সাইকেল বিহার – রম্যরচনা

[এই স্মৃতিচারণটি আমার নিজের শহর রামরাজাতলার ওপর। কিন্তু যেকোনো শহরতলির মানুষ আশা করি রিলেট করতে পারবেন। ১৫ নভেম্বর, ২০১৭-এর স্মৃতিচারণ ]

কদিন হল নিজের শহরে এসেছি। আজ সারাদিন বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোই নি। পুরোদিন বাড়িতে বসে শুষে নিয়েছি স্মৃতিগন্ধবাহী রূপকথাদের।

সারাদিন বাড়িতে বসে বসে হাতে পায়ে কেমন একটা জং ধরে যায় না? বেরিয়ে পড়লাম আমার প্রিয় সাইকেলটা নিয়ে। আমি ছাড়া আমাদের বাড়িতে আর কেউ সাইকেল চালানোর নেই। আগে বাবা চালাতো। এখন বয়স হয়েছে। আর সাইকেল চালায় না। বাবার এখন পদব্রজেই বিস্তার। দাদাও সঙ্গত কারণেই মোটর বাইকে শিফট করে গেছে। তাই প্রতি বছর দেশে ফিরলেই দেখি সাইকেলটা দুয়োরানির মত এক কোণে পড়ে আছে। কালিঝুলি মাখা জীর্ণ অবস্থা। আমি সাইকেলটাকে যা একটু প্যাম্পার করি। নিয়ে গিয়ে বাচ্চুদার দোকানে ফেললেই এক বেলার মধে চক্‌চকে স্মার্ট। এন-আর-আই  দেখে বাচ্চুদাও একশো টাকা হাঁকিয়ে বসে। দরাদরি করাটা কোনোদিনই আমি ঠিক ভাল পারি না। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে একটি পাতা ধরিয়ে বাহনটিকে হস্তগত করি। সেই সাইকেলটা নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাব কিছু ঠিক না করেই প্যাডেলে চাপ দিয়ে আমি সাইকেল আরোহি। বিনা কারণেই দুবার বেলটা টিপে দিই। টুং টুং টুং টুং। কি মিঠে শব্দটা। পথচারীদের পথ ছেড়ে দেওয়ার জন্য কি সুশীল, বিনীত অনুরোধ। যেন দুটো টুনটুনির ফিরিঙ ফিরিঙ প্রেমালাপ। বাইকের উদ্ধত হর্ন যদি ইয়ো ইয়ো হানি সিং হয় তবে এ যেন রাখালিয়া বাঁশি। এই সাইকেল চালানোটা আসলে আমার একটা style statement। মায়ের বুকের স্তন্যদুগ্ধের মত এই সবুজ গ্রহের বুক থেকে শুষে আনা ফসিল ফুয়েলের অবিরত অপচয়ের সামনে দাড়িয়ে এই যে মন্দগতি অথচ শব্দদুষণ, বায়ুদুষণরহিত যানটি – এ যেন এই উত্তুঙ্গ, তিল তিল করে আত্মহননের পথযাত্রী সভ্যতার বুকে একটা কড়া থাপ্পড়। আমি যখন সাইকেল আরোহি, দেখি এক অদৃশ্য placard লাগানো আছে আমার handle-এ “এই পৃথিবী আমায় একটু বেশি  ভালবাসে কারণ আমি আমার চলার পথের পাথেয় স্বততই তার স্তন্যদুগ্ধ পান করে সংগ্রহ করি না”।

 

আমাদের রামতলার রাস্তায় সাইকেল চালানোর জন্য যে gymnastic skill আয়ত্ত করার দরকার পড়ে সেটা রীতিমতো আয়াসসাধ্য – দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়ে সেটা আয়ত্ত করতে হয়। আপনার সাইকেলের পূর্ব-পশ্চিম-ঈশান-নৈঋত সব দিশাতেই ইঞ্চিখানেকের দূরত্বে নিশ্বাস ফেলছে বাইক, রিকশা, চারচাকা আর পদচারীরা। হাওড়ার গলিগালা, বড়রাস্তা সকলই কিঞ্চিত সরু, অপরিসর। এ কথা সকলেই জানে। আর বহুতল ফ্ল্যাটবাড়িগুলো আগমনের সাথে সাথে মানুষ যেভাবে বেড়েছে সেভাবে রাস্তাগুলো পেটমোটা হবার সুযোগ পায় নি। নিজেদের শীর্ণ ক্লীশ শরীর নিয়ে মানুষের পদভারে নীরবে ত্রাহি ত্রাহি করছে তারা। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বরূপ ইদানিং যোগ হয়েছে টোটো। শব্দহীন এই ত্রিচক্রযানটিও আপনার আগে-পিছে-ডাইনে-বাঁয়ে, শিশু প্রহ্লাদের ইষ্ট নারায়ণের মতই, সর্বত্র বিদ্যমান। এ হেন পরিস্থিতিতে গতিশীল সবরকম যানবাহনের মধ্যে একটা নির্ভুল সুষমা বজায় রেখে এবং অভিকর্ষের নিরন্তর ডাককে উপেক্ষা করে এই দ্বিচক্রযানের পিঠে করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা শিল্পকলা বললে বোধ হয় সত্যের অপলাপ হবে না। আমি নিশ্চিত রামতলায় যারা সাইকেল চালাতে পারে তাদের কোন বিলিতি সার্কাসে ওই দড়ির ওপর দিয়ে সাইকেল চালানো ইত্যাদি খেলায় অবলীলায় সুযোগ মিলতে পারে। তার ওপর আছে পান থেকে চুন খসলেই যাকে বলে হেভি বাওয়াল। এই দ্রুতগতি জীবনের সাথে পা মিলিয়ে চলতে থাকা অসহিষ্ণু ক্লান্ত মানুষগুলির মুখ থেকে একটু এদিক ওদিক হলেই বেরিয়ে পড়ছে দু অক্ষরের সেই লিঙ্গসূচক শব্দটি। মনুষ্যজাতীয় প্রাণীর সাথে যদি বা সমতান বজায় রাখতে পারেন, চতুষ্পদদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রাখা আর একটা শিল্প। একটু ফাঁকা গলি হলেই এ পাড়া ভার্সেস ও পাড়ার কুকুর মন্ডলীর gang fight-এর মধ্যে পড়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। আপনাকে “ইস্পাতের মত মজবুত আর ঠান্ডা স্নায়ু” যাকে বলে “নার্ভ অফ স্টীল” বজায় রেখে শক্ত হাতে একটা optimum স্পিড-এ তাদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এরা সাধারণত কামড়ায় না কিন্তু যেভাবে উচ্চৈঃস্বরে নিজের এলাকার দখলদারির সরব দাবি জানায় তাতে কামড়াবে না এই ভরসা রাখাটা যে সহজ নয় সেটা সহজেই অনুমেয়।

 

এইভাবে হেমন্তের মিঠে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে সাইকেলে চেপে পথ বাইতে বাইতে রামতলা বাজার পেরিয়ে সাঁতরাগাছি মোড় পেরিয়ে নতুন রাস্তার মোড়। তখন পথের নেশা চেপে বসেছে। প্যাডেল করতে করতে দালালপুকুর। কয়েকটা অতিকায় গাছ ঝুঁকে পড়ে ঐ ক্ষুদ্র জলাশয়টিকে যেন সভ্যতার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থেকে সশস্ত্র প্রহরীর মতই রক্ষা করছে। আর একটু এগিয়ে গেলে কিছু বছর আগে হলেও পেতেন পার্বতী সিনেমা আর তার একটু পরে শ্যামাশ্রী সিনেমা। কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পপকর্ন সমৃদ্ধ multiplex – এর যুগে আজকাল এই ধরনের একক ছবিঘরেরা, whatsup এর যুগে নিতান্ত টেলিগ্রামের মতই, outdated। আমাদের রামতলার শ্যামলী সিনেমা, যেখানে আমার মনে থাকা বয়সের প্রথম ছায়াছবি kingkong and godzilla দেখেছি, তার মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। এই সিনেমা হল দুটো বৃদ্ধ হেঁপো রুগির মত বেঁচে থাকার লড়াইটা চালিয়েছিল অনেকদিন। সভ্যতার অভিঘাতে মারা গেছে বছর দুয়েক হল। স্বর্গত শ্যামাশ্রী সিনেমা পেরিয়ে চলতে চলতে যখন মল্লিক ফটক পৌঁছলাম তখন মনে হল এতদূর এলাম যখন গঙ্গার ঘাটটা দেখে যাব না? অতএব ফের প্যাডেলে চাপ। মল্লিকফটক পেরিয়ে গঙ্গাগামী হলেই আপনি দেখবেন একটা সম্পূর্ণ অন্য সভ্যতা, এক অচেনা পরিবেশ। আলো ঝলমল, দোকানে দোকানে ছয়লাপ শহুরে সভ্যতা হঠাৎ যেন মৃত্যুগর্ভে বিলীন। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। এই এলাকাটি মূলতঃ হিন্দি ভাষাভাষী অবাঙ্গালী অধ্যুষিত। বিহার থেকে জীবিকার সন্ধানে কয়েক পুরুষ আগে এরা এখানে এসেছে। এই কয়েক পুরুষেও জীবন যুদ্ধে খুব একটা সফল যে হতে পারেনি তার পরিচয় মিলবে বাড়ি-ঘর-দোর-দোকানপাটের চেহারা দেখে। আর্থিকভাবে অনুন্নত এই এলাকাটা একটা মিনি বিহার বলা চলে। পার্থক্য একটাই। এরা প্রায় প্রত্যেকেই ঝরঝরে বাংলা বলতে পারে প্রয়োজনে। সন্ধ্যে নটার পরে গেলে যদি কান খাড়া রাখেন দু এক কলি “রামা হৈ” কি হনুমান চালিশা শুনতে পাবেন। কিছু নির্বিবাদী মানুষ খালি গায়ে বসে লিট্টী সহযোগে নৈশভোজ সম্পন্ন করছে দেখতে পাবেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই গোটা ছয়েক ছাতুর সরবতের স্টল স্পট করে ফেলতে অসুবিধে হবে না। কখনো সুযোগ হলে একবার চেখে দেখবেন। আমাদের Cafe Coffee Days-এর চারশো টাকার পানীয়ের তুলনায় এই দশ টাকার (এখন বোধ হয় কুড়ি) ছাতুর শরবৎ লেবু আর মশলার ঝাঁজে খুব একটা কম সুস্বাদু নয়। শেষমেশ একটু-আধটু রাস্তা গুলিয়ে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা বাঁক ঘুরতেই আসন্ন সেই সুবিস্তীর্ণ গঙ্গা। সাইকেলটাকে stand করে দাঁড়াই। এখানে গঙ্গার রূপ কিন্তু স্বচ্ছসলিলা, পূণ্যতোয়া নয়। সেই হরদুয়ার থেকে এই আগ্রাসী সভ্যতার উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করতে করতে এইখানে এসে তার ক্লান্ত জীর্ণ রূপটি চোখে পড়ে। হরিদ্বারের পায়ে নূপুর পরা কিশোরী গঙ্গা এইখানে এসে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েছে। পুরো এক জীবনের অবসাদ। কিন্তু তাতে কি? এই যে সুদীর্ঘ পাচ হাজার বছর ধরে এই আর্য-অনার্য সভ্যতাকে মায়ের মত মমতায় লালন করল? সেই মাতৃস্বরূপার পরম স্নেহপরশটি পেতে হলে বুক ভরে শ্বাস নিন। নিঃশ্বাসের সঙ্গে মনের সব জঞ্জাল বের করে ঐ গঙ্গাজলে মনে মনে সঁপে দিন। সারা উত্তর ভারতের জঞ্জাল নিয়েছেন যিনি আপনারটাও নেবেন। নিরাশ করবেন না।  আজ আবার কার্তিক পূজোর বিসর্জনের দিন। একটা বড়সড় কার্তিক ঠাকুর এল ভ্যানে করে। ধুপ ধুনো দিয়ে হাতে মিস্টির প্যাকেট ধরিয়ে চিবুকে চুমু খেয়ে তাকে বিদায় করছে বিবাহিত মহিলারা। এই মাটির প্রতিমার প্রতি কি অপ্রতিম সন্তান স্নেহ। এখন সঙ্গত কারণেই জলে প্রতিমা বিসর্জন নিষেধ। গঙ্গাপাড়ে নামিয়ে যাওয়াই দস্তুর। যতক্ষণ এই বিদায়পর্ব চলল চারটে অর্ধনগ্ন ছেলে এসে দাড়িয়ে রইলো যেন মৃত্যুপথযাত্রী কোনো প্রাণীর আশেপাশে ভিড় করা শকুন। জীবনযুদ্ধে পরাভূত সমাজের প্রতিনিধি এরা মৃন্ময় দেবতার হাতে মিস্টির প্যাকেটের বিলাসিতা সহ্য করতে অপারগ। বিসর্জনে আসা মানুষগুলো চলে গেলেই কার্তিক ঠাকুরকে দেওয়া সব জাগতিক সম্পদ এই জ্যান্ত কার্তিকরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। বিসর্জনে আসা মানুষগুলোর কথাবার্তা একটু আধটু কানে এল। কানে এল বললে একটু মিথ্যে বলা হবে। আমার একটু আড়ি পাতা স্বভাব আছে। বিশ্বাস করুন কারও ক্ষতি করার জন্য নয়, অন্যের বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরী করতে সম্পূর্ণ অচেনা লোকেদের কথা কখনো সখনো চেখে থাকি।  ধর্মবিশ্বাসী লোকগুলো বলাবলি করছে কার বাড়িতে জোড়া কার্তিক ফেলার ফলে যমজ ছেলে হয়েছে। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় কিন্তু সভ্যতার আলো যত উজ্জ্বলতর হয়েছে তত এই ধরণের কার্য-কারণ সম্বন্ধে আস্থা রাখা হয়েছে দুঃসাধ্য।

 

অবশেষে গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া অনেকটা ফুসফুসে ভরে নিয়ে ফেরতা পথে সাইকেল ধরলাম। হিসেব করে দেখলাম ফেরার পথটা হবে পাঁচ কিমির কিছু বেশি। যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় দশ কিমি। ভাবছেন উরিব্বাস এ তো অনেকটা পথ? আমি কোনো অতিমানব নই, sportsman-ও নই, বছরে একবারই দেশে ফিরে সাইকেলে চড়ি – আসলে দশ কিমি সাইকেল চালানোটা আদৌ কোনো শক্ত ব্যাপার নয়। মেন্টাল ব্লক আর আপনার ভটভটি অর্থাৎ মোটর বাইকটিকে একদিনের জন্য নির্বাসন দিলেই দেখবেন কাজটা জলের মত সোজা। আর ঐ যে বললাম – দূষণ না ছড়ানোর জন্য এই পৃথিবীই আপনাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করবে, সাহস জোগাবে। ফেরার পথে আর একটা procession দেখলাম যে মিছিলটায় আমাদের সবাইকে একদিন না একদিন সামিল হতে হয়। যত খেদ, ঘৃণা মানসিক কলুষ, যত মিথ্যা জৌলুস সব পিছনে ফেলে রেখে হরিধ্বনি দিতে দিতে আর  বিন্নি খৈ ছড়াতে ছড়াতে আমাদের সবাইকে উত্তর পুরুষ পৌছে দেবে আমদের অন্তিম শয়ানে। তবে কেন এত হিংসা, প্রতিযোগিতা শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান? রামতলা বাজার দিয়ে ফেরার পথে হঠাৎই চোখে পড়ে গেল নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে দোকানের নাম “জয়নগরের মোয়া”। সাইকেলের ব্রেকটা কোন শালা টিপল ঠিক জানিনা। কিন্তু দেখলাম দোকানের সামনে আমি সাইকেল থেকে নেমে দণ্ডায়মান। আশি টাকায় আটটা জয়নগরের মোয়া (মানে আদতে রামতলারই। কিন্তু ঐটুকু ব্র্যান্ডিং না করলে আমি দাঁড়াতাম বলুন?) কিনে বাড়ি ঢুকলাম যখন তখন সাড়ে নটা। দেড় ঘন্টার সাইকেল সফরে প্রাণ-মন চাঙ্গা। আজকাল শপিং মল-এ হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে আনন্দ কেনাই দস্তুর। তার বিরুদ্ধে সওয়াল করছি না। কিন্তু মাঝে মাঝে এ ভাবেও আনন্দ কেনা যায়। সাইকেলের maintenance cost টা যদি না ধরেন, মোট খরচা আশি টাকা আর বেশ কিছুটা ক্যালরি যেটা কিনা আমার মধ্যপ্রদেশের প্রগতি রুখতে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে। অবিশ্যি মোয়াগুলো খেয়ে সেটা মেকআপ হয়ে যাবে। কারণ বাঙালির প্রায় পরিচয়পত্র স্বরূপ নোয়াপাতি ভুঁড়ি নিয়ে যাকে বলে “No Compromise”!!

23 thoughts on “সাইকেল বিহার – রম্যরচনা

  1. Anonymous

    Chotobelar shyamali cinema hall,chinebadam vaja,ramtalar mela -sab smriti vese uthlo.shyamalir ultodiker dujan panolar kathao.khub sastay misti pan dito.Sei bayese pan khaoa prai baro haoar sangei mile jeto.

Leave a Reply