“ঈশ্বর পৃথিবী ও ভালোবাসা” পড়লাম। শিবরামের আত্মচরিত। শিবরামের হাসির রচনাগুলির কথা সকলেই জানে। পড়েছেন আপনিও। আমিও। কিন্তু এ একেবারে অন্যরকম। এই আত্মজীবনীটিতে হাসির উপদান থাকলেও এমন গভীর তত্ত্বকথা আছে যে পড়লে যারপরনাই বিস্মিত হতে হয় যে এ কি সেই একই লোকের কলম থেকে নিঃসৃত হয়েছে? আমার সেই বালক বয়সে আমার দাদু বলেছিল এই বইটির কথা। কি আশ্চর্য দেখুন চল্লিশটা বসন্ত পার করে সেই বইয়ের ধার আমায় ধারতে হল। পড়লাম এসে এতদিনে এক দাদার রেকমেন্ডেশানে। দেবাশিসদা। এ বইতে শিবরামের জ্ঞান ও বুদ্ধিচ্ছটাতে প্রতিটা বাক ও বাক্যাংশ যেন হীরক খণ্ডের মত ঝলমল করছে। এমনই তার লেখনীর মধু যে মধুমক্ষীর মত তাতে মজে রইলাম। এমন বর্ণনা যে এক বর্ণ না পড়ে থাকতে পারলাম না। সাড়ে চারশো পাতার পথ সাড়ে চারদিনে ধুলো উড়িয়ে গেলাম। ধূলিবিজড়িত অবস্থায় শেষ পাতা অব্দি পড়ে তবে পরিত্রাণ। নিজেরই গল্প এত সরস করে বলা যায়, নিজেকেই একটি মহাকাব্যের প্রোটাগনিস্ট করে এমন ধারা দাঁড় করানো যায়, এ বই পড়ার আগে তা শুধু একবারই দেখেছি। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মহাস্থবির জাতকে। সেটিও তাঁর আত্মচরিত।
মহাস্থবির জাতক বইটির সঙ্গে আমার পরিচয় কিছু নাটকীয়। আসল কথায় আসার আগে সেইটি বলে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। বইটার নাম আমি কোনোদিন শুনি নি আগে। কেমন করে যে এমন একটা বহুলচর্চিত বই আমাকে রীডার করে নি, আমার রাডার এড়িয়ে ছিল বহুদিন, তা জানি না। কয়েক বছর আগের কথা। একদিন কলেজ স্ট্রীটে একটি বইয়ের দোকানে ঢুকেছি দু একটি বই সংগ্রহ করতে। বইয়ের তাক থেকে একটু চোখ সরাতে দেখি কোন ফাঁকে পাশে ঝলমল করছে এক ছিমছাম সুন্দরী। সেই রমণীয় রমণী কোন বই সংগ্রহ করেন বইয়ের আড়তে দাঁড়িয়ে আড়চোখে তাই দেখতে থাকি। রূপই তো তছরুপ করি আমরা বইয়ের পাতায়। সে রূপ যদি অমনি এসে পাশে দাঁড়ায় তবে বই খোঁজা কিছুক্ষণ বন্ধ রাখা যায় বই কি! তো তিনি কিনলেন একটি এক মণ ওজনের বই। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মহাস্থবির জাতক। আমি তখন স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যেমন ধীরে তিনি এসেছিলেন তেমনই ভিড়ে মিলিয়ে গেলেন। আমায় কিছু অধীর করে হয়তো। তো দোকানদার জিগ্যেস করল, আপনার কোন বইটা চাই যেন। কোনটা চাই তখন কি ছাই মনে পড়ে! বললাম ওই। ওই মানে কোনটা? মানে ওই। মানে উনি। মানে উনি যেটা কিনলেন। বইটা হাতে পেলাম এভাবেই। হাজার পাতার বই। সে বই পড়ে আতর্থীবাবুর জীবনের সিনেমার অলীক কল্পলোকে যখন বিচরণ করেছি, তখন মনে মনে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছি সেই ক্ষণিকাকে।
কিন্তু কথা হচ্ছিল “ঈশ্বর পৃথিবী ও ভালোবাসা” নিয়ে। মহাস্থবির জাতকের জাত আর “ঈশ্বর পৃথিবী ও ভালোবাসা”-র জাত এক হলেও মানুষ দুটো জাতে এক নয়। প্রেমাঙ্কুর অঙ্কুর বেলা থেকেই পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন শহর থেকে শহরে। আর শিবরাম জাত ঘরকুনো। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস না করে পাশ কাটিয়ে সেই যে কলকাতার একটি মেসবাড়িতে এসে ঢুকেছিলেন ওখান থেকেই গেছেন অনন্তের পথে। তবু সেই ঘরকুনো জীবনও যে এমন একঘর হতে পারে তা শুধু পড়লে বোঝা যাবে। আনন্দবাজার পত্রিকা বিক্রি করে এবং অর্জিত সামান্য টাকায় আনন্দ করে ম্যাটিনি শোয়ে আর নাইট শোয়ে শয়ে শয়ে ছবি দেখে আর রাবড়ি খেয়ে যে জীবনের শুরু সেই জীবনেরই উত্তরণ সেই আনন্দবাজারেরই কলাম রাইটার হিসেবে যার হকারই তিনি করতেন। মাঝখানে ইংরেজ সরকারের হাতে দেশদ্রোহের নামে জেলে যাওয়া, দেশবন্ধুর ইচ্ছায় আত্মশক্তি কাগজের সম্পাদনা আর সুভাষচন্দ্রের হাতে চাকরি নট, বিধানাবাবুর কাছে রোগের অজুহাত নিয়ে চাকরির একটা রেফারেন্স পেতে যাওয়া কত যে মজার ঘটনা সে বলার মত না। এক চোর তাঁর ঘরে এসে এক ফোঁটা কিছু চুরি করার জিনিস না পেয়ে দশটা টাকা রেখে গেল। সঙ্গে চিঠি। “তুমি ভাই লেখো টেখো দেখছি। কিন্তু খেতে পাও না মনে হয়। তাই এই টাকা কটা দিয়ে ধুপ কিনে এনে বেচো। অন্নসংস্থান হবে।” সব ঘটনা মজার হয়তো না যেমন জীবনের প্রারম্ভে দিনের পর দিন ফুটপাথে শোয়া আর দিনের পর দিন উপবাসের জঠর জ্বালায় ভোগা খুব মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা নয়, কিন্তু বলার গুনে বা বৈগুণ্যে তা এত রসসিঞ্চিত হয়েছে যে জামবাটি ধরে ধরে খাওয়া যায় সে রস। তবে এ লেখার অবতারণা পাঠ প্রতিক্রিয়া নয়, বলা যেতে পারে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।
প্রথমটি হল, দুটো আত্মচরিত দেখেই একটা জিনিস মনে হচ্ছিল সেই কথাখানাই লিখি। প্রেমাঙ্কুর শিবরাম দুজনেই বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে তবে দুজনেই বাউন্ডুলে। আর সেই বাউন্ডুলেপনাই তাদের বাউন্ডারি বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক। যে কথাটি দুজনেই লেখেন নি, কিন্তু লেখার মধ্য দিয়ে ফল্গুর মত প্রবাহিত সেটা হল, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্মো ভয়াবহঃ। সত্যিই তাই। মানে অন্যের ধর্মের প্রতিপালন করার থেকে নিজের ধর্মে মরা ভাল। এ ধর্ম হিন্দু কি ইসলাম নয়। এ ধর্ম স্বধর্ম। ধৃ ধাতু থেকে উৎপন্ন ধর্ম মানে যা আমাদের ধারণ করে। শিবরামের অনুকরণে বলতে গেলে বলতে হয় ধর্ম মানে যা ধারণ করে মানে ধার অন করে আমাদের ধারালো করে দেয়। শিবরামের আত্মচরিতে দেখি একটা অংশে ভদ্রলোকের বহুদিন অন্নসংস্থান নেই। মল্লিকবাড়ির লঙ্গর খানায় ভিখিরিদের সঙ্গে খেয়ে জীবনধারণ। এমন সময়ে কেউ একজন তাকে একটি বিজ্ঞাপন লিখিয়ের চাকরি দিচ্ছে। মাস মাইনে খারাপ না। শিবরাম বাড়ি বয়ে সে চাকরি প্রেমেন মিত্তিরকে দিয়ে এলো। প্রেমেন জিগেস করছে, তুমি তো খেতে পাচ্ছ না। করো না কিছুদিন চাকরিটা। শিবরাম বলছেন, না ভাই, আমি দশটা পাঁচটা চাকরি করতে পারব না। এক পেটের অধীন হয়ে নিজের বাকি সব স্বাধীনতা খোয়াতে পারব না। চিন্তার এই স্বচ্ছতা, clarity of thought ছিল বলেই শিবরাম খেতে না পেয়েও বেঁচে গেলেন। মানে শুধু জীবনকালে বাঁচলেন না। মরার পরে বেঁচে রইলেন আপামর বাঙালির জনমানসে। যে কাজে তাঁর মন লাগে না, শত মন্দার দিনেও তেমন কাজে তাঁকে কলুর বলদের মত জুড়ে দিতে পারে নি সমাজের জাঁতাকল।
অনেক লেখকেরই জীবনে এরকম সংগ্রাম দেখা যায়। প্রকাশকরা তাঁর সাহিত্যশ্রমের দাম দেবে না, অন্য লেখকেরা গুঁতো দেবেন, লেখক খেতে পাবেন না ইত্যাদি। আজকে যখন ফেসবুকে অনেক সখের লেখককে দুঃখ করতে দেখি আমার লেখা কেউ পড়ে না, আমায় কেউ লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দিল না ইত্যাদি তখন মনে হয় বলি, আপনি আপনার জীবনের পান থেকে চুন খসালেন না, সংগ্রাম দূর অস্ত এক গ্রামও ত্যাগ স্বীকার করলেন না, অথচ অমরত্বের খাতায় নাম লেখানোর প্রত্যাশী তা কি হয়? আপনি স্ট্রাগল করবেন না, স্মাগল করে যশ খ্যাতি নিয়ে যাবেন পাঠককুল তেমন ছাগল নয়।
আর দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি লক্ষ্য করলাম সেটা আতর্থীর ব্যাপারেও লক্ষ্য করেছিলাম। কথাটা কিছুদিন আগে চন্দ্রিলও বলেছিল মনে হয়। বাঙালি এক সময় একটু আলগোছে বাঁচতে জানত। মানে প্রথাগতভাবে পড়াশুনো, চাকরি, বিবাহ সন্তানাদি করা ছাড়াও আরও একটি অল্টারনেটিভ পথ খোলা ছিল আগেকার দিনে বাংলায় (অন্যান্য প্রদেশ বা দেশের খবর জানি না)। ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী হয়েও তখনকার দিনে কেউ কেউ সেই পথে হাঁটত। মানে পরীক্ষায় কিছুতেই পাশ হবে না জেনে যারা স্কুল পালায় সেই ধারার নয়, বরং কলেজের প্রথম দ্বিতীয় পদাধীকারীদের কলিজায় ব্যাথা হলে পারে এরকম ধরণের প্রতিভাশালী কিছু লোকও প্রথাগত শিক্ষার ধার না ধেরে, মানে বাংলায় বলে নিজেকে ধেড়িয়ে দিয়ে বসেছিলেন। তাদেরই কেউ কেউ হয়তো অমরাবতীর পথে যাত্রা করার পরেও জনমানসে অমর হয়ে রয়ে গেছেন । আজকের দিনে সেই সম্ভাবনা কোথায়? রবীন্দ্রনাথকেই দেখুন। প্রপার স্কুলিং হলে তাঁর প্রতিভার এমন স্ফুরণ হত কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অলীক অসম্ভবের সব সম্ভাবনা নিকেশ করে দেওয়ার নাম এডুকেশান। পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন সব নিউক্লিয়াসকে বৃত্তাকারে ঘুরছে ঠিকই। ওরা আমার আপনার মত কলুর বলদ। কিন্তু থাকে কিছু ফ্রী আয়ন। তারাই বিদ্যুৎ পরিবহন করে। এই শিবরাম চক্কোত্তির মত মানুষগুলো তখন ছিল এইরকম ফ্রী আয়ন। কেউ ধরে বেঁধে ধরাবাঁধার গণ্ডীতে আনতে পারে নি। তাই ইনি নিজের সম্পূর্ণ আত্মশক্তিটা দিতে পেরেছেন ভাষার একটু সম্পূর্ণ নতুন ধারার প্রণয়ন করতে। কিন্তু আজকের দিনে সম্ভাবনাময় কোন ছাত্র স্কুল কি কলেজ পালিয়ে ভ্যাগাবন্ড হয়ে যাচ্ছে তার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। প্রায় শূন্যই হয়তো। তাই সাহিত্য কি শিল্পেও সম্পূর্ণ একটা গোলামাল কিছু হওয়ার চান্সও ওই গোল্লা।
যাই হোক মহাস্থবির জাতক আর ঈশ্বর পৃথিবী ও ভালবাসা পড়ে ফেলুন। এমন কাহিনি, জীবন নিয়ে এমন ছিনিমনি, এমনটা আর পাবেন না। পড়তে ল্যাদ লাগে জানি, কিন্তু পড়তে আরম্ভ করলে গল্পের মধ্যে এমন লেদিয়ে যাবেন যে কখন শেষ পাতায় পৌঁছবেন বুঝতেই পারবেন না।