিসিস জব চালাচ্ছে। রাজনীতিকরা সব বলছে “এই নাকি আচ্ছে দিন?” এই দুষিত বাতাসের জন্য RAW পাকিস্তান অ্যাংগলটাও খতিয়ে দেখছে। কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না বাতাস হঠাৎ এত ভারী আর আর্দ্র হয়ে যাওয়ার কারণটা ঠিক কি? কেন শ্বাস নিতে গেলেই মনে হচ্ছে বাতাসে অক্সিজেন-এর সঙ্গে কি যেন মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শেষমেষ একটা চ্যাঙড়া ছোঁড়া, সে কয়েকদিন যাবৎ এক ক্ষীণকটি সুন্দরীর বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করছে কিন্তু ঠিক লাইন করতে পারেনি, সে বললে “আপনারা দেখছি বড়ই বেবুক। আমি জানি কি হয়েছে। সক্কলে সমস্বরে বলল “কি, কি, কি হয়েছে ভাই?” ছেলেটা বলল “ভয়ের কিছু নেই। সাময়িক সমস্যা। কেটে যাবে। 14th February-r পর। February মাসে রোজ রোজ এই রোজ ডে, টেডি ডে, চকলেট ডে, ভ্যালেন্টাইনস ডে এই সব সাপ-ব্যাঙ দিনের প্রভাবে বাতাসে ভালবাসার পরিমাণ একটু বেড়ে গেছে। তাই বাতাস একটু ভারি আর ভেজা। ভালবাসাটা কর্তব্য হয়ে গেলে সেটা পাপের থেকেও ভারি বোঝা। 14th February টা কেটে গেলেই দেখবেন দখিনা বাতাসের মত ফুরফুরে আর অ্যানুয়াল-পরীক্ষা-শেষ-হওয়া-মনের মত হালকা হাওয়া আবার বইবে।

যোগা

Facebook, twitter, instagram এর জটাজালে বিশ্বাত্মার সাথে সংযোগ
আর লাইক পেয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগা
কলিযুগে এরই নাম যোগা…:-) 🙂