শিকাগো সামার মানেই আউটডোর ফান। ওদের মা কোথায় বেরিয়েছে। সানাই আর তাথৈ নামক দুটি বিচিত্র জীবের দায়ভার আমার ওপর অর্পণ করে। আমি এক কাপ কফি সহযোগে আমার বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে বসে ল্যাপটপে একটি গল্প সাজানোর চেষ্টা করছি। আমাদের জীবনের কত গল্পই তো আখের রসের মত জীবনের ইক্ষুগাছে জমে জমে ওঠে। সেইসব দোহন করে শব্দের প্রাকারে সাজানো, গল্প মানে তো তাই।
সানাই এসে বলল, তুমি সারাক্ষণ অফিস করো। আমার সাথে খেলো না। সানাইয়ের অভিমানী স্বরে শ্রাবণ। আমি তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ বন্ধ করে বলি, চলো খেলি। সানাইয়ের খেলার স্বভূমিতে বিভিন্ন নাটক, যাত্রাপালা, চলচ্চিত্র অভিনীত হয়। তবে কিনা সে নিজেই ডিরেক্টর, স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং প্রধান চরিত্রে নিজেই অবতীর্ণ হয়। আমরা নেহাত এলেবেলে সাইড রোলে। মানে মৃত সৈনিক টাইপ আর কি! আজকের পালা রামায়ণ। তবে আগাস্টের ফুরফুরে হাওয়ায় সানাইয়ের মন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতই দক্ষিণাপন আজ। তাই আমি একটা প্রধান চরিত্র পেয়ে গেছি। শ্রীরামের ভূমিকায় আমায় কাস্ট করা হয়েছে। হনুমানের রোলটা নিজে নিয়েছে। ও সাধারণভাবে যে পরিমাণ লম্ফঝম্প করে থাকে, তাতে পবনপুত্রের রোলে ওকে খুব একটা প্রয়াস করতে হবে বলে মনে হয় না। নিজ চরিত্রগুণেই ও হনুমানের চরিত্রে মানিয়ে যাবে। মহাকাব্য রামায়ণ অভিনীত হতে হলে সীতা দরকার। আমি সানাইয়ের বোনু অর্থাৎ আমার দ্বিতীয় কন্যা তাথৈকে সীতার রোল দেওয়ার জন্য আর্জি করি। সানাই শোনামাত্র আর্জি খারিজ করে দেয়। তাথৈয়ের বয়স এখনও দুই হয় নি। সীতার মত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তাথৈয়ের মত বালখিল্য স্বভাবের একজন মানুষকে কাস্ট করতে ওর ডিরেক্টর সুলভ মন কেমন যেন কু গায়। শেষমেশ সীতা হলেন সিন্ড্রারেলা। মানে সিন্ড্রারেলার পুতুল। পুতুলেরা নিজেদের স্বভাববশত হাত পা নাড়ে না বা কথা বলে না স্বেচ্ছায়। কিন্তু তার প্রক্সি তো আমাদের সানাই দিতেই পারে। বোনু নেহাত কোনো রোল না পেয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছিল, আমি ফট করে তাকে লক্ষ্মণের রোলে কাস্ট করে দিলাম। সানাই দেখলাম তাতে বিশেষ আপত্তি করলো না।
পালা এদিকে জমে উঠেছে। আদি কাণ্ড আর অযোধ্যা কাণ্ড শেষ হয়ে অরণ্য কান্ড শুরু হয়ে গেছে। মহারাজা দশরথ পুত্রশোকে প্রাণত্যাগ করেছেন। মানে সানাইএর ভাষায় ডাই হয়ে গেছেন। রাম লক্ষ্মণ সীতা অনেক ঘুরেটুরে পঞ্চবটির আশ্রমে আস্তানা গেড়েছেন। পাঁচ পাঁচখানা বট গাছ পাওয়া দুষ্কর। তাই আমাদের ব্যাকইয়ার্ডের তিনখানা বড় ব্ল্যাক চেরী ট্রীকেই মনে মনে বটবৃক্ষ হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছি। শূর্পণখার নাসাচ্ছেদ হয়ে গেছে। এবার তবে রাবণকে আসতে হয় মারীচকে সাথে করে। কিন্তু বাড়িতে তো মোটে তিনখানি প্রাণী। তারা মুখ্য চরিত্র রাম লক্ষ্মণ হনুমান হয়ে বসে আছে। চতুর্থ প্রাণী নেই যে রাবণের ভূমিকার নামবে। সমস্যার সমাধান করতে সানাই নিজেই ডাবল রোলে। হনুমান রাবণ হয়ে গেল চোখের নিমেষে। এই ধরণের চরিত্র বদলে মৃদু আপত্তি জানানোয় সানাই যুক্তি দিল, রাবণ হলে আমি পুষ্পক রথে করে আসতে পারব, বাবা। ব্যক্তিগত বিমান পাওয়ার লোভেই এই পার্টি বদল। সেতো আমাদের মুকুলও…না থাক।
হরিণরূপী মারীচকে কোথায় পাওয়া যায় জিগেস করতেই সানাই বিদ্যুৎগতিতে দোতলায় চলে গিয়ে ওর খেলার ঘর থেকে একটা ইউনিকর্ন নিয়ে চলে এল। ইউনিকর্নকে হরিণ হিসেবে ভাবতে একটু বেগ পেতে হলো ঠিকই। কিন্তু নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। হরিণেরও চারটে পা। ইউনিকর্নেরও। হরিণের দুটো শিং। ইউনিকর্নের একটা। চলে যাবে। সীতারূপী পুতুল সিন্ড্রারেলার প্রক্সি সানাই রামরূপী আমাকে আদেশ দিল ইউনিকর্ন থুড়ি সোনার হরিণ ধরে আনতে। আমি তো পরম বিক্রমে অদৃশ্য ধনুক টনুক বাগিয়ে ক্রমাগত অদৃশ্য তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে সিংহগর্জন করে ছুটলাম হরিণ ধরতে (আসলে অধিকাংশ দিন আমি বিউটি অ্যান্ড দ্য বীস্ট পালায় বীস্টের চরিত্র পেয়ে থাকি। তাই হাঁউ মাউ করাটা আমার, কি যেন বলে, হ্যাঁ, ওই ম্যানারিজমে পরিণত হয়েছে)। বাগানের এক কোনায় গিয়ে মারীচের গলায় রামের স্বর নকল করে আমি এস ও এস পাঠাই – বাঁচাও বাঁচাও। সীতার আড়াল থেকে সানাই তখন লক্ষ্মণকে হাঁক দিয়েছে রামকে সাহায্য করতে যেতে। হিসেব মত লক্ষ্মণের তখন লক্ষ্মণরেখা কেটে দিয়ে রামের সন্ধানে বনে যাওয়ার কথা। কিন্তু লক্ষ্মণ অর্থাৎ তাথৈ জন্ম ইস্তক এই ধরণের যাত্রাপালায় চরিত্রের ধার মোটেই ধারে না। মার্জিত ভাষায় বললে অবাধ্য আর অপরিশীলিত ভাষায় বললে ঢ্যাঁটা, তাথৈ হল তাই। বাংলায় যাকে বলে, আপনি মর্জিকা মালিক। সে মাটিতে পড়ে থাকা গাছের ডালপালা পাতামাতা তুলে পরমানন্দে নিজের ওপরেই পুষ্পবৃষ্টি করছে।
লক্ষ্মণের আমাকে উদ্ধার করতে আসার কোনো লক্ষণ নেই দেখে আমি স্বপ্রবৃত্ত হয়ে নিজেই ফিরে এসে দেখি রাবণরূপী সানাই সিন্ড্রারেলা সীতাকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ঠিক উড়ছে না, একটা গাছের ডাল ধরে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে আছে। আশু বিপদের সম্ভাবনায় আমি রাম, রাবণকে চ্যাংদোলা করে নামিয়ে দিই। রাবণ ওরফে সানাই তাতে খুব খুশি না হলেও এই টেন্সড মুহূর্তে সেই নিয়ে মাথা গরম করে না। তার আদেশে আমাকেই রাম থেকে জটায়ু হয়ে যেতে হয়। ঘেঁটে পুরো ঘ হয়ে গেছি। কে রাম, কে হনুমান, কে জটায়ু, কে রাবণ , কে সীতা, কে লক্ষ্মণ কিচ্ছু ঠিক নেই। রাবণের সঙ্গে জটায়ুর এদিকে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে হাতাহাতি। সানাই-এর হাতের চটাস চটাস মার খেয়ে চটকে যাই বেশ। তারপর গদাযুদ্ধ। জটায়ুকে গদাযুদ্ধ করতে হবে কেন সে প্রশ্ন করতে গিয়ে পশ্চাদ্দেশে গদাম করে গদাবাড়ি খেলাম। সানাই-এর রামায়ণ। এখানে রাম রাবণে এক ঘাটে জল খায়। যুদ্ধ করতে করতে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে রাবণ মারীচ ওরফে খেলনা ইউনিকর্নকে জটায়ুর দিকে অর্থাৎ আমার দিকে ছুঁড়ে মারে। পুরো স্পাইডার ম্যান ওয়ানের স্টাইলে ইউনিকর্নের শক্তিশেলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বলি, সানাই, এটা হচ্ছেটা কি? লেগে যাবে না? সানাই পরম বিক্রমে জানান দেয়, সে সানাই নয় রাবণ। সে তুমি রাবণই হও আর পতিত পাবনই হও, একটা হৃষ্টপুষ্ট ইউনিকর্ন ছুঁড়ে মারবে এ কেমন অভদ্রতা।
কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড হাল্কা করে স্কিপ মেরে সুন্দর কাণ্ডে পৌঁছে যাই। সানাই এইবার তার আসল রোলে কাস্ট হয়েছে। এক লাফে সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কায় যাবে বলে তার ভীষণ উত্তেজনা। যাকগে যাক, সে সব তো হল। ফাইনালি লঙ্কাকাণ্ড টা তো হতে হবে। যাকে বলে সিনেমার ক্লাইম্যাক্স। লক্ষ্মণকে না পেলে রাম রাবণের যুদ্ধটা নেহাত ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে ভেবে লক্ষ্মণের খোঁজে গিয়ে দেখি কেলেঙ্কারী টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি। লক্ষ্মণ সারা মুখে মাটি মেখে শিব সেজে দাঁড়িয়ে আছে। মাটি ছাড়াও শুকনো পাতা, গাছের ডাল, শিকড় বাকড়, জড়িবুটি কি নেই শেই ক্ষুদ্র শরীরে? তার ওপরে পাখিদের খাওয়ার জন্য যে জল রাখা হয়, পরিপাটি করে নিজের মাথায় ঢেলেছে। ভিজে সপসপে জামা প্যান্ট। দুটো চোখ আর খুদে দাঁতের সারি ছাড়া তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। ভদ্র ঘরের ভদ্র সন্তান বলে কেউ দূর কল্পনাতেও ভাববে না। লক্ষ্মণ নয় একে জাম্বুবানের রোলে কাস্ট করা উচিত ছিল। ওর মা এই অবস্থায় তাথৈকে অর্থাৎ লক্ষ্মণকে দেখতে পেলে রাম, হনুমান আর লক্ষ্মণের বনবাস তো নিশ্চিতই, স্বর্গবাস হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
কিছু মানুষ জন্মে ধীরে বাঁদরে পরিণত হয়। আর কিছু জন্মসূত্রেই বান্দর হয়। তাথৈ দ্বিতীয় গোত্রের। নিজের ভাগ্যকে ছাড়া কাকেই বা দুষি। এই মুহূর্তে সমস্ত অপরাধের চিহ্ন গায়েব করার তাগিদে আমি রাম, লক্ষ্মণরূপী তাথৈকে চ্যাংদোলা করে তুলি। লক্ষ্মণ এমন একটা কিছু আশা আগেই করেছিল। তাই পিতৃপ্রতিম দাদার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্ভ্রম প্রদর্শন না করে একটা ঝেড়ে লাথি কষায়। ব্যাক কিক। সে লাথি কোথায় গিয়ে লাগে বললে সম্পাদক মহাশয়/মহাশয়া নিশ্চয়ই কাঁচি করে দেবেন, তাই আর লিখলাম না। চোখে দু দন্ডের জন্য সর্ষে ফুল দেখি। লক্ষ্মণের লাথির হাত থেকে বাঁচতে ওকে পাঁজাকোলা করে ধরি। হনুমানরূপী সানাই এদিকে নেহাত অধৈর্য হয়ে জামা ধরে টানাটানি শুরু করেছে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার জন্য। দাঁড়াও সানাই, দেখছ না বোনু মাটি মেখেছে, বলাতে হনুমানরূপী সানাই তার পরমারাধ্য শ্রীরামচন্দ্রকে চড়াম করে মেরে বলে, আমি সানাই নই, হনুমান। তোমাকে যুদ্ধ করতেই হবে। এদিকে লক্ষ্মণ কোলে উঠে ইস্তক মাথা দিয়ে দুম দুম করে হেড মারছে কুশলী কুস্তিগীরের মত। মাথা তো নয় একটা ঝুনো নারকেল! ধনুকের ছিলার মত উল্টোদিকে বেঁকে গেছে আর তারস্বরে চেঁচিয়ে জানান দিচ্ছে ওর মাটি মাখায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছি। লঙ্কাকান্ড প্রায় পণ্ড হয় দেখে হনুমানও চটাচট মারছে রামকে। আক্ষরিক অর্থে লঙ্কাকান্ড বেঁধে উঠেছে, মানে মঞ্চে নয়, বাস্তবে। আমি রাম না রাবণ, জটায়ু নাকি শূর্পনখা কিচ্ছু মনে পড়ছে না। এর থেকে বিউটি অ্যান্ড দ্য বীস্ট পালা অভিনীত হলে ভাল ছিল। শেষমেষ হনুমান ওরফে সানাইকেও আর এক হাতে কোলে তুলে নিই। হনুমান ওরফে রাবণ ওরফে সানাই এবং লক্ষ্মণ ওরফে তাথৈ, দুজনকে দু কোলে নিয়ে আমি ঘরে ঢুকে সোজা বাথরুমে চলে যাই। গৃহিণী ফেরার আগে দুটোকে স্নান করিয়ে নিতে হবে।
মাথায় খানিক জল ঢালায় সানাইয়ের মাথা ঠান্ডা হল। তবে দেখলাম রাবণবধ না হওয়ার শোকটা পুরো ভুলতে পারে নি। দুখী দুখী মুখে বলে, বলেছিলাম বোনুকে খেলায় না নিতে।
Another marvelous piece!!
Thank u