বাংলা – রম্যরচনা

“হুঁকোমুখো হ্যাংলা বাড়ি তার বাংলা” বলে গেছেন সুকুমার রায়। ভদ্রলোককে নস্ত্রাদামুস পুরস্কারে ভূষিত করতে মন চাইছে কারণ এত বড় একটা ভবিষ্যবাণী এত দিন আগে থেকে করে রাখা চাড্ডিখানি কথা নয়। কারণ সত্যি সত্যি পশ্চিমবঙ্গ ওরফে ওয়েস্ট বেঙ্গল নাম বদলে বাংলা হতে চলেছে, স্রেফ বাংলা মানে বাংলা বাংলা আর কি। ইতিহাসের কুইনাইন খাইয়ে মাথা ধরানোর ইচ্ছে নেই। তবু একটু ফ্ল্যাশব্যাক। এই ধরুন সাত আট শতক আগে ছিল অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ অর্থাৎ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা। অবশ্যই এর মধ্যে বঙ্গ আমাদের বাংলা। বঙ্গ কেমনে বাংলা হল সে কথা সুনীতিকুমার ভাল জানবেন। আর এখন গুগল করতে ইচ্ছে করছে না, তাই আমার অনুমানটা বলি। লিপিস্টিক আবিষ্কারের অনেক আগে বঙ্গললনারা তাম্বুল রাগে তাদের বিম্বোধর রঞ্জিত করত। খটোমটো বাংলা হয়ে গেল? মানে পাতি বাংলায় পান খেয়ে ঠোঁট লাল করত যাতে প্রিয়পুরুষটির হার্টরেট এই ধরুন টেন পার্সেন্ট বেড়ে যায়। পান খাওয়া ভাল জিনিস – নেশাকে নেশাও হয়, সাথে প্রসাধন ফ্রি। পরে ম্যাক, রেভলনের তন্বী সুন্দরী লিপস্টিকরা এসে পানেদের সেই একচেটিয়া ঠোঁটবাজার কিছুটা খেয়ে নিয়েছে কিন্তু সে কথা অন্য। কথা হচ্ছিল বঙ্গ কি করে বাংলা হল। আমার মনে হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পান-খাওয়া বাঙালি পান খেয়ে দেশের নাম বলতে গিয়ে একটা এক্সট্রা ল জুড়ে দেশের নাম বানিয়ে দেয় বঙ্গ’ থেকে বঙ্গাল, মানে ঐ অতিরিক্ত ল টা মুখভর্তি পানের পিকজাত আর কি! অবশ্যই এটা আমার অনুমান। যাই হোক, বঙ্গাল শব্দটা ভারি গুরুগম্ভীর ছিল, বঙ্কিমি স্টাইল। অথচ মানুষ গুলো চরম ল্যাদ। জিভের ওপর অযথা স্ট্রেস দেওয়া স্বাস্থ্যকর নয় ভেবে আমরা নিজেদের বঙ্গালী থেকে বাঙালি করে নিয়েছি আর সেই সাথে বঙ্গালকে বাংলা। বাংলাটা কেমন বাংলা শোনায় না? বেশ একটা হৃদয়ের সংযোগ, একটা সখ্যতা স্থাপন হয়, ঠাট্টা ইয়ার্কি চলে। বঙ্গালের সাথে বোধ হয় তেমনটা চলত না? কিন্তু যারা সেই বনিকের মানদণ্ড নিয়ে এসে ছক করে সেটাকে রাজদণ্ড বানিয়েছিল, সেই ইংরেজ জাতি কিন্তু সিরিয়াস জাতি। তাঁরা এই বাঙালি বালখিল্যপনায় যোগ না দিয়ে ওরিজিনাল নাম বঙ্গালটাই ধরে রাখলো। শুধু বঙ্গালকে বেঙ্গল করে নিলো নিজেদের সৃজনশীলতার পরিচয়স্বরূপ বোধ হয়। স্বাধীনতার সময় এক বাংলা কাঁচি হয়ে মাঝে কাঁটাতার পড়ল। সঙ্গে পড়ল অনেক গ্যালন রক্ত ফ্রীতে। আমরা হয়ে গেলাম ওয়েস্ট বেঙ্গল বা পশ্চিমবঙ্গ। এদিকে হুকোমুখো তাকে তো সেই মহান শিশু কবি সুকুমারবাবু বলে গেছেন “তোর বাড়ি বাংলা”। সে বেচারি গুগল মাপে খুঁজে খুঁজে মরে। দেশের ম্যাপে না পেয়ে খোঁজ করে দেখে একটা বিদেশ আছে যার নাম বাংলাদেশ। তো হুকোমুখো সেখানেই গিয়ে স্থায়ী আস্তানা গাড়তে বিদেশমন্ত্রকের কাছে আবেদন জানাবে ভাবছে, এমন সময় পশ্চিমবঙ্গ নাম বদলে হয়ে যাচ্ছে বাংলা। হুকোমুখো শেষমেশ দেশবাসী হল। “বাংলা” শব্দটার আরও একটা মানে বাড়ল। বাংলা বলতে একটা রাজ্যও হল। শব্দটা অলরেডি বহু অর্থবাহী, অনেক connotation। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।

“তুই বাংলা বল না এই কাজটা তোর দ্বারা হবে না” – এখানে “বাংলা বলা” অর্থে “পরিষ্কার করে বলা”। তারপর ধরুন, “কোথায় বাংলা বসে বসে একটু খেলা দেখব তা না বস ফোন করে ভাটাচ্ছে” – এ ক্ষেত্রে “বাংলা” মানে হল “আরাম করে”। তারপর ধরুন পাড়ার দাদা বলছে “এই যে চাঁদু বাংলা বোঝো না? এ পাড়ায় দোকান চালাতে হলে কেলাব ফান্ডে মাল্লু ছাড়তে হবে” – এখানে “বাংলা” মানে “সোজা কথা”। তারপর “আজকে স্কুলের লাস্ট পিরিয়ড দুটো বাংলা কাটিয়ে দে। রাম তেরি গঙ্গা মইলি পার্ট টু এসেছে। এবারে মন্দাকিনীর জায়গায় সানি লিয়নে” এখানে “বাংলা কাটিয়ে দেওয়া” মানে “পাতি কাটিয়ে দেওয়া”। এ তো গেল বাংলার অব্যয় রুপে ব্যবহার। বাংলার বিশেষ্য বা নাউন ব্যবহার-ও আছে। যেমন ধরুন “খোট্টা গুলো বাংলা জানে না” এখানে বাংলা মানে বাংলাই, মানে বাংলা ভাষা আর কি! বাংলা খেয়ে বিষক্রিয়ায় দশ বিশ জন সুধী বাঙালি যখন পটলডাঙার বাসে চড়ে বসে, বুঝতে অসুবিধে হয় না কোন অমৃতসুধা বাংলার কথা বলা হচ্ছে।  বাংলার বিশেষণ ব্যবহারও আছে। যেমন ধরুন “ব্যাপারটা খুব বাংলা হয়ে যাচ্ছে না?” এখানে “বাংলা” মানে “সাধারণ, পাতি”। বাংলার আগে জয় জুড়লে আবার চোখে পড়তে হয় রোদচশমা। বাংলা নামে দেশ আছে সে কথা আগেই বলেছি। এখন দুগ্গা দুগ্গা বলে একটা রাজ্য নেমে গেলেই সোনায় সোহাগা হয়।

শুধু দুঃখ হচ্ছে কিছু ক্যালকেশিয়ান বাংলা মায়ের জন্য যাদের অ্যাংলো পোলাদের বাংলাটা ঠিক আসে না। একেই রাস্তায় ঘাটে বাসে ট্রামে ডিসগাস্টিং বাংলা ভাষা শুনে কানে আঙুল দিতে হয়, তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া হবে এখন আবার বাংলা রাজ্যে থাকতে হবে। ওয়েস্টবেঙ্গল নামটার তাও কিছু কৌলিন্য আছে, হাজার হোক ব্রিটিশদের দেওয়া, মহারাণীর ব্লু ব্লাডের একটু ছিটেফোঁটা তো আছে নিশ্চয় তাতে। কোথায় নাম বদলে ব্রিটেনের অনুকরণে ব্রিটানিয়া (নট মেরী গোল্ড) রাখবে তা না নাম বদলে বাংলা? This is utter rubbish.

তবে ভাগ্যি ভাল, রাজ্যের নাম বদলে বাংলা করছে, হাওড়া ষ্টেশানের নয়। মেট্রোরেল টিকিট কাউন্টারে অলরেডি লোকজন দেদার তিনটে নজরুল, দুটো রবীন্দ্রনাথ কিনে নিচ্ছে মাত্র পঞ্চাশ টাকায়। ভাবুন? তিন তিনখানা নজরুল, দু দু খানা রবীন্দ্রনাথ, মূল্য মাত্র পঞ্চাশ টাকা। হাওড়া ষ্টেশানের নাম বদলে বাংলা করলে বাংলাও রোজ বিক্রি হত জলের দামে। এ কথা শুনলে রাজা লক্ষন সেন তো বখতিয়ার খিলজির কাছে তাড়া খেয়ে পালানোর আগেই কাঁসাই নদীতে ডুবে মরতেন। ওপারে বাংলা দেশ থাকুক, এপারে বাংলা রাজ্য থাকুক, দুই পারেই বাংলা ভাষা আর বোতলভর আকণ্ঠ নেশার পানীয় বাংলা থাকুক, কিন্তু ষ্টেশান না হলেই হল।

কবি জীবনানন্দ বলেছেন “আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়”। ধানসিঁড়ি না হয় ওপার বাংলা ভাগে পেয়েছে, কিন্তু আমাদের রূপনারাণ আছে, তিস্তা, জলঙ্গী আছে আর এখন থেকে আমরাও বাংলা। তাই তিস্তা, মহানন্দার তীরে এপার বাংলায় তিনি ফিরতে চাইলে আমরা হই হই করে নিয়ে নেব কবিকে।

Leave a Reply