খেলা

২০১৭ ডিসেম্বর

আজকের এই যে দিনটা, এই দিনটা আগামী কাল কোথায় থাকবে? আজ যে দিনটাকে এত সত্যি মনে হচ্ছে, বাস্তব মনে হচ্ছে কাল কি সেটা শুধুই একটা স্মৃতিকথা, একটা অলীক কল্পনা? আমরা প্রতি মুহূর্তে এই দিনটাকে, এই মুহূর্তটাকে ধরে রাখতে চাই। আর মুঠো করে জল ধরতে চাওয়ার মতই আমাদের সবরকম চেষ্টাকে কাঁচকলা দেখিয়ে, আমাদের বজ্রমুষ্টি ছাড়িয়ে সুখমুহূর্তগুলো পালিয়ে যায়। তাই আমরা অনবরতই তাকে still picture কিম্বা video photography করে ধরে রাখতে চাই। আমাদের স্মৃতি বড় প্রতারক। আজকে বেড়াতে এসে যে জায়গাটা, যে দ্রষ্টব্যটা ভীষণ ভাল লাগছে, কদিন পরে হয়তো সেটার নাম মনে করতে পারি না। তাই আমরা ডিজিটাল ফ্রেমে ধরে রাখার চেষ্টা করি সেই ছবি, সেই নাম। কিন্তু সেই ক্ষণটার যে সমগ্র অনুভবটা, total experience-টা সেটা কতটা ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী রাখা যায় সে আমার সুধী পাঠক পাঠিকারাই বলতে পারবেন, আপাতত আমি ভাবছিলাম আমার দুই বছরের কন্যা সন্তানের কথা। তার হাসিমুখ প্রায়শই তো ডিজিটাল পিকচারে, শূন্য-একের ভাষায়, ধরে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু তাতে তার এই শিউলি ফুলের মত স্নিগ্ধ শৈশব যতটা চাই, ঠিক ততটা ধরে রাখতে পারি না বোধ হয় । তাই ভাবলাম ঐ আলো আর ছায়ার, ঐ শূন্য আর একের লিমিটেড অভিধানের বাইরে এসে ভাষার সাহায্য নিই। অক্ষর আর শব্দদের সাহায্য নিয়ে এঁকে রাখি আমার দু বছরের ডানা লুকোনো পরীর ছবি।            

স্ত্রী দুপুরবেলা থেকে গেছিল শপিং-এ। অতএব সানাইকে সামলানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ভাগে। ওর বয়স দুই। ওর সব খেলারই সঙ্গী আমি। প্রথমে কিছুক্ষণ চলল রান্নাবাটি খেলা। ওর খেলাঘরে রান্না হওয়া সব খাবারই আমায় টেস্ট করতে হয়।  শুধু “খাও” আর “ভাল?” ছাড়া রান্না বিষয়ক আর কোন শব্দ এখনও আয়ত্তে আসে নি তার। তাই প্রতিবার একটাই রাবারের টুকরো টেস্ট করে ভাল বলার আগে আমিই কষ্টকল্পনা করে বলতে থাকি “এটা ইলিশের পাতুরি”, “এটা চিংড়ির মালাইকারি” ইত্যাদি। 

রান্নাবাটু খেলা শেষে কিছুক্ষণ “লিটল কৃষ্ণ” দেখা হল computer-এ। সেটা দেখারও সঙ্গী আমি। বালকৃষ্ণের কীর্তিকলাপ একা দেখতে আমার কন্যাসন্তান মোটেই পছন্দ করেন না। কালীয়দমন থেকে বকাসুর বধ পর্যন্ত সব লীলাখেলা দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়ে, মুখে হাত রেখে বিস্ময়সূচক শব্দ করে, অনবরত বলবে “বাবা দেখো”। অগত্যা আমাকেও কিছু বিস্ময়সূচক শব্দ বের করতে হয় মুখে। অন্তত শ দুয়েকবার দেখে ফেলেও বালক কৃষ্ণের দস্যিপনায় ওর সমান উৎসাহ। 

কৃষ্ণের দাপাদাপি কিছুটা প্রশমিত হলে শুরু হবে  “কালাল কলা” অর্থাৎ কালার করা অর্থাৎ coloring. তাতে আমায় এই পাখিটা, মাছটা, ডগিটা এঁকে দিতে হয়। উনি তাতে রঙের পোঁচ মারেন। আমি ছোটবেলায় কিছুদিন আঁকা শিখেছিলাম। তবু ঐ বিষয়ে আমার প্রতিভা একদমই সহজাত নয়। আর এখন তো সে বিদ্যা একেবারেই ভুলেছি। তো পাখি বা মাছ আঁকলে যেটা দাঁড়ায় সেটা আমার দু বছরের পুত্রী ক্ষমা ঘেন্না করে নেয় বলেই নিশ্চিন্তি। প্রাপ্তবয়স্ক তো ছেড়েই দিলাম পাখি বা মাছেদেরও সে ছবির জাজ হিসেবে দাঁড় করালে দশে শুন্য পেতাম সে ব্যাপারে আমি শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত। কিন্তু সানাই সেই মাছ, পাখি দেখেই অত্যুৎসাহিত হয়ে তাতে রঙ করতে শুরু করে। কিন্তু দু এক পোঁচ রঙ চাপিয়েই উৎসাহ হারিয়ে অন্য কিছু এঁকে দিতে বলে। দশমিকের পরে পৌনপনিকের মত আমি একই জিনিস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আঁকতে থাকি। কারণ আঁকার ব্যাপারে আমার ভোকাবুলারি যথেষ্ট লিমিটেড। ছোটবেলায় সেই একটাই সীনারী আঁকতাম আমরা সবাই। একটা কুঁড়ে ঘর, একটা রাস্তা চলে গেছে সামনে দিয়ে। পাশে একটা গাছ। পেছনে পাহাড়, পাহাড়ের কোলে সূর্য আর কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে দিকভ্রান্ত। ওরকম দু একটা জিনিসেরই নক্সা বানাতে পারি। 

কিছুক্ষণ রঙ করে তারপর অন্য খেলা। আমায় বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। আর ও প্রায় WWF-এর স্টাইলে বিভিন্ন কোণ থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর। সে ভারি গোলমেলে খেলা। কোনোভাবে চোখ-নাক-মুখ ইত্যাদি ভাইটাল অর্গানগুলো বাঁচিয়ে সে অত্যাচার সহ্য করতে হবে। প্রতিবার ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর অকারণ খিল খিল করে হাসি। আসলে ওদের হাসার জন্য কোনো কারণের দরকার হয় না। ছোট থেকে বড় হওয়ার কোনো এক পথের বাঁকে আমাদের এই অকারণে হাসির ক্ষমতাটা ফেলে আসতে হয়। 

ঠিক সাড়ে তিন মিনিট পরে সেই খেলাটায় বোর হয়ে গিয়ে আবার অন্য খেলা। কিছু কিছু খেলা আমার এই বুড়ো হাড়ে যথেষ্ট স্ট্রেসফুল। একটা যেমন কোন একটা কাল্পনিক ভুতের ভয়ে ক্রমাগত দৌড়ন। সানাই “ভুত আচছে, ভুত আচছে” বলে ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে আর আমার কাজ হল সেই ভুতের ভয়ে ওর সাথে ছুটতে থাকা। মাঝে মাঝে ঢিলে দিলেই ভাগ্যে জুটছে বকুনি। “বাবা ভুত” বলে চিল চিৎকারে কানের পর্দার দফারফা করে দেবে। 

আর একটা আছে ঘুম ঘুম খেলা। ওর ছোট্ট একটা খেলনা বিছানায় এসে দুজনে মিলে শুতে হবে আর নাক ডাকতে হবে। যদি মনে করেন এই খেলাটায় অ্যাক্টিভিটি কিছু কম, আমাদের মত কুঁড়ে মানুষদের জন্য বাঞ্ছনীয় তাহলে খুব ভুল ভাবছেন কারণ খেলাটাকে ইন্টারেস্টিং করার জন্য প্রত্যেক তিরিশ সেকেন্ড পরে পরে উঠে একটা কাল্পনিক লাইটের সুইচ বন্ধ করতে হয় আর হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন – ওই সুইচ বন্ধ করার গুরুদায়িত্ব আমার ওপরেই পড়ে। মাঝে মাঝেই বলে উঠবে “বাবা, লাইট বন্ন”। “এই মাত্র তো লাইট অফ করলাম সানাই। বন্ধ লাইট তো আর আপনা আপনি জ্বলে উঠবে না” ইত্যাদি টাইপের যুক্তি খুব একটা কাজে দেয় না। সেই কাল্পনিক লাইট আবারও অফ করানোর জন্য চেঁচিয়ে মাথা ধরিয়ে দেবে। অগত্যা একবার করে শোয়া আর উঠে উঠে গিয়ে মিছিমিছি লাইট অফ করে আসা। সব মিলিয়ে বাবাকে স্লিম আর ফিট রাখার দায়িত্ব চওড়া কাঁধে নিয়েছে আমার কন্যা। 

এর থেকেও গোলমেলে খেলা আছে। যেমন ডাইনিং টেবিলের তলাটা ওর হট ফেভারিট। এবং ওর আদেশে ওর পেছন পেছন আমাকেও ঢুকতে হয় সেই অপরিসর জায়গাটাতে। ওর দু ফুটের শরীর তো দিব্যি ফিট হয়ে যায় কিন্তু আমার ওখানে ঢুকতে আর বেরোতে রীতিমত কসরত করতে হয়। ভেতরে বসে থাকার সময়টাও খুব একটা আনন্দদায়ক নয়। কিন্তু কি আর করা? ওর মুখে হাসি দেখার জন্য কেন যেন মনে হয় সব কিছু করা যায়। 

মাঝে মাঝে ভাবি বোধ হয় ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুযায়ী “যোগ্যতমের উদবর্তন”-ই এর জন্য দায়ী? আমাদের মানুষদের এই অপরিসীম অপত্যস্নেহ এটাই কি আমাদের বাঁদর থেকে মানুষ করেছে? সন্তানস্নেহই কি আমাদের অন্য পশুদের থেকে যোগ্যতর করেছে? ওর সাথে খেলতে খেলতে মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় ঠাকুরের দু কলি গান – “তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়/আনন্দে তাই ভুলেছিলেম কেটেছে দিনবেলা”। কখনো কখনো ওর মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে চোখে জল নিয়ে যখন আমার কোলে এসে ওঠে তখন একটা অদ্ভুত গর্বে বুক ফুলে ওঠে। নিজেকে ঈশ্বর মনে হয়। অফিস থেকে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই চা খাওয়ার অবসর না দিয়েই সে টেনে নিয়ে যায় তার খেলার ঘরে। বিরক্ত লাগে। কিন্তু তবু পরের দিন বাড়ি ফেরতা ট্রেনে মনে পড়ে যায় সেই প্রতীক্ষারত প্রিয় মুখটা। আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে ওকে রক্ষা করতে হবে, ওকে একজন মানুষের মত মানুষ, একজন দরদী মানুষ করে গড়ে তুলতে হবে – নীরবে এই প্রতিশ্রুতি করি মনে মনে।

Leave a Reply