এক পিস দেড় ফুটিয়া আর এক পিস তিন ফুটিয়া যে বাড়িতে থাকে সে বাড়ির অভিভাবকবৃন্দ নির্বাণ লাভ করার পথে যে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে সে সুধীজন মাত্রেই স্বীকার করবেন। আমরাও “দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেসু বিগতস্পৃহ” হয়ে গেছি অনেকদিন। ছো্টখাটো ট্যাঁ ফোঁ ধর্তব্যের মধ্যে আনি না। বড় জোর সানাই অর্থাৎ আমার বড় কন্যা সানাই বাজানো শুরু করলে ওর ঐ নামকরণ করার জন্য মনে মনে স্ত্রীকে অভিশম্পাত করি। মুখে করি না। কারণ নিশ্চয় বলে দিতে হবে না। আমার একটা বই দুটো মাথা নেই আর সেই মাথাটা রসনাতৃপ্তির কাজে আমার প্রধান সহায়ক। তা রসনা বলতে মনে পড়লো বছরে একদিন করে আমার জন্মদিন থাকে। আজ যেমন ছিল। জন্মদিন থাকার প্রধান সুবিধে হল বৌয়ের ওপর আমি আমার স্বভাব অনুযায়ী হম্বিতম্বি করলে বৌ পাল্টা আক্রমণ শানায় না। আর কাঁসার থালায় খাবার পাই। সে প্রায় কোটি কোটি পদ। একটার পাশে একটা রেখে দিলে পৃথিবী থেকে চাদে পৌঁছনো যাবে। আজও তেমন পেয়েছিলাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি চুরাশি রকমের পদ এবং অপর প্রান্তে গৃহিনীর হাসি হাসি এবং প্রশংসার-আশায়-প্রোজ্জ্বল মুখ দেখলে আমি একটু নার্ভাস বোধ করি কারণ আমার পেটের পরিসর নেহাতই এক কামরার ফ্ল্যাট, দালানকোঠা নয়। অথচ সব কটা পদ যাকে বলে ঠিক করে অ্যাপ্রিশিয়েট না করতে পারলে আমার পদস্খলন হতে পারে অর্থাৎ হতাশাজনিত কারণে গৃহিনীর সিংহিনী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমি যখন এই অজস্র পদের ভুলভুলাইয়াতে দাঁড়িয়ে মাথার মধ্যে একটা ডিটেইল্ড এক্সিকিউশান প্লান ছকে নিচ্ছি, সে সময় উদয় হল আমার সুলক্ষণা বড় কন্যা সানাই। সে সকাল থেকে বাবার হ্যাপি বাড্ডে জনিত কারণে মহোৎসাহে গোটা তিনেক কার্ড মেখে ফেলেছে। তার মধ্যে একটা ছিল বাটারফ্লাইরা বাড্ডেতে এসে ফ্লাওয়ারের জুস খেয়ে হেভি মৌজ মস্তি করছে। এখন দাবি সে বাবাকে খাইয়ে দেবে। জন্মদিনে প্রথম পাতে পায়েস খাওয়া হয়। সে কথা তাকে জানাতেই সে এক চামচ পায়েস তুলে কিছুটা আমাকে আর কিছুটা আমার কাচা টি শার্টকে সরাসরি অফার করে দিল। টি শার্ট থেকে টুপটুপ করে অধোগতি প্রাপ্ত গড়িয়ে নামা পায়েস মুছেটুছে, সানাইকে মৃদু ভর্ৎসনা করে (সানাইয়ের তাতে বিশেষ অনুতাপ হল বলে মনে হল না), সবে খাওয়াতে মনসংযোগ করেছি সানাই তেজের সঙ্গে জানাল সে আরো খাওয়াতে চায়। অতএব শাক ভাজা দিয়ে ভাতের অপার্থিব স্বাদ উপভোগ করার মাঝেই আর এক চামচ পায়েস খেয়ে নিতে হল। ভাবলাম যাক ঝামেলা মিটল। কিন্তু রোগের প্রকোপ যেমন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় সেরকম সানাই আমায় এর পরের পনের মিনিটে মাছের সাথে পায়েস, পটলের দোলমার সাথে পায়েস, আলুভাজার সাথে পায়েস খাইয়ে সুচিন্তিত ভাবে আমার স্বাদকোরক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে থাকল। ধৈর্যের পরীক্ষাও বলা চলে। ফলতঃ আমি ইলিশ মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খেতে খেতে সানাই দত্ত আমের চাটনি খেলাম। পটলের দোর্মার দুরন্ত স্বাদ মাঠে মারা গেল কারণ সাথে এক মুঠো সাদাভাত, হ্যাঁ একদম প্লেইন সাদা ভাত, খেতে হল।
আমার স্ত্রীয়ের রান্নার হাতটি খাসা। কিন্তু সানাইয়ের অশেষ বদান্যতায় যে মোটের ওপর সমস্ত টেস্টের গুষ্টির তুষ্টি হয়ে গেল সেটা বোধ হয় সুধী পাঠক বুঝতেই পারছেন। এইভাবে খাওয়া পর্ব চালিয়ে যখন শেষ পাতে পৌঁছেছি এবং যুত করে আমের পায়েসের বাটিটা ধরে সেই অমৃতসম লেহ্য পদ দিয়ে জিভের সুখবিধান করতে এক চামচ মুখে দিয়েছি, সানাই আমাকে আমার প্রথম পাতের ছেড়ে আসা একটা জাম্বো সাইজ উচ্ছেভাজা অফার করল। পায়েসের সাথে উচ্ছে? আপনারাই বলুন কাঁহাতক সহ্য করা যায়। আমি ফুট ডাউন করলাম। না সানাই, উচ্ছে এখন খায় না। কিন্তু ততক্ষণে ওর মাথায় খুন চেপে গেছে। উচ্ছে আমায় ও খাইয়েই ছাড়বে। আমিও উচ্ছে কিছুতে খাব না। শেষমেশ ধুন্ধুমার কাণ্ড, ওর মায়ের বকুনি এবং ফলস্বরূপ সানাইয়ের সপ্তম সুরে সানাই বাজাতে বাজাতে পা ঠুকে ঠুকে সোফার দিকে প্রস্থান। এর মধ্যে ওর বোনু অর্থাৎ তাথৈয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গেছে। সে কোনোরকম পূর্বলক্ষণ না জানিয়ে তারস্বরে কাঁদতে শুরু করল। বাবার দুঃখে না নিজের দুঃখে না দিদির দুঃখে নাকি দিদিকে সঙ্গত দেওয়ার জন্য সেটা বোঝা গেল না। শুধু এই দ্বিবিধ আক্রমণে আমার খাওয়ার অবশিষ্ট ইচ্ছার পরলোক প্রাপ্তি হল। আমি কোনমতে বাকি পায়েসটুকু মুখে ঠুসে দিয়ে দুই রত্নসম কন্যার কান্না থামানোয় তথা বাড়ির শান্তি বিধানে উদ্যোগী হলাম। জিভ সেবা, সাংসারিক ভোগসুখ থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে আমাদের নির্বাণ লাভের পথ প্রশস্ত করাই যে আমার কন্যারত্ন দ্বয়ের মূল উদ্দেশ্য সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহই রইল না।
