আমার তিন বছরের কন্যার ভারি টিভি দেখার নেশা বেড়ে যাচ্ছে। তাই আদর্শ বাবার মত ঠিক করলাম ওকে একটু বই পড়ে শোনাতে হবে। আমেরিকানরা তো সন্তানের জন্ম থেকেই বাচ্চার ঘুমোনোর আগে তাকে বই পড়ে শোনায়, তাতে নাকি সেই দুগ্ধপোষ্য শিশুদের vocabulary বাড়ে। আমি সেই দুঃসাহস করি নি। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে সানাইকে একটু স্টোরি রীড করে শোনাতে সচেষ্ট হই। তো আজকের গল্প Beauty and the Beast।
বেশ অনেকটা পড়ে ফেলেছি গল্পটা। এক ডাইনি রাজপুত্রকে অভিশাপ দিয়ে কদাকার পশুমানবে, অর্থাৎ একটা Beast-এ পরিণত করেছে। এদিকে Beauty-র বাবার খুব দুঃসময়। ঝড়ে জাহাজডুবি হয়ে ভাঁড়ে-মা-ভবানী হয়ে গেছে। তাও আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া। জাহাজ উদ্ধার করতে গিয়ে ফেরার পথে Beast-এর প্রাসাদে আশ্রয় নেয়। ভুড়িভোজ খেয়েটেয়ে, রাত্রে নরম বিছানায় ঘুমিয়ে টুমিয়ে সকালে যখন Beauty-র জন্য Beast-এর গোলাপ বাগান থেকে গোলাপ ছিঁড়ে নিয়েছে তখন Beast-এর মাথা যাকে বলে একেবারে ভিসুভিয়াস। Beauty-কে পাঠিয়ে দেওয়ার শর্তে মুক্তি দিয়েছে ওর বাবাকে। রুদ্ধশ্বাস ব্যাপার। বাড়িতে এসে সব ঘটনা বলায় Beauty স্বেচ্ছায় Beast-এর প্রাসাদের উদ্দেশে যাত্রা করছে। Beauty কাঁদছে। Beauty-র বাবা কাঁদছে। আকাশ বাতাস পাখি নদী সবাই কাঁদছে। সমস্ত ক্রন্দসী কাঁদছে বলা চলে। এরকম একটা ভয়ানক বিষণ্ণ মুহূর্তে সানাই জিজ্ঞেস করে বসল, Beauty কাঁদছে কেন বাবা? ও কি ভাতু খায় নি? মাম্মা বকেছে? লে… সাত কাণ্ড রামায়ণ শুনে সীতা রামের মাসি? ভাতু-না-খাওয়া-জনিত-মাম্মার-বকা ছাড়াও যে মানুষের দুঃখের আরো কারণ হয় বোঝাতে চেষ্টা করি। সিকুয়েন্স অফ ইভেন্টটা আবার একবার রিপিট মারি। কিন্তু সানাই অলরেডি Beauty-র কান্নার কারণ জানার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। শেয়ার মার্কেটের থেকেও তড়িৎ গতিতে মনের মতি বদলায় ওর। অতএব চরৈবেতি। পরে কি হল জানতে চায়। বাকি গল্পটুকুও পড়ে ফেললাম। Beast-এর Beauty-র প্রতি সহৃদয় ব্যবহার (সুন্দরী মেয়ে পেলে কে আর extra nice ব্যবহার করে না – মনে মনে ভাবছি)। কয়েকদিন Beast-এর প্রাসাদে থাকার পরে Beauty-র বাবার জন্য মন খারাপ। Beast Beauty-কে বাড়ি আসতে অনুমতি দেয়। Beauty বিরহে Beast-এর এই যায় সেই যায় অবস্থা। Beauty-র প্রত্যাবর্তন আর তার চোখের জলে Beast-এর শনির দশা কেটে আবার রাজকুমারে রূপান্তর। অতঃপর Beauty আর রাজপুত্রের বিয়ে-সাদি-সানাই (ইয়ে মানে এটা বাদ্যযন্ত্র সানাই। কথাযন্ত্র সানাই না) । গল্পটা সবাই জানে। কিন্তু মুস্কিল হল গল্পশষে সানাইয়ের প্রশ্নগুলোতে।
সব শুনেটুনে সানাই বলল বাবা, প্রিন্সের মাম্মা কই? খুব-ই চাপের প্রশ্ন। গল্পের লেখক ও পাঠককুল কেউ কোনদিন Beast-cum-রাজপুত্রের বাবা মা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। আগডুম বাগডুম একটা বললাম। পরের প্রশ্নগুলো এইরকম –
বিউটির বাবা কই? বাড়িতে আছে। কেন? কারণ Beauty Beast-এর রাজপ্রাসাদে গেছে তাই। রাজপ্রাসাদে গেছে। ও। কেন? কারণ Beast-এর শরীর খারাপ হয়ে গেছে ( গল্পপাঠকালীন কিছুই বোঝাতে পারিনি ভেবে আমার রক্তচাপ বাড়ছে) । ও শরীর খারাপ? Beast ডক্করের কাছে যাবে? ইনজেকশান দেবে ডক্কর? “সেটা দিতেও পারে। কিন্তু এখানে সেরকম লেখা নেই।” গল্পে ডাক্তার বদ্যি আমদানী হবার আগেই আমি তাড়াতাড়ি আর একবার ঘটনাপ্রবাহ বলে দিই। “Beauty-র বাবা Beast-এর বাগান থেকে গোলাপ ছিঁড়েছিল তো। তাই Beast রেগে গিয়ে Beauty কে আসতে বলেছিল।” বাবা গোলাপ ছিঁড়েছিল? কেন? আরে Beauty একটা red rose চেয়েছিল না? এই যেমন তুমি কিছু চাইলে বাবা এনে দেয় না? Beauty red rose কেন চেয়েছে বাবা? আরে বললাম না, বিউটির বাবা ওকে জিগেস করল, তুমি কি গিফট্ নেবে। তখন ও একটা রক্তগোলাপ চাইল। ক্রিস্টমাস গিফট্? হ্যাঁ, ক্রিস্টমাস গিফট্। Oh. I see. যাক বুঝেছে। গল্পটা বোঝাতে পেরেছি ভেবে আমি মনে মনে গর্বিত বোধ করি যাকে বলে basking in glory. পরে সানাই-এর থেকে শুনে দেখলাম, গল্পটা আসলে এরকম।
Beauty ভাতু খায় নি। তাই Beauty-কে তার মাম্মা বকেছে। তাই বিউটি কাঁদু করেছে। তখন বিউটির বাবা christmas gift দেবে বলেছে। Beauty-র বাবা Beast-এর বাড়ি গিয়ে ফুল ছিঁড়েছে। তাই Beast বিউটিকে timeout দিয়েছে (যাঃ বাবা, টাইম আউটের কথা বললাম কোথায়? Beauty and the beast-এর গল্পের সঙ্গে এ যে দেখছি নিজের original creation punch করে দিচ্ছে)। বিউটি timeout পেয়ে কাঁদু করেছে। Tears লেগে Beast প্রিন্স হয়ে গেছে। তখন প্রিন্স-এর মাম্মা এসেছে। এসে বিউটিকে ঠিক করে ভাতু খেয়ে নিতে বলেছে (যাক বাবা এটা বলে নি প্রিন্স-এর মাম্মা এসে প্রিন্সকে বলেছে Beauty-র সারা জীবনের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করতে)।
……এতক্ষণের পণ্ডশ্রমের কথা ভেবে ততক্ষণে আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে।
শুনেছি বয়সকালে ছেলেমেয়ের কাছে লাথি ঝাঁটা খেতে হয়। আমার “বয়সকাল” হয়েছে কিনা জানি না কিন্তু কালে কালে বয়স তো কম হল না। বয়সকাল হয়েছে না বয়সটাই কাল হয়েছে বলতে পারব না, আর ঝাঁটাটা ভবিষ্যতে বরাদ্দ হবে কিনা জানি না কিন্তু লাথি বরাদ্দ হচ্ছে এখন থেকেই।
আমাদের বাড়ির নতুন সদস্য, বয়সে নেহাতই নবীন। তিনি পৃথিবীকে অনুগ্রহ করার পর থেকে একটাই বছর ঘুরেছে, মানে তাঁর বয়স এই মাত্র এক বছর। কিন্তু হলে কি হবে, নিশ্চয়ই আগের জন্মে লিটল বম্ব তাথৈ দেবী চুনি গোস্বামী থেকে থাকবেন কারণ পা দুটি পুরো ফুটবল-বলিষ্ঠ। ক্ষুদ্র বলিয়া তুচ্ছ নই এই নীতিকথা অনুসরণ করে তিনি সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে, মানে যাকে বলে পাখি ডাকা ভোর থেকে (আমার জন্য অবশ্যই অর্ধেক রাত্রি) পদাঘাত করতে শুরু করেন মানে কাঁচা বাংলায় লাথি মারতে শুরু করেন। বক্তব্যটা হল আমার যখন ঘুম ভেঙেই গেছে তখন তোমরা ঘুমোও কোন অধিকারে? উনি তো সুযোগ সুবিধে মতই একটু গড়িয়ে নেন, আমি হয়তো সপ্তাহান্তের পার্টি প্রেসার সামলে, ধেই ধেই করে নেচে, ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলির বাপ বাপান্ত করে, সোনালি তরলের ঘুমঘোর মোহে দেশের দুঃখদুর্দশার কথা বন্ধু সহযোগে তর্কাতর্কি করে, ফেসবুকীয় বিপ্লব সেরে রাত্রি দ্বিপ্রহরে বডি বিছানাতে ফেলেছি। তাই শরীরের বিশ্রামের প্রয়োজনেই এবং মনের বিশ্রামের অধিকারেই ঘুমোই। কিন্তু এ যুক্তি তার কাছে প্লেস করার সুযোগ নেই কারণ যে দু তিনটে ভাষায় আমার সামান্য দখল আছে, আমাদের বাড়ির নবীনতম সদস্য এখনো সেই ভাষায় বাক্যালাপ করতে বিশেষ উৎসাহ প্রদর্শন করে নি। তাঁর স্টাইল পুরোপুরি একনায়কতান্ত্রিক। নিজের সুবিধা-অসুবিধা প্রয়োজন-অপ্রয়োজন উঁচুস্বরে নির্দ্বিধায় অন্যের সময়-অসময়ের তোয়াক্কা না করেই তিনি জানান দেন। হিটলার মুসোলিনিও লজ্জা পাবে সেই অথরিটেটিভ স্টাইল দেখে। ধরুন আপনি সকালবেলার প্রথম পটি – না না সকাল সকাল বাজে কথা নাই বা বললাম – ধরুন সকালবেলার প্রথম চা-টা হাতে নিয়ে সোফায় “রাতভর ঘুমোনো ক্লান্ত শরীরটা” একটু এলিয়ে দিয়েছেন এমন সময় বাজ পড়ার মত বাজখাঁই গলায় চিৎকার। আপনি ভাবছেন এই তো সবে ডাইপার চেঞ্জ করে দুধ খাইয়ে সব প্রয়োজন মিটিয়ে দিলাম। কথা হচ্ছে সে প্রয়োজন ছিল শরীরের। এখন তার আত্মার প্রয়োজন আর সেটা হল বাবার কোলে উঠে একটু মর্নিং ওয়াক করা। পিতাপুত্রীর সুসম্পর্ক সাধনের সদিচ্ছা নিয়েই সে সাশ্রু নয়নে জানাবে এই দাবী। কোলে তুলে নিলেই যে দু পাটি দাঁত বের করে এমন নিখাদ স্মাইলটি দেবে দেখেই মনে হবে আগের কান্নাটা ছিল কুমীরকান্না। দু পাটি দাঁত বের কথাটা একটু অত্যুক্তি হয়ে গেল কারণ দু চার খানা দাঁতেরই শুভাগমন হয়েছে সে মুখে।
যাকগে যাক, কথা হচ্ছিল লাথি ঝাঁটা খাওয়ার। তা হ্যাঁ, লাথিটা নিয়ম করেই খাচ্ছি। তিন বছর আগে খেতাম বড় মেয়ের কাছে। কিন্তু সে এখন রেগে গেলে রাম চিমটি, লক্ষ্মণ কিল ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে (ওর মায়ের কাছে হেভি ঝাড় খাওয়ার সম্ভাবনাটা কনসিডার করে নিজের পায়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে)। কিন্তু ছোট মেয়ের সে আপদ নেই। এই এক বছর ধরে হোম স্কুলিং-এ বাংলা ভাষা শিক্ষা করে নিশ্চয়ই ভাষাটাকে তার খুব ফানি ল্যাঙ্গুয়েজ লেগে থাকবে নয়তো তার মা তার ওপরে গলা চড়ালেই দু পাটি না-হওয়া দাঁত বের করে ফ্যাকফ্যাক করে হাসবে কেন? বকাঝকা ভীতির উদ্রেক না করলে বকার উৎসাহ, উদ্যম দুটোই চলে যায়। তো যা বলছিলাম, তিনি বকাঝকার তোয়াক্কা না করেই লাগাতার লাথি মেরে ছটার মধ্যে আমার ঘুমের দফারফা করে দিয়ে আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকেন। খিদের মুখে যেমন পৃথিবী গদ্যময়, ঘুমের মুখে তেমনি পৃথিবী রাত্রিময়। থুড়ি ঘুমের চোখে পৃথিবী শত্রুময়। আর সেই শত্রুই যখন ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে মনজয় করার চেষ্টা করে তখন মনে গৌতমবুদ্ধসুলভ সদ্ভাবনার উদ্ভব হয় না এ কথা অকপটে স্বীকার করাই যায়। তবুও ভদ্রতার খাতিরে মুখে দেঁতো হাসি লাগিয়ে পুতুল সাইজের প্রাণীটাকে জড়িয়ে ধরে সেকেন্ড রাউন্ড ঘুমোনোর চেষ্টা করি। প্রাণপণ।
আজ ছিল আমার দ্বিতীয় কন্যার প্রথম জন্মদিন। দিনটা ওদের কাছাকাছি কাটাব বলে দিনভর বাড়ি থেকে কাজ করেছি। কাজের মাঝে মাঝে শিশু কন্যার স্পর্শসুখ। ওর হাতের মুঠির মধ্যে আমার আঙুল যখন আশ্রয় পায়, মনে হয়, শুধু এই সুখটুকুর জন্য আরো হাজার জন্ম নেওয়া যায়। আজ ওর জন্মদিন। আজ ওর জন্য একটু বেশি আদর। আজ ওর সাথে একটু বেশি খেলা। মনে মনে হয়তো বা বলা – “আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার, ওগো প্রিয়।”
সঙ্কর প্রজাতি আমরা। সকাল বেলা বাঙালি মতে পায়েস আর ওর মায়ের পরম যত্নে রান্না করা পঞ্চব্যাঞ্জন আর সন্ধেবেলা বিলিতি মতে একটু কেক। ছিমছাম একটা আনন্দের দিন। কিন্তু দিন…সে তো শেষ হয়। সন্ধ্যা আসে। রাত্রি নামে। জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে প্রতি রাতেই আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা। আজকেও ব্যতিক্রম হল না। ওর ঘুমিয়ে পড়া ছোট্ট, ভীষণ ছোট্ট শরীরটা দেখলে মনে হয় কোথা থেকে যেন একটুকরো প্রাণের কণা বসন্তের মলয় সমীরে উড়ে আমাদের মাঝে এসে পড়েছে। অনেকটা মানুষ মানুষ কিন্তু ঠিক মানুষ না। যেন একটা খেলনা মানুষ। জীবনের পরীক্ষাগারে আরও একটা ছোট্ট মডেল, আরো নতুন কিছু সম্ভাবনা।
ওকে বিছানায় শুইয়ে দিতে এসে হঠাৎ বুকের মধ্যে ছাঁত করে উঠল। তাহলে একটা বছর ঘুরে গেল ওর জীবনের। সূর্যের বাহুলগ্না হয়ে যে ব্যালে ড্যান্স শেষ হাজার কোটি বছর ধরে করে চলেছে পৃথিবী, তার আর একটা অধ্যায় সমাপ্ত হল। সূর্যকে ঘিরে মহাশুন্যপথে পুরো এক পাক ঘুরে নিল নীলগ্রহ। ওর অজান্তেই ওর বয়স এখন এক। অসীম নিষ্ঠা ভরে এই বারো মাসে শিখে নিয়েছে অনেক কিছু। মাতৃস্তন্য পান থেকে শুরু করে উবুড় হওয়া, তারপর হামাগুড়ি দেওয়া আর সর্বশেষে টলোমলো পায়ে হাঁটতে চলার এক বছরের নিবিড় জীবনপাঠ। জীবনের রসদ প্রাণপণে ঠুসে নিচ্ছে নিজের ক্ষুদ্র শরীরে। এখন শুধুই নেওয়ার পালা। স্নেহ সঞ্চয়, জীবনের রসদ সঞ্চয়। কিন্তু দেওয়ার বেলাও আসবে। কুঁড়ি মানুষটা যে সম্ভাবনাগুলোর সমষ্টি, তার কতটা রূপায়িত হল সেটা জানার জন্য গুঁড়ি মেরে অপেক্ষা করছে মহাকাল।
আমি ভাবি, ওর জীবনের আরো একটা বছরের সূচনা হয়ে গেল অথচ কোনো ওয়ার্নিং বেল বাজল না, কোনো ঘন্টি বাজল না, কোন মহাপ্রাণ এসে কানে কানে বলে গেল না “সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়, যে জন না বোঝে তারে ধিক, শত ধিক।” টিক টিক টিক। ঘড়ির কাঁটার অনিবার্য ঘূর্ণন যা প্রতিনিয়ত আমাদের জীর্ণ করে, আমাদের ছায়াকে দীর্ঘতর করে তার চলন এতই ধীরে যে তা বুঝতে বুঝতেই অনেক কটা গ্রীষ্ম বর্ষা শরত হেমন্ত পার করে এখন আমি জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। মহাকাল। পাহাড়ি দস্যুর মত বজ্র মুষ্টি তার অথচ ভোরের শিউলির মত নিঃশব্দ পদসঞ্চালন। আবার খুব হীনবৃত্তি নিন্দুকের মতই judgemental, ছিদ্রান্বেষী। সে চলে যাবে আপন তালে। বলবে না, “একটু তাড়াতাড়ি পা চালাও ভাই। তোমার তো সন্ধ্যা নেমে এল।” অথচ প্রতিটা মানুষকে তার শেষ স্টেশানে নামিয়ে দেবার দিনে করবে চুলচেরা বিচার। বিচার করবে যে, সে মানুষটার লোটা কম্বল, জীবনের সঞ্চয় বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, নাকি তার সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই শ্রেয়। কালের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার গহ্বরে তাকে নিক্ষেপ করে চলে যাবে, নাকি ক্ষীণ একটা বাতি ধরে দিয়ে যাবে যাতে ভবিষ্যত তার খবর পায় – সেই বিচার। মহাকাল। জীবৎকালে নীরব সাক্ষী, মরণকালে চুলচেরা বিচারক। আমার ফেলে আসা বছরগুলোর দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে তাই বলতে ইচ্ছে করে, “সে চলে গেল, বলে গেল না। সে কোথায় গেল ফিরে এল না। সে যেতে যেতে চেয়ে গেল। কি যেন গেয়ে গেল। তাই আপন মনে বসে আছি…”। আপন মনে বসে আছি…আপন মনে বসে আছি…
আমার এই যে হাসি, এই যে কান্না, এই যে প্রেম, এই যে বিরহ, এই যে স্নেহ, এই যে ঘৃণা, এই যে রমণ ইচ্ছা, এই যে মহোত্তমের খোঁজ – জানি জানি তুমি কিছু নেবে না এ সবের। জানি তুমি আমাকে নেবে না। শুধু যে কটি ফুল ফুটিয়েছিলাম মনের উঠোনে, হে নির্দয় মহাকাল, সে ফুলের সাজি রাখবে কি তোমার অক্ষয় মালঞ্চে?
ব্লগটা লেখা যখন শুরু করেছিলাম বছর তিনেক আগে, ভাবি নি সেটা এতো পাঠকের চোখ পাবে। তবু পেল যখন তখন যযাতির ঝুলিকে মুদ্রিত মাধ্যমে নিয়ে আসার কথা মাথায় এলো স্বভাবতই। আমার কলমকে কালি দিল পত্রভারতী। বইমেলায় বইটি বেরিয়েছে এবং অনেকেই সংগ্রহ করেছে। তাই বাকি দু-দশ কপি যা পড়ে আছে সংগ্রহ করতে বেরিয়ে পড়লাম কলেজ স্ট্রীটের দিকে। গন্তব্য পত্রভারতীর অফিস। এই কপি কখানা আমার ইউ এস এর কিছু সুহৃদ্ বন্ধুদের জন্য নিয়ে যাব। আমার একা কোথাও যাওয়ার থাকলে সাধারণত ট্রামে বাসে যাই, জীবন দেখতে দেখতে। পত্রভারতীর যে আধিকারিক আসতে বলেছেন তার নির্দেশ অনুযায়ী রামরাজাতলার থেকে হুগলি সেতু দিয়ে যাওয়াটাই তাড়াতাড়ি হবে। বাকসাড়া মোড় অব্দি টোটোয় গিয়ে একটা গরম বাসের জঠরে সেঁধিয়ে গেলাম। মাতৃ জঠরে থাকার অভিজ্ঞতাটা মনে নেই। তবে আন্দাজ করতে পারি এই বাসের পেটের মতই হবে। ঠাসা, গরম আর ভেজা ভেজা। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের নির্বাচনী আসর জমে উঠেছে। বাসের গরমে ইলেকশানের বাজার আরও সরগরম হয়ে উঠেছে। হাত জোড় করে ভিক্ষাপাত্র থুড়ি ভোটপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে জননেতারা, পোস্টারে, পোস্টারে। নির্বাচনী আসরে, বাসের গরমে, গরম আলোচনা হচ্ছে অফিসযাত্রীদের মধ্যে। এই একটাই সময়ে মানুষ এই জননেতাদের মাটিতে টেনে নামায়।
জানলা পথে একটা বিজ্ঞাপন দেখে মনে মনে একটু তারিফ না করে পারলাম না। ওরিপ্লাস্ট বলে একটা ব্রান্ড অ্যাড দিয়েছে, “দরের থেকে কদর বেশি”। আমরা যারা পানাসক্ত অর্থাৎ পানিং-এ আসক্ত এমন সুন্দর pun দেখলে মুখে এক চিলতে হাসি চলে আসে বৈকি। রবীন্দ্রসদনে বাস থেকে নেমে আমার পাতাল প্রবেশ। অর্থাৎ পাতাল রেল ধরব। “তুমি কি শুনেছ মোর বাণী, হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি / জানি না তোমার নাম, তোমারেই সঁপিলাম আমার ধ্যানের ধনখানি।” – লেখা আছে মেট্রোরেলের প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে। আহা কি কথা। ঠিক যেন tailor made আজকের এই ক্ষণখানির জন্য। আমাকেই সঁপেছেন, একটা গোটা শতাব্দীর ওপার থেকে শুধু আমাকেই সঁপেছেন কবিবর তাঁর ধ্যানের ধনখানি, তাঁর সুললিত শব্দভান্ডার। সার্থক কবি আপনি, হে রবীন্দ্রনাথ। এতদিন পরেও বয়ঃসন্ধিক্ষণ পেরোনোর পর থেকেই নতুন প্রজন্ম এক অনিবার্য আকর্ষণ বোধ করে আপনার বাণীর প্রতি। কিছু নির্বোধ আঁতেল নিশ্চয় আপনাকে খাদারে ফেলে দিতে চায় তবে তাদের লেখা বছর পার করতে পারে না। আপনি তো শতবর্ষের পরেও অমলিন। রবি ঠাকুরের দেশ থেকে আমি যাব গান্ধীজীর দেশে। অর্থাৎ কিনা রবীন্দ্রসদনে উঠে আমার মেট্রোমুক্তি মহাত্মা গান্ধী স্টেশানে। তাঁকে মহাত্মা নামটা ঘটনাচক্রে এই রবীন্দ্রনাথই দিয়েছিলেন। মেট্রো রেলের দরজা বন্ধ হতেই নিশ্চিন্তি। কলকাতার যানজটের তোয়াক্কা না করে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চললাম আমার গন্তব্যের দিকে।
“স্টেশান রবীন্দ্র সেডান, পরবর্তী স্টেশান ময়ডান।” কৃত্রিম অ্যাক্সেন্ট মেরে ঘোষণা করে এক নারীকণ্ঠ। সত্যি সেডান-ই বটে। সদন কথাটা মোটেই যুগোপোযোগী নয়, ম্যাদামারা মিয়নো বিস্কুটের মত। তার থেকে সেডান “একেবারে কড়ক আছে”। বাংলা ভাষার ‘ত’ থেকে ‘ধ’ অব্দি অক্ষরগুলো ব্যান করে দেওয়া উচিত। ‘ট’ থেকে ‘ঢ’ অব্দি তো আছেই। আমাদের দু-শ বছরের পলিটিকাল মাস্টাররা ‘ত, থ’ বলতে পারে না যখন তখন ওই বর্ণ কখানার নিশ্চয়ই অস্তিত্বসঙ্কট।
বার বার পকেটের মধ্যে মেট্রো রেলের প্লাস্টিক টিকিট হাৎড়াই। ওইটা ছাড়া বেরোতে পারব না। আর জিনিসপত্র হারানোর ব্যাপারে আমার মেলা বদনাম আছে। বছরে গোটা তিনেক ছাতা আর একখানা অন্তত মানিব্যাগ আমি পরার্থে পথে দান করে আসি। কিন্তু টিকিট হারালে পাতালজীবন থেকে মুক্তি পেতে টিকি মাথায় উঠবে।
মহাত্মা গান্ধী স্টেশানে নেমে অটো ধরার নির্দেশ দেওয়া ছিল। আমার কোনদিকে যেতে হবে একে তাকে জিগেস করতেই সুলুক সন্ধান পাওয়া গেল। কলকাতার এই এক সুবিধে। অন্ধের জষ্টির মত পথচারীরা আছেন যাঁরা পথের সুলুক সন্ধান দেবে। দেবেই দেবে। চড়ে পড়লাম অটোতে। অটোটা যখন আরো যাত্রী তোলার জন্য গড়িমসি করছে আমি দেখছিলাম ঝুড়ি ঝুড়ি ঝুড়ি-মানুষ। সেটা কি? সেটা হল কিছু প্রকাণ্ড ঝুড়ি। সার সার রাখা আছে। আর তার ভেতরে গুটলি পাকিয়ে শুয়ে রোদ-গরমে বিশ্রাম নিচ্ছে ঝুড়ির মালিক বোধ করি। ঝুড়ি পিছু একজন। যে ঝুড়ি তার জীবিকা সেই ঝুড়িই তার বিশ্রামাগার। এমন চমৎকার দৃশ্য, ঝুড়ির এমন অভিনব ব্যবহার কলকাতা ছাড়া কোথায় দেখতে পাবো? খুব লোভ হচ্ছিল ঝুড়ি মানুষের কাছে একটা বিড়ি টিড়ি চাওয়ার অছিলায় একটু আড্ডা মেরে নিতে। বহুবার করেছি। নস্টালজিয়া খুব পাওয়ারফুল ড্রাইভার। দেশ-গাঁয়ের কথা বললেই এনারা গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন। এদের মধ্যে যা গল্প আছে তা দিয়ে একটা উপন্যাস লেখা যায় সহজেই। কিন্তু আজ সময় নেই। সময়ে পৌঁছনর একটা বদনাম আছে আমার। ঝুড়ি মানুষদের পেছনে ফেলে আমাদের অটো এগিয়ে চলল।
যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে সেটা ঝাঁ চকচকে কলকাতা নয়। “মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণা” যত্রতত্র অর্থাৎ কিনা পলিটিকাল পোস্টার। সারা কলকাতা যেন একটা ফলাও দিদি এ্যালবাম। পাশেই অবিশ্যি কাস্তে-হাতুড়ির ত্রিকোণ পতাকা। সোনালি স্বপ্নের দিন নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতাদের হাত জোড় করে ভোট ভিক্ষা। নেতাগণ, নেতৃগণ আর কত বছর, আর কত যুগ অপেক্ষা করবে বাঙালি সেই সোনাঝরা দিনের জন্য? রাস্তার কল দিয়ে মোটা ধারায় জল পড়ছে আর সেই জলে পথশিশুরা স্নান সারছে। এই গরমে জলকেলি করতে পেরে তাদের মুখে পরম পরিতৃপ্তি। একটা কাক, সেও গরমে কাহিল, একটু গা ধুতে চায়। একবার করে উড়ে এসে সে-ও একটু জলে ঝটপট করে নিচ্ছে ডানা। আবার তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে। এ শহরের পাখি বলতে ওই এক কাক। দেখে নিন। প্রাণ ভরে দেখে নিন তার চিকণ শ্যামল গা। কান ভরে শুনে নিন তার কর্কশ সঙ্গীত। কারণ, পঞ্চাশ বছর পরে এরাও থাকবে না। মানুষ ছাড়া আর কারু বাঁচার অধিকার নেই, এ আমাদের মানবজাতির দৃপ্ত ঘোষণা। জরাজীর্ণ বাড়ি, তাতে বট গাছ মাথা তুলেছে কার্নিশে। দ্বিপ্রাহরিক আজান ভেসে আসছে কাছেই কোনো দেবস্থল থেকে। দুপুরের গনগনে আগুনে পান বিড়ির দোকানে বসে খদ্দেরের অভাবে ঢুলছে দোকানদার। আমার ছোকরা অটো ড্রাইভার বেশ চড়া ভলিউমে কাওয়ালি লাগিয়েছে তার বাহনের স্টিরিও সিস্টেমে। “আল্লাহ জানে ক্যা হ্যায় মহম্মদকা মারতাবা”। সত্যি-ই যেভাবে মানব সভ্যতার অকল্পনীয় বিস্তার হয়েছে শেষ বিশ বছরে, তাতে আল্লাহ্ই জানে কোথায় গিয়ে ইতিচিহ্ন টানা হবে, ঈশ্বরের সন্তানের স্থান এখন ঠিক কোথায় বলা মুস্কিল। গানের তালে তালে ছোকরা মাথা নাড়ছে। পথশ্রম তুচ্ছ করে, রোজকার দৈনন্দিনতার ক্লেশ তুচ্ছ করে সঙ্গীতের সঞ্জীবনী তাকে উজ্জীবিত করছে। আর একটু যেতেই অটোচালক ছোকরাটি নামিয়ে দিল যেখানে সেখান থেকে কলেজ স্ট্রীট পায়ে হাঁটা দূরত্বে।
অদ্ভুত এই বইপাড়া এই কলেজে স্ট্রীট। সারা পৃথিবীতে এরকম একটা সারস্বত সাধনার জায়গা আর একটিও নেই। বইয়ের ভারে ন্যুব্জ আর জ্ঞানভারে মন্থর। কাশির গলির মত অপ্রশস্ত পথ। একদিকে প্রতিষ্ঠিত দোকান আর একদিকে স্টল করে বই বিক্রি করছে খুচরো ব্যাবসায়ী। পুরীতে যেমন পান্ডারা ছেঁকে ধরে সেরকমই এই পথ দিয়ে গেলেই নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কানে আসবে “দাদা, আপনার কি বই চাই বলুন না”। আর এদের অদ্ভুত বইয়ের জ্ঞান। যেকোনো বইয়ের নাম বললেই হয় আনিয়ে দেবে নয় বলে দেবে কোন দোকানে পাওয়া যাবে। আমি মূলত এসেছি আমার প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছেছি। কলেজ স্ট্রীট এসেছি আর লোভী মৌমাছির মত বইয়ের খোঁজে গলিতে গলিতে ঘুরব না তা কি হয়? দু একটা বইয়ের খোঁজে ছিলাম। লেখালেখি সামান্য করি কিন্তু আমি মূলত পাঠক। দেজ-এর কাউন্টারে গিয়ে আমার লিস্টি থেকে বইগুলো বলছি আর প্রদীপের দৈত্যর মত বইগুলো সামনে এনে ফেলছে একটা অল্পবয়সী ছেলে। যেন কতদিন ধরেই জানতো এই বইগুলো আমি চাইব। সে যা হোক কলেজ স্ট্রীটের একটা ব্যাপার হল, হরেক ধরণের পাঠক দেখা যায় এ চত্বরে। এক বৃদ্ধা মহিলা নজরুলের একটি বিশেষ গানের খোঁজে এসেছেন। নজরুলের গানের যত সঙ্কলনই দেখাক তিনি বলছেন না এতে ঐ গান নেই। তবু ক্লান্তি নেই দোকানের কর্মচারীদের। এক এক করে দেখাচ্ছে অন্য অন্য সঙ্কলন। আমি আমার বই কটার দাম দিয়ে ঝোলা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবার আমার প্রকাশকের সঙ্গে বসব আমার প্রকাশিত বইটার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
মার্কিন মুলুক থেকে কলকাতা ফিরলে থাকে একটা বাৎসরিক অনু্ষ্ঠান। তার নাম ভিসা স্ট্যাম্পিং। আমেরিকায় ঢোকার অনুমোদনপত্র নবীকরণ করতে হবে। তাই দেশে পৌঁছে সপ্তাহান্তটা বাড়িতে কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভিসা অভিযানে। আমাজন অভিযানের থেকে সেটা কিছু কম উত্তেজক ঘটনা নয়। পার্থক্য হচ্ছে আমাজন হল রেইন ফরেস্ট, আর মে মাসের কলকাতা হল বৃষ্টিহীন কংক্রিটের অরণ্য। প্রথম দিনেই বাসে ট্রামে যাওয়ার রোমহর্ষক কিম্বা স্বেদসিঞ্চক ঘটনা ঘটাতে রাজি হল না স্ত্রী। তাই বাড়ির গাড়ি এবং ড্রাইভার বাবুদা। বাবুদা গাড়ি চালানোটা শিখেছে ঠিকই কিন্তু কলকাতার মানচিত্রটা শেখেনি। আর মাপ করবেন পৃথিবীর কোন শহরেরই ম্যাপ আমি কোনদিনও আত্মস্থ করতে পারি নি। অতএব গুগল দেবতাকে স্মরণ করা হল। গন্তব্য হো-চি-মিন সরণী। ইউ এস কনসুলেট। বাবুদার অসাধারণ কলকাতাপ্রীতি হোক বা গুগলের নির্দেশ অমান্য করার ধৃষ্টতাই হোক, কোনো একটা কারণে মোটামুটি পার্কস্ট্রীট চত্বরের প্রায় প্রতিটা গলি থেকে বড় রাস্তায় চাকার ধুলো দিয়ে যখন কনসুলেটে পৌঁছলাম তখন অনেক বেলা। গিয়েই বুঝলাম ছড়িয়েছি। শুধুমাত্র ভিসা ইন্টারভিউ দেওয়ার থাকলেই এখানে আসতে হয়, আমি করতে এসেছি ভিসা রিনিউয়াল। সে কাজ হয় শেক্সপিয়ার সরণী থেকে। কনসুলেটের নিরাপত্তারক্ষী বুঝিয়ে দিল হো-চি-মিনের পদপ্রান্ত থেকে শেক্সপীয়ারের সান্নিধ্যে পৌঁছনোর রাস্তা। মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। বাবুদার ম্যাপজ্ঞানের অনুগ্রহে আর কলকাতার ওয়ান-ওয়ে রাস্তার নিগ্রহে এই দশ মিনিটের হাঁটাপথ তিরিশ মিনিটের গাড়িপথ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে মনে করে হাঁটাই মনস্থ করলাম। যমলোকে শুনেছি পাপীদের ফুটন্ত তেলের কড়াইতে নিক্ষেপ করা হয়। পাপকর্ম জীবনে কম করি নি ! তাই যমলোকে জীবন্ত মানুষের মত বোশেখি দাবদাহে দগ্ধ হতে হতে অতঃপর শেক্সপিয়ার সরণীর ভিসা অফিস।
এই কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে একটা ফলভারে বিনম্র আম গাছ এক টুকরো মরূদ্যানের মত আগলে রেখেছে জেসমিন টাওয়ার। ঢুকে পড়ে ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সাবমিট করতেই চমক। ছবিটা নাকি স্পেসিফিকেশান মত হয় নি আর তাছাড়া একটি ডকুমেন্ট লাগবে যা আমি নিয়ে আসিনি। মাথায় বজ্রাঘাত হলেও এর থেকে কম পাথর হতাম। এই গরমে অন্য একদিন জেসমিন টাওয়ারের চক্কর কাটতে হলেই চিত্তির। বাইরে অপেক্ষারত স্ত্রীরও গরম বাণী নসীব হবে। “ঠিকঠাক দেখে ডকুমেন্ট আনো নি” এইবিধ আক্রমণের আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে প্রতিরক্ষাস্বরূপ নিজের যুক্তি পেশ করি, “ওয়েবসাইটে ঠিক করে কিছু লেখা নেই”। কিন্তু চুপি চুপি বলে রাখি, ওয়েবসাইটে ঠিকই লেখা ছিল। আমি সব কিছু একটু ক্যাজুয়াল নিই বলেই আজ এই হাল। হালে পানি কিভাবে পাই, পা ছড়িয়ে বসে ভাবছি, এমন সময় নিরাপত্তারক্ষীর অম্লমধুর আবেদন, “এখানে ওইভাবে পা ছড়িয়ে বসবেন না”। তাই শুনে এক অচেনা প্রিয়দর্শিনীর মুখে এমন একটা অপ্রিয়দর্শন বাঁকা হাসি ফুটে উঠল তাতে স্বকীয় অভব্যতার প্রতি যথেষ্ট লজ্জিত বোধ করলেও গরমে মতিভ্রম হয়েছে মনে করে মনে মনে নিজেকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর ইন্টারনেটের খোঁজ। যদি মিসিং ডকুমেন্টটা পাওয়া যায় কোনভাবে। আমার মত মুর্গিদের জাঁতাকলে পেষবার ব্যাবস্থা সামনেই। অনেকেই ভিসা ফর্মের প্রিন্ট আউট নিয়ে আসে না বলে ঝোপ বুঝে কোপ মারার ব্যাবস্থা। ইন্টারনেট ক্যাফেতে ঢুকতেই এক মাড়োয়ারী ভদ্রলোক জানিয়ে দিল ভিসা ফর্মের প্রিন্ট নিতে পাঁচশ টাকা লাগবে। সবিনয়ে জানাই আমি সেই অপরাধে অপরাধী নই। অন্য ডকুমেন্ট প্রিন্টপ্রার্থী। দেড় মিনিটের ইন্টারনেট সার্ফিং আর প্রিন্ট করার মূল্য ধার্য করল দুশ টাকা। অন্যায্য। তবু তৃষ্ণার্তকে এক ফোঁটা জল দিলে যেমন সে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে আমিও করলাম। এইবার ভিসা স্পেসিফিকেশান অনুযায়ী ছবি তুললেই এ যাত্রা কাজ উদ্ধার হবে। সন্ধান পাওয়া গেল যে বি কে মার্কেট বলে এক জায়গায় একদম মার্কিনদের মনোমত ছবি তুলে দেবে কিন্তু হাঁটতে হবে বারো থেকে পনের মিনিট। “আরাম হারাম হ্যায়” – এই মন্ত্র জপ করতে করতে হাঁটতে লাগালাম। পথ হাঁটতে আমার খুব ভাল লাগে। জীবন থাকে। যাপন থাকে। সাহিত্যিকদের শুনেছি এক জোড়া অতিরিক্ত চোখ থাকে। আমি তেমন লেখিয়ে নই। তবু চোখ খুলে রাখতে চেষ্টা করি। চলুন আমার সাথে হাঁটুন। দেখি কেমন কলকাতা?
ওই তো একটা উভলিঙ্গ (unisex) সেলুন। বাইরের দেওয়ালে এক শ্বেতাঙ্গী, বিদেশিনী, সুন্দরীর মোহময়ী আমন্ত্রণ। ভারতীয় চোখ সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে শ্বেতাঙ্গী ও বিদেশিনীদের এখনো দু দশ নম্বর বেশি দিয়ে থাকে। আর দু পা হাঁটতেই প্রতিস্পর্ধী নগর সভ্যতার পাশাপাশি উপস্থিত কিছু হেরে যাওয়া মানুষ। ইটালিয়ান সেলুন – অর্থাৎ ইঁটের ওপর বসিয়ে নরসুন্দর ওরফে নাপিত চুল দাঁড়ি কাটছে। লেখা না থাকলেও এ সেলুন উভলিঙ্গ নয়, শুধু পুরুষ প্রাণীদের জন্য। আছে ফুটপাথে বসা লিট্টি বিক্রেতা। জীবনদায়ী ছাতুর সরবত কেবল মাত্র দশ টাকায়। না…খাওয়ার স্পর্ধা আমার নেই। আমি সুখী পান্থজন মাত্র। বিহারী ভোজনের পাশেই বিশুদ্ধ বাঙালি ভোজনেরও ব্যবস্থা। ভাত ডাল দু কুচি আলুভাজা আর মাছের ঝোল প্লেটে প্লেটে পরিবেশন হচ্ছে। একটা আনুবীক্ষণিক সাইজের পাতিলেবুও আছে। এই গরমে ওটাই অমৃতের চাঙ্গড়। মাছ কিন্তু ভাগাড়ের হয় না। শুধু জলেই তাদের প্রতিপত্তি। খাবার স্পর্ধা নেই তবু অনুসন্ধিৎসু মন দাম জিজ্ঞেস করে। মাত্র পনেরো টাকা।পাশেই পান বিড়ি সিগারেটের দোকান। ক্লাসিক ব্র্যান্ডের সাদা কাঠির দাম পনেরো এখন। দু মিনিটের ফুসফুস ফুটো করার বিলাস আর এক পেট ভাত একই দামে পাওয়া যাচ্ছে পাশাপাশি দোকানে। আজও কলকাতা তার হেরে যাওয়া সন্তানদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেয় নি। মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে ঠিকই কিন্তু কিছু বিজ্ঞাপন মুখে মিচকি হাসিও আনে কখনো সখনো। চোখে পড়ে গেল একটা বিজ্ঞাপন। “হার পানি কা বোতল বিসলারি নেহি” – জলসঙ্কটে পড়া এক উট অন্য সব জল দেখে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, শুধু বিসলারির বোতল পেলে তৃষ্ণা নিবারণ করছে। এই আর্বান ঊস্ট্রকে দেখে একটু হাসতেই হল। নিখাদ হিউমার। দু পয়েন্ট দিতেই হল বিসলারিকে। জল ভাবতেই দেখলাম রাস্তার ধারে এক গামলা জল রাখা। আর কাকেরা তেষ্টা মেটাচ্ছে। আমাদের মত লব্ধপ্রতিষ্ঠরা নয়, পাখিদের জন্য জল রেখে দেওয়ার এই সহৃদয়তা হয়তো ঐ মুচিটার যে ওখানে বসে ঘামতে ঘামতে জুতো সেলাই করছে কিম্বা ঐ জাঁতা হাতে ইঁটের ওপরে বসা লোকটার যার পেশা সুপুরি পেষা। আবার একটু এগোতেই সুতানুটি কাফের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আমন্ত্রণ। তিন সহোদর ভাই কলকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুর। সময়ের সাথে ভাই গোবিন্দ আর সুতানুটির থেকে সব জমি হড়পে নিয়েছে ছোটভাই কলকাতা। গোবিন্দপুর তো ধ্যারধেরে হয়ে অখ্যাত হয়েছে। সুতানুটির নামে কাফে তাই তার হারানো জমির জন্য বিচার প্রার্থনা করছে। হাঁটতে থাকি। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে ইলেকশান সিজন। পাশাপাশি ছবিতে সহাবস্থান দেশের প্রধানমন্ত্রী আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ভোটপিপাসু নমস্কার মুদ্রায়। হাসির বিষয় নাকি লজ্জার বিষয় জানিনা, কোনো মা-মাটি-মানুষ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি মুদিতা প্রদর্শন করতে প্রতিটা ছবিতে তাঁর চোখ দুটো গেলে দিয়ে গেছে। ঈশ্বর(চন্দ্র) যেখানে মুণ্ডুহীন, সেখানে দেশের কর্ণধার চক্ষুহীন হবেন, আশ্চর্য নয়। সুপুরি কাটার দোকানের থেকে একটু এগোলেই চুনের একটা বড় গামলা। বিনামূল্যে। সুপুরির সাথে চুনের জন্মান্তরের আত্মীয়তা। হঠাৎ মনে পড়ল, কলকাতার সাথে চুনের সম্বন্ধও অঙ্গাঙ্গি। কলকাতার নাম নিয়ে অনেক মত প্রচলিত। একটি মতে কলকাতা এসেছে কলি-কাতা বা চুনের ভাটি শব্দ থেকে।
দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম বি কে মার্কেটে ছবি তোলার স্টুডিওতে। দাম আবার গলাকাটা। তিনশো টাকা এক এক জনের। বোঝা গেল অনেকেই ভিসা অফিস থেকে নাকচ হয়ে ভরাডুবি থেকে উদ্ধারে এই স্থানে আগমন করে থাকেন। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটির হাতটি ভাল। মুহুর্তের মধ্যে ফটোশপ করে ব্যাকগ্রাউন্ড করে ফেলল ধপধপে সাদা ঠিক যেমনটা মার্কিন কনসুলেট চেয়েছে, মুখের ওপর পড়া অবাধ্য চুলেদের কাঁচি করে দিল ম্যাজিকের মত। আমার স্ত্রী ছবি তুলতে ভীষণ ভালবাসেন। তিনি এমন এক রিফ্লেস্ক তৈরী করেছেন যে ক্যামেরা তাক করলেই বারোটা বাজতে পাঁচ কিম্বা বারোটা বেজে পাঁচের ভঙ্গিতে মাথাটা সাইডে হেলে যায়। মাথার বারোটা বাজানোর জন্য অর্থাৎ মাথাটিকে সিধে রাখতে ফটোগ্রাফের ছেলেটিকে বেশ বেগ পেতে হল। সেই নিয়ে একটু ঠাট্টা করছিলাম। কিন্তু যে হারে গরম বাড়ছে আর বাড়ছে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন, ব্যাস্তানুপাতিক ভাবে কমছে রসবোধ। তাই রসিকতাগুলো অপাত্রে গেল। ছেলেটির মুখে হাসির রেখাও দৃষ্ট হল না। সে যাই হোক, তার তোলা ছবি আর ইন্টারনেট কাফে থেকে পাওয়া ডকুমেন্ট বলে বলীয়ান হয়ে আবার ফিরে গিয়ে কাজটা উদ্ধার হয়ে গেল।
ভিসা স্ট্যাম্পিং-এর জন্য পাসপোর্ট জমা করে যেই বেরোলাম, ব্যাস বেজে গেল ছুটির ঘন্টা। ভিক্টোরিয়ার পরীর ডানা দুটো ধার করে কপোত কপোতী উড়ে চলল দক্ষিণ দিশায়। দক্ষিণাপন। শপিং টাইম। সেখানে বিশ্বের সমস্ত অদরকারি জিনিসের সম্ভার। কিন্তু বানিয়েছে বাংলার শিল্পীরা। প্রতিশ্রুতি সমস্ত লাভের গুড় নাকি তাদের ভাগেই যায়। সত্যতা জানা নেই। পথে পড়লো গড়িয়াহাট ব্রিজের নিছে চেস ক্লাব। কদিন আগেই তার উপরে প্রতিভাষণ শুনছিলাম একটা। সূর্যের প্রবল দাপটকে প্রতিহত করছে ব্রিজ আর তারই ছায়ায় গুটি সাজাচ্ছে মহারথী দাবাড়ুরা যাতে অন্যের রাজাকে প্যাঁচে ফেলতে পারে। আর দেখলাম ট্রাফিক পুলিশের বিজ্ঞাপন। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পেরোচ্ছেন প্রসেনজিত, জীৎ, দেব। বিজ্ঞাপন বলছে, “এনারা জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পেরোতে পারলে আপনারাও পারবেন।” বেশ সৃজনশীল। তবে একটাই খটকা লাগল। শুধু বাংলা সিনে জগতের লোকেরাই তবে কি এখন আইকন? সিনেমার কুশীলবদেরই শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবী আখ্যা দিয়ে যবে থেকে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তবে থেকেই কি বাংলা বৌদ্ধিক দারিদ্রে ভুগছে? কোনো লেখক কি বিজ্ঞানী কি স্পোর্টস ফিগার কি অর্থনীতিবিদ নেই এ লিস্টিতে! যাকগে। সিগনাল মেনে রাস্তা পেরোবার আর একটা বিজ্ঞাপন বলছে, “এক মিনিটের একটু থামা। আর একটু বেশি হলে ক্ষতি কি?” বেশ মজাদার।
আর দেখলাম কৃষ্ণচুড়া গাছ। ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে। তার রক্তিম গুমোরে সূর্যও খানিকটা ভীত, সঙ্কুচিত। ও কৃষ্ণচুড়া তুমি অজুত নিযুত অর্বুদ কোটি পুষ্প বৃষ্টি করো এ ক্লান্ত, অবসন্ন শহরের বুকে। ঘৃণাকে ঘৃণা করে ফুলেল প্যারেড হোক রাজপথে। পুষ্পহন্তাদের বিরুদ্ধে গড়ে তোল বলিষ্ঠ জনমত। ছায়াহীন এই পৃথিবীকে ছায়াচ্ছন্ন করতে তুমিই পারো। কৃষ্ণচুড়া, শুধু তুমিই পারো এ শহরকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে এক অসূয়াহীন পৃথিবী গড়তে।
বচ্ছরভরকার মত দেশে ফিরলে তড়িঘড়ি স্টুডিওতে ছুটতে হয় প্রায় প্রতিবারই। না না টলিউড পাড়ার নয়, আমাদের পাড়ার শিপ্রা স্টুডিও। উদ্দেশ্য নিজের ছবি তোলা। নিজের মুখের প্রতি কোন বিশুদ্ধ প্রেমজনিত কারণে নয়, তার জন্য তো সেলফি ক্যামেরাই আছে (হৈ হৈ করে সেলফি কনটেস্ট হচ্ছে এন্তার), বিভিন্ন জায়গায় প্রমাণপত্র দাখিলে, ভিসা স্ট্যাম্পিং নামক বাৎসরিক উৎসব ইত্যাদি সবেতেই প্রয়োজন পড়ে আমার মুখচ্ছবি। বেরোতেই পলিটিকাল পোস্টার – “মিলে মিশে লুটে খায় বুঝে গেছে জনতা / ও পাড়ার মোদী আর এ পাড়ার মমতা”। বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না কোন পার্টি। অজস্র “এই চিহ্নে ভোট দিন”-এর ভিড়ে এমন চমৎকার পোয়েট্রিকে দু নম্বর দিতেই হয়। কাস্তের ধার না থাকলেও কথার ধার আছে বইকি।
শিপ্রা স্টুডিওর দাদা বহু পুরনো যাকে সেই স্কুল জীবন থেকে দেখে আসছি। কখনো নামটা জানা হয় নি। তবু কুশল বিনিময় হয় দেখা হলেই। প্রথাগত “কবে এলে?” প্রশ্নের উত্তর করে ভেতরে যখন ঢুকলাম সেই চেনা ছবি। একটা সাদা কাপড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা বেঞ্চি। ওইখানে সাবজেক্ট বসবে। আর তার দিকে তাক করা আছে দৈত্যাকৃতি তিনটে লাইট। কখনো কখনো কোন একটা দৃশ্য কি কোন এক গন্ধ টাইমমেশিনে করে ফিরিয়ে নিয়ে যায় গত জন্মে। প্রাচীন সুগন্ধী অতীতে।
তখন আমার বয়স পাঁচ। আর সেদিন আমার জন্মদিন। যেন কোন অনন্ত অতীত। সময়ের রেখাগুলো সমান্তরাল হয়ে গেছে তাই। ছোঁয়া যায় না শুধু দেখা যায়। আমি তখন খড়গপুর। আমি তখন কিশলয়। জন্মদিন তখন এক অদ্ভুত আনন্দ-মৌতাত বয়ে আনত। আজ যখন জন্মদিন আসে সে সাথে করে নিয়ে আসে কি একটা হারিয়ে ফেলার একটা যন্ত্রণা – নিজের ছেলেবেলাই হবে বোধ হয়। আমার কিশলয়-আমিকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা প্রতি মুহূর্তে আমাদের জীর্ণ করতে থাকে। কিন্তু বয়স যখন পাঁচ, জন্মদিন মানেই এক অবিমিশ্র আনন্দ। বিশেষ দিনটিতে নো বকাবকি। নো পড়াশুনো। মায়ের হাতের পায়েস আর “আমি ভীষণ মহার্ঘ্য” এইধরনের একটা অনুভূতি দিনভর। আমার জন্য মা মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছে। আমার জন্য পায়েস রাঁধছে। মহাকালের গর্ভ থেকে একখানা দিন শুধু আমার জন্যই কাস্টম-মেড করে বানানো হয়েছে। শুধু আমারই জন্য আজ সূর্য উঠেছে, দোয়েল পাখি ডেকেছে, জানালার পাশের শিউলি গাছ ফুল ঝরিয়েছে। রাতভর। আমার জন্য কৃষ্ণচূড়া গাছ রঙ-মাতাল। ভাবতে ভালো লাগত।
এখনকার মত কেক কেটে লোক খাইয়ে ঘটা করে পাঁচ বছরের জন্মদিন পালন করার রীতি তখন ছিল না। সভ্যতা তখনও কিছু শম্বুক-শ্লথ, সম্মোহিত। সেই বয়সে আমি কিছু ঠিক করতাম না। বাড়ি থেকে বোধ হয় ঠিক করা হয়েছিল আমার আমার পঞ্চম বর্ষ পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে আমার ছবি তোলা হবে। সময়, হা সময়। প্রতি মুহূর্তে যে পিছলে গলে বেরিয়ে যায় এক মুঠো জলের মত, সেই সময়কে স্থাণু করে রাখার কি অদম্য মানবিক আগ্রহ! বাড়িতে ক্যামেরা ছিল না। তখন ক্যামেরা খুব একটা বিলাসদ্রব্য যা ধনীদের বাড়িতেই থাকত। আর সরস্বতী লক্ষ্মীর রেষারেষি খুব। যে বাড়িতে সরস্বতী সে বাড়িতে লক্ষ্মী পা রাখেন না। আমার মা স্কুলে পড়ায়। বাবা কলেজে। তাই ক্যামেরা কেনার সঙ্গতি ছিল না। স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা হবে ঠিক হল। আমাকে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হল। স্পেশ্যাল ট্রিটমেন্ট পেয়ে আমি সুপার এক্সাইটেড। দাদা আর আমি বাবার হাত ধরে গেলাম চিত্রালি স্টুডিও। ইন্দা মোড়ে। দুটো গোড়ের মালা। একটা দাদা, একটা আমি পরে বসলাম। স্টুডিওর কাকু ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মাথা দুটোকে ডানদিকে, বাঁ দিকে, ওপরে, নিচে, ঈশান, নৈঋত কোণে ঘোরালেন যতক্ষণ না মুখের সব হাসি অন্তর্হিত হয়ে মুখটা বেশ গোমড়া গোমড়া হয়। ইনস্ট্যান্ট নুডলের দিন নয় সেটা। ফিল্মে তোলা ছবিও ইনস্ট্যান্ট দেখা যায় না। ডার্করুমে ডেভেলপ হয়ে তবে তার দর্শন মিলবে। ফটোগ্রাফার নিজেও দেখতে পাবে না। আজকের চোখ দিয়ে দেখলে প্রায় অসম্ভব মনে হয়। খড়গপুরের চিত্রালি স্টুডিওর কাকু সময়ের হাত ধরে আজ রামরাজাতলার শিপ্রা স্টুডিওর দাদা হয়ে গেছে। তবে মুখ ক্রমাগত ওপর নীচ করতে বলে হাসি মারার টেকনিক এখনো আছে।
ছবি তুলে বেরোলাম যখন, দেখলাম আকাশ কালো করে এসেছে। জ্যোৎস্নাস্নাত টাঁড়ভূমির সঙ্গমরতা, কামোন্মত্তা যুবতী সম্বর হরিণীর চোখের কাজল কে যেন চুরি করে এনে মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দিয়েছে। আকাশময়। জ্বোরো রুগীর ঘন ঘন নিঃশ্বাসের মত হাওয়া চলছে। কালবৈশাখী। অত্যাচারী জমিদারের মত তেজীয়ান নিষ্ঠুর সূর্যটা কোন অপরূপ জাদুবলে ছাপোষা গৃহস্থ স্বামীর মত মুখ লুকিয়েছে মেঘের আঁচলে। উড়নচণ্ডী প্রেমিকার মত হাওয়া কোনপথে যাবে নিজেই ঠিক করতে পারে নি। একবার দু পা সামনে যাচ্ছে তো তারপর তিন পা পেছনে। চিতায় পুড়তে থাকা শব যেমন শেষকালে এক বালতি জল পেয়ে শীতল হয়, তেমন করেই শীতল হবে এ শহর। আজ। হাওয়ায় হাওয়ায় তারই কানাকানি। আমি হাঁটতে হাঁটতে দেখি রাশি রাশি হলুদ কল্কে ফুল ঝরে পড়েছে রাস্তায়। অনাদরে। কেউ দলিত, বিগলিত। কেউ অনাহত, ফুটফুটে। একখানা অক্ষত ফুল তুলে নিলাম। সানাই হল গে “ফুলোফিলিক”। না, এমন কোনো শব্দ অভিধানে নেই। শব্দটা আমার বানানো। মানে হল সানাই ফুল খুব ভালবাসে। ফুলটা পেলে যত্ন করে রাখবে ওর ইউনিকর্ন পার্সে।
কৌলীন্যহীন কল্কে ফুল। পাপড়ির বাহার নেই, তবু গাঢ় হলুদ রঙা। আমাদের সারা জীবনটাই তো রঙের খোঁজ। আহার-নিদ্রা-মৈথুন-ফেসবুক অন্তে ক্রমাগত আমরা জীবনে রঙের পোঁচ দেওয়ারই চেষ্টা করছি। কিন্তু ভ্যানিশিং কালারের মতই এই রঙ দিলাম আর এই ভ্যানিশ। সবে রঙের প্যালেট থেকে এ রঙ ও রঙ মিশিয়ে মনোমত উজ্জ্বল রঙ বানিয়ে কালার ব্রাশ দিয়ে এই মাখালাম জীবনের গায়ে তো প্রাত্যহিক দৈনন্দিনতার চাপে এই আবার বর্ণহীন। আবার খোঁজ, খোঁজ, রঙের খোঁজ। অথচ কত অজস্র রঙের উপাচার আমাদের আশেপাশে। আমরা দেখতে পাই না। সভ্যতা আমাদের বর্ণান্ধ করেছে। এই আপাত বেরঙ দুনিয়ার রঙ-মিলন্তি খেলায় আমি তুমি সবাই সামিল। এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে যখন বাড়ি ঢুকলাম তখন জলপরীরা ডানা মেলেছে। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে।
কেমন আছেন যযাতির বন্ধুরা? অনেকদিন দেখা নেই বলে ভাবছেন যযাতি বুড়ো পটল তুলেছে নাকি? পটল তুলিনি ঠিকই কিন্তু ভাবনার বীজ রুয়ে-বুনে-চাষ-করে ফসল ঘরে তুলতে সময় লাগে বই কি! দেড় বছর পরে প্রায় মাস দেড়েকের জন্য গেছিলাম আমার নিজের শহরে। প্রতি মুহূর্তেই তো আমাদের মনোমধ্যে অন্তর্বিপ্লব ঘটে যায় নিঃশব্দে। তাই সেই পুরনো শহর নতুন চোখে ধরা পড়ল। তাই কতক লিপিবদ্ধ করেছি।
আপনাদের জন্য তাই রইল এই কলকাতা ডায়েরী। পড়ুন। হয়তো দেখবেন এর অনেক মুহূর্ত আপনিও যাপন করেছেন। উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও উদ্দেশ তো আমাদের কম বেশি একই।
****
May 18, 2019, Evening
গতকাল ভোর রাত্রেই এসে পৌঁছেছি আমার শহরে। কুসুম কোমল লাজুক সূর্যটার ঠোঁটে লেখা ছিল, “স্বাগতম”। কেউ দেখতে পায়নি। আমি পেয়েছি। বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কাঠবিড়ালি আনন্দরা। স্নেহের সুসিক্ত আবেশে ভারি হয়েছিল বাতাস। অনেককটা প্রত্যাশী মুখে ফুটে উঠেছিল হাসি। প্রিয়জন মিলনের এক অমোঘ আগ্রহ তাড়া করে ফেরে আমাদের। প্রত্যহ।
আমার তিন বছরের ডানা লোকানো ছোট্ট পরীর হাসিতে-কান্নায়-অভিমানে-দুঃখে-আনন্দে-উৎসাহে-বিড়ম্বনায় মর্মর, বিহ্বল তার দুই দিদি, মানে আমার দুই প্রিয় ভাইঝি। কাকা-কাম্মা-সানাইয়ের আসার অপেক্ষা করছিল তারা ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে। চিটেগুড়ে লেগে থাকা লোভাতুর পিঁপড়ের মত পান করি স্বজন সুখ। সারাদিন। দিনভর। বুদ্ধপূর্ণিমা কাল। চতুর্দশী চাঁদ তাই সন্ধেবেলা যৌবন বিলোচ্ছে অকৃপণ। ভোলানাথ আশ্রমে একবার যেতে হবে। বাবা বলে গেছে। আমিও বেরিয়ে পড়ি। মা বলেছিল টোটো করে নিতে। আমি ভাবলাম, হাঁটিনা খানিক। এ শহর তো রোজ রোজ আসে না আমার কাছে। গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহে হাহুতাশ করতে থাকা আমার শহর। বাস-বাইক-কার-টোটো উদ্গত ধূলিধূসরিত আমার শহর। ক্যান্সারকোষের মত দ্রুত বাড়তে থাকা উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির চাপে নিঃসঙ্গ হতে থাকা আমার শহর। তবু আজ কোকিল শুনেছি ভোররাতে। কে বলে – “কোকিল শুধু বসন্তের, উহারা শীত গ্রীষ্মের কেহ নহে”। আজকে বৈশাখী ভোরেও কোকিলের কণ্ঠ চালিয়েছে সঙ্গিনীর খোঁজ। এখন সন্ধেবেলা শব্দহীন ধোঁয়াহীন টোটোরা সর্বত্রগামী। আমি লুব্ধ দৃষ্টি হানি। কিন্তু না এগারো নম্বর বাস অর্থাৎ হাঁটাই শ্রেয়। শহরের গল্পরা তো অনাদরে পড়ে থাকে হাঁটা রাস্তায়। সঙ্গিনীকে চিনতে যেমন মধুচন্দ্রিমার রাত্রিনিবাস, শহরকে চিনতে তেমন তার হাঁটা রাস্তা। আমি হাঁটতে থাকি। আমি দেখতে থাকি। শুষে নিতে থাকি আমার অতীতকে। চেখে দেখি পরিবর্তন। বর্তমানকে। বুড়ো শিবমন্দিরের পাশ দিয়ে যাই। মন্দিরের চাতালে তিনটে বৃদ্ধ খালি গায়ে বসে। আগের বছরেও যেন ওরা ওখানেই ওরকম করে বসেছিল। ঠায়। নিশ্চুপ। অনন্তকাল ধরে ওরা ওখানে ওরকম করেই বসে আছে। আজ থেকে অর্বুদ কল্প পরেও ওরা ওরকম করেই ওখানে বসে থাকবে বাক্যহীন। আমি পাশ কাটিয়ে ডানদিকে চলি। গল্পেরা চলে সাথে সাথে। এইসব গল্পগাছা কুড়িয়ে বাড়িয়েই তো জীবন। দু চারটে চারপেয়ে জীব ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশহীন। শীর্ণ, মন্থর। দু একটি বসে। এই তাপপ্রবাহের সাথে যোঝবার শক্তি সংগ্রহ করছে ক্ষণিকের জন্য। চোখে ক্লান্ত বিষণ্ণতা। মাসখানেকের মধ্যে এ শহরে এসে পড়বে বর্ষার সজল সঘন উচ্ছ্বাস। ওদের চোখে সেই মৌসুমী সজীবতারই নিরবধি প্রতীক্ষা।
শর্টকাট নিতে বাঁদিকে বাঁকি। কিছুদূর যেতেই পথ রূদ্ধ। কিন্তু এখান দিয়ে তো রাস্তা ছিল! শ্যাওলাধরা মৈনাকদের বাড়ির পাশ দিয়ে সোজা বেরোনো যেত ক্যাঁচাল সঙ্ঘ ক্লাবের কাছে। ক্যাঁচাল সঙ্ঘের একটা ভালো নাম ছিল কিন্তু বড় বেশি ক্যাঁচাল করে এই উপাধি পেয়েছে তারা। সেই চেনা পথ এমন করে পথহারা হল কেমন করে? এক শূন্যদৃষ্টি লোক বসে বৈশাখী তাপে ভাজা ভাজা হচ্ছে। জিগেস করলাম – দাদা এখান দিয়ে হাওড়া হোমসের দিকে বেরোনো যেতো না? “কোথা থেকে এসেছ হে পথিকবর” টাইপ একটা দৃষ্টি হেনে বলল, “সে অনেকদিন বন্ধ। পার্ক হয়েছে। যান না। পার্কের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যান।” জন্মাবধি দেখে আসছি নামগোত্রহীন যে পুকুরটাকে, সেটাকেই বংশমর্যাদা দান করে তৈরী হয়েছে বাচ্চাদের পার্ক আর রামকৃষ্ণ উপাসনা মন্দির। ভারি মনোহর। তবে সেই কৌলীন্যবৃদ্ধির দায়ে পায়ে-হাঁটা পথ পড়েছে কাটা। আমার অতীত কি তবে একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে? মন্দাক্রান্তা চালে বয়ে চলে সময়। তার রথারূঢ় বিজয়গৌরবে কাটা পড়েছে কত কত রাজ্যপাট – নীলনদ, সিন্ধুনদের পার্শ্ববর্তী সভ্যতা। এ তো সামান্য হতভাগা পায়ে-হাঁটা পথ।
পরিবর্তিত ভূগোলের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে বড় রাস্তায় পড়ি। ডান দিকে আশ্রমের গলি। নির্বাচনের গরম নিঃশ্বাস বাতাসে। পাঁচিলে ছোটো ছোটো পতাকায় শোভা পাচ্ছে জোড়াফুল, পদ্ম, কাস্তে-হাতুড়ি। চিহ্নধারীরা যেখানে একে অপরকে বাক্যবাণে কুচিকুচি করছে, চিহ্নগুলো একে অপরের গায়ে ঢলে পড়েছে পরম বিশ্বাসে। ওদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ওরা ঘাতকের ভয়ে ভীত নয়। আশ্রমের মধ্যে একটা প্রাচীন আমগাছ অজস্র ডালপালা বিস্তার করে মাতৃস্নেহে ধারণ করছে পুরোনো বাড়িটাকে। ফলভারে ন্যুব্জ। দূরে একটা তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে। মাথা দোলাচ্ছে হা-হা-উষ্ণ বাতাসে।
দেখি আর ভাবি এখনো তো সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায় নি। এই তো আমার দেশ, আমার শহরতলি। এখনো তো প্রাণ জেগে আছে লালসাক্লিন্ন শরীরে। আজ সকালেই এক টোটোওলাকে খুচরো কুড়ি টাকা দিতে না পেরে দশ টাকার একটা নোট দেওয়াতে বলেছিল, “কোনো ব্যাপার না। পরে দেখা হলে বাকি দশ টাকা দিয়ে দেবেন।” তবু জোর করে দাঁড় করিয়ে খুচরো করে এনে দিলাম। কারণ জানি দেখা হবে না। যেমন করে দেখা হয় নি শিশুবয়সের প্রাণের বন্ধু বুবুনের সাথে আর কোনোদিন। দেখা হয় নি শিপ্রা এক্সপ্রেসে ইন্দোর যাওয়ার পথের বালিকা সহচরীর সাথে। এই ব্যস্তসমস্ত গতিবান সভ্যতায় কারু সাথে কারু আর দেখা হয় না। একই ছাদের তলায় থাকা দুজনের মধ্যেও অনেক সময় অনন্ত ছায়াপথ। তবু কোকিল ডাকে, তবু অকারণে হৃদয় খুলে ধরে কেউ আচম্বিতে। রাজনৈতিক রক্তপাত, ঘৃণা, হানাহানি থেকে দূরে এ আমার স্নেহসিঞ্চনে সুসিক্ত স্নেহার্দ্র স্বভূমি।
ইনি আমার এক প্রিয় বন্ধুর দিদিমা। বয়স নয় নয় করে তিরানব্বই! ছোটবেলা থেকেই মুদ্রিত অক্ষর থেকে রস আহরণ করার বদ অভ্যাস ওনার। এ বছর পত্রভারতী থেকে আমার “যযাতির ঝুলি – এক ডজন গপ্পো” নামে যে বইটি বেরিয়েছে সেটা উনি মন দিয়ে পড়েছেন মলাট থেকে মলাট এবং শুভেচ্ছা জানিয়েছেন লেখককে। ব্যাপারটা জেনে মনটা এক অদ্ভুত গর্বে ভরে গেল। কারণ দুটো। এক, আমার ছোটগল্পগুলো যে একজন নবতিপর বৃদ্ধার সাথেও যোগসূত্র স্থাপন করতে পারছে সেটা লেখক হিসেবে আমার জন্য ভীষণই একটা আনন্দের অনুভূতি। কারণ আমি মূলত কিশোরদের জন্য লিখেছিলাম গল্পগুলো।
আর দ্বিতীয় কারণ হল, ওনার যেহেতু সারা জীবনই বই পড়ার বদ অভ্যাস ছিল তাহলে একটু হিসেব করলেই দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ যখন দেহ রাখছেন তখন তিনি ষোড়শী। অতএব ওনার গল্পকবিতার ঝুলিতে আছে রবি, জীবনানন্দ, পরশুরাম, শিবরাম, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমর, সুভাষ, শঙ্খ, শক্তি, ত্রৈলোক্যনাথ। তারপরেও যে উনি আমার লেখা পড়েছেন এবং ভালোবেসেছেন সেটা আমার জন্য খানিকটা ভরসার কথা বই কি! যারা দেশে আছেন এবং বইয়ের এক কপি সংগ্রহ করতে চান ফ্লিপকার্টে গিয়ে “Jojatir Jhuli” নাম দিয়ে সার্চ করবেন। সারা বছরই অনলাইন (এবং কলেজস্ট্রীটের বইপাড়ায়) পাওয়া যাবে এমন ভরসা দিয়েছে আমায় আমার প্রকাশক পত্রভারতী।
এছাড়াও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন অনলাইন স্টোরে। যেখানে সস্তায় পাচ্ছেন সেখানেই কিনুন।
শিকাগোতেই দেখা হয়ে গেল সাহিত্যিক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে। সাউথ এশিয়ান লিটারেচার ফেস্টিভালের উদ্যোগে সানফ্রান্সিকো এসেছিলেন কবি। একটু আড্ডা গল্প করতে, একটু সাহিত্য আড্ডা দিতে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম শিকাগোতে। সাহিত্যিকের মনের আঙিনায় উঁকিঝুঁকি দেওয়ার জন্য তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনার দরকার হয় না, কারণ সাদা কাগজের পরিসরে তাঁর শব্দ দিয়ে করা আঁকিবুঁকি তার ভাবনা, চিন্তা জীবনদর্শনের সবচেয়ে সৎ ও প্রকট দলিল। কিন্তু সে চেনাটা সাহিত্যিক বিনায়ককে চেনা, কবি-ঔপন্যাসিক বিনায়ককে চেনা। কিন্তু সামনাসামনি আলাপচারিতা হওয়ায় ব্যক্তি বিনায়ককে চেনার সৌভাগ্য হল। লেখার পরিসরে যেমন তিনি একটু বিশিষ্ট, একটু স্বতন্ত্র, ব্যক্তিগত বিনায়কও তাই। ভাল লাগল এই দেখে যে সাহিত্যচর্চার মই বেয়ে শিখরে পৌঁছনোর তাগিদে তিনি তাঁর স্বকীয়তাটা ফেলে আসেন নি মইয়ের নিচের কোন ধাপে।
সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল তারকা বিনায়কদার সাথে গোটা দুই নিজস্বী তুলে এবং ফেসবুকে পোস্ট করে মুহূর্তগুলোকে ধরে রেখে দিতে পারতাম। তবে তাতে একসাথে কাটানো সেই সময়টুকুর ঠিক কতটা ধরে রাখতে পারতাম। ছবি মানুষের ঠিক কতটা ধরতে পারে? সেলফি তো শুধু সুখ ধরে অথবা সুখের অভিনয়। সত্যি কথাটা হল, একজন মানুষের যে ছবি ধরা যায় ক্যামেরাতে সে তার বহিরঙ্গের ছবি। যা কিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য তাই শুধু ধরা পড়ে সে ছবিতে। কিন্তু যা কিছু অনুভুতিগ্রাহ্য তা ধরার জন্য একটাই ক্যামেরা, সে ক্যামেরা ভাষার, সে ক্যামেরা শব্দের। তাই শব্দের ক্যামেরায় চিত্রিত করতে চাই মানুষটাকে। আনুষ্ঠানিক যে সাহিত্যবাসর আর সাক্ষাৎকার তার কথা অন্য একদিন হবে কারণ ওনার মাপের সাহিত্যিকের ইন্টারভিউ দেশ পত্রিকায় এবং অন্যান্য নানা পত্রিকায় ইতিপূর্বেই বেরিয়েছে এবং পরেও অনেক বেরোবে। কিন্তু যে ক্যাজুয়াল মোমেন্টসগুলো একসাথে কাটালাম সেই কথাগুলো লিখতে চাই। নিচের অনুচ্ছেদগুলোতে বিনায়কদার বলা কিছু কথা কোটেশানে লিখলেও অবশ্যই প্যারাফ্রেজ করেছি, কারণ সর্বক্ষণ কোন ভয়েস রেকর্ডার চালিয়ে রাখিনি আর স্মৃতি বড় প্রবঞ্চক। তাই ওনার বলা কোন কথার ভুল ব্যাখ্যা করলে বিনায়কদার কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
প্রথমেই যে ব্যাপারটা মন কাড়ে তা হল অনুজ সাহিত্যিক তৈরী করার ব্যাপারে ওনার নিখাদ আন্তরিকতা। বারে বারেই রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তির কথা উল্লেখ করছিলেন যার সারমর্ম হল – যেদিন আমি মহাপৃথিবীর অংশ হয়ে যাব সেদিন যদি জানি যে লোকে আমার লেখা ছাড়া আর কারো লেখা পড়ছে না, বা নতুন কিছু কেউ লিখছে না তবে সেটাই হবে আমার মহামৃত্যু। সেই হবে আমার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। সাহিত্য একটা ধারা, একটা বহতা নদীর মত। তাতে নতুন শাখানদীর জলসিঞ্চন না হলে সে নদীর জল একদিন শুকিয়ে যাবে। নিজের অমর হওয়ার তাগিদেই তাই আমায় এই ধারা পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের হাতে দিয়ে যেতে হবে। তবেই একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যানুরাগীতে উত্তরণ। আর সাহিত্যিক হওয়ার প্রথম ধাপ নয়, বোধ হয় শেষ ধাপ হল সাহিত্যানুরাগী হওয়া। “শব্দশিল্পকে ভালবাসি বলেই অনুপ্রেরণা দেব সব নতুন লেখকদের।” – এই কথা বলছিলেন। কবি বিনায়ক একান্ত আলাপচারিতায় হাতে ধরে দেখিয়ে দিলেন ছন্দের রীতিনীতি নিয়মগুলোকে। কখনো জীবনানন্দ, কখনো রবীন্দ্রনাথ থেকে কোট করে দেখিয়ে দিলেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার। সবটুকুকেই যে মনে রাখতে পেরেছি তা নয়, কিন্তু যেটা হয় সেটার নাম দীক্ষা। ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনে বলা হয় দীক্ষা ছাড়া ঈশ্বরলাভ হয় না, আবার দীক্ষা নিলেই ঈশ্বরলাভ হয় না। দীক্ষামন্ত্রতে অধ্যাত্মজীবনের শুরু। আর তারপর থাকে সাধনা। সেরকমই ছন্দের জগতে দীক্ষা নিলেই একজন সার্থক ছন্দকার হবেন তা নয়, তার জন্য দরকার নিষ্ঠা। কিন্তু ছন্দটাকে প্রাথমিক ভাবে না জানলে তো শুরুটা করা যায় না। তাই না? বলছিলেন “অনেকে ছন্দ জিনিসটা আদৌ না শিখে বলছে পোয়েটিক লিবার্টি নিচ্ছি। আরে বাবা বাঁধনটা কি না জানলে সেটার থেকে মুক্তি নেওয়া যাবে কিভাবে?” কথাটা ঠিকই – কাব্যিক স্বাধীনতা যেন কাব্যিক অক্ষমতা গোপনের অজুহাত না হয়।
আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ বললেন “শিল্পীরা সাধারণত খুব নিষ্ঠুর হয় জানো। কেন জানো? কারণ ধরো একজন শব্দশিল্পী বা সাহিত্যিক। মানুষের মধ্যে যে সহজাত আবেগ আছে সেটা কোন পাত্র বা পাত্রীতে সমর্পণ না করে সাহিত্যিকরা সেই আবেগের সম্পূর্ণটুকুই কাগজে সমর্পণ করে। একজন চিত্রশিল্পী তাঁর আবেগ সমর্পণ করে ক্যানভাসে। কাগজের পরিসরে নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়ে শিল্পী কপর্দকশূন্য হয় হৃদয়ের আঙিনায়। তাঁর সৃষ্টিই পৃথিবীকে তাঁর একমাত্র দেয়। ঘনীভূত আবেগ থেকেই তো শিল্পের সৃষ্টি। আর সে আবেগ শব্দের আকরে, শিল্পের আকরে জমা পড়লে তবেই সে শিল্প কালোত্তীর্ণ হয়। লেখকের সবটুকু নিংড়ে নিয়ে জারিত শব্দমালা যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন লেখকের ঘনিষ্ঠজনদের ওই লেখাটুকু ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার থাকে না।” কথাটা খুবই ইন্টারেস্টিং। তাই না? মধুসূদন দত্ত থেকে রবীন্দ্রনাথ অনেকের মধ্যেই আমরা আপনজনের প্রতি কিছুটা অবিবেচনা দেখতে পাই। এই অবিবেচনা দেখতে পাই ভিনসেন্ট ভ্যান গগের মত কালজয়ী চিত্রশিল্পীর মধ্যেও। স্পষ্টত বুঝতে পারি মানুষগুলো নিজের সাথেই শুধু ঘর করে। সম্পূর্ণ একা, নির্বান্ধব। তার কারণটা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিলেন বিনায়কদা।
বলছিলেন “সৃষ্টিশীল মানুষেরা সৃষ্টি করে কেন জানো? যে লেখে, যে ছবি আঁকে, যে সুর দেয়, কেন দেয়? মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। মৃত্যু মানে তো বিলুপ্তি, বিস্মরণ। আমার শরীরটা যতটা আমি তার থেকে অনেকটা বেশি আমি হল আমার এই নামটা। উত্তর প্রজন্মের কাছে নিজের বিশিষ্টতা, নিজের ডি এন এ, নিজের পদবী পৌঁছে দেওয়ার জন্যই যেমন মানুষের যৌন ইচ্ছা জাগে, সেরকমই শরীরের মৃত্যুর পর নামটুকুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই সমস্ত সৃজনশীলতা। পাঠকের বইয়ের তাকে কতদিন বাঁচল সেটার নিরিখেই একজন লেখকের চরম নির্দয় বিচার হয়। সেটা বাদ দিলে ফেসবুকে কটা লাইক হল, আনন্দ পুরস্কার হল না অ্যাকাডেমি সেটা তো একটা সন্ধ্যার ব্যাপার। আনন্দ পুরস্কারের মঞ্চটা এক সন্ধ্যার ব্যাপার, পাঠকের হৃদয়ের সিংহাসন চিরকালীন। বলছিলেন উনি নিযুত পাঠক নয়, নিবিড় পাঠক চান – “অযুত লক্ষ নিযুত পাঠক যেদিন আমার লেখা ভালবাসবে সেদিন বুঝব ফেলনা লেখা শুরু করেছি। সস্তা গিমিক শুরু করেছি।” আজকে তো ফেসবুকে লেখা পোস্ট করে আর একশ-দুশ লাইক পেয়ে যে কোনো পুরুষ বা নারীই মনে করছে আমি লেখক। কিন্তু লেখার প্রতি নিষ্ঠা প্রদর্শন করতে যে সাধনা দরকার সেটা নেই। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়রা লাইকের নামে যেটা দেয় সেটা তো তাঁদের মুগ্ধতা নয়, সেটা পরিচিত বন্ধু বা আত্মীয়টির প্রতি তাঁদের স্নেহ, প্রশ্রয়। সেটা লেখার মান বিচার কখনো নয়। অচেনা পাঠকের ভারবহনের ক্ষমতাতে হয় লেখার প্রকৃত মান বিচার। লেখার মধ্যে সত্যিকারের সততা থাকলে সে লেখা আপনিই কিছু কিছু মনে অনুরণন তুলবে সে পাঠক তোমায় চিনুক বা না চিনুক। যদি সাহিত্যিক হতে চাও পাঠকের কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটি সবসময় মাথায় রাখবে।” আনন্দবাজার শারদীয়া পত্রিকায় ওনার উপন্যাস “মন্ত্র” খুব জনপ্রিয় হয়েছে বলাতে বললেন – “মানুষ এখন আর বানিয়ে বানিয়ে লেখা গল্প আর চাইছে না। তারা লেখার মধ্যে জীবন চাইছে, জীবনের কথা চাইছে। তাই উপন্যাস লেখার সময় সেই উপন্যাসের সঙ্গে নিজের যাপন দরকার। লেখক মানসে উপন্যাসের ঘটনাক্রমের সত্যি সত্যি ঘটে যাওয়ার দরকার আছে। তবে সে উপন্যাস লোকে পড়বে।” লেখালেখির ক্ষেত্রে দিয়ে গেলেন কিছু দামী টিপস যার একটা মনে পড়ছে “একসাথে গল্প, উপন্যাস, কবিতা সব লেখার চেষ্টা করবে না। অন্তত প্রথম প্রথম। মাথাটাকে প্রতিটা ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে কাজ করাতে হয়। তাই গল্প, কবিতা বা উপন্যাস কোন একটা ফিল্ড ধরে তাকে দুটো বছর পুরো দাও।” শুনে মনে হল ঠিকই তো বলেছেন। ওরা প্রেমিকার মত। সবটুকু চায়। ফাঁকি দিয়েছ কি নিজেই ফাঁকে পড়বে। একসময়ে একটা প্রেমিকা রাখলেই যেমন সর্বতোভাবে মঙ্গল, তেমনি একইসঙ্গে কবিতা, গল্প, উপন্যাসের যেকোনো একটির প্রতি হতে হবে নিষ্ঠাবান। তবেই রসোত্তীর্ন লেখার জন্ম হবে।
বাংলা ভাষাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার জিহাদে সামিল হয়েছেন কবি। আইওয়া আন্তর্জাতিক সাহিত্য সমাবেশে এসে বার্ষিক পাঁচ হাজার ডলারের বাংলা বই কেনার সুপারিশ করে গেছেন। যেখানে পঞ্চাশ হাজার ডলারের কন্নড় বই কেনা হত সেখানে নাকি এক ডলারেরও বাংলা বই কেনা হত না। অন্যান্য ভাষার সৈনিকরা নিজের ভাষার প্রতি অনেক বেশি একনিষ্ঠ। বলছিলেন ভাষা সংস্কৃতির ব্যাপারটা অনেকটা ফুটবল খেলার মাঠের মত। তুমি যত জমি ছেড়ে দেবে অপর পক্ষ এসে তত জমি দখল করে নেবে। শক্তিগড়ে পিৎজার দোকান খুলে গেছে কিন্তু শক্তিগড় নিজের ল্যাংচা নিয়ে ইটালিতে পৌঁছতে পারে নি। ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা যত বাংলা বলা, বাংলা লেখা, বাংলায় ভাবা কমিয়ে দিচ্ছি ইংরেজি এসে দখল করে নিচ্ছে সেই ছেড়ে দেওয়া পরিসরটুকু। এইভাবে ছাড়তে থাকলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে একদিন। বাংলা গান, নাটক, সিনেমা সবই কিন্তু ভাষাকেন্দ্রিক। ভাষার ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গেলে একদিন হুড়ুমুড়িয়ে ভেঙে পড়বে আমাদের সংস্কৃতির অট্টালিকা যেটা নিয়ে আমাদের এত গর্ব। আমি কথায় কথায় ইংরেজি বলাতে দাদাতুল্য অগ্রজ সাহিত্যিকের মৃদু ভর্ৎসনা – “তুমি কথায় কথায় ইংরেজি বলো কেন? কই পিনাকী তো বলে না?” পিনাকী আমার বন্ধু যে এই প্রচেষ্টাটাতে সর্বতোভাবে আমার সাথে ছিল। আমি মাথা চুলকে জিভ বার করে বললাম “সরি।” সত্যিই তো একজন আমেরিকান কি ইংরেজ তো কথা বলতে বলতে, নিজের ভাব প্রকাশ করার জন্য হঠাত করে স্প্যানিশ কি বাংলা কি গুজরাটি বলে ফেলে না। নাকি সাত আট দশক আগে বিজিত জাতি ছিলাম বলে আজও মনে মনে দাসত্ব করছি? কথায় কথায় ইংরেজি বাক্য বলা, বাংলাতে লেখা একটা অনুচ্ছেদের জায়গায় ইংরেজিতে লেখা একটা প্যারাগ্রাফ পড়তে স্বচ্ছন্দ বোধ করা আত্মম্ভরিতা নয় লজ্জার বিষয় হওয়া উচিত।
সবচেয়ে ভালো লাগল সমসাময়িক বাংলা ভাষার একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক হয়েও নিজেকে তিনি তারকা মনে করেন না। আমার মনে আছে প্রথম যেদিন চ্যাটে কথা হয়েছিল আমি কথায় কথায় বলেছিলাম – আপনার কক্ষপথ, আপনার বৃত্ত আর আমার কক্ষপথ, আমার বৃত্ত ভীষণই পৃথক। উত্তর বলেছিলেন “আমার কক্ষপথও ভীষণ পরিচিত, বৃত্তও খুব চেনা”। হ্যাঁ ঠিকই বিনয় করার জন্য বিনয় করার একটা রেওয়াজ আজকালকার তারকাদের মধ্যে এসেছে। অনেকে বিনয়কে খুব কৌশলে ব্যাবহারও করছেন নিজের বিদগ্ধতা প্রমাণ করার জন্য। কথাই আছে “Out of proportion humility is actually arrogance”. তাই মুখের মুখোশটাকে চেনা যায় সহজেই। বিনায়কদাকে কাছ থেকে দেখে মনে হল ওনার ঐ কথাগুলো বিনয় দেখানোর জন্য বিনয় নয়। এসে থেকেই বলছেন আমার লেখা তো তোমরা শুনবেই, কিন্তু তোমাদের লেখা আমি শুনতে চাই। আজকালকার ছেলেরা কি লিখছে জানতে চাই। যেটুকু জেনেছি সেটুকু তোমাদের জানিয়ে যেতে চাই। আমার লেখা একটা কবিতা শুনে ছন্দের ভুলগুলো ধরিয়েও দিলেন। আমি নিজে খুব সামান্য কলম প্রয়াস করি তবু নিজেকে দিয়েই বুঝি লেখকরা একটু নার্সিসিজমে ভোগে অর্থাৎ নিজের প্রেমে নিজেই হাবুডুবু খায়। নিজের লেখা নিজেই পড়ে এবং অন্যকে শুনিয়ে মুগ্ধ হয়। আসলে লেখা তার সন্তান তো আর সন্তানের প্রতি অহেতুক মুগ্ধতা সব বাবামায়ের পক্ষেই স্বাভাবিক। তবু সেই মুগ্ধতা কাটিয়ে অন্যের লেখা শোনার আগ্রহটা ধরে রাখা, অন্য অনুজ সাহিত্যিককে গ্রুম করার চেষ্টা করা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
মুস্কিল হচ্ছে আরও অনেক কথাই মনে ভিড় করে আসছে। কিন্তু খুব বড় পোষ্ট পড়তে চায় না কেউ। তাই লেখার দৈর্ঘের প্রতি লক্ষ রেখে এবারে শেষ করব। প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্যমহলের টুকরোটাকরা মজাদার ঘটনা বলে হাসিখুশি মানুষটা জমিয়ে রাখলেন দুটো দিন। লৌকিকতার যে অদৃশ্য দেওয়াল দুটো মানুষকে আলাদা করে রাখে, নিজেই সেটি ভেঙে দিলেন নিজের ডাউন-টু-আর্থ পার্সোনালিটি দিয়ে। হাসিমস্করাতেও শ্লীলতা অশ্লীলতার সীমারেখাগুলো একটু একটু মুছে যাচ্ছিল। তারকার দূরত্ব নিয়ে কখনোই দূরে সরে থাকতে চান নি। মানুষটার মধ্যে ভণ্ডামি নেই, কোন দেখানো সফিস্টিকেশান নেই। নির্দ্বিধায় বলতে পারেন “কলকাতায় বড় হয়েছি। কাক ছাড়া কোন পাখি দেখিনি। কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখিনি। তাই নেচার বা প্রকৃতি আমার লেখায় আসে না। শহুরে সুখ, দুখ, যন্ত্রণা, বিষাদ বুঝতে পারি। গাছ, পাখি, ফুল, নদীর সাথে রিলেট করতে পারি না সেভাবে। কল্পনা কবি সাহিত্যিকদের একটা প্রধান হাতিয়ার কিন্তু কল্পনার সাহায্যে নিজের অভিজ্ঞতাটুকুর ওপর একটু আদর প্রলেপ দেওয়া যায় মাত্র, সম্পূর্ণ অপরিচিতের সাথে পরিচিত হওয়া যায় না।” নিজের এই সীমাবদ্ধতার কথা এত স্পষ্ট করে আর কেউ বলতে পারত কিনা জানি না। শুধু দু দিনের আলাপেই এক অলীক বন্ধনে জড়িয়ে দিয়ে নিজের বৃত্তে ফিরে গেলেন কবি-ঔপন্যাসিক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
[Binayak Bandyopadhyay who is one of the most promising faces of current Indian Vernacular poetry is also considered as the changing face of Bengali fiction. His writing is a subtle blend of Cosmic and mundane, world and locality. He has till date published 15 novels and as many poetry collections. Binayak has received quite a few awards for his work and has represented India in the Iowa International Writers program 2014. He lives in Kolkata and combines a career in writing and teaching]
অফিস ফেরতা ট্রেনসফরটুকু শেষ করে বাসে উঠে পড়েছিলাম। এই বাসেই শুধুমাত্র সাত মিনিটের সফরে পৌঁছে যাব বাড়ির দোরগোড়ায়। অক্টোবর মাসে শিকাগোতে সুযযিজেঠুর ডিউটি আওয়ারস নেহাতই কম। পাঁচটা বাজল কি বাজল না, আলো-টালো গুটিয়ে নিয়ে সে দিনের মত বিদায় নেওয়ার যোগাড়যন্ত্র করে। গুঁড়ি গুঁড়ি সন্ধ্যারা চুপিসাড়ে নেমে এসে ঘাসের ডগায় অপেক্ষা করছে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার। আলোর বিন্দুগুলো আর একটু তেজ হারালেই, আর একটু ম্রিয়মাণ হলেই তাদের জায়গাজমি দখল করে নেবে অন্ধকার কণারা। আমার তিন বছরের কন্যার আধো আধো গলা শোনার ইচ্ছায় তখন মনের মধ্যে কাঠবিড়ালির পিড়িক পিড়িক। বাস ছাড়ার একটু আগে বাসে আমার উল্টোদিকে এসে যে আসন গ্রহণ করল সে একটি মধ্যবয়স্কা মহিলা। দু এক সেকেন্ড দেখলেই বোঝা যায় মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। হতশ্রী শতছিন্ন কাপড়জামা। কিন্তু পরিপাটি করে পরেছে। চুপ করে বসে থাকার চেষ্টা করছে কিন্তু যেন পারছে না। মাঝে মাঝে কথা বলে উঠছে, মাঝে মাঝে উঠছে হেসে। পরমুহুর্তেই চুপ। যেন কোন এক অস্থির সবল শিশুস্বত্তা ক্রমাগতই বডি ফ্রেমের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে আর ছোটবেলা থেকে শেখা সামাজিক সংস্কারের দুর্বল স্বত্তা বারে বারে তাকে ঠেলে ভিতরে পাঠাচ্ছে। নিজের মধ্যেই যেন এক মাস্টারনি বলছে “না না এ শোভন নয়। সমাজোচিত নয়। অকারণে হাসলে, কথা বললে লোকে তোমায় পাগল বলবে।” কিন্তু পরমুহুর্তেই আবার যেন ভুলে যাচ্ছে। এই বিরুদ্ধ দুই স্বত্তার মধ্যে যেন লেগেছে শুম্ভ নিশুম্ভ যুদ্ধ।
এমন মানুষ দেখলে তাকে উপেক্ষা করাই দস্তুর। আমিও তাই করছিলাম। অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে রেখে না দেখার অভিনয়। কিন্তু আমাদের সকলের মধ্যেই একটা পাগল থাকে যে কিনা পাগল দেখার লোভ সামলাতে পারে না। তাই চোখ পড়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। হঠাৎ দেখি মহিলা আমার দিকে কিছু একটা বাড়িয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। মনে মনে শঙ্কিত হলাম। ভাবলাম “মনে হচ্ছে জ্বালাবে মহিলা।” একটু কান দিয়ে শুনে দেখলাম মহিলা আমাকে একটা ফ্রুটজুসের কাচের বোতল খুলে দিতে অনুরোধ করছে। বোতল ধরে থাকা হাতটা আমার দিকে বাড়ানো। যতদূর মনে হয় বাড়িতে তাকে এই জুসের বোতল খুলে দেওয়া হয়। আর ওই শিশুসুলভ মাথাতে আপন পরের বোধ তৈরী হয়নি আজও। তাই আমাকেই করে ফেলেছে বোতল খুলে দেওয়ার অনুরোধ। অনিচ্ছা স্বত্তেও বোতলটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কসরত করলাম। কাচের ওপর লোহার ঢাকনা শক্ত হয়ে লেগে আছে। অনেক চেষ্টাতেও একটুও ঘোরাতে না পেরে নিজের অক্ষমতা জানিয়ে ফেরত দিলাম কাচের কন্টেনারটা। কোন দ্বিতীয় বাক্য খরচ না করে মহিলা বোতলটা নিয়ে নিলো। আর তারপর আমি সবিস্ময়ে দেখলাম বোতলের গলার দিকটা এক হাতে ধরে অন্য হাত দিয়ে বোতলের পেছনে সজোরে তিন চার বার মারল যাতে ভিতরের রঙিন তরলটা সবেগে এসে ভেতর থেকে চাপ দেয় ঢাকনায়। আর তারপরেই বোতলটা আবার বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। হাতে নিয়ে ঢাকনাটা একটু ঘোরাতেই যখন খুলে এলো তখন লাজুক মুখে “আই ডিড নট নো দিস টেকনিক” বলে বোতলটা ফেরত দিতেই ধন্যবাদ জানিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জুস খেতে শুরু করল মহিলা।
সান্দ্র তরলের সজোরে ধাক্কায় বোতলের আর ঢাকনার সংযোগ আলগা করে দেওয়ার এই বুদ্ধি তো আমার মাথায় আসে নি। জীবনের এই যে পাঠ আমার জানা ছিল না, এই মানসিক প্রতিবন্ধী মহিলা জানল কি করে? আর যদি জানল, বোতলের ঢাকনা খোলার কৌশলটা ব্যাবহার করার পরেও ঢাকনাটা নিজে না খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল কোন অভিপ্রায়ে? বাস ভর্তি লোকের সামনে আমার অক্ষমতাটাকে একটু কম করে দেওয়ার জন্য কি? হয়তো বা। মহিলার অপরিণত মনে এত সূক্ষ্ম অনুভূতিরও কি তবে জায়গা আছে? অথচ এই যে আমি যে কিনা একটু আগেই নাক সিঁটকাচ্ছিল, কতক্ষণে এই পাগলিটার সামনাসামনি বসা থেকে মুক্তি পাবে সে কথা ভেবে, আমি তো সুস্থ সমাজের প্রতিনিধি। এমনকি আমাকে অনেকে প্রতিভাবানও বলে। তবে কি কোথাও সুস্থ মন আর অসুস্থ মনের যে লেবেল আমরা সাঁটিয়েছি সেটা উল্টো লাগানো হয়ে গেছে? অসহিষ্ণু, সমালোচনাপ্রিয় মনই বহুলদৃষ্ট বলে তাকেই সুস্থ স্বাভাবিক নাম দিয়েছি আর অনুভূতির উথালপাথাল বন্যায় ক্রমাগত ডুবতে থাকা, ভাসতে থাকা মনগুলোকে পাগল আখ্যা দিয়েছি?