ছোটবেলায় যারা রাশিফল দেখতেন তারা “স্ত্রী ভাগ্যে ধনলাভ” কথাটা শুনে থাকবেন। তখনকার দিনে স্ত্রীর ভাগ্যে অর্থাগম হত কিনা জানিনা, এখনকার দিনে প্রাডা, ম্যাক, বারবারা-দের বর্বর আক্রমনে সে সমীকরণের সত্যনাশ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ধনলাভ তো দূরের কথা, স্ত্রী যখন শপিং নামক ভয়ানক অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে যায় তখন আপনার যথেষ্ট এবং যথেচ্ছ ধনক্ষয় হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। স্ত্রীভাগ্যে ধনক্ষয় হলেও আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি কারণ স্ত্রীয়ের মুখে কল্যাণময়ী হাসি দেখে হৃদয় দ্রব হয় না এমন পাষাণ হৃদয় কোন পাষণ্ডর? আবার পুরুষদের মধ্যে যারা আরও একটু দুর্ভাগা, যাদের মাঝে মাঝে অল্প বিস্তর প্রেমে পড়ার বদ অভ্যেস আছে তাদের আবার পরস্ত্রী ভাগ্যেও কিছু কিছু কষ্টার্জিত ধনসম্পদ খোয়া যায়। তার ওপর ধরা পড়লে মান মর্যাদা আর সেরকম জাঁদরেল বৌ হলে একপাটি কানের মত মূল্যবান জিনিস খোয়া যেতে পারে কিম্বা বিবাহবিচ্ছেদ ও ভরণপোষণ বাবদ প্রভূত অর্থ ব্যয়। ক্ষতির অঙ্ক খতিয়ে না দেখে যদি লাভের অঙ্ক দেখতে চান তাও অনেকরকম আছে। তার মধ্যে যেমন একটা ধরুন বৈবাহিক বন্ধনে নিজেকে না বাঁধতে পারলে বিবাহিতদের পার্টিতে কিছুতেই চট করে জায়গা করতে পারবেন না। তার ফলে আপনি হাট্টিমাটিমটিমের মাঠে-পাড়া-ডিমের-ডালনা কি ছাগলের-ছদ্মবেশী-কারী কি আমের-আম্মোহনী-চাটনি এরকম বাবার-জন্মে-না-শোনা-ডিশ খেতে পারবেন না। বেনুদির কিচেন কিম্বা সুদীপার রান্নাঘরের ছোঁয়া লেগে এমনতর রান্না করার ছোঁয়াচে রোগ এখন গৃহস্থ বাঙালির ঘরে ঘরে। কিন্তু দুঃখের কথা বেনুদি কি সুদীপারা এখনও কুমার কুমারীদের সেভাবে পকটস্থ করতে পারে নি। তাই তাদের সপ্তাহান্তে বিয়ার সহযোগে মুরগির ঝোল আর ভাত খেয়ে জীবন কাটাতে হবে। বিয়ে করার ইত্যাদি নানাবিধ সুবিধে থাকলেও যে সুবিধার কথা বলতে এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি সেটা অন্য। সেটা হল স্ত্রী ভাগ্যে আজকাল ধনলাভ না হলেও অতি অবশ্যই আপনার ফেসবুক লাইকলাভ হবে। অর্থাৎ কিনা রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন। বন্ধুদের সত্যিকারের পছন্দের তালিকায় আপনি যতই লাস্ট বেঞ্চার হন না কেন, জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসবেন যদি একটি কাজ করেন। সেটি হল ফেসবুকে স্ত্রীসঙ্গে আসুন। সীতা অপহরণের পর বিলাপ করতে করতে শ্রীরামচন্দ্র বলেছিলেন “সীতা ছাড়া আমি যেন মণি হারা ফণী”। আজকের দিনে জন্মালে অবশ্য ফেসবুকে সীতাদেবীকে ট্যাগিয়ে বলতেন “মাই লেডি লাভ ইজ মিসিং। ফিলিং ডিপ্রেসড…”। কিন্তু সে কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে আজকের দিনে বলা যায় “লাইক কর্ম লাইক ধর্ম লাইক চিন্তামণি। লাইক ছাড়া আমি যেন মণি হারা ফণী।” জীবনে লাইকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বেসিকালি ফেসবুক-ইনষ্টাগ্রাম ইত্যাদি গুরুত্বপুর্ণ সফটওয়াররা আমাদের শৈশব ধরে রাখতে সাহায্য করে। কেন বলছি? যেমন ধরুন আমার আড়াই বছরের মেয়ে। তাকে ডাইপার ছাড়িয়ে পটি সীটে বসিয়ে পটি করানোর চেষ্টা চলছে। প্রত্যেকবার সে কাজে সার্থক হলেই সে বলবে “মাম্মা বল। বাবা বল।” অর্থাৎ কিনা সবাইকে “গুড জব” বলতে হবে এবং হাততালি দিতে হবে। বাবা অফিসে গেলে সে দাবী জানায় “ফোনে বল।” অন্যায় দাবী সন্দেহ নেই কিন্তু ওর সাথে তর্ক করতে গেলে যেকোন তর্কালঙ্কার বাচস্পতিও ফেল করে যাবে কারণ একটু পরেই ও কেঁদে নিজের স্কোর বাড়িয়ে নেবে। অতএব বাবাকেও কোন গুরুত্বপুর্ণ ডিস্ট্রিবিউটেড অ্যালগরিদম লেখা থামিয়ে ফোনে “গুড জব” বলতে হয়। মানে ব্যাপারটা হল লাইক পাওয়ার ইচ্ছে। তারিফ পাওয়ার ইচ্ছে। সেই ইচ্ছেটাকে আমল দিয়েই ফেসবুকেদের রমরমা ব্যাবসা। আমার তো মনে হয় ওরা শিশুদের জন্য একটা কিডিবুক বের করতেই পারে যেখানে মিয়া, সানাই, পিকু, হৃদুরা পটি পার্টি করতে পারে, অর্থাৎ পটিতে বসে পটি করে ছবি লাগিয়ে লাখো লাইক কুড়োতে পারে। মোটের ওপর ব্যাপার হল আমাদের সকলের মধ্যেই থাকে শিশু স্বত্তা বা শিশুসুলভ “লাইকড” হওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু চাইলেই পাচ্ছেন কোথায়?
যেমন ধরুন আমি। আমি ভয়ানক অসামাজিক জীব (মানে আনসোশ্যাল। অ্যান্টিসোশ্যাল নই। অ্যান্টিসোশ্যাল-এর তর্জমা বোধ হয় সমাজবিরোধী। ঠিক জানিনা। বাংলায় আমি বরাবরই কাঁচা। মাধ্যমিকে কোনক্রমে চৌষট্টি পেয়েছিলাম)। তো এ হেন আমি যে কিনা নিজের লেখা লাগালে কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে পাঁচ-দশ আর নিজের একার ছবি পোষ্ট করলে ঐ গোটা কুড়ির মধ্যে স্কোর করি মানে ওই কটি লাইক পাই আর কি, সেই আমি-ই স্ত্রী-এর সাথে ছবি পোষ্ট করলে পুরো ঝিঙ্গা-লা-লা কেস। পঞ্জি স্কিমের মত পুরো দশ গুণ রিটার্ন। এক ধাক্কায় কুড়ির থেকে দুশো। অ্যাসটেরিক্স কমিকসে সেই গল-রা মাঝে মাঝে পাওয়ার পোশান খেয়ে কিছুক্ষণ হুরুদ্দুম মারপিট করতে পারতো, অনেকটা সেরকম। ঘন্টাখানেক অন্য সব “feeling mortified”, “feeling beatified” টাইপ পোষ্ট-এর সাথে যুদ্ধ করে সক্কলের টাইমলাইনে প্রথমে থাকবে আপনার পোস্ট। ব্যাস ফলস্বরূপ দুশো লাইক। গোটা বিশেক কমেন্ট-ও পেয়ে যাবেন শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে। ছবিতে স্ত্রীকে সঙ্গে রাখলে হবে এমনতর অভুতপূর্ব লাইক ও কমেন্ট লাভ। একেই বলে নারীশক্তি বা উইমেন পাওয়ার। শাস্ত্রে নারীকে শক্তি কেন বলেছে এবারে বুঝতে পারছেন তো? আপনার শিশু কন্যার সাথে ছবি লাগালেও বাজার পাবেন। রোববার সকালের লুচি-আলুর চচ্চড়ির মত পাতে পড়ার আগেই উঠে যাবে বিদ্যুৎগতিতে। মায়ের সাথে ছবি লাগিয়ে “হ্যাপি মাতৃদিবস” ক্যাপশান দিলেও ফুটেজ পাবেন কিন্তু সেটা ছেলেদের খুব একটা করতে দেখিনা। মায়ের কথা মনে পড়লে ছেলেদের বোধ হয় ফেসবুকের থেকে বেলনার বাড়ির কথাই বেশি মনে পড়ে। ছোটবেলায় পড়াশুনো করানোর জন্য বেয়াড়া রকমের জোরাজুরি করার জন্যই আমার স্থির বিশ্বাস ছেলেরা ফেসবুকে মায়ের সাথে ছবি লাগায় না। মোট কথা হল, আপনার ডিজিট্যাল জনপ্রিয়তা বাড়াতে ছবি তুলুন এবং সে ছবিতে বাড়ির কোন একজন প্রিয় নারীকে সঙ্গে রাখুন এবং একটা ঝাক্ক্যাস ক্যাপশান সহ ফেসবুকে পোষ্টিয়ে দিন। মা স্ত্রী কন্যা কেউ একজন থাকলেই হল। স্ত্রী হলে তাঁকে ট্যাগাতে ভুলবেন না। কিন্তু মনে রাখবেন নিজের বাড়ির মধ্যেই থাকবেন। অন্যের বাড়ির কোন নারীর সাথে ফেসবুকে দেখা গেলে, এমনকি কোন অন্যপূর্বার কাছাকাছি দেখা গেলেও বাড়ির মধ্যে ছাদ ফুটো না হয়েই আপনার বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রবল বৃষ্টিতে ভেজার সম্ভাবনা।