২৫ আগাস্ট, ২০২০
আজ সানাইয়ের পাঁচ হল। কোভিডের অদৃশ্য প্রহরা না থাকলে হয়তো বড় করেই জন্মদিনের পার্টি হত। কিন্তু এ বছরটা আর পাঁচটা বছরের থেকে আলাদা। তাই সকালে পায়েস, পাঁচভাজা, মাছ, পায়েস আর রাত্রে অল্প কেক কাটা, কিছু পুরনো বন্ধু ও ভাতৃস্থানীয় স্বজন।
আজ সানাইয়ের পাঁচ হল। আজ থেকে ঠিক পাঁচটা বছর আগে এক মাথাচুল আর দু চোখে বিস্ময় নিয়ে আমি এই নিজেরই হাতে মায়ের নাড়ি কেটে ওকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলাম। নাড়ি কাটার পর শুনেছি বাচ্চারা চিল চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। একদম ভুল। একটুও কাঁদে নি। বরং হাবভাবটা এরকম ছিল, এ আবার কোথায় এলাম? এত আলো? সেই থেকে শুরু। তারপর থেকে জুঁই ফুলের মত সেই ছোট্ট প্রাণটার একটা করে পাপড়ি খুলে যাওয়া…জীবনের এক একটা অধ্যায়…প্রথম উবুড় হওয়া, প্রথম হামাগুড়ি, প্রথম হাঁটতে শেখা টলোমলো পায়ে, প্রথম বাবা, মাম্মা বলা…যেন এক স্মৃতির চোরাকুঠুরি। কত হাসি, কত কান্না, কত মান অভিমানের পালা বাবা-মেয়ের – সে লিখতে বসলে বুঝি শেষ হবে না। এই হয়তো মুখে খাবার নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে বকুনি খেয়ে কিম্বা মাঝে মাঝে ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে দু এক ঘা খেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে “বাজে বাবা” বলে চলে গেল তো পরমুহূর্তেই ও বিউটি হলে আমি বীস্ট। কিম্বা আমি ঘোড়া আর ও ঘোড়সওয়ার।
আজ সানাইয়ের পাঁচ হল। হ্যাঁ আনন্দের দিন। কিন্তু সকাল থেকে আমার মনটা খারাপ। খালি মনে হচ্ছে পাঁচ হয়ে গেল। আর বড়জোড় পাঁচ কি দশ। কত অল্প, কত খসে-পড়া-তারার মত স্বল্পায়ু এই সময়। পৃথিবীর কোনো মহার্ঘ জিনিসই বোধ হয় অপরিমিত নয়। “গুপি বাঘা ফিরে এলো” ছবিতে আচার্য ব্রহ্মানন্দ শেষ দৃশ্যে যেমন দু হাত দিয়ে রত্নগুলোকে মুঠি করে ধরছিল আর হাত খুলতেই দেখছিল সে রত্ন গায়েব, ঠিক সেরকমই দু হাত দিয়ে মুঠো করে ধরতে চেয়েছি দিনগুলো। আর কখন মুঠোর ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে গেছে। অসহায়ের মত অভিশম্পাত করেছি মহাকালকে।
মহাকাল। সে টর্পেডোর মত চুপি চুপি এসে সমস্ত সঘন মুহূর্তকে বিস্মৃতির অতলান্তিকে ডুবিয়ে দেয়।
আসলে সকল কন্যা সন্তানের বাবার জীবনেই আসলে একদিন “রহমত আলি” মুহূর্ত আসে। সেই মিনির কাবুলিওয়ালা? যে অনেক কটা বছর জেল খেটে এসে একদিন দেখল তার কন্যাসম মিনি অনেক বড় হয়ে গেছে। সেই পুরনো সুর আর বাজছে না। কোথায় যেন সম্পর্কের এসরাজ বাজছে অচেনা সুরে। সেরকম সব বাবাই সময়ের স্রোতে ভেসে চলতে চলতে একদিন হঠাত অনুভব করে তার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। হয়তো যোগাযোগের নতুন সূত্র খুঁজে পায়, কিন্তু তার শিশু কন্যাটিকে আবার নতুন করে চিনতে হয়। নতুন করে আলাপ করতে হয় নিজেরই মেয়ের সাথে।
আচার্য ব্রহ্মানন্দের মত প্রাণপণে ধরে রাখতে চেষ্টা করি আমার ছোট শিশুকন্যার আধো আধো কথা, তার অভিমানী চোখের জল, তার দুদিকের বিনুনি, তার অবাধ্যতা, আমার বকুনি, আমার আদর, ওর ছোট ছোট হাত হাতে নিয়ে পথ হাঁটার অপার্থিব স্পর্শসুখ কিন্তু পারি না। আলোছায়ায় ধরি, চলচ্চিত্রে ধরি, ছন্দে ধরি, শব্দে ধরি। তবু ধরা যায় না। তবু মনে হয় ওই আসল মুহূর্তগুলোর কাছে ওই ক্যামেরায় ধরা ছবি, ছায়া কি নিষ্ঠুর রকমের অকিঞ্চিৎকর। আমাদের প্রতি মুহূর্তের যে এক্সপিরিয়েন্স, যে অনুভব কোনো রেকর্ড বাটন টিপে তাকে যদি ধরে রাখা যেত আর আমাদের আগত সেই হলুদ বিকেলবেলায়, আমাদের সন্ধে নাম্বার আগের বিষণ্ণ ক্ষণে যদি রিপ্লে করে দেখা যেত, না না দেখা নয়, আবার করে যদি যাপন করা যেত, কি ভালই না হত? তাই না?
আমাদের সমস্ত মহার্ঘ ক্ষণ চুরি করে নিয়ে চলে যায় মহাকাল। আমরা অসহায় চোখে দেখি। কত অভিসম্পাত করি। কিন্তু সে চলে যায় রাজার চালে। তার ভ্রুক্ষেপ নেই।
September 24, 2020 at 7:35 am
সানাই এর সুর শুনতে পেলাম এই লেখাটায়। রেশ থেকে যাবে জানি কারন এই নতুন করে চেনা যে সারা জীবনের।
September 25, 2020 at 6:53 pm
Thank u
September 26, 2020 at 1:10 pm
Beautiful
September 26, 2020 at 1:49 pm
Thank u