সিম্বা-কিম্বা-জুম্বা

ছোটবেলায় একটা ভূতের গপ্পো পড়েছিলাম যেখানে ভূতটা কারু বৈঠকখানায় গিয়ে বসলে খুলিটা খুলে পাশে নামিয়ে রাখত। তা রোহিত শেট্টির ফিল্ম দেখতে যাব যখন ঠিক করেছি, তখন এরকম একটা কিছু করব ঠিক করেই রেখেছিলাম। ছোটবেলায় কলকাতার গরমে অনেকেই এসিতে ঠান্ডা হতে কিম্বা বান্ধবীর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে সিনেমা হলে ঢুকত। বান্ধবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার দিন আমার গেছে আর এসি? না তার খোঁজে দরকার নেই। সমগ্র শিকাগো এখন একটা বিশাল রেফ্রিজারেটর হয়ে আছে। ঠান্ডাঘরের খোঁজে নয়, এখানে এখন সবাই উত্তাপের সন্ধানেই মাথার ওপর ছাদ খুঁজছে। তবে রোহিতের ছবি দেখতে যাওয়ার incentive কি? পরিজনের মুখে হাসি ফোটানো বলতে পারেন আর অবশ্যই সুন্দরী সারাহ্‌। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, রবিবাসরীয় আলসেমি আর ফুর্তির-প্রাণ-গড়ের-মাঠ নিয়ে পৌঁছে গেলাম সিম্বা দেখতে। সিম্বা বলতে আমি শেষ জানতাম একটা মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম যা ব্ল্যাকবেরি ডিভাইসকে প্রাণ দিত। সে লঙ্কা নেই, নেই সে রাবণও। কালোজাম ফোন এক্সটিঙ্কট হয়ে গেছে। সাথে সাথে সিম্বা নামক অপারেটিং সিস্টেমও। কিন্তু তার উত্তরসূরী হিসেবে জন্ম নিল পুলিশ অফিসার সিম্বা। হাবভাব চালচলন তার দাবাং-এর সল্লু মিয়ার মত। কলেজ লাইফে একটা তিন অক্ষরের গালাগালি ব্যবহার হত। শুরু আর শেষের অক্ষর মিলে হয় হামি। তিনি হলেন গে তাই। হা-ড্যাশ-মি। আর কেউ তাকে সেই বিশেষণে ভূষিত করলে প্রথমে তিনি মারাঠিতে কি একটা বলেন। পরে দয়া করে সেটাকেই ইংরেজিতে তর্জমা করে দেন – “Tell me something I don’t know”।

না না, সিম্বার মত একটা আপাদমস্তক ননসেন্স মুভি নিয়ে ক্রিটিকাল রিভিউ লিখছি এরকম ভাববেন না, এ নেহাতই পিয়োর আড্ডার ছলে সিম্বার সিম্বায়োসিস। তো যা বলছিলাম আর কি, এই পুলিশ অফিসার, সামথিং ভালেরাও, ওরফে সিম্বার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সবচেয়ে বড় স্ট্র্যাটেজিক ডিসঅ্যাডভান্টেজ, ইনি ছোটবেলা থেকেই অনাথ। তবে অনাথদের সাধারণত এরকম ফার্স্টনেম সারনেম সহ গালভরা নাম হয় না। তারা নাম পায় চিন্টু, পিন্টু ছোটে, রাজু ইত্যাদি। কিন্তু ইনি সৌভাগ্যক্রমে একটা দাঁতভাঙা নাম হাতিয়েছেন। এখন এই ভালেরাও মোটেই ভাল রাও নন। অনাথ হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকে ইনি যন্তর ছিলেন, পেটের দায়ে পকেট মারতেন এবং কালক্রমে ধরাও পড়েন পুলিশের হাতে। অল ইন্ডিয়া পকেটমার অ্যাসোসিয়েশানের জেনেরাল সেক্রেটারি তাকে ছাড়াতে এসে পুলিশের হাতে চাঁটা খায় আর তারপর পুলিশকে টাকা খাওয়ায়। সেই থেকেই সিম্বা ঠান মেরে আছে বড় হয়ে সে পুলিশ হবে আর খুব ঘুষ খাবে। তা মারাঠি মানুষ পুলিশ হবে না তো কি মাছ-ভাত-খাওয়া বাঙালি হবে? হাজার হোক ছত্রপতি শিবাজির রক্ত বইছে ওদের শরীরে।

জীবনটা বাজেরাও থুড়ি ভালেরাও-এর বেশ ভালোই প্ল্যানমাফিক এগিয়েছিল। সিম্বা তার পুলিশ অবতারে রীতিমতো জুম্বা করতে করতে এন্ট্রি নিলেন। স্পাইডারম্যান স্টাইলে ধোপার কাপড় ছুঁড়ে দিয়ে একটা সোনাচোরের গলায় পেঁচিয়ে তাকে আছাড়িপিছাড়ি খাওয়ালেন। তারপর চোরের কাছেও টাকা খেলেন। চুরির মাল ফেরত দিয়ে মালিকের কাছেও কাট নিলেন। ঘুষখোর সিম্বার শিবগড়ীয় নিরঙ্কুশ জীবনে মুস্কিল শুরু হল যখন তিনি শিবগড় থেকে গড়গড় করে মিরামার পুলিশ স্টেশানে ট্রান্সফার হয়ে গেলেন। মিরামার থানার বিপরীতেই শাগুনের হোটেল। এই শাগুন, তিনি রূপে আগুন, ভালেরাওয়ের হৃদয়ে এনে দিল প্রেমের ফাগুন। আর সেই ফাগুনে আরও রঙ ধরলো যখন উনিশবর্ষীয়া মিষ্টি মেয়ে, আকৃতি, সিম্বার কাছে দরবার করতে আসল। আকৃতি একটা evening school  চালায়। দূর্বা নামে এক দুর্বৃত্ত আর তার সাঙ্গপাঙ্গ সেই স্কুলে পড়তে আসা গরীব বস্তির ছেলেদের ড্রাগ পেডলিং-এর কাজে ব্যবহার করছে।

না দূর্বা বলে যদি একটি সুন্দরী মিষ্টি মেয়ের কথা মনে আসে তাহলে আগেই বলে দিই ভুল করছেন। বাঙালি দূর্বারা মেয়ে হয়, মারাঠি দূর্বা নিতান্ত গুঁফো এবং পেশিবহুল দুষ্টু লোক (তবে নিজের মা-কে খুব ভালবাসে তাই শতকরা একশভাগ দুষ্টু বলা যায় না)। তবে লোকটার এলেম আছে বলতে হবে, বলিহারি তার মনের জোর। ব্যাবসায় তাকে ঠকিয়েছে বলে নিজের বৌয়ের ভাইকে, মানে আপন শালাকে নিজের হাতে খুন করেছে এবং ফলাও করে বলে বেড়ায়। বাঙালি পুরুষ বৌ-এর ভাইয়ের কেন বৌ-এর চোখে চোখ রাখতেই ভয় পায়! এই না হলে মারাঠা ক্ষাত্রবীর্য!

যাই হোক দূর্বা রেনিডে থুড়ি দূর্বা রানাডের কিসসা ক্লাইম্যাক্স অব্দি মুলতুবি থাক। অভিযোগকারিণী, সমাজসেবী আকৃতির নরমসরম প্রকৃতি দেখে সিম্বা তাকে বোন পাতিয়ে ফেলে। আর তার থেকেই সিম্বার অধঃপতন (কিম্বা উত্থান যাই বলবেন) শুরু। ঘুষের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় – কবি সুকান্ত বলে গেছেন। আর সম্পর্ক তো কবিতা। জীবনের তার সম্পর্কের সুরে বাঁধলেই যাকে বলে এক্কেরে সাড়ে সব্বোনাশ। ড্রাগপেডলারদের ডেরায় গিয়ে আকৃতি তাদের কুকীর্তির ভিডিও করে নেওয়ায় তার ওপর যৌন অত্যাচার ও হত্যা। সিম্বার ঘুমিয়ে থাকা বিবেক নাড়া দিয়ে জাগিয়ে দেয় এই ঘটনা আর তারপরেই শুরু প্রায়শ্চিত্ত। সিম্বা তার ঘুষখোর অফিসার অবতারে এক বৃদ্ধকে হুড়কো দিয়েছিল (পড়ুন সম্পত্তি হড়পে নিয়ে মনঃকষ্ট দিয়েছিল)। প্রায়শ্চিত্তর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সিম্বা তাঁকে ফটাফট্‌ বাবা পাতিয়ে নেয় আর রীতিমতো ভিক্ষা করে একটা ঠাটিয়ে থাপ্পড় খেয়ে আসে তাঁর হাতে (কোটি কোটি টাকার জমি হড়পানোর শাস্তি যদি একটি থাপ্পড় হয় আমি বারে বারে সেই অপকার্য করে থাপ্পড় খেতে রাজি আছি)। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, অনাথ হওয়ার কারণে মিরামারে পা রাখার পর থেকেই সিম্বা মুম্বাইমেলের গতিতে মা, বোন, বৌ, বাবা ইত্যাদি সম্পর্ক পাতিয়েছে। এমন কি প্রবল প্রতাপশালী দূর্বার মা আর বউকেও নিজের টাপোরি ভাষা আর ভালোবাসায় জয় করে ফেলেছে। আকৃতির অকালপ্রয়াণে বিবেকতাড়িত সিম্বা দূর্বার দুই ভাইকে অসমসাহসে ধরে নিয়ে এসে কোর্টে পেশ করে। আকৃতির ওপর অত্যাচার তারাই করেছে। কিন্তু বিচারের দিন সব সাক্ষ্যপ্রমাণ গায়েব। আকৃতির ওপর অত্যাচারের যে  ভিডিও পুলিশ হেফাজতে ছিল, তা মহামান্য ধর্মাবতারকে দেখানোর জন্য কম্পিউটার-এ পেন-ড্রাইভ ইনসার্ট করতেই একটা নীল পপ-আপ বলছিল “empty empty”। এমন অভূতপূর্ব অপারেটিং সিস্টেম, পেন ড্রাইভ ঢোকালেই যা কিনা empty empty বলে শোরগোল করে, আমি জীবনে দেখিনি। ওটা বোধ হয় কম্পিউটার-নিরক্ষরদের (এবং এই সিনেমা প্রধান গ্রাহক) জন্য হবে। আমি তো আমার খুলি সিনেমা হলের বাইরে খুলেই এসেছি। আমার চাপ নেই।

মোটের ওপর  দূর্বার দুর্বার ভাইদের কোর্টে কাবু করতে না পেরে সিম্বা নিজের সব পাতানো বৌ, বোন, মা, বাবাদের কাছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট নিয়ে ফেলল। সর্বসম্মতিক্রমে দূর্বার দুই ভাইকে পৌরুষে সুড়সুড়ি দিয়ে লকআপ থেকে বের করে “স্টেজড এনকাউন্টার” করে ফেলল। ভাতৃবিরহের ক্রোধে অন্ধ দূর্বা যখন আমাদের সিম্বুকে বাম্বু দিতে তুলে নিয়ে গেছে আর মেরে হাতের সুখ করছে তখনই দরজা টরজা ভেঙে গাড়ি নিয়ে গ্র্যান্ড এন্ট্রি নিলেন আমাদের সিংহম, হ্যাঁ আমাদের সেই আদি অকৃত্রিম অজেয় অজয়। এমন মুহূর্তে টেনিদা থাকলে বলতেন “ডি-লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক”। সে যাক।  তারপর আবার শুরু হল সিংহম,  সিম্বা আর ভিলেনদের জুম্বা নাচ। দুজনে মিলে ফাটিয়ে মারল দূর্বা ও তার সঙ্গীসাথীদের। নেপথ্যে বাজল “সিংহম সিংহম সিম্বা সিম্বা” ধ্বনি। এই প্রসঙ্গে একটা কথা আমার খুব মনে হয় যে, বলিউডের সব সিনেমার ফাইট মাস্টার বোধ হয় একজনাই। অন্তত একে অপরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু তো বটেই। কারণ সব সিনেমার মারপিটেই একই স্ট্যান্স পাবেন। হ্যাঁ, ঐ যে একটাতে দুজন দুষ্টু পেছন থেকে এসে হিরোকে ধরবে আর সামনে একটা লোক লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে আর হিরো ঐ পেছনের দুজনের কাঁধে ভর করে তেড়ে আসা সামনের লোকটাকে মোক্ষম “বাপি বাড়ি যা” শট মারবে আর তারপর তিনশো ষাট ডিগ্রি ভল্ট খেয়ে নেমে পেছনের দুষ্টু দুটোর চুলের মুঠি ধরে দুম করে একে অপরের মাথায় ঠুকে ছেড়ে দেবে…হ্যাঁ এই সিনেমাতেও সেই স্ট্যান্স পাবেন। পাবেন হিরো কর্তৃক ভিলেনকে একটা টেনিস বলের মত কাচের টেবিল কি কাচের দরজার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া এবং তজ্জনিত কারণে কাচ ভেঙে খানখান হয়ে ছত্রাকারে ছড়িয়ে পড়া (তবে বিনা রক্তপাতে)।

শেষে দূর্বার মা-বৌ গদ্দারি করে দূর্বার সাথে। আগেই বলেছি রিলেশানশিপ মাস্টার, অনাথ সিম্বা ফটাফট অন্যের মা-বোন-বৌ ইত্যাদি নিজের পক্ষে টেনে নিতে সিদ্ধহস্ত অথবা সিদ্ধহৃদয় বলা চলে। দূর্বার মা-বৌ যথাক্রমে নিজের ছেলে ও দেওরের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে দিল। দূর্বার ভাইরাই আকৃতির যৌন হেনস্তা ও খুন করেছে সে কথা ভরা কোর্টে দাঁড়িয়ে বলে দিল (দূর্বার বৌ বোধ হয় এইভাবে নিজের ভাইয়ের খুনের বদলা নিলো)। কিন্তু দূর্বার মা-বৌয়ের কেউই অপরাধের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকা স্বত্তেও সে সাক্ষ্য কোর্টে গ্রাহ্য হল কেন সেটা না হয় রোহিতবাবুকেই জিগেস করে নেবেন।

সিম্বা করলেন সাম্বাClick To Tweet

সব মিলিয়ে মাথার খুলি খুলে রাখলে সিম্বা ওরফে রণবীরের জুম্বা খানিকটা সহনীয় হলেও হতে পারে। শুধু দু-একটা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে। এক, ধর্ষণ আর অ্যাসিড অ্যাটাক জঘন্যতম অপরাধ। সেটাকে নিয়ে এরকম সস্তা বাণিজ্য করে এইধরণের পৈশাচিক অপরাধের গুরুত্বটাকে প্রতিদিন লঘু থেকে লঘুতর করে দেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়? এরকম ছবির স্রষ্টার  মাথা যখন শিশুসুলভ তখন ছোটদের জন্য সিনেমা করলেও তো পারেন। ছোটদের ছবি তো আর বেরোয় না বললেই চলে! দ্বিতীয়, সারাহ্‌ কেরিয়ারের বারা না বাজিয়ে, শুরুতেই নিজেকে সারা না করে একটু ভাল ছবিতে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করতে পারেন যেখানে নিজের প্রিটি ফেস ছাড়াও ওঁর আরও কিছু অবদান থাকবে। আর তৃতীয়, সিম্বার হাতঘড়িটা বন্ধ ছিল। সেট-ডিজাইনার বোধ করি অনুমান করতে পারেন নি যে দৈবক্রমে কখনো হাতঘড়ির ওপর ক্যামেরা ক্লোজ-আপ হয়ে যেতে পারে।

 

Leave a Reply