বিকেলে প্রথমে টিপটিপিয়ে, পরে ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি পড়েছে। বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির মধ্যে এমন একটা সমাহিত প্রসন্নতা থাকে, এমন একটা বুনো নিবিড় গন্ধবহা সাহচর্য থাকে যে ঘরে বসে থাকতে মন চায় না। উপরন্তু আমার ছোট্ট সঙ্গিনী বিকেলে দ্বিপ্রাহরিক ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই “ইন্সি স্পাইডার” দেখতে যাওয়ার দাবী জানিয়ে রেখেছে সজল নয়নে। ইন্সি স্পাইডার দেখতে যাওয়ার মানে হল আউটডোরে যাওয়া আর কোন গুল্মজাতীয় গাছের ধারে মাকড়সা স্পট করা। হ্যাঁ মাকড়সার অষ্টপদী-জুলজুলে-পুঞ্জাক্ষী সৌন্দর্যের প্রতি তার আছে ভয়মিশ্রিত অপার মুগ্ধতা। এমনই মাকড়সা প্রেম যে তাদের দর্শনমাত্র স্পর্শনাকাঙ্খা হয় অর্থাৎ কিনা ধরতে চেষ্টা করে। তখন এই বলে বিরত করতে হয় যে বন্যেরা বনে সুন্দর, মাকড়সারা জালে। তাদের জালমুক্ত করার ইচ্ছেটা খুব একটা সমীচীন নয়। মানুষ নামক প্রাণীর মত বিষাক্ত না হলেও আত্মরক্ষার খাতিরে একটু আধটু বিষ উদ্গীরণ তারাও করে থাকে। সে যাই হোক, তাই বৃষ্টি থামতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম সেই ছোট্ট সঙ্গিনীর হাত ধরে। কুট্টিপারা হাত খানা ধরে প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে ঘুরতে ঘুরতে ভেজা বাতাস ফুসফুসে ভরে নিতে বেশ লাগে। হাতটা ধরে রাখা জরুরী হয় নয়তো পাখি কি প্রজাপতি দেখলে তাদের সাহচর্য পেতে সেইদিকে ধাবমান হওয়ার একটা বিপজ্জনক প্রবণতা দেখা যায় সেই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে। হাঁটতে হাঁটতে কোন বাঁক ঘুরতেই হঠাৎ যদি সবুজ শ্যামলিমার মধ্যে এসে পড়ি, উচ্ছ্বসিত সানাইয়ের গলায় খুশি ঝরে পড়ে – “প্রিটি”, “বিটিফুল” ইত্যাদি। সন্তানের চোখে খুশি দেখার থেকে বড় পুরস্কার বোধ হয় মানুষের কিছু হয় না। যাই হোক তার ক্ষুদ্র হাতের স্পর্শসুখ আর সদ্যস্নাতা আদ্র মায়াবী গোধূলির নৈকট্য উপভোগ করতে করতে আনমনে হাঁটছিলাম। হঠাৎ হাতে পড়ল টান। আমার ক্ষুদ্র সঙ্গিনী যে unpredictable সেটা জানতে বিশেষ অন্তর্দৃষ্টির দরকার হয় না। সে কেন থেমে পড়েছে, কোন বস্তু তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বুঝতে ওর চোখের দিকে চোখ চালাই। না প্রজাপতি বা পাখিরা নেই, মাকড়সাদেরও অষ্টবক্র উপস্থিতি নেই। আছে একটি ঘাসফুল, এদেশে একে বলে ড্যান্ডিলিয়ন। বসন্তের শুরুতে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটে ওঠে তখন রাস্তার ধারে ধারে তাদের অপরূপ শোভা। কিন্তু বড়ই ক্ষণজন্মা তারা। একবার বৃষ্টি পড়লেই পাপড়ি টাপড়ি খসে নেহাত দৈন্যদশা। ফুলেদের জাতবিচারে এরা অবিশ্যি নিতান্তই দলিত। সুযোগ পেলেই মানুষের পা বা ময়িং মেশিন তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বসন্ত শেষে এই গ্রীষ্মে তাদের সকলেই প্রায় বৃন্তচ্যুত হয়েছে। এখানে একটা ড্যান্ডিলিয়ন এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর আমার ক্ষুদ্র সঙ্গিনী বসে পড়ে ছোট আঙুল দিয়ে স্নেহ ছড়িয়ে দিচ্ছে তার ফুলেল গায়ে। তার চোখে এই ঘাসফুলের রূপটুকু ধরা পড়েছে দেখে খুশি হলাম। সাথে এলো একটা অবসাদ। জীবনের পথ চলার কোন বাঁকে ওকে এই রুপসন্ধানী চোখখানা ফেলে যেতে হবে। কিছুতেই আটকাতে পারব না। এই নিষ্ঠুর বস্তুতান্ত্রিক সমাজ ঠিক কেড়ে নেবে ঐ চোখদুটো। শ্যামলিমার থেকে শপিং মলের আহ্বান ক্রমে ক্রমেই বেশি মনোগ্রাহী হবে। সমাজ বিসদৃশতা পছন্দ করে না। সবাইকে নিজের রঙে রাঙিয়ে নিয়ে তবে তার শান্তি। তার মগজ ধোলাইয়ের প্রক্রিয়াটি নির্ভুল ও পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত। সানাই ঘাসফুলটাকে বৃন্তচ্যুত করতে চাইলে বাধা দিলাম না। কোন মদগর্বী বুটের তলায় যাওয়ার থেকে ওর হাতে ভাল মানাবে। কিন্তু পরক্ষণেই বায়না – তার এই ঘাসফুল সংগ্রহের কৃতিত্ব দূরভাষযোগে মাম্মাকে জানাতে হবে। একজন মহাপুরুষ, সঞ্জয় দত্তের জীবন সম্বন্ধে জানতে সিনেমাহলে গেছেন মাম্মা। কিন্তু সে যুক্তি ধোপে টিকল না। ফোনটা না করে দিলে চোখে সজল আর মুখে সরব আকুতি। দোনামনা করে ফোনের বোতাম ঘোরালাম। আধো আধো গলায় দু চারবার ফ্লাওয়ার বলে তবে দেবী ক্ষান্ত দিলেন। সঞ্জয়রুপী রনবীরের গলা ছাপিয়ে সে গলা ও প্রান্তে পৌঁছল কিনা বলতে পারব না।
Category: reminiscence
সুরপথ – রম্যরচনা
কাগজের নৌকো – রম্যরচনা
আহা রে মন আহা রে মন আহারে মন আহারে আহা।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি বউ বাড়ি নেই। দূরভাষযোগে জানা গেল মিশিগান হ্রদের সৈকতে হাওয়া খেতে গেছে। শীতের দেশে এই গরম কালের চারটে মাস সকলেরই ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। আমার এই শহরতলিতে তখন ফুরফুরে হাওয়ে বইছে। মিঠে। বাতাসে প্রথম প্রেমে পড়ার শিরশিরানি। কোএড কোচিং-এ পড়তে যাওয়ার আগে দশ-ক্লাস-অব্দি-বয়েজ-স্কুলে-পড়া মনের উথালপাতাল মনে। বাড়ির বাইরে মেঘের নরম তুলোট আদরে ঢেকে থাকা সুয্যিমামার লাজুক হাসি। মনের মধ্যে শবেবরাতের সন্ধে নামার খুশি। সবে এক কাপ চা বানিয়ে এমন গোধূলি লগনটাকে উপভোগ করতে বারান্দায় বেরিয়েছি, কাপের গরম সবুজ তরলে ঠোঁটের আলগা স্নেহ ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই ঝুপুস বৃষ্টি নামলো। সারাদিনের ফ্যা ফ্যা রোদ্দুরে বাড়ি-লাগোয়া কাঠফাটা কাঠের উঠোনে বৃষ্টিকণাদের লুটোপুটি আর হুল্লুড় শুরু বিনা নোটিশে। বড় বড় ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে মাটি। শুষে নিচ্ছে সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদ। মনে পড়ে যাচ্ছে ছেলেবেলা। সেই খড়গপুরের ছোট্ট কোয়ার্টার। যেখানে জায়গা ছিল কম। শান্তি ছিল বেশি। মনে পড়ে যাচ্ছে হু হু রোদ-পোড়া দিনের শেষে কালবৈশাখী। ফটাফট্ অঙ্ক খাতার পাতা ছিঁড়ে সেই আয়তাকৃতি প্যাপিরাস দিয়ে বানিয়ে ফেলা কাগজের নৌকো। যেন কোন পূর্বজন্মের কথা। ভাঙাফাটা সিমেন্টের উঠোনের পশ্চিম দিকটা দিয়ে অঝোরে বয়ে যাচ্ছে জল। তখন আমার কাঁচা বয়স। অপু মন। সেই ঝরঝরিয়ে বয়ে চলা হঠাৎ-নির্ঝরিণীতে ভাসিয়ে দিচ্ছি পাটিগণিতের নৌকো। কেশব চন্দ্র নাগ দুলতে দুলতে ভেসে যাচ্ছে ঐ দূরে। এই জলে ভরে উঠল আমার মাঝিবিহীন কাগজের নৌকোর সংক্ষিপ্ত পরিসর। সে বেচারা ওপরের আর নিচের জলের চাপে পানকৌড়ি-ডুব দিল জলের মাঝে। আবার আর একটা নৌকো ছাড়লাম। এলোমেলো হাওয়া বয়ে চলেছে হরিণ শিশুর মত। সেই হাওয়ার অবিমৃষ্যকারিতায় একবার জলের ছাঁট এদিক থেকে আসে, তো পরের বার আসে ওদিক থেকে। তারে শুকোতে দেওয়া ভিজে জামা কাপড় ভিজে জাব। দে টান দে টান। সাগরের ওপার থেকে ভেসে আসছে মায়ের গলা- “বাবাই ঢুকিয়ে আন জামাকাপড় গুলো। সব ভিজে গেল রে। ঘরের সব জানলা বন্ধ কর রে”। তড়িঘড়ি ব্যস্ততা। কিন্তু সে সব মায়ের কাজ। আমার তাতে মন নেই। আমি আমার নৌকোর ভয়েজ দেখতে ব্যস্ত। ওই শুরু হল শিল পড়া। এক ছুট্টে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কদম গাছের নিচে। ঘন গন্ধ নিয়ে কদম ফুল গুলো ঝরে ঝরে পড়বে। ঝরে পড়বে কৃষ্ণচূড়া কুঁড়ি। সেই পুষ্পবৃষ্টির মাঝে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কোঁচড় ভরে কুড়িয়ে আনতে হবে। সারা সন্ধে ধরে বাড়িতে বসে আলতো নখের আদরে ফুটিয়ে তুলব ফুলগুলোকে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসবে খিচুড়ি-ডিমভাজার সুবাস আর একটা মা-মা গন্ধ। ওই তো ঝরঝরিয়ে শিল পড়া শুরু। তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মত কুড়োচ্ছি আর মুখে পুরছি। সত্যি, বরফেরও ওরকম স্বাদ হয়? পৃথিবীর আর এক প্রান্তে মৌরুসিপাট্টা জমিয়ে বসেছি। কিন্তু এই সাঁইত্রিশ বছরে দেখা চোদ্দটা ফ্রিজের কোনটার বরফে অতো স্বাদ পাইনি। কচরমচর করে চেবাও। মুখে অনাবিল আনন্দের ঝিলিক। বাড়িতে ঢুকেই শঙ্কিত-মায়ের-কড়া-বকুনির-সম্ভাবনার তৃপ্তি লেগে থাকে মুখে। একটা বড়সড় গোছের শিল মাথায় ঠাঁই করে পড়লেই ফুলে চাঁই। ওই যে শিউলিদের আম গাছটা থেকে টুকটাক করে পড়তে আরম্ভ করেছে শিশু ফল গুলো। ওদের অকালপ্রয়াণে আমার বালক মন আনন্দে শিহরিত। ছুট ছুট ছুট। আমগাছটার তলায় এসে ফটাফট্ দক্ষ হাতে কাঁচা আম কুড়োনোর বর্ষাপিয়াসী প্রসন্নতা। বাড়িতে ঢুকেই বৃষ্টি-অর্জিত সেই অমূল্য সম্পদগুলোকে ছাল ছাড়িয়ে হাল্কা নুনে জারিয়ে আমাদের সেই ছোট্ট ফ্রিজে শীতল শয়ন দেওয়া। আগামিকাল স্কুল থেকে ফিরে তার অম্লরসে জিভের স্বাদকোরকগুলোকে বিয়ে-বাড়ির-ফুর্তি-আর-রোশনাই প্রেরণ। সেই ছোট্টবেলার আমার শহরের জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচুড়া রাধাচূড়ার মত এই দূর প্রবাসেও আমার প্রতিবেশী, আমার দোরগোড়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চিরসখা দুটো দেবদারু গাছ। এখানে আদর করে ওদের বলে ক্রিস্টমাস ট্রি। কিন্তু সেই নামে ডাকলে আমার বাঙালি শহরতলীয় পরাণে কি দেবদারু নামের রোমান্টিকতা আসে? হাত-পা ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে গাছ দুটো একমনে। যেন এই মুহুর্তে বৃষ্টিতে ভেজাই ওদের একমাত্র কর্তব্য। পাতায় জলসিঞ্চন করা ছাড়া আর কোনো কাজেই তাদের উৎসাহ নেই।
হুড়ুদ্দুম করে ছপ্পড় ফাড়কে চিলগতিতে মিনিট পনের ধরে নেমে আসার পরে মেঘেদের ফাটল ফুড়ুত করে বন্ধ। আর তৎক্ষণাৎ শুরু এ পাড়ার পাখিদের বর্ষামঙ্গল গীতি। গোধূলির ঈষৎ রক্তিম আলোয় আর আর্দ্র মলয় সমীরে শরীর জুড়িয়ে গলা ফেড়ে একে অপরকে ডাকাডাকি। ওদের অবোধ্য ভাষায় ওরাও কি কাগজের নৌকোর কথাই বলছে? ভাবতে গিয়ে হঠাৎ বুঝতে পারলাম ছোটবেলার সেই কাগজের নৌকো বানানোর ম্যাজিক পদ্ধতিটা এই সুদীর্ঘ পথচলার কোনো বাঁকে ফেলে এসেছি, বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছি। এমন একটা প্রবাসী ক্ষণস্থায়ী কালবৈশাখী আমার জন্য অপেক্ষায় আছে জানলে কি ভুলতে পারতাম? যাই হোক কোই পরোয়া নেহি। পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারের বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে গেছে। ইউটিউবে ঢুকে ওরিগামি বলে খোঁজ করলে কাগজের নৌকো বানানোটা কি আর একবার মনে করিয়ে দেবে না? হয়তো বা। এখানে বাড়ির উঠোনে জল জমে না। বৃষ্টি হলে উঠোন-বাগান খরস্রোতা নদী হয়ে ওঠে না। তাতে কি? নৌকোটা আজ না ভাসিয়ে যদি পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিই? যদি আমার ডানা লোকানো ছোট্ট পরী, আমার কন্যাকে উপহার দিই? নিশ্চয় ও ওর বড় বড় খুশির ঝিলিক-ওলা চোখ নিয়ে হাত পেতে নেবে আর মিনমিনে অশ্রুত-প্রায় আধোআধো গলায় বলবে “হ্যাঁ বোত”।
আহা রে মন আহা রে মন আহারে মন আহারে আহা।
[ছবির নৌকোটা কিন্তু আমার এই লেখার পরে ইউটিউব ঘেঁটে আজই বানানো]
খাওয়ানো – রম্যরচনা
স্ত্রী গেছেন জনৈকা সন্তানসম্ভবার সাধপূরণ করতে অর্থাৎ কিনা সাধ খেতে। আমার আড়াই বছরের কন্যার মধ্যাহ্নভোজনের দায়িত্ব পড়েছে আমার ঘাড়ে। আমার মেয়ের পছন্দের খাদ্যতালিকা সম্বন্ধে বলি। আমার স্থিরবিশ্বাস আমার মেয়ে পূর্বজন্মে সাধু সন্নিসী ছিল। স্বাত্তিক খাবারেই তার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ। স্বাত্তিক খাবার বলতে আমি যা বুঝি সেটা হল দুধ, ফলমূলাদি ইত্যাদি। রজোগুণী খাবার বলতে আমি বুঝি যে খাবার খেলে কাজ করবার শক্তি পাওয়া যায় যেমন ভাত, ডাল ইত্যাদি শর্করা জাতীয় খাবার। আর তমোগুণী খাবার মানে অবশ্যই প্রাণীজাত প্রোটিন অর্থাৎ মাংস – মুরগী অথবা মাটন। স্বাত্তিক খাবারে ওর আগ্রহ প্রবল। এক বাটি স্ট্রবেরী কি ব্লুবেরী, কলা হোক আপেল হোক চোখের নিমেষে সাবাড় করে দেবে। এক কাপ দুধ উড়িয়ে দেবে পলক ফেলার আগেই। রাজসিক খাবারে অর্থাৎ ভাত ডালে বিশেষ বিরক্তি আর চিকেন মাটনে যেটা আছে সেটা যারপরনাই ঘৃণা বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু শিশু বিশেষজ্ঞরা শুধু ওই তথাকথিত স্বাত্তিক খাবারে শরীরের সম্পুর্ণ পুষ্টি হয় বলে মনে করে না। তাই সকাল সন্ধে আমাদের ওই রাজসিক ও তামসিক খাবার খাওয়ানোর অ্যাডভেঞ্চারে নামতে হয়। অ্যাডভেঞ্চার কথাটা কেন ব্যাবহার করলাম সেটার জন্য একটু বিশদে যাওয়া প্রয়োজন। তো যা বলছিলাম লাঞ্চ করানোর দায়িত্ব আমার ওপরে আজ। তামসিক খাবারের রিস্ক না নিয়ে কম বিপজ্জনক রাজসিক খাবারেরই ব্যাবস্থা করে গেছে স্ত্রী। অর্থাৎ ভাত, মুসুরের ডাল, আলু সেদ্ধ। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি শাকসবজী স্বাত্তিক খাবারের মধ্যে পড়লেও তাতে ওর মোটেই আকর্ষণ নেই। তাই সবজি আজকের ওর মেনু থেকে বাদ। একটু স্বাত্তিক টাচ দেওয়ার জন্য ভাত ডাল আলুসেদ্ধর সাথে বেশ বড় চামচের এক চামচ ঘি চটকে মেখেছি। এর পরের ঘটনা নিম্নরূপ।
একটা বড় নিঃশ্বাস নিলাম। ইস্ট দেবতাকে একটু স্মরণ করে নিলাম। নিজেকে ভগবান বুদ্ধের মত প্রশান্ত চিত্ত করতে কল্পনা করলাম সবুজ কচি ঘাসে ভরা একটা মাঠে চলে গেছি। পাশ দিয়ে উপলখণ্ডের মধ্য দিয়ে ঝিরিঝিরি করে বয়ে চলেছে একটা নাম-না-জানা নদী। পাখিদের কুহুকাকলিতে মুখর পরিবেশ। প্রিয় কবিদের প্রিয় কবিতা স্মরণ করি। ইত্যাদি বিভিন্ন রকম মানসিক যোগাসন করে গলার স্বরের মধ্যে যথেষ্ট চিনি এবং উত্তেজনা ও উৎসাহ ভরে ডাকলাম “সানাই। এবার আমরা ভাতু খাব। ইয়েয়ে…ইয়ামি…” ভাতের থালা নিয়ে ওর দিকে এগোতেই আমার কৃত্রিম উৎসাহে জল ঢেলে উল্টোদিকে ছুটল। আমি যে ইয়ামি খাবার দিচ্ছি এমনটা আর মনে হয় না। আত্মবিশ্বাসে সামান্য একটু চিড়। ভাতের থালাটা টেবিলে নামিয়ে রেখে হাসি হাসি মুখ করে ঘরের মধ্যে খানিক ছোটাছুটি করে বেড়ালছানার মত প্রাণীটাকে বগলদাবা করে নিয়ে এসে বসলাম সোফায়। “নাহ, চাপ আছে। সোফিয়া চালিয়ে দিই। ওর প্রিয় রাজকুমারীর বিভিন্ন অভিযান দেখতে দেখতে নিশ্চয়ই খেয়ে নেবে।” সোফিয়ার মিষ্টি গলার স্বরে ওর মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল। গুড সাইন। এক চামচ ভাত-ডাল-আলুসেদ্ধ-ঘি মুখে চালান করে দিলাম। সোফিয়াকে দেখতে দেখতে বেশ উৎসাহের সঙ্গে মুখে নিলো গ্রাসটা। স্বস্তি। ওর মা ফালতুই বলে “মেয়েটা একদম খায় না।” এই তো বেশ খেয়ে নিচ্ছে। আসলে মায়েরা বাচ্চা হ্যান্ডল করতেই জানে না। আর মাত্র নটা মোটে চামচ। খাওয়াতে পারলেই পড়া শুরু করতে পারব সলমন রুশদির অর্ধসমাপ্ত উপন্যাসটা। মিনিট পাঁচেক পরে দ্বিতীয় চামচটা নিলাম। সানাইয়ের দিকে বাড়াতেই খুব উৎসাহের সঙ্গে মুখ খুলে দিল। যাক আজ চাপ দিচ্ছে না। ও হরি। মুখের মধ্যে প্রথম চামচের প্রায় অর্ধেকটা এখনও নিজগুণে বিরাজমান। শিশুদের এই একটা দৈব ক্ষমতা। আমাদের মুখের মধ্যে খাবার গেলেই স্যালিভা সিক্রেশান হয়, লালাক্ষরণ হয়। ওরা কোন এক ম্যাজিকাল পাওয়ার থেকে সেইটে বন্ধ করতে পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটাই গ্রাস মুখে নিয়ে বসে থাকতে পারে। শিশুদেরকে ভগবানের অংশ এমনি এমনি বলে না! যাকগে যাক আধ চামচ তো খেয়েছে। Think positive. Be positive. দ্বিতীয় চামচ খাবারটাকে কমিয়ে অর্ধেক চামচ করি। মুখে ভরে দিতেই মুখবিবর পুরো ভর্তি। গালগুলো ব্যাঙের মত ফুলে আছে। চিবোনোর কোন লক্ষণ দেখি না। সোফিয়া ততক্ষণে কিছু মৎস্যকন্যাকে নিজের বার্থডে পার্টিতে নেমন্তন্ন করে ফেলছে। সেইটেই চোখ দিয়ে গিলছে। খাবার গলাধঃকরণ করার তেমন কোন ইচ্ছে নেই। অগত্যা পরের সাত মিনিট সোফিয়ার কার্যকলাপ দেখি ওর সাথে। প্রসঙ্গত সোফিয়ার সব কটা এপিসোড একশ আট বার আমার সামনে প্লে হয়ে গেছে। প্রতিটা গল্প শুরু থেকে শেষ অব্দি জানি। এখন ডায়ালগগুলো পর্যন্ত মুখস্ত হতে শুরু করেছে। কিন্তু সানাইয়ের কোন ক্লান্তি নেই। মাঝে মাঝে ভাবি ওর মত ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা যদি আমার হত, প্রতিদিনই নতুন করে পৃথিবীটাকে দেখতে পারতাম, চোখে একই বিস্ময় নিয়ে উপভোগ করতে পারতাম সূর্যোদয় কি সূর্যাস্ত গুলোকে, কি ভালই না হত? স্মৃতি বড় বিস্ময়-প্রতিরোধক। সে যাক। আবার পাঁচ মিনিট পরে এক চামচ ভাত নিয়ে মুখ খুলতে বলতেই খুলে দেয় সে। এ ব্যাপারে ও বড় বাধ্য। একেবারেই ঝামেলা করে না। মুস্কিল হল এবারে শুধু দেখি মুখটা চার ভাগের তিন ভাগ ভর্তি। আগের গ্রাসের কিছুই প্রায় শেষ করে নি। “সানাই খেয়ে নাও, খেয়ে নাও। অল ডান করতে হবে। ফিনিশ করতে হবে। ফাস্ট” বলে আবার অপেক্ষা। না কোন কাজ হয় নি। মুখ নড়ে না। যথাযথ কারণেই গলার ওজন বাড়ে। “সানাইইইই। খাওওও”। ঠোঁট ফুলে ওঠে। কান্নার প্রস্তুতি। কিন্তু গালের পেশীগুলো তথৈবচ। নো নড়নচড়ন। গলা নামিয়ে “খেয়ে নাও সানাই। ওদিকে মিয়া সব খেয়ে নিলো”। মুখ চলে সামান্য। দু তিন সেকেন্ডের মত। তারপরেই মিয়ার সাথে প্রতিযোগিতা বুঝি ভুলে গেল। আবার বলি “সানাই পিকু সব খেয়ে নিলো।” – এ বারে মুখ আর চললই না। বোঝা যাচ্ছে মিয়া বা পিকুদের সাথে খাওয়ার স্পীডের ইঁদুর দৌড়ে সামিল ও হবে না। এসবের ঊর্ধে চলে গেছে। খাওয়ানো শুরু করার আগে মনের মধ্যে যে ঝিরি ঝিরি নদীটা বইয়েছিলাম এখন তার জলটা বেশ ঘোলা লাগছে। অপেক্ষা। অপেক্ষার থেকে ভাল বন্ধু আর কিছু নেই মনকে বোঝাই। আর খানিকক্ষণ পরে যখন দেখলাম দ্বিতীয় চামচ প্রায় শেষের মুখে, (মানে জিভের ওপর ভাতের একটা বেস আছেই, সে থাক…অত বেশী আশা করলে চলে না) তৃতীয় চামচটা চালান করে দিই মুখে। নেয় কিন্তু নতুন আসাইনমেন্টের ওপর কাজ শুরু করে না। এই লক্ষণ আমি বিলক্ষণ চিনি। আমাদের সরকারী অফিসের মত। ফাইল আসে কিন্তু প্রসেস হয় না। মিঠে কথায় আর কাজ হবে না মনে করে কিছু কাল্পনিক চরিত্রকে নিয়োগ করি। “পুলিশ, পুলিশ আছ তো? সানাই খাচ্ছে না। ও তোমরা আসছ? আচ্ছা দাঁড়াও। সানাই বোধ হয় খেয়ে নেবে” – ফোনে কাল্পনিক পুলিশের সাথে আমার কথোপকথন। ওর স্নায়ুশক্তির প্রশংসা করতেই হচ্ছে। পুলিশের নাম শুনে হৃৎকম্প তো দূরের কথা, মুখে চিন্তার রেশ মাত্র দেখা যায় না। যেই কে সেই ঢ্যাঁটা হয়ে বসে থাকে। “ওকে, তাহলে হাঁকার মাকে ডাকি? ডাকবো তো?” সেই খুদে লৌহস্নায়ু প্রাণীটিকে প্রশ্ন আমার। মুখ ভর্তি ভাত নিয়ে একটা দুর্বোধ্য শব্দ করে। অর্থ বোধ হয় ডাকতে মানা করছে। আজকাল হাঁকার মা-তে একটু কাজ হচ্ছে। কিন্তু সামান্যই। শীঘ্রই নতুন কোন চরিত্রকে আনতে হবে। গতকালই ও হাঁকার মা হয়ে আমায় ভয় দেখাচ্ছিল। অতএব হাঁকার মার ম্যাজিক প্রায় গেল বলে। তাও সামান্য ভয়ে তিনচারবার মুখ নাড়া আওয়াজ পাওয়া যায়। ক্রমে ধীর হয়ে আসে। আবার সানাই সোফিয়ার দেশে হারিয়ে যাচ্ছে। গোরু একটা! সেই মানসিক নদীর ঘোলা জলটা এখন নর্দমার জলের মত কর্দমাক্ত লাগে। পাখি নয়, শেয়ালের আর প্যাঁচার ডাক শুনতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে। নাহ। Calm down. Calm down. Peace. ওম মধু, ওম মধু, ওম মধু। মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ। মনে মনে শান্তি মন্ত্র আওড়াই। আমি বিশ্বশান্তির বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি। Peace noble টা আমার লাগল বলে – এইসব ভাবি। আবার বড় করে শ্বাস নিই। “সানাই সোফিয়া কি করছে? ও সোফিয়া ফ্লায়িং? উড়ছে?” উৎসাহের সাথে জিগ্যেস করি। বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে। মুখভর্তি খাবারের অলিগলি পথে একটা হ্যাঁ বলারও চেষ্টা করে। “গুড। খেয়ে নাও। খেয়ে নাও। নয়তো সোফিয়া রাগ করবে।” মাথা নাড়া বন্ধ। সাথে মুখ চালানো। বোঝাই যাচ্ছে সোফিয়ার প্রতি ওর কোন সহানুভুতি নেই। না থাকুক, বাবার ওপর তো থাকবে। “সানাই, বাবার খুব খিদে পেয়েছে। বাবা কাঁদছে।” একটু কুমীর কান্না কাঁদি। নাহ লাভ হচ্ছে না। বাবার ওপরেও বিশেষ সহানুভুতিশীল নয়। “সোফিয়া বন্ধ করে দেব কিন্তু।” হুমকি ছাড়ি। জোড়ে জোড়ে মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রদর্শন করে। কিন্তু কোন চুক্তিতে বা ডীলে আসে না। গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের আইডিয়াটা এদের কাছ থেকেই পেয়েছিল কি? কে জানে? ঘড়ির কাঁটা একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে গেছে। ওর মুখের বাঁধন অতিক্রম করে খাদ্যনালীতে খাবার না পৌঁছনর ফলে আমার ধৈর্যের বাঁধন ভাঙছে। মাত্র চার চামচ মত ঠুসতে পেরেছি বলা চলে। পঞ্চমটা নিজের মুখে ভরে দিই। যাক, ও খাওয়া আমি খাওয়া একই ব্যাপার। আফটার অল বাপ মেয়ে তো! ষষ্ঠটা ওর দিকে বাড়াতেই মুখ খুলে দেয়। তৃতীয় আর চতুর্থ চামচ এখনো সেখানে। হাউসফুল। মরিয়া হয়ে তাও ঠুসি। ব্যাস…আমার এই অসৎ কর্মের শাস্তি স্বরূপ গোটা আড়াই চামচ মত নীরবে উদ্গীরণ করে দেয়। সাড়ে চারটে গোল দিয়ে আড়াই খানা গোল খেয়ে আমার স্কোর এখন দুই। মানে দুই চামচ মত খাওয়াতে পেরেছি। সেই ছোটবেলায় বাঁদরের অঙ্ক কষেছিলাম – তেল লাগানো বাঁশে বাঁদর তিন মিটার ওঠে, পরে দু মিটার নামে। এই গল্পে তিন গ্রাস যায়, দু গ্রাস বেড়িয়ে আসে। হতাশা। নাহ সত্যিই খাওয়ানো চাপ ওকে। মনে মনে ওর মাকে সেলাম জানাই। প্রাণপণে চেঁচাই “সানাইইইই”। ব্যাস…ফল স্বরূপ কান্না। মিনিট তিনেক সোফিয়ার শব্দ ছাপিয়ে সেই চিল চিৎকার কর্ণবিবরে ঢোকে। আর বিশেষ আশা নেই। সমস্ত আশায় গ্যামাক্সিন। আত্মবিশ্বাসে তখন রিক্টার-স্কেল-এইটে -হয়ে-যাওয়া ভূমিকম্পের ফাটল। কান্না থামাতে গ্লাসে একটু জুস নিয়ে আসি। চোখের জল আর জুস দুটো মিশিয়ে জুলজুল চোখে চুকচুক করে খেয়ে নেয়। ফলের রসের স্বাত্তিক স্বাদ পেয়ে এবার ওর মেজাজ কিছুটা শরিফ। শান্ত চিত্তে চেষ্টা করে আরও চামচ দুয়েক খাইয়ে দিই। সানাইকে খাওয়াচ্ছি ভেবে দু এক চামচ নিজেকেও খাইয়ে দিই। প্লেটটা ফাঁকা হলে নিজেকেই একটা সান্ত্বনা দেওয়া যায় তাই। প্লেটটা প্রায় খালি হয়ে এসেছে। নতুন করে উৎসাহ দিই সানাইকে। “এই দেখ না, প্রায় শেষ হয়ে গেছে। আর এক চামচ। মুখ চালাও। অল ডান করতে হবে।” বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে। ভাবটা যেন ওরও পুরো ভাতটা মেরে মুচড়ে খেয়ে নেওয়ারই ইচ্ছে। সাধ আছে অথচ সাধনা নেই! আর এক-দু চামচ আরও মিনিট কুড়ির প্রচেষ্টায় ঢুকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের খাবার গুছোই। অনেক ধকল গেছে। চাট্টি এক্সট্রা ভাত নিয়ে নিই।
আধ ঘণ্টা পরে আমার খাওয়া হওয়ার পর, খাওয়ার পরবর্তী বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়ার কাজ করার পর, যখন ওকে মুখ ধোয়াতে নিয়ে যাই দেখি মুখের মধ্যে চামচ দেড়েক ভাত এখনো জড়ো করে রাখা আছে। কি আর করা? সেইটুকু বের করে ডাস্টবিনে ফেলে দিই। বিশেষ কিছু খাওয়াতে না পারার দোষিমন্যতা নিয়ে কটা স্ট্রবেরী অফার করি। পেট ভরে যাওয়ার দরুন যে কিনা একটু আগে একটুও ভাত খেতে পারছিল না, সেই খুদে বুদ্ধিমান দুহাতে দুটো করে স্ট্রবেরী ফটাফট মুখে চালান দিয়ে দেয়। আড়াই মিনিটে সাড়ে তিন খানা জাম্বো স্ট্রবেরী শেষ করার পরে ওর মুখে হাসি ফোটে। ওর বাবার মুখেও।
ফল – রম্যরচনা
[জানুয়ারী ২০, ২০১৮ -র স্মৃতিচারণ ]
পড়ার ব্যাপারে আমার একটা অসামান্য দক্ষতা আছে, একটা অবিশ্বাস্য নৈপুণ্য। এ কথা আমি বুক বাজিয়ে বলতে পারি। না না, পড়া মানে পড়াশুনোর কথা বা রীডিং স্কিলের কথা ভাববেন না। আমি যে পড়ার কথা বলছি সেটা মাটিতে পড়া। ইংরেজিতে যাকে বলে “ফল”। Fall বলতেই মনে পড়ল কোন এক গুরুতর ব্যক্তি বলেছিলেন “Don’t fall in love. Rise in love.” কিন্তু সে সব গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে আমরা এখন মাথা ঘামাব না। আমরা সকলেই সময়ে অসময়ে অল্প বিস্তর প্রেমে পড়ে থাকি। কোথায় কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসবে। তাই ওসব কথা থাক। আমি বলছিলাম ধপাস করে পড়ার কথা। হ্যাঁ এই বিষয়ে আমার বিস্তর জ্ঞানগম্যি, কিছু অনতিক্রম্য রেকর্ডও আছে। আমি জীবনে বহুবার পড়েছি। কখনো গাছের ডাল থেকে, কখন বাড়ির ছাদ থেকে, কখনো খাট থেকে, কখনো সিঁড়ি থেকে। কিন্তু সপাটে পড়ার ফলস্বরুপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাতে পায়ে প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে যে একটা গোদা মতন ভাস্কর্য শিল্প করা হয় সেটা কৌশলে এড়িয়ে গেছি। অর্থাৎ প্রভূত পরিমাণ পড়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও অঙ্গহানি হয়নি, হাত পা ভাঙে নি কখনো। যে নারী সূর্যের মুখ দেখেনি তাকে যদি অসূর্যম্পশ্যা বলা হয়, তাহলে আমার হাত-পা গুলোকে অ-প্লাস্টার-পশ্যা বলা যেতে পারে। নির্দয় পাঠক যদি এতক্ষণে নাক সিঁটকে বলছেন যে “তাহলে আপনি পড়ার মত করে পড়েন নি কখনো” – তাহলে ভুল ভাবছেন। কয়েকটা উদাহরণ দিই। পুরাণমতে বালখিল্য মুনিরা গাছে ঝুলে থাকত। তো তাই থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে কিনা কে জানে, বাল্যকালে আমি একটা বালখিল্যপনা প্রায়ই করে থাকতাম। একটা তেঁতুল গাছের টঙে চড়ে তার একটা ডালে জড়িয়ে থাকা একটা মোটাসোটা লতার ওপর বসে দোল খেতাম। লতাটা বার্ধক্যজনিত কারণে একটু দুর্বল হয়ে পড়লেও আমার অত্যাচার নীরবে সহ্য করত। উপায়ই বা কি? মানুষের মত চেঁচিয়ে নিজের অধিকার আদায় করতে আর কোন জীবই বা পারে। মুস্কিল হল একদিন দোল খেতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম। লতা (না না মঙ্গেস্কর নয়, তিনি দীর্ঘজীবি হন এই কামনা করি) দেহ রাখল। সঙ্গে সঙ্গে আমি নিউটনের আপেলের মত পুরো 9.8 m/s^2 ত্বরণের সাথে এসে মাটি ছুঁলাম তা প্রায় দোতলা বাড়ির মত উচ্চতা থেকে। জামাটামা ছিঁড়ে, পিঠে হাতে ছড়েটড়ে গিয়ে যাকে বলে আমার তখন একেবারে নববধুর মত রক্তিম অবস্থা। কিন্তু না অঙ্গহানি হয় নি। হাত পা কোমর ইত্যাদি ইন ট্যাক্ট। যেই কে সেই। অন্য একটা মনে পড়ছে। স্কুল কম্পাউন্ডে লুকোচুরি খেলা হচ্ছে। আমি চোর। বাকি বন্ধুরা বিভিন্ন অভুতপূর্ব জায়গায় লুকিয়ে অতর্কিতে ধাপ্পা দেওয়ার জন্য প্রহর গুনছে। একটা কমন জায়গা ছিল স্কুলের বাথরুমের ছাদ। না, সেখানে যাওয়ার জন্য সিঁড়িটিড়ি কিছু ছিল না। একটা পাঁচিল, তার এই পাশে বাথরুম, আর ঐ পাশে একটা পুকুর। ওই পাঁচিলে উঠে ছাদের থেকে দাঁত বের করে থাকা দুটো ইঁটকে ধরে ঝুলে পড়ে একটা পা কোন মতে বাথরুমের ছাদে রাখতে পারলেই হাঁটু আর দুই হাতের চাপে বাকি বডিটাকে ছাদে টেনে তুলে ফেলা যেত। হ্যাঁ এই ধরনের কাজকর্ম তো কুঁচোকাঁচারা করেই থাকে। না হলে তাদের যে অবশ্য কর্তব্য, বাবা মাদের চিন্তায় ফেলা, সেটা করতে কিভাবে সমর্থ হবে? এ তো গেল যারা লুকোচ্ছে তাদের কথা। যে চোর সে ওইভাবে ওপরে উঠতে গেলে অবধারিত ধাপ্পা হয়ে যাবে। যে লুকিয়েছে তার সেটাই strategic advantage। কার্গিলের যুদ্ধে পাক সেনাদের যেমন ছিল আর কি! তাই চোরকে ওই ইঁট দুটো ধরেই পাঁচিলের ওপর থেকে ছোট ছোট লাফ দিয়ে ছাদে কেউ লুকিয়ে আছে কিনা আর থাকলে সেটা কে বুঝতে হবে। ধাপ্পা হয়ে গিয়ে পুনরায় চোর জন্ম আর কেই বা চায়। তো সেবারে আমি চোর। তো ইঁট ধরে দিলাম ছোট্ট লাফ। কিন্তু ইঁট দুটো বহুল ব্যাবহারে বোধ হয় প্রায় খুলে এসেছিল। লাফের উর্ধগতি শেষ হয়ে যখন অধঃপতন শুরু হল দেখলাম ইঁট দুটো ছাদের কার্নিশ থেকে খুলে আমার সাথেই fall করছে বা আমাকে follow করছে বলা যেতে পারে। স্বভাবতই দু খানা আধলা ইঁট দু হাতে নিয়ে নামতে হবে এমনটা ভেবে লাফটা শুরু করিনি। হিসেবে গরমিল হয়ে পা দুটো পাঁচিলের ওপরে নেমে আর স্থির হল না। পাঁচিলের ওধারে পুকুরের দিকে তরতরিয়ে নেমে চলল। ফলাফল আমি পাঁচিলের ওপর উপুর হয়ে, পা পুকুরের দিকে আর মাথা স্কুল কম্পাউন্ডের বাথরুমের দিকে, হাতে দুটো আধলা ইঁট শক্ত করে ধরা। দুখানা ইঁটের সাথে এমনতর সহপতনে কোমর-টোমর অনেক সময়েই…বাট না। As usual, No অঙ্গহানি। এ ছাড়া আরও অনেক বাঁদরামির ফলে বিভিন্ন রকম “ফ্রী ফল”-এর সম্মুখিন হয়েছি। একটা বকুল গাছের ডাল ছিল বেশ স্থিতিস্থস্পক। ওটা ধরে ঝুলে পড়লে স্কুলের ছাদ থেকে বেশ তাড়াতাড়ি নেমে আসা যেত। নিচে নেমে ছেড়ে দিলেই ডালটা ব্যাক টু ছাদ। ছোটবেলায় সময়ের বড়ই অভাব ছিল। তাই ওই করে প্রায়ই কিছু সময়ের সাশ্রয় করতাম। সে পাজি ডালখানাও একদিন বিশ্বাসঘাতকতা করে ভেঙ্গে গিয়ে মাটিতে সজোরে ফেলেছিল। এ ছাড়া খাট থেকে পড়েছি। সিঁড়ি থেকে আকছার পড়েছি। সবক্ষেত্রেই হাত-পা-মাথা ইত্যাদি যে অঙ্গগুলো প্রায়ই কাজে লাগে সেগুলো ইন-ট্যাক্ট রেখেছি।
যাক গে যাক, প্রশ্ন হল পড়ার প্রসঙ্গ এল কেমনে? এই জন্য এল যে আজকে আবার পড়েছি। একেবারে যাকে বলে সজোরে, সপাটে। না, লুকোচুরি কি কুমিরডাঙা খেলতে গিয়ে কি গাছে উঠে দোল খেতে গিয়ে নয়, সে সুখের দিনগুলো বোধ হয় আর ফিরে আসবে না। লাগামহারা শৈশবের দিনগুলোকে আজীবনের মত দ্বীপান্তরে পাঠিয়েছি সে বহুকাল হল। এখন শুধু কর্তব্যেস্মিন কুরু। সকাল সকাল রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে অদৃশ্য কর্পোরেট মুখোশ পড়ে বেরিয়ে পড়লাম অফিসের পথে। বাড়ি থেকে বড় রাস্তা মোটে দু তিন মিনিট। সেখান থেকে বাস। গতকাল সকালেও এই রাস্তাটুকু সাদা নরম পালকের মত বরফের চাদরে ঢাকা ছিল। সেই কচি-কাঁচা বরফেরা আজ পেকেছে অর্থাৎ জমে হয়ে গেছে “ব্ল্যাক আইস”। সাপের পিঠে চড়েছেন? চড়েন নি? আমিও চড়ি নি। আশীর্বাদ করবেন যেন সেরকম ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা না হয়। কিন্তু সে জীবটি যেভাবে সরসরিয়ে ভূমিপথে যায় তাতে মনে হয় ওদের ত্বকটা লোভনীয় রকমের পিচ্ছিল। আজ রাস্তার অবস্থা তার থেকেও বাজে। আনকোরা নতুন পাথরের মেঝেতে খানিকটা মোবিল ঢেলে দিলে ঠিক যেমনটা হবে আর কি? প্রতি মুহুর্তে পদস্খলনের সম্ভাবনা। ছিঁচকে চোরেদের মত পা টিপে টিপে চলেও গড়ে প্রতি চারটে পদক্ষেপের একটা ঠিক প্ল্যানমাফিক হচ্ছে না। ফেলার সাথে সাথেই সাপের মত সরসরিয়ে আর একটু এগিয়ে যাচ্ছে। টীনএজার ছেলেমেয়েদের যেভাবে সামলে সুমলে রাখতে হয় সেই ভাবে পা দুটোকে কড়া শাসনে রেখেও তাদের মতিস্থির রাখা যাচ্ছে না। অনেক কসরত আর জিমনাস্টিক-এর সাহায্যে বাসস্টপে পৌঁছে গেলাম। প্রায় গোটা সাত আটেক বার ভূমির আকর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তখন আমি ভূমায় উড়ছি। ভাবলাম আজকের মত ফাঁড়া কাটল। কিন্তু বিধি বাম। রাস্তায় কালো বরফের এমনই মসৃন পাতলা আবরণ, যে গাড়িরা সকলেই গজগামিনী আজ – ৪৫ মাইলের রাস্তায় মেরেকেটে ২০ তে চালাচ্ছে। এদিক ওদিক থেকে গাড়ি স্কিড করার আওয়াজ ভেসে আসছে। যে বাসটা আমায় রেল স্টেশান অব্দি বহন করে সে সুন্দরী যুবতীর মতই মুডি। কোনদিন সাতটা পঞ্চাশে দর্শন দেয় তো কোনদিন আটটায়। যাদের বিদেশ সম্বন্ধে এই ধারণা আছে যে ট্রেন বাস সব সময়মত চলে তাঁরা ধারণাটা এই বেলা বদলে নিন। এই হিমেল শীতের দিনে বাসটার গরম বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়ার জন্য যতই আকুলিবিকুলি করি ও ততই দেরি করে কাছে আসে। আজকেও মিনিট দশেক অপেক্ষার পর সে সুন্দরীর দর্শন মিলল। কাছে এসে সে কিন্তু না দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলল। বুঝলাম বাস-এর ব্রেক ধরছে না। ফুট কতক এগিয়ে গিয়ে সবে যখন সে থামবে থামবে করছে, আর আমিও প্রিয়ার বুকের গরম নিতে পিচ রাস্তায় নেমে পড়েছি, তখনি ঘটনাটা ঘটল। ডান পা-টা আমার নির্দেশ উপেক্ষা করে সরসরিয়ে সোজা সামনে খানিক এগিয়ে তারপর উর্ধমুখে চলল আর আমার কোমর থেকে মাথা অব্দি চলল নিচের দিকে। একেবারে যাকে বলে পিছলে পপাত ধরণী তলে। পুরো ধরাশয়ী হওয়ার পরেও দেখলাম আমার গতিরুদ্ধ হয়নি। আমি পিছলে বাস-এর পেছনের চাকার নিচে চলে গেছি প্রায়। এরপর না থামলে রীতিমত রসিকতা হয়ে যাবে। বাসপৃষ্ট হয়ে পথচারীর মৃত্যুর খবরটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই প্রাণপনে হাত দিয়ে হ্যাঁচড়-পাঁচড় করে ঐ বরফাবৃত রাস্তাকে আঁচড়ে-কামড়ে শরীরটা বাসের চাকার তলায় যাওয়ার যে বিপজ্জনক প্রবণতা দেখিয়েছিল সেটাকে রুখলাম। গতিরুদ্ধ হল বটে কিন্তু ঘটনাটার আকস্মিকতায় আর অভিনবত্বে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বহু কষ্টে উঠে যখন বাসের ভেতরে সেঁধোলাম, ততক্ষনে স্নায়ু পেশী ইত্যাদি জানান দিচ্ছে যে এই অকস্মাৎ অধঃপতন তাদের মোটেই পছন্দ হয় নি। বাস ড্রাইভার দিদি গম্ভীর মুখ করে জানতে চাইলেন “Do u need medical attention?” মুখ দিয়ে আমার বাক্যস্ফুর্তি হল না। মাথা নেড়ে জানালাম “না”। কোমর আর ডান হাতের কনুই তখন ঝালায় বাজচ্ছে। স্টেশান অব্দি মিনিট পাঁচেকের বাসযাত্রা আমার। বাস-এ আসন গ্রহণ করে ভাবলাম স্টেশানে পৌঁছে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারি তখন ডাক্তার সন্দর্শনে যাওয়া যাবে। বাস থামলে নিজের পায়েই দাঁড়ালাম। ট্রেন ধরে শহরে পৌঁছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অফিস পথগামী হয়ে এত আনন্দ হল যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জলতরঙ্গ বাজাচ্ছিল যে পথশিল্পীটা তাকে একটা কড়কড়ে এক ডলারের নোট দিয়ে ফেললাম। ততক্ষণে পুরো ডানদিক টাটিয়ে গেছে। প্রথমের যে যন্ত্রণা ঝিনিক ঝিনিক করে বাজছিল সেটা চলে গিয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকের মত একটা একটানা একঘেয়ে যন্ত্রণা। সে হোক। হাত-পা-কোমর তো এবারেও ভাঙেনি। পড়ে হাত-পা না ভাঙার রেকর্ডটা এখনো অক্ষত। তার থেকেও বড় ব্যাপার – বাসের চাকার তলাতেও শরীরের দুচারটে পার্ট খোয়াইনি। সব কিছুর ইতিবাচক দিকটা দেখলেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। কোন এক গুণীজন বলেছিলেন মানুষের সবচেয়ে বেশি মনোবেদনার কারণগুলোকে নিয়ে রসিকতা করলে বেদনার ভার লাঘব হয়। অফিস থেকে ফিরে এখন আমার সারা গায়ে প্রবল ব্যাথা। একটা পেনকিলার খেয়েছিলাম অফিসেই। তা ভাবলাম গুনীজনেদের উপদেশ অনুসরণ করে আমার এই গাত্রবেদনা নিয়ে রসিকতা করে এটা কিছু কমানো যায় কিনা। পেনকিলার না খেয়ে শুধু রসিকতা করেই যদি এই গাত্রদাহ কিছু কমে তবে মন্দ নয়, কি বলুন?
ট্রেনপথে – রম্যরচনা
[২০ নভেম্বর, ২০১৭-এর স্মৃতিচারণ ]
কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়লেই চোখে পড়ে বাংলার সবুজ সুন্দর সহজিয়া রুপ। আমাদের মত যারা কর্পোরেট কালচারে অভ্যস্ত ব্যস্ত শহুরে প্রাণী, তাদের এই বর্ধমান কি দুর্গাপুর যাওয়ার পথে, ঐ আকাশের পাড় পর্যন্ত আঁকা সবুজে আল্পনার থেকে বেশি প্রকৃতিস্নান ভাগ্যে লেখা নেই। একটা কংক্রিট জঙ্গল থেকে আর একটাতে যাওয়ার পথে উপোসী চোখ দিয়ে জানালা পথে যতটুকু সবুজের সন্ধান করে ফেরা সম্ভব আর কি! তাও চারচাকা বাহনটির বদান্যতা মিললে সেটুকুও হয়ে ওঠে না। সে বড় উদ্ধত যান। তার ভিতরে ঢুকলেই ঘষা কাচ তুলে দিয়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মিঠে স্নেহপরশ মেখে চোখ মুদে থাকি। অধিকাংশ সময়েই বিশ্বস্ত বাহনটি হাজির থাকে। কিন্তু এবারে বাড়ির গাড়িটা না পাওয়া যাওয়ায় অগত্যা ট্রেন পথে বর্ধমানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নারকেল গাছের সঙ্গে কলাগাছ জড়াজড়ি, মাখামাখি করে মিলেমিশে আছে যেন কতো প্রাচীন এক বন্ধুত্ব। পানায় ভরা পুকুর রেল লাইনের ধারে ধারে। তাতে অজস্র শালুক ফুল অযত্নে ফুটে আছে। কি একটা অজানা কারণে এই অনন্য রুপসী ফুলগুলো মানুষের সর্বগ্রাসী গৃধ্নুতার হাত থেকে আজও বেঁচে আছে। বাজারের ফুলের দোকানে এদের দেখা মেলে না। মাতৃক্রোড় থেকে তুলে নিলেই ফুলগুলো বড় তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। তাই বোধ হয় বাজারি মর্যাদা পায় নি। আমরা যারা মফস্বলের মানুষ তারা বোধ হয় ছোট বেলায় বকুল, কদম, শালুক ফুল নিজের হাতে তোলার আনন্দ পেয়েছে। যারা কলকাতায় মানুষ, বড় শহরে মানুষ, তারা আর্সালানের বিরিয়ানি, পার্ক স্ট্রীটের পিটার ক্যাটের চেলো কাবাব খেতে খেতে অনেক কিছু, অনেক কিছু মিস করে গেছে। একটু এগোতেই দেখা গেল টালির চালের বাড়ি। ওপরে কুমড়ো লতা। তাতে একটা হলদে কুমড়ো ফুল লাজুক চোখে চেয়ে আছে। আহা তার কি শোভা। অন্যান্য কবিদের মত বাংলাকে যদি কখনও কোনো নারীরূপে কল্পনা করি, যে মেয়েটার ছবি মনে আসে সে ফর্সা, উজ্জল, গৌরবর্ণা চটকদার সুন্দরী নয়, ডানাকাটা পরী নয় – শ্যামলা রঙের ডাগর চোখের মিতভাষী কোনো মেয়ে। জানি এই গ্রাম বাংলার মানুষগুলো আর এই মায়াময় রুপসী প্রকৃতির মত সুন্দর নির্বিবাদী নয়। বিশ্বায়ন, বাণিজ্যায়ন, রাজনীতি, বহির্বিশ্বের হাতছানি প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে জনজীবনের রুপরেখা। কিন্তু এই যে গাছ, ধানখেত, মেঠো রাস্তা, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা বক যারা ইন্টারনেটের তীব্র দহনে নিত্য ব্যতিব্যস্ত নয়, তাদের মধ্যে দিয়ে বোধ হয় আজ সেই মাথায় এক ঢাল চুলওলা ছিপছিপে সুন্দরী বাঙালি মেয়েটা, বাংলার স্বত্বাটি বসে থাকবে। এই মায়ারই আকর্ষণে কবিরা বারে বারে সৃষ্টি করেছে নীরা, বনলতা সেনদের। যাবতীয় নাগরিক ক্লান্তি আর শহুরে বিষাদ থেকে দু দণ্ডের শান্তি পেতে বারে বারে ছুটে যেতে চেয়েছেন এই মায়াবী মানবীর কাছে। এখন বর্ষাকাল নয়। কিন্তু বঙ্গোপসাগর ব্যাপী নিম্নচাপ অসময়ে সঘন মেঘমালায় আকাশ ছেয়ে দিয়েছে। সদ্যবৃস্টিস্নাত সর্ষে খেতে যেন কোনো সদ্য যুবতীর মুগ্ধ চোখের মাদকতা। তাল আর নারকেল গাছেরা এক জলজ বিষণ্নতা চোখে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। পাশেই একটা ছোট্ট জলা জায়গা। ডোবা বলা চলে। একটা মাছরাঙ্গা পাখি তার পাড়ে সন্ধানী চোখে চুপ করে বসে আছে। চোখে তার আলগোছে টানা রূপটান। আর একটু এগোতেই রেললাইনের ধারে একটা ছোট্ট গ্রাম। কিছু একচালা বাড়ি। একটা পুকুর। কিছু হাস মুর্গি পুকুর পাড়ে দল বেধে বসে গুষ্ঠিসুখ উপভোগ করছে। অকালবৃষ্টিতে পর্যুদস্ত সদ্য বোনা ধানের চারাগুলো তাদের কচি মাথা দোলাচ্ছে। পুকুরপাড়ে কিছু পঁচিশ-তিরিশ বছরের বিবাহিত মেয়ে বসে বাসন মাজছে। আটোসাঁটো করে পরা শাড়ীর ভিতর থেকে লাউডগার মত লকলকে যৌবন চলকে পড়ছে। হয়ত এর মধ্যে কোনো কাব্য নেই। হয়তো এ কঠোর জীবনসংগ্রাম। কিন্তু সেইভাবে দেখতে গেলে এই ক্রুরা কঠোরা পৃথিবী সবটাই কঠোর গদ্যময়। এর মধ্যে যেটুকু কাব্য আমরা খুঁজে নিই সেইটুকু আমাদের নিজেদেরই প্রয়োজন, নিজেরই মনের স্নানের জল জোগানোর প্রয়োজনে।
এইসবই হাবিজাবি ভাবছিলাম। হঠাৎ এক অন্ধ বেসুরো গায়কের গানের আওয়াজে ঘোর কাটল।
“সে যে গান শুনিয়ে ছিল হয় নি সেদিন শোনা। সে গানের পরশ লেগে হৃদয় হল সোনা।
চেনা শোনা জানার মাঝে কিছুই চিনি না যে। অচেনায় হারাল মন আবার ফিরে এসে।”
আজ হঠাৎ গানটা বড়ো প্রাসঙ্গিক মনে হল। সামান্য আর্থিক সঙ্গতি বাড়লেই এই কলকাতা-বর্ধমান কি কলকাতা-খড়গপুর টাইপ স্বল্প দূরত্বের ট্রেনপথগুলো অচেনা হয়ে যায়। সেই অচেনা পথেই যদি একদিন সফর করা হয়, সুর হারাব বলেই যদি একদিন গান সুরে বাঁধা হয় সেটাকে উপভোগ করার মন কি আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি? boyhood থেকে adulthood-এ পৌঁছনোর ঠিক কোন বাঁকে আমাদের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা, মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতাটুকু ফেলে রেখে আসি সেইটে শুধু ভেবে পাই না। Antibiotic খাওয়ার সাথে সাথে যেমন শরীরমধ্যস্থ ব্যাকটেরিয়াদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে থাকে ঠিক সেভাবেই মুগ্ধ হওয়ার যে সহজাত ক্ষমতা একটা শিশুর থাকে, বয়ঃপ্রাপ্তির সাথে সাথে মন যত পেকে ঝুনো হয়, ততই মন রূপ-resistant হয়ে যায়। তখন মানালি শহরে বিপাশার জলে পা ডুবিয়ে মনে হয় আল্পস না দেখলে পাহাড়ের রূপ কিছু দেখাই হল না। গোয়ার সমুদ্র সৈকতে বসে মনে হবে ফুকেটে সমুদ্রস্নান না করলে কোনো মজা নেই। Way of living-এর ওপর অনেক talk শুনেছেন, সপ্তাহখানেকের কোর্সও কেউ কেউ attend করেছেন। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানেন, বয়সের সাথে সাথে মুগ্ধতা, বিস্ময় এ সবের প্রতি আমাদের যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, ওটাকে রুখে দেওয়ার সচেতন বা অবচেতন নিয়ত চেষ্টা করাই রক্তচাপ, irritability, hypertension কমানোর সব চেয়ে ভাল উপায়। মনটাকে আর একটু গ্রহণক্ষম, receptive রাখলেই দেখবেন অজস্র ছোট্ট রঙ্গিন জলফড়িঙদের মত খুচরো খুচরো আনন্দের উৎস আপনার চারপাশে লুকোচুরি খেলছে। Quality আনন্দ একেবারে বিনামূল্যে অফার করাই আছে আপনাকে। খুঁজে নিতে পারলেই হল। যদি আমাদের কোন পুরনো স্মৃতিই না থাকত, প্রতিদিনই যদি একটা আনকোরা নতুন দিন হত, প্রতিটা সূর্যোদয় দেখেই যদি সেই প্রথম সূর্যোদয় দেখার মত শিহরণ হত, তবে কি ভালই না হত। তাই না?
এই ভাবে সবুজের বুক চিরে ট্রেন যখন বর্ধমান ছুঁলো তখন স্বপ্নভঙ্গের মত ঘুম ভাঙ্গাল কর্কশ গলায় চিৎকার “ভাঁড়ে চা ভাঁড়ে চা।” বর্ধমান স্টেশানে তড়িঘড়ি নেমে টোটো করে যাত্রা শ্বশুরবাড়ির পথে। ছোটবেলায় মা বলত “পড়াশুনো নেই, খালি টোটো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”এই বুড়ো বয়সে কথাটা যেভাবে আক্ষরিক অর্থে ফলে গেছে তাতে মাকে নস্ত্রাদামুস-এর ছোটবোন বলা যেতেই পারে।এই বায়ুদুষণরহিত, শব্দদুষণরহিত battery driven ত্রিচক্রযানটি শহরতলি অঞ্চলে বহুল জনপ্রিয় এখন। তিন-পেয়ে অটোর এই নির্বিবাদী ছোট ভাইকে মানুষ আদর করে নাম দিয়েছে টোটো। সারাদিন তাই অনায়াসেই এখন টোটো করে যত্রতত্র ঘোরা যায়। যাওয়ার পথে একটা বাড়ির নাম চোখে পড়লো “মুকুল-রাঙা”। মিস্টি নামখানা। ইঁট-কাঠ-পাথরের শুকনো মরুভূমির মধ্যে সুন্দর নামখানা নিয়ে মরূদ্যানের মত দাঁড়িয়ে আছে যেন বাড়িখানা। অনেকক্ষন ধরে ঐ সুন্দর নামখানা মনের মধ্যে সুর ছড়াতে লাগলো। এই বাড়িটার বাসিন্দারাও কি বাড়ির নামের মতই সুন্দর না জীবন যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত, irritated? কে জানে। অন্তত সেই মানুষটা, যিনি বাড়ির নামখানা মুকুল-রাঙা রেখেছিলেন, তিনি অন্তত কালবৈশাখীর ঝড়ে কুচো আম কুড়োতে বেরোন কি আজও? এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পৌছে গেলাম গন্তব্যে। বেশ কাটলো ঘন্টা খানেক। মানুষের কাছাকাছি। মানুষের পাশাপাশি।
****
বাধ্যতামূলক সতর্কীকরণঃ যযাতির ঝুলির সব লেখাই শতাধিক বার ফেসবুকে শেয়ার হয় সেটা তো সুধী পাঠক বা প্রিয়দর্শিনী পাঠিকা নিচের ফেসবুক শেয়ার বাটন দেখে বুঝতেই পারছেন। এত অকুণ্ঠ ভালবাসা দেওয়ার জন্য পাঠক পাঠিকাকে যযাতির আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আপনিও শেয়ার করুন। কিন্তু শেয়ার করার আগে নিচের কমেন্ট বক্সে (বেনামী হোক বা নাম সহ) একটি মন্তব্য ছেড়ে যান যাতে যযাতি তার যজমানদের একটু চিনতে পারে। যযাতি তার ফেসবুক পেজের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। পোস্ট ভাল না লাগলে আপনাকে ছাড় দেওয়া হবে, কিন্তু ভাল লাগলে কমেন্ট না করে শুধু শেয়ার করলে যযাতির অভিশাপে (বিবাহিত হলে দাম্পত্য কলহজনিত কারণে আর অবিবাহিত হলে বাবা মার দাম্পত্য কলহজনিত কারণে) আগামী রবিবার রবিবাসরীয় লুচি তরকারি থেকে বঞ্চিত হবেন।
সাইকেল বিহার – রম্যরচনা
[এই স্মৃতিচারণটি আমার নিজের শহর রামরাজাতলার ওপর। কিন্তু যেকোনো শহরতলির মানুষ আশা করি রিলেট করতে পারবেন। ১৫ নভেম্বর, ২০১৭-এর স্মৃতিচারণ ]
কদিন হল নিজের শহরে এসেছি। আজ সারাদিন বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোই নি। পুরোদিন বাড়িতে বসে শুষে নিয়েছি স্মৃতিগন্ধবাহী রূপকথাদের।
সারাদিন বাড়িতে বসে বসে হাতে পায়ে কেমন একটা জং ধরে যায় না? বেরিয়ে পড়লাম আমার প্রিয় সাইকেলটা নিয়ে। আমি ছাড়া আমাদের বাড়িতে আর কেউ সাইকেল চালানোর নেই। আগে বাবা চালাতো। এখন বয়স হয়েছে। আর সাইকেল চালায় না। বাবার এখন পদব্রজেই বিস্তার। দাদাও সঙ্গত কারণেই মোটর বাইকে শিফট করে গেছে। তাই প্রতি বছর দেশে ফিরলেই দেখি সাইকেলটা দুয়োরানির মত এক কোণে পড়ে আছে। কালিঝুলি মাখা জীর্ণ অবস্থা। আমি সাইকেলটাকে যা একটু প্যাম্পার করি। নিয়ে গিয়ে বাচ্চুদার দোকানে ফেললেই এক বেলার মধে চক্চকে স্মার্ট। এন-আর-আই দেখে বাচ্চুদাও একশো টাকা হাঁকিয়ে বসে। দরাদরি করাটা কোনোদিনই আমি ঠিক ভাল পারি না। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে একটি পাতা ধরিয়ে বাহনটিকে হস্তগত করি। সেই সাইকেলটা নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাব কিছু ঠিক না করেই প্যাডেলে চাপ দিয়ে আমি সাইকেল আরোহি। বিনা কারণেই দুবার বেলটা টিপে দিই। টুং টুং টুং টুং। কি মিঠে শব্দটা। পথচারীদের পথ ছেড়ে দেওয়ার জন্য কি সুশীল, বিনীত অনুরোধ। যেন দুটো টুনটুনির ফিরিঙ ফিরিঙ প্রেমালাপ। বাইকের উদ্ধত হর্ন যদি ইয়ো ইয়ো হানি সিং হয় তবে এ যেন রাখালিয়া বাঁশি। এই সাইকেল চালানোটা আসলে আমার একটা style statement। মায়ের বুকের স্তন্যদুগ্ধের মত এই সবুজ গ্রহের বুক থেকে শুষে আনা ফসিল ফুয়েলের অবিরত অপচয়ের সামনে দাড়িয়ে এই যে মন্দগতি অথচ শব্দদুষণ, বায়ুদুষণরহিত যানটি – এ যেন এই উত্তুঙ্গ, তিল তিল করে আত্মহননের পথযাত্রী সভ্যতার বুকে একটা কড়া থাপ্পড়। আমি যখন সাইকেল আরোহি, দেখি এক অদৃশ্য placard লাগানো আছে আমার handle-এ “এই পৃথিবী আমায় একটু বেশি ভালবাসে কারণ আমি আমার চলার পথের পাথেয় স্বততই তার স্তন্যদুগ্ধ পান করে সংগ্রহ করি না”।
আমাদের রামতলার রাস্তায় সাইকেল চালানোর জন্য যে gymnastic skill আয়ত্ত করার দরকার পড়ে সেটা রীতিমতো আয়াসসাধ্য – দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়ে সেটা আয়ত্ত করতে হয়। আপনার সাইকেলের পূর্ব-পশ্চিম-ঈশান-নৈঋত সব দিশাতেই ইঞ্চিখানেকের দূরত্বে নিশ্বাস ফেলছে বাইক, রিকশা, চারচাকা আর পদচারীরা। হাওড়ার গলিগালা, বড়রাস্তা সকলই কিঞ্চিত সরু, অপরিসর। এ কথা সকলেই জানে। আর বহুতল ফ্ল্যাটবাড়িগুলো আগমনের সাথে সাথে মানুষ যেভাবে বেড়েছে সেভাবে রাস্তাগুলো পেটমোটা হবার সুযোগ পায় নি। নিজেদের শীর্ণ ক্লীশ শরীর নিয়ে মানুষের পদভারে নীরবে ত্রাহি ত্রাহি করছে তারা। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বরূপ ইদানিং যোগ হয়েছে টোটো। শব্দহীন এই ত্রিচক্রযানটিও আপনার আগে-পিছে-ডাইনে-বাঁয়ে, শিশু প্রহ্লাদের ইষ্ট নারায়ণের মতই, সর্বত্র বিদ্যমান। এ হেন পরিস্থিতিতে গতিশীল সবরকম যানবাহনের মধ্যে একটা নির্ভুল সুষমা বজায় রেখে এবং অভিকর্ষের নিরন্তর ডাককে উপেক্ষা করে এই দ্বিচক্রযানের পিঠে করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা শিল্পকলা বললে বোধ হয় সত্যের অপলাপ হবে না। আমি নিশ্চিত রামতলায় যারা সাইকেল চালাতে পারে তাদের কোন বিলিতি সার্কাসে ওই দড়ির ওপর দিয়ে সাইকেল চালানো ইত্যাদি খেলায় অবলীলায় সুযোগ মিলতে পারে। তার ওপর আছে পান থেকে চুন খসলেই যাকে বলে হেভি বাওয়াল। এই দ্রুতগতি জীবনের সাথে পা মিলিয়ে চলতে থাকা অসহিষ্ণু ক্লান্ত মানুষগুলির মুখ থেকে একটু এদিক ওদিক হলেই বেরিয়ে পড়ছে দু অক্ষরের সেই লিঙ্গসূচক শব্দটি। মনুষ্যজাতীয় প্রাণীর সাথে যদি বা সমতান বজায় রাখতে পারেন, চতুষ্পদদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রাখা আর একটা শিল্প। একটু ফাঁকা গলি হলেই এ পাড়া ভার্সেস ও পাড়ার কুকুর মন্ডলীর gang fight-এর মধ্যে পড়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। আপনাকে “ইস্পাতের মত মজবুত আর ঠান্ডা স্নায়ু” যাকে বলে “নার্ভ অফ স্টীল” বজায় রেখে শক্ত হাতে একটা optimum স্পিড-এ তাদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এরা সাধারণত কামড়ায় না কিন্তু যেভাবে উচ্চৈঃস্বরে নিজের এলাকার দখলদারির সরব দাবি জানায় তাতে কামড়াবে না এই ভরসা রাখাটা যে সহজ নয় সেটা সহজেই অনুমেয়।
এইভাবে হেমন্তের মিঠে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে সাইকেলে চেপে পথ বাইতে বাইতে রামতলা বাজার পেরিয়ে সাঁতরাগাছি মোড় পেরিয়ে নতুন রাস্তার মোড়। তখন পথের নেশা চেপে বসেছে। প্যাডেল করতে করতে দালালপুকুর। কয়েকটা অতিকায় গাছ ঝুঁকে পড়ে ঐ ক্ষুদ্র জলাশয়টিকে যেন সভ্যতার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থেকে সশস্ত্র প্রহরীর মতই রক্ষা করছে। আর একটু এগিয়ে গেলে কিছু বছর আগে হলেও পেতেন পার্বতী সিনেমা আর তার একটু পরে শ্যামাশ্রী সিনেমা। কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পপকর্ন সমৃদ্ধ multiplex – এর যুগে আজকাল এই ধরনের একক ছবিঘরেরা, whatsup এর যুগে নিতান্ত টেলিগ্রামের মতই, outdated। আমাদের রামতলার শ্যামলী সিনেমা, যেখানে আমার মনে থাকা বয়সের প্রথম ছায়াছবি kingkong and godzilla দেখেছি, তার মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। এই সিনেমা হল দুটো বৃদ্ধ হেঁপো রুগির মত বেঁচে থাকার লড়াইটা চালিয়েছিল অনেকদিন। সভ্যতার অভিঘাতে মারা গেছে বছর দুয়েক হল। স্বর্গত শ্যামাশ্রী সিনেমা পেরিয়ে চলতে চলতে যখন মল্লিক ফটক পৌঁছলাম তখন মনে হল এতদূর এলাম যখন গঙ্গার ঘাটটা দেখে যাব না? অতএব ফের প্যাডেলে চাপ। মল্লিকফটক পেরিয়ে গঙ্গাগামী হলেই আপনি দেখবেন একটা সম্পূর্ণ অন্য সভ্যতা, এক অচেনা পরিবেশ। আলো ঝলমল, দোকানে দোকানে ছয়লাপ শহুরে সভ্যতা হঠাৎ যেন মৃত্যুগর্ভে বিলীন। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। এই এলাকাটি মূলতঃ হিন্দি ভাষাভাষী অবাঙ্গালী অধ্যুষিত। বিহার থেকে জীবিকার সন্ধানে কয়েক পুরুষ আগে এরা এখানে এসেছে। এই কয়েক পুরুষেও জীবন যুদ্ধে খুব একটা সফল যে হতে পারেনি তার পরিচয় মিলবে বাড়ি-ঘর-দোর-দোকানপাটের চেহারা দেখে। আর্থিকভাবে অনুন্নত এই এলাকাটা একটা মিনি বিহার বলা চলে। পার্থক্য একটাই। এরা প্রায় প্রত্যেকেই ঝরঝরে বাংলা বলতে পারে প্রয়োজনে। সন্ধ্যে নটার পরে গেলে যদি কান খাড়া রাখেন দু এক কলি “রামা হৈ” কি হনুমান চালিশা শুনতে পাবেন। কিছু নির্বিবাদী মানুষ খালি গায়ে বসে লিট্টী সহযোগে নৈশভোজ সম্পন্ন করছে দেখতে পাবেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই গোটা ছয়েক ছাতুর সরবতের স্টল স্পট করে ফেলতে অসুবিধে হবে না। কখনো সুযোগ হলে একবার চেখে দেখবেন। আমাদের Cafe Coffee Days-এর চারশো টাকার পানীয়ের তুলনায় এই দশ টাকার (এখন বোধ হয় কুড়ি) ছাতুর শরবৎ লেবু আর মশলার ঝাঁজে খুব একটা কম সুস্বাদু নয়। শেষমেশ একটু-আধটু রাস্তা গুলিয়ে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা বাঁক ঘুরতেই আসন্ন সেই সুবিস্তীর্ণ গঙ্গা। সাইকেলটাকে stand করে দাঁড়াই। এখানে গঙ্গার রূপ কিন্তু স্বচ্ছসলিলা, পূণ্যতোয়া নয়। সেই হরদুয়ার থেকে এই আগ্রাসী সভ্যতার উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করতে করতে এইখানে এসে তার ক্লান্ত জীর্ণ রূপটি চোখে পড়ে। হরিদ্বারের পায়ে নূপুর পরা কিশোরী গঙ্গা এইখানে এসে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েছে। পুরো এক জীবনের অবসাদ। কিন্তু তাতে কি? এই যে সুদীর্ঘ পাচ হাজার বছর ধরে এই আর্য-অনার্য সভ্যতাকে মায়ের মত মমতায় লালন করল? সেই মাতৃস্বরূপার পরম স্নেহপরশটি পেতে হলে বুক ভরে শ্বাস নিন। নিঃশ্বাসের সঙ্গে মনের সব জঞ্জাল বের করে ঐ গঙ্গাজলে মনে মনে সঁপে দিন। সারা উত্তর ভারতের জঞ্জাল নিয়েছেন যিনি আপনারটাও নেবেন। নিরাশ করবেন না। আজ আবার কার্তিক পূজোর বিসর্জনের দিন। একটা বড়সড় কার্তিক ঠাকুর এল ভ্যানে করে। ধুপ ধুনো দিয়ে হাতে মিস্টির প্যাকেট ধরিয়ে চিবুকে চুমু খেয়ে তাকে বিদায় করছে বিবাহিত মহিলারা। এই মাটির প্রতিমার প্রতি কি অপ্রতিম সন্তান স্নেহ। এখন সঙ্গত কারণেই জলে প্রতিমা বিসর্জন নিষেধ। গঙ্গাপাড়ে নামিয়ে যাওয়াই দস্তুর। যতক্ষণ এই বিদায়পর্ব চলল চারটে অর্ধনগ্ন ছেলে এসে দাড়িয়ে রইলো যেন মৃত্যুপথযাত্রী কোনো প্রাণীর আশেপাশে ভিড় করা শকুন। জীবনযুদ্ধে পরাভূত সমাজের প্রতিনিধি এরা মৃন্ময় দেবতার হাতে মিস্টির প্যাকেটের বিলাসিতা সহ্য করতে অপারগ। বিসর্জনে আসা মানুষগুলো চলে গেলেই কার্তিক ঠাকুরকে দেওয়া সব জাগতিক সম্পদ এই জ্যান্ত কার্তিকরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। বিসর্জনে আসা মানুষগুলোর কথাবার্তা একটু আধটু কানে এল। কানে এল বললে একটু মিথ্যে বলা হবে। আমার একটু আড়ি পাতা স্বভাব আছে। বিশ্বাস করুন কারও ক্ষতি করার জন্য নয়, অন্যের বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরী করতে সম্পূর্ণ অচেনা লোকেদের কথা কখনো সখনো চেখে থাকি। ধর্মবিশ্বাসী লোকগুলো বলাবলি করছে কার বাড়িতে জোড়া কার্তিক ফেলার ফলে যমজ ছেলে হয়েছে। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় কিন্তু সভ্যতার আলো যত উজ্জ্বলতর হয়েছে তত এই ধরণের কার্য-কারণ সম্বন্ধে আস্থা রাখা হয়েছে দুঃসাধ্য।
অবশেষে গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া অনেকটা ফুসফুসে ভরে নিয়ে ফেরতা পথে সাইকেল ধরলাম। হিসেব করে দেখলাম ফেরার পথটা হবে পাঁচ কিমির কিছু বেশি। যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় দশ কিমি। ভাবছেন উরিব্বাস এ তো অনেকটা পথ? আমি কোনো অতিমানব নই, sportsman-ও নই, বছরে একবারই দেশে ফিরে সাইকেলে চড়ি – আসলে দশ কিমি সাইকেল চালানোটা আদৌ কোনো শক্ত ব্যাপার নয়। মেন্টাল ব্লক আর আপনার ভটভটি অর্থাৎ মোটর বাইকটিকে একদিনের জন্য নির্বাসন দিলেই দেখবেন কাজটা জলের মত সোজা। আর ঐ যে বললাম – দূষণ না ছড়ানোর জন্য এই পৃথিবীই আপনাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করবে, সাহস জোগাবে। ফেরার পথে আর একটা procession দেখলাম যে মিছিলটায় আমাদের সবাইকে একদিন না একদিন সামিল হতে হয়। যত খেদ, ঘৃণা মানসিক কলুষ, যত মিথ্যা জৌলুস সব পিছনে ফেলে রেখে হরিধ্বনি দিতে দিতে আর বিন্নি খৈ ছড়াতে ছড়াতে আমাদের সবাইকে উত্তর পুরুষ পৌছে দেবে আমদের অন্তিম শয়ানে। তবে কেন এত হিংসা, প্রতিযোগিতা শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান? রামতলা বাজার দিয়ে ফেরার পথে হঠাৎই চোখে পড়ে গেল নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে দোকানের নাম “জয়নগরের মোয়া”। সাইকেলের ব্রেকটা কোন শালা টিপল ঠিক জানিনা। কিন্তু দেখলাম দোকানের সামনে আমি সাইকেল থেকে নেমে দণ্ডায়মান। আশি টাকায় আটটা জয়নগরের মোয়া (মানে আদতে রামতলারই। কিন্তু ঐটুকু ব্র্যান্ডিং না করলে আমি দাঁড়াতাম বলুন?) কিনে বাড়ি ঢুকলাম যখন তখন সাড়ে নটা। দেড় ঘন্টার সাইকেল সফরে প্রাণ-মন চাঙ্গা। আজকাল শপিং মল-এ হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে আনন্দ কেনাই দস্তুর। তার বিরুদ্ধে সওয়াল করছি না। কিন্তু মাঝে মাঝে এ ভাবেও আনন্দ কেনা যায়। সাইকেলের maintenance cost টা যদি না ধরেন, মোট খরচা আশি টাকা আর বেশ কিছুটা ক্যালরি যেটা কিনা আমার মধ্যপ্রদেশের প্রগতি রুখতে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে। অবিশ্যি মোয়াগুলো খেয়ে সেটা মেকআপ হয়ে যাবে। কারণ বাঙালির প্রায় পরিচয়পত্র স্বরূপ নোয়াপাতি ভুঁড়ি নিয়ে যাকে বলে “No Compromise”!!
বাঁধন
মাস চারেক আগে যখন দেশে যাওয়ার টিকিটটা কেটেছিলাম তখন ভেবেছিলাম এক্সপিরিয়েন্সটা সুখকর হবে। আমার স্ত্রী আর আমার দু বছরের কন্যা সন্তান মহারাজার কাঁধে চেপে যাবে দিল্লি হয়ে কলকাতা। আর তার এক মাস পরেই আমি তাদের জয়েন করব আমার খুব কাছের সেই ছোট্ট শহরতলি রামরাজাতলায়। এ শহরে সরু সরু অলিতে গলিতে আমার ছোটবেলাগুলো সারা বছর আমার দেখা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। সেই বুড়ো শিবতলা, সেই বারোয়ারী মণ্ডপের পুজো, সেই জমিদার বাড়ির আদলে মৈনাকদের বাড়ি আজও আমার অভাবে খাঁ খাঁ করে – অন্তত এই দুর প্রবাসে বসে এমনটাই আমি মনে করি। স্ত্রী-কন্যা বিহনে আমি এই একটা মাস উপভোগ করতে পারব আমার হঠাত-করে-পাওয়া আইবুড়ো সময় বিশেষত এক মাস পরেই যেখানে নিছক ছুটি কাটাতে দেশে যাওয়া এবং সেই মানুষ দুটির সাথে পুনর্মিলন, সাথে পাব বাবা-মার আদর, আমার প্রিয় ভাইঝিদের সর্বক্ষণ ন্যাওটা হয়ে আমার সাথে লেগে থাকা। কিন্তু তার আগে এই একলা একটা মাস। সত্যি কথা বল্যতে কি আমার নিজের সঙ্গ আমার বেজায় পছন্দ। কোন এক মনীষী লিখে গেছেন “A Poet talks to himself only. Others just overhear it” – লেখালেখি করা যে কোন মানুষের ক্ষেত্রেই কথাটা প্রযোজ্য। আর এই নিজের সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা নিজের সময়ের প্রয়োজন হয়। আমার ব্যাচেলরহুড মানে বেশি কিছু নয়, একটু হয়তো জিনিস যত্র তত্র ছড়িয়ে রাখা। কিচেনের দেরাজ হোক বা বইয়ের, যে বা যারা যেখান থেকে বেরোল তাদের স্বস্থানে প্রত্যাবর্তনের কোন তাড়া নেই। রাতের বেলা ভাত-রুটির বদলে এক প্যাকেট ম্যাগি। অফিস থেকে ফেরার নো তাড়া। ফেরার পথে কোন পথ চলতি রেস্তোরায় পা আটকে গিয়ে একটা কি দুটো সোনালি তরল যদি আত্মস্থ করে নিই তাহলেই বা ক্ষতি কি? টিভিতে ইয়াপ টিভিতে বাংলা সিরিয়ালের বদলে আমার প্রিয় গজল বা ভজন কি চন্দ্রবিন্দু কি ফসিল। মোটের ওপর কারু কাছে জবাবদিহি করার নেই। একটা মাস আমার শর্তে আমার জীবন বাঁচা। আর আপনারা যারা বিবাহিত তাদেরকে বোধ হয় বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না যে ছাপোষা বাঙালি হিসেবে আমাদের জীবনে দাম্পত্য ঝগড়া-বিবাদ-কলহ লেগেই থাকে। কথায় বলে ঘটি-বাটি একসাথে থাকলে ঠোকাঠুকি হয়। কিন্তু জড় হওয়ার সুবাদে সেই ঠোকাঠুকি কুরক্ষেত্র যুদ্ধের আকার নেয় না। কিন্তু সজীব বস্তুর ক্ষেত্রে ব্যাপার আলাদা। এই ধরুন সবে একটা ব্লগের পাতায় একটু চোখ দিয়েছি কিম্বা একটা রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসের নরম উত্তাপে নিজেকে একটু সেঁকে নিচ্ছি কি আমার শ্রীমতীর ডাক পড়বে “শোনো না সানাই-এর দুধটা গরম করে আনো না গো।” কিম্বা “বাসন গুলো মেজে দাও”। শুনে যদি মুখ বেঁকিয়েছ তাহলেই বাড়িতে শুরু হয়ে যাবে হার্ড মেটাল। না দাবী গুলো কোনটাই অন্যায় নয়। কিন্তু ন্যায্য দাবী হলে যে মেনে নেবই, নিজেকে এমন সবিশেষ মহাপুরুষ বলে দাবী আমি করছি না। বিশেষতঃ মানুষ সবচেয়ে বেশি স্বার্থপর তো তার নিজের জনের ওপরেই হয়। প্রবাসে থাকলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ সব কিছুই নিজেকে করতে হয়। কোন সাহায্যকারী মাসীর অভাবে আমাদের বাঙালি স্বত্তার একেবারে ত্রাহিমাম অবস্থা। আর তার ওপরে আছে সানাই-এর দেখভাল করার ভার। সানাই, আমার কন্যা সন্তানটিকে এক কথায় বর্ণনা করতে হলে বলতে হয় “আশাতীত”। অর্থাৎ কিনা ওর ওই ক্ষুদ্র মাথায় এই মুহূর্তে ঠিক কি প্ল্যানিং চলছে সেটা বোধ হয় সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাও ঠিক ঠাহর করতে না পেরে এ যাত্রা সেই দায়িত্বটা তাই আমাদের ওপর বর্তে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নতুন সৃষ্টি কর্মে মেতেছেন। এই হয়তো দেখলেন দেবী মন দিয়ে কিষা দেখছে অর্থাৎ কিনা লিটল কৃষ্ণ দেখছে, আর সেই দেখে পায়ের ওপর পা তুলে আমি চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়েছি, চোখের নিমেষ ফেলবার আগেই তাকে হয়তো পাওয়া যাবে ডাইনিং টেবিলের তলায় চেয়ারের চক্রব্যূহে আটকা পড়ে তুমুল চিৎকারে এস-ও-এস পাঠাচ্ছে। অমন একটা জনমানবহীন জায়গায় ওর কি কাজ থাকতে পারে সে ব্যাপারে আমায় প্রশ্ন করবেন না। কারণ উত্তরটি আমি সম্যক অবগত নই। কিন্তু তাকে ওখান থেকে রেসকিউ করতে ওই সবুজ অমৃতের চাঙড়কে সেন্টার টেবিলে ঠকাং করে নামিয়ে আমাকেই যে মাঠে নামতে হবে সেটা বোধ হয় বলাই বাহুল্য। চায়ের আমেজের যাকে বলে এক্কেরে হাতে হ্যারিকেন। সেটাও যদি ছোট্ট গোপালের দুষ্টুমি দেখে অনুপ্রাণিত ভেবে ক্ষমা করে দেন, তবে দেখবেন রাত্তির সারে বারোটার সময় হঠাত করে আপনাকে হাত ধরে ঠাকুরের বেদীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি ভেবে থাকেন ঠাকুর দেবতায় ভক্তি ভাল বই মন্দ না – তাহলে নিতান্ত ভুল করছেন। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ বলে যে প্রবাদ শোনা যায় তা যে নেহাত অপবাদ নয় তার প্রমাণ হাতেনাতে পাবেন। চোখ টোখ বুজে একটি জোরদার প্রণাম ঠুকেই দেবীর দাক্ষিণ্য পেতে হাত বাড়িয়ে দেবে। অর্থাৎ কিনা প্রসাদ চাই। দেবী তখন প্রসন্ন হয়ে প্রসাদ দিতে চান কিনা ঠিক জানি না, কিন্তু আমার আপনার নিশ্চিত অপ্রসন্ন লাগবে সেটা স্বাভাবিক। আপনি যদি রাত্রি সাড়ে বারোটার সময় প্রসাদরুপী মিছরি না খেয়ে ঘুমনোটাই শ্রেয় কর্ম বলে উপদেশ দিয়ে তাকে বিছানায় পেড়ে ফেলার চেষ্টা করেন, তাহলে সানাই সপ্তম স্বরে যে সানাই ধরবে তাতে আক্ষরিক অর্থে পিলে চমকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রভূত। আলকাতরাজে নিয়ে গিয়ে থার্ড ডিগ্রী টর্চার করলেও কেউ এই ধারা চেঁচায় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। তারপর ধরুন না সেদিন দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন যখন শিকাগোর ভারত সেবাশ্রমের ছোট্ট পরিসরে প্রায় গোটা আটশ লোক পুষ্পাঞ্জলি দিচ্ছে তখন হয়তো দেবী মুমুক্ষু হয়ে পড়লেন। মুমুক্ষু অর্থাৎ বাবার বাহু বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা। বাবার হাত হ্যাঁচকা টানে ছাড়িয়ে নিয়ে ভক্ত মণ্ডলীর থিকথিকে ভিড়ে মুহুর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তারপর মিনিট দশেক পর্যন্ত গোরু খোঁজা খুঁজে যখন বুকের মধ্যে আপনার হাপর পড়ছে, আপনার স্ত্রীয়ের চোখের অশ্রুগ্রন্থি গুলো সবে কাজে নামবে বলে মনঃস্থির করেছে সেই সময় কোন শুভাকাঙ্ক্ষী এসে যদি আপনার বাচ্চা ধরে দিয়ে যায় এবং বলে যায় “রাস্তায় হাঁটছিল। একটু খেয়াল রাখিস।” তখন নির্ভেজাল মুখ করে তাকে অজস্র ধন্যবাদ দিলেও মনে যে বড় আনন্দের উদ্রেক হয় না সেটা দুরন্ত বাচ্চার (মানে বাঁদরের ইউফেমিজম আর কি) বাপমা মাত্রেই অনুধাবন করতে পারবেন। এ হেন সানাইকে সামলানো মোটের ওপর স্ট্রেসফুল। আমার এক মার্কিন কলিগ আমায় একবার বলেছিল “With small kids, you have high moments and low moments. Where high moments are truly blissful, low moments are truly frequent.“ হাড়ে হাড়ে সেটা উপলব্ধি করি নিয়মিত।
এর পরে আছে ধরুন আমার স্ত্রীয়ের পরিষ্কারের বাতিক ও তৎসম্বন্ধীয় পিটপিটানি। বেসিনের বেড থেকে বেডরুমের, কোথাও এতটুকু আঁচিল দেখলেই সেটা পরিষ্কার করে ফেলবে তৎক্ষণাৎ কিন্তু তার পরিবর্তে দুটো বাঁকা কথা আমার বরাদ্দ। আমি নিশ্চিত, স্বচ্ছ ভারত অভিযানে সামিল হলে ও একটা কেউকেটা কিছু হতে পারত। স্বচ্ছতায় ও একেবারে লেটার মার্ক্স আর আমি মেরেকেটে দুই কি তিন। অতএব লাগ লাগ লাগ ভেল্কি নারদ নারদ। তো এই বৌ-বাচ্চার যাঁতাকলে চাপা পড়া আমি নিরীহ মানুষ যদি এই এক মাসের মুক্তি একটু রেলিশ করি তাহলে সংসারী মানুষের পরীক্ষায় আমায় দশে শূন্য দিয়ে ক্লাসরুমের বাইরে কান ধরে দাঁড় করিয়ে নিশ্চয়ই রাখবেন না। আচ্ছা এখানে একটা কথা না বলে রাখলে সত্যের অপলাপ হবে যে আমি নিরীহ মানুষ এই মতবাদটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত। আমার স্ত্রীয়ের মতবাদ হল আমার মত ঝগড়ুটে খিটখিটে মানুষ ত্রিভুবনে নেই।
তাই টিকিট কাটার পরে প্রথম প্রথম আনন্দই হচ্ছিল এক মাসের পূর্ণ স্বাধীনতা আর তত পরবর্তী কলকাতায় গিয়ে স্ত্রী সন্তানের সাথে পুনর্মিলিত হওয়ার কথা ভেবে। ওদের কলকাতা যাত্রার দিনটা দুর্গাপূজার পরে। দেখতে দেখতে দুর্গাপুজা এসে পড়ল। শিকাগোয় পুজো বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রমে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা দ্যাবা দেবী দুজনেই। কোথাও নাটকে অভিনয় করছি, কোথাও নাট্য নির্দেশনা সব মিলিয়ে একেবারে যাকে বলে শিকাগো সরগরম। প্রবাসী বাঙ্গালিদের মধ্যে বাঙ্গালিয়ানা ধরে রাখার যে চাড়টুকু থাকে গড়পড়তা কলকাতার বাঙালিদের মধ্যে সেটা থাকে না। কারণ কলকাতার বাঙালিরা এমনিই বাঙালি। কেউ তাদের বাঙ্গালিত্ব কষ্টি পাথরে যাচাই করতে আসে না। কিন্তু সেই সুবিধা দিল্লি কি শিকাগোর বাঙালির নেই। তাই প্রতি মুহুর্তেই ঝাঁপ দিতে হয় বাঙ্গালিত্বের অগ্নিপরীক্ষায়। তাই দুর্গাপুজো হোক বা নববর্ষ, বাঙালি সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাজি সাজিয়ে বসে পড়তে হয়। আর তাই এই দুর্গাপুজোর আগে আগে চোখে নাকে দেখতে পাওয়া যায় না। চওড়া কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে দুর্গাপুজোটা যখন উতরে দিলাম তখন দেখলাম ওদের দেশে যাওয়ার দিনটা আর দুদিন পরে। আশ্চর্য ব্যাপার হল টিকিট কাটার দিনে মনের মধ্যে যে তিরতিরে গঙ্গা ফড়িংটা উড়ে বেড়াচ্ছিল সেটাকে আর অনেক খুঁজেও কোথাও পেলাম না। বিয়ের ভাঙ্গা আসরের মতই রশনচৌকি ঝুপ করে বন্ধ। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন ফাঁকা। নিয়ন আলোয় ভরা ম্যাডিসন স্কোয়ারে যেন ঝুপ করে হয়ে গেছে লোডশেডিং। অথচ এই দিনটার প্রত্যাশাতেই বসে ছিলাম কিছুদিন আগেও। কিন্তু আজ যখন মানুষ দুটোর দেশে যাওয়ার দিন দুয়েক বাকি, আসন্ন আমার অখণ্ড স্বাধীনতা আর অবসর, অলক্ষ্যে অপলকে তাকিয়ে থাকি আমার দু বছরের ডানা লোকানো ছোট পরীটির ঘুমন্ত মুখের দিকে। মুখ ফুটে জিগ্যেস করতে পারি না কিন্তু হঠাতই অকারণে জানতে ইচ্ছে হয় আমার সাত বছরের সঙ্গিনীটি কলকাতা ট্রিপের হই হট্টগোলের মধ্যে আমায় মিস করবে কিনা। বিদায়ী মুহুর্তটিতে চোখে একটা অস্বস্তকর বিচ্ছিরি জ্বালাধরা ভাব। “ভাল ভাবে যেও” বলতে বলতে চোখ ফিরিয়ে নিতে হয় কারণ চোখের মধ্যে অবাধ্য কিছু গ্ল্যান্ড সিক্রেশান শুরু করেছে। বিশ্বাস করুন আমি একেবারে কাঁদুনি ছিলাম না। কিন্তু আজকাল কারণ অকারণে হঠাৎ হঠাৎ চোখের পাতা কেমন ভারি হয়ে আসে। কোন ছায়াছবির করুণ রসাত্মক কোন দৃশ্য হোক বা কলকাতা থেকে ফেরার সময় এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা মার মুখের দিকে তাকিয়েই হোক চোখটা বড়ই নিয়ন্ত্রণ হারায় আজকাল। আসলে মায়া বড় প্রবঞ্চক। যত দিন যায় মানুষকে তার অদৃশ্য গুটিপোকার জালে আস্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে। নিজের মুখ নিঃসৃত লালারসে বিজারিত করে কখন যে আমাদের সকলকে আমি থেকে আমরা করে দেয় টেরই পাওয়া যায় না।
যাই হোক বিদায়ী মুহুর্তটা কেটে যাওয়ার পরে সারাদিন অফিসের কর্তব্য সামলে সন্ধে বেলা যখন বাড়ি ফিরি দেখি আমার বাড়ির সব আসবাব, সকল সামগ্রী সেই মানুষ দুটির জন্য যেন নীরবে প্রতীক্ষা করছে। যে দুটো মানুষের হাঁকডাকে আমার স্বাধীনতা নিত্য বিপন্ন আজ এই শূন্য ঘরে তাদেরই গলার স্বর শুনতে মন হয়ে ওঠে উচাটন। পরিপাটি করে ভাঁজ করে রাখা জামা প্যান্টে, সেলফে গুছিয়ে রাখা চায়ের কাপে সর্বত্র খুঁজে পাই আমার স্ত্রীয়ের ছোঁয়া। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা পুতুল আর খেলনা গাড়িগুলোকে দেখলে সেই ছোট্ট দুরন্ত মানুষটার কচি আঙ্গুলগুলোকে ছুঁয়ে দেখার লোভে আমার আঙ্গুলগুলো ব্যাকুল হয়ে ওঠে। শাস্ত্রে বলে “ত্রিয়া চরিত্রম দেবা ন জানতি” অর্থাৎ মেয়েদের বোঝা দেবতাদেরও অসাধ্য। কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হল পুরুষের মন জানাও বোধ হয় দেবতাদের অসাধ্য – শুধু দেবতাদের কেন নিজের পক্ষেও নিজের মন জানা মোটেই অনায়াসসাধ্য নয় এই উপলব্ধি আমার শিরায় উপশিরায় এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল।