বাগেদের বাগাড়ম্বর

তা হয়েছে কি শীত গিয়ে বসন্ত এসে পড়েছে। ফাগুন হাওয়ায় দুলে দুলে নতুন ফোটা ফুলের গরবে গরবিনী, সদ্য যুবতী গাছগুলো নিজেদে মধ্যে চুপকথা শুরু করে দিয়েছে। রতিদেবী ঘুরে ঘুরে পুষ্পশর ছুঁড়ছেন আপন খেয়ালে। আর তার ফলে পোকা মাকড়েরা ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি করে নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে চলেছে। তা আপনি জিজ্ঞেস করবেন তা তোমার বাপু তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। পোকামাকড়েরা যা করছে করুক, তোমার তাতে কি?

কথা ঠিক, কিন্তু এ কথা আমার ছোটকন্যাকে বোঝায় কে? তাকে কিছুদিন হল বাগে পেয়েছে। অর্থাৎ কিনা সে বাড়ির বিভিন্ন প্রত্যন্ত অংশে মানে ধরুন খাটের নিচে, সোফা ও কফিটেবিলের মাঝের অতি সংকীর্ণ পরিসরে, সিলিঙে, টবে বসানো গাছের গোড়ায় ছোট বড় মাঝারি, সবুজ লাল গেরুয়া, একলা কিম্বা সমবেত, স্থির কিম্বা চলমান পোকা এবং মাকড়দের খুঁজে বের করছে আর বাড়িতে ডাকাত পড়লে লোকে যেভাবে তারস্বরে চিৎকার করে, সেইভাবে চিৎকার করছে, “বাবা বাগ।” বিবাগী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে।

তাকে যতই বলি বাগেদের কেউ কোনোদিনই বাগে আনতে পারে নি, তারা পরব্রহ্মের মত সর্বভূতে ও সর্বস্থানে বিরাজমান কে শোনে কার কথা? তারা নিজগুণেই এত জলদি নিজেদের জ্ঞাতিগুষ্টিকে ডেকে আনে, যে তাদের গুনে শেষ করে, সাধ্য কার। কিন্তু কন্যা শুনলে তো? সৃষ্টি পূর্বে শ্রীবিষ্ণু অনন্ত শয্যায় ছিলেন। আমি সেই আদিপুরুষের দ্বারাই সম্ভবত অনুপ্রাণিত হয়ে এবং আমার দ্বারা কোনোকিছু সৃষ্টি সম্ভবপর নয় জেনে যোগনিদ্রায় শরীর এলিয়ে রাখা পছন্দ করি। কিন্তু তাথৈইয়ের বাগ সন্দর্শন হলেই  প্রথমে চিৎকার করে বাবা বাগ। সেই চিৎকারে আমার যোগনিদ্রা টলাতে না পেরে ছুটে এসে তার খুদে আঙুল আঙুলে জড়িয়ে টানতে থাকে। মানে আমাকেও গিয়ে দেখতে হবে। আরে দেখে হবেটা কি ছাতা? তারা মোটেই আমায় ডরায় না। আমার নাকের ডগা দিয়ে তারা সকলে “আমরা সবাই ড্যাং ড্যাং” করে চলে যাবে।

বাগেদের কে কবে বাগড়া দিতে পেরেছে? পোকাদের কে কবে বোকা বানাতে পেরেছে? মাকড়দের কান পাকড় করে বাড়ি থেকে বের করে দিতে কে কবে পেরেছে? বাগান থেকে বেগুণ, বাগে কাটা নান থেকে বাগনান, গোলাপবাগ থেকে আরামবাগ সর্বত্র বাগেদের অবাধ বিস্তার। প্রবল প্রতাপশালী  ডাইনোসররাই যাদের ঠিকানা লাগাতে পারে নি, তাদের আমি ঠেকাই কি করে? বাগেদের ওপর রাগ করে করবই বা কি, তারা আমার রক্তচক্ষুর পরোয়া করে না। সমস্ত রকম বাগ স্প্রে ট্রাই করে ফেলেছি। তাদের নিকেশ করা তো দূরের কথা, তাদের কেশকর্ষণ (এর খারাপ বাংলাটা আর বললাম না। সমঝদারের জন্য ইশারাই যথেষ্ট) পর্যন্ত করতে পারি নি। বাগেদের ওপর রাগ করার থেকে বাগেশ্রী রাগ শিখে ফেলা সোজা। বাগদেবীর দেখা পাওয়া যদি বা সম্ভব হয় বাগেদের বাগে আনা নেহাত অসম্ভব। বাগদের ওপর রাগ করে আপনার রক্ত টগবগ ফুটতেই পারে, কিন্তু তাতে বাগবাহিনীর কিছু যায় আসে না। তারা জাঁক ভরে ঘুরে বেড়াবে বাড়িময়। বাগেদের ডিবাগ করার থেকে ব্যাগাডুলি খেলা ঢের সোজা। তর্কবাগীশকেও তর্কে হারাতে পারবেন, কিন্তু বাগেদের টর্কে (torque) আপনি নাজেহাল হবেন নি।

কথায় আছে না, নরকের কীট। নরকেই যারা মহা আনন্দে উৎসব করে, এই মর্ত্যে তাদের প্রভাব ও আধিপত্য যে অপ্রতিম হবে তাতে আর আশ্চর্য কি? কীটেদের ঢিঁট করতে পারে এমন কিরীটী মর্ত্যলোকে নেই। কীটেদের হারায় এমন হিরো কেই বা আছে? যাক গে আর বাগবিতণ্ডায় গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু আমাদের তাথৈশ্রী বাগুলার বাগপ্রীতি কমায় সাধ্য কার?

Leave a Reply