করোনার ক্যারিস্মায় দুসপ্তাহ হল গৃহবন্দী।
বাড়িতে বেসমেন্ট আর তিনতলা মিলিয়ে কটা সিঁড়ি আছে গুনে ফেলেছি। Cosco আর Whole Foods-এর মধ্যে কাঁচা সব্জির দামের তুলনামূলক বিচার করে নিয়েছি। করোনা নিয়ে আড়াই হাজার Opinion Piece, আর তিনশ আটানব্বইটা “ভাইরাল ভিডিও” দেখে ফেলেছি। সমগ্র ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চার বছরে যা শিখেছি, গত দু সপ্তাহে করোনা এবং ভাইরোলজি সম্বন্ধে তার থেকে বেশি জেনে ফেলেছি। এই রিসেশানের বাজারে চাকরিটা গেলে নিশ্চয়ই Virologist হিসেবে ডক্টর ফসি’র সহকারী হিসেবে চাকরি বাঁধা। প্রতি আড়াই দিনে একবার করে সানাইকে পড়তে বসানোর একটা বিফল চেষ্টা করে ফেলেছি। দিনে পৌনে তিনখানা করে আমার ছোট মেয়ে তাথৈ আর বড় মেয়ে সানাইয়ের ঝগড়া সমাধান করে ফেলেছি। দেড়খানা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুএজ শিখে ফেলেছি। পৌনে দু খানা উপন্যাস শেষ করে ফেলেছি। যে ভাবে আগে ক্রিকেট সম্রাট শচীনের স্কোর ট্র্যাক করতাম সেরকম করে করোনায় লোকান্তরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ট্র্যাক করছি পাঁচ মিনিট অন্তর। তারপরেও তো সারাদিন সময় কাটে না। তাই সারাদিন খাই খাই করছি। কিচেনের আশেপাশে পোষা বিড়ালের মত ঘুরঘুর করছি নিজের অমতেই। Involuntary Motion-এর মত নিজের অজান্তেই হাত চলে যাচ্ছে ছোলার ডিব্বেতে, কেকের প্যাকেটে, কিম্বা চানাচুরের বোয়ামে। দু মাস এমন চললে “ছোটা হাতি” হয়ে বেরোবো সন্দেহ নেই। কিন্তু মুসকিলটা অন্য জায়গায়। আমার যদি “খাই খাই” রোগ লেগে থাকে তবে আমার ছোট কন্যার (আপাতত এক-বছর-কত-জানি-মাস বয়স তার) “খাও খাও” রোগে ভুগছে। রোগের লক্ষণ বা দুর্লক্ষণ এই যে, যেকোনো ধরণের জিনিস হাতে নিলেই আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলছে “খাও খাও”। শব্দটা নতুন আবিষ্কার করায় ব্যবহার করার ভীষণ তাড়া ওর। এমনটা মনে আছে স্কুল জীবনে নতুন ইংরেজি শব্দ শিখলে হত আমার। যেকোনো সেন্টেন্সেই শব্দটা ফ্যাটাক করে ঢুকিয়ে দিয়ে রিডারের হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দেওয়ার মত আনন্দ কিছুতে ছিল না। সে যাই হোক। প্রসঙ্গে ফিরি। তো আমার মেয়ে যেসকল জিনিস আমায় খেতে অনুরোধ করছে সেগুলো হল এরকম – এক পাটি জুতো (কখনো মানুষের, কখনো পুতুলের), সোফার দুর্গম কর্নার থেকে বের করে আনা ক্ষয়রোগাক্রান্ত, ধসে-যাওয়া কর্নফ্লেক্সের টুকরো, কিচেনের ঘনান্ধকার কোনো গলিখুঁজি থেকে বের করে আনা আনুবীক্ষণিক সাইজের (মোস্ট লাইকলি ইঁদুরে কাটা) বিস্কুটের টুকরো, মাঝে মাঝে সোফিয়া কি রপাঞ্জেলের প্রতিমূর্তি বা ডল ইত্যাদি। আমি চাইনীজ নই। এমন অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়ার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তাই বিনয়ের সঙ্গে সেই বদান্যতা প্রত্যাখ্যান করলে সেই দেড় ফুটিয়া তিরিশ পাউন্ডের অণু মানবীটি ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়। অনেক কটা খুব খারাপ গালাগালি দিয়ে (মনে হয় গালাগালিই হবে কারণ সেই শব্দগুলোর একটাও আমার বাংলা কি ইংরেজি অভিধানে নেই) সে আবার সেই “খাও খাও” কথাটি রিপিট মারে ভাঙা ক্যাসেটের মত। চোখে আশা আর হাতে অখাদ্য নিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে। সানাই খুব উৎসাহের সঙ্গে বুঝিয়ে দেয়, বাবা প্রিটেন্ড খাওয়া খেতে হবে। অর্থাৎ কিনা খাওয়ার অভিনয় করতে হবে। এমন একটা দুর্ঘট ঘটনায় সানাই যে যারপরনাই পুলকিত সে তার চোখ মুখের ঔজ্জ্বল্য দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। পড়তে বসার সময়টুকু ছাড়া ও সবকিছুতেই বেশ ফুর্তি পায়। বিশেষ ফুর্তি পায় বাবা বোনুর হাতে কি মায়ের হাতে নাকাল হলে। পড়তে বসানোর চেষ্টা করা ছাড়া এ জন্মে ওর পেছনে কোনো কাঠি করেছি বলে মনে পড়ে না। পূর্বজন্মের শত্রুতা হবে নিশ্চয়ই। যাই হোক। তাথৈর সেই বাড়ানো ছোট মাপের হাতটা মুখের কাছে টেনে এনে খাবার অভিনয় করতেই কচি মুখে এক মুখ হাসি ফুটে ওঠে এবং সাথে তার কিছু আশীর্বাণী বর্ষায় (আশীর্বাণীই হবে কারণ এ শব্দগুলোও আমার বাংলা বা ইংরেজি অভিধানে নেই)। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চ্যাংদোলা করে হাত ধোয়াতে নিয়ে গেলে সে চেঁচাতে থাকে তারস্বরে “ছেলে দাও। ছেলে দাও।” (না “ছেলে” চায় না, “ছাড়া” পেতে চায়)। আপাতত তার ভাষাশিক্ষা এই অবধি। পেছনে হাততালি দিতে দিতে সানাই অনুগমন করে আমার ও আমার কব্জায় থাকা অসন্তুষ্ট বোনুর।
গ্রহণের করাল ছায়ার মত বাইরে মৃত্যু কেড়ে নিতে থাকে জীবনের জমি। আর চার দেওয়ালের মধ্যে এমন করেই নতুন প্রাণ, নতুন কিছু শাখামৃগ নিজেদের শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে। Death is the only constant. And life is the only derivative.