কাগজের নৌকো – রম্যরচনা

আহা রে মন আহা রে মন আহারে মন আহারে আহা।

 

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি বউ বাড়ি নেই। দূরভাষযোগে জানা গেল মিশিগান হ্রদের সৈকতে হাওয়া খেতে গেছে। শীতের দেশে এই গরম কালের চারটে মাস সকলেরই ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। আমার এই শহরতলিতে তখন ফুরফুরে হাওয়ে বইছে। মিঠে। বাতাসে প্রথম প্রেমে পড়ার শিরশিরানি। কোএড কোচিং-এ পড়তে যাওয়ার আগে দশ-ক্লাস-অব্দি-বয়েজ-স্কুলে-পড়া মনের উথালপাতাল মনে। বাড়ির বাইরে মেঘের নরম তুলোট আদরে ঢেকে থাকা সুয্যিমামার লাজুক হাসি। মনের মধ্যে শবেবরাতের সন্ধে নামার খুশি। সবে এক কাপ চা বানিয়ে এমন গোধূলি লগনটাকে উপভোগ করতে বারান্দায় বেরিয়েছি, কাপের গরম সবুজ তরলে ঠোঁটের আলগা স্নেহ ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই ঝুপুস বৃষ্টি নামলো। সারাদিনের ফ্যা ফ্যা রোদ্দুরে বাড়ি-লাগোয়া কাঠফাটা কাঠের  উঠোনে বৃষ্টিকণাদের লুটোপুটি আর হুল্লুড় শুরু বিনা নোটিশে। বড় বড় ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে মাটি। শুষে নিচ্ছে সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদ। মনে পড়ে যাচ্ছে ছেলেবেলা। সেই খড়গপুরের ছোট্ট কোয়ার্টার। যেখানে জায়গা ছিল কম। শান্তি ছিল বেশি। মনে পড়ে যাচ্ছে হু হু রোদ-পোড়া দিনের শেষে কালবৈশাখী। ফটাফট্‌ অঙ্ক খাতার পাতা ছিঁড়ে সেই আয়তাকৃতি প্যাপিরাস দিয়ে বানিয়ে ফেলা কাগজের নৌকো। যেন কোন পূর্বজন্মের কথা। ভাঙাফাটা সিমেন্টের উঠোনের পশ্চিম দিকটা দিয়ে অঝোরে বয়ে যাচ্ছে জল। তখন আমার কাঁচা বয়স। অপু মন। সেই ঝরঝরিয়ে বয়ে চলা হঠাৎ-নির্ঝরিণীতে ভাসিয়ে দিচ্ছি পাটিগণিতের নৌকো। কেশব চন্দ্র নাগ দুলতে দুলতে ভেসে যাচ্ছে ঐ দূরে। এই জলে ভরে উঠল আমার মাঝিবিহীন কাগজের নৌকোর সংক্ষিপ্ত পরিসর। সে বেচারা ওপরের আর নিচের জলের চাপে পানকৌড়ি-ডুব দিল জলের মাঝে। আবার আর একটা নৌকো ছাড়লাম। এলোমেলো হাওয়া বয়ে চলেছে হরিণ শিশুর মত। সেই হাওয়ার অবিমৃষ্যকারিতায় একবার জলের ছাঁট এদিক থেকে আসে, তো পরের বার আসে ওদিক থেকে। তারে শুকোতে দেওয়া ভিজে জামা কাপড় ভিজে জাব। দে টান দে টান। সাগরের ওপার থেকে ভেসে আসছে মায়ের গলা- “বাবাই ঢুকিয়ে আন জামাকাপড় গুলো। সব ভিজে গেল রে। ঘরের সব জানলা বন্ধ কর রে”। তড়িঘড়ি ব্যস্ততা। কিন্তু সে সব মায়ের কাজ। আমার তাতে মন নেই। আমি আমার নৌকোর ভয়েজ দেখতে ব্যস্ত। ওই শুরু হল শিল পড়া। এক ছুট্টে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কদম গাছের নিচে। ঘন গন্ধ নিয়ে কদম ফুল গুলো ঝরে ঝরে পড়বে। ঝরে পড়বে কৃষ্ণচূড়া কুঁড়ি। সেই পুষ্পবৃষ্টির মাঝে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কোঁচড় ভরে কুড়িয়ে আনতে হবে। সারা সন্ধে ধরে বাড়িতে বসে আলতো নখের আদরে ফুটিয়ে তুলব ফুলগুলোকে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসবে খিচুড়ি-ডিমভাজার সুবাস আর একটা মা-মা গন্ধ। ওই তো ঝরঝরিয়ে শিল পড়া শুরু। তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মত কুড়োচ্ছি আর মুখে পুরছি। সত্যি, বরফেরও ওরকম স্বাদ হয়? পৃথিবীর আর এক প্রান্তে মৌরুসিপাট্টা জমিয়ে বসেছি। কিন্তু এই সাঁইত্রিশ বছরে দেখা চোদ্দটা ফ্রিজের কোনটার বরফে অতো স্বাদ পাইনি। কচরমচর করে চেবাও। মুখে অনাবিল আনন্দের ঝিলিক। বাড়িতে ঢুকেই শঙ্কিত-মায়ের-কড়া-বকুনির-সম্ভাবনার তৃপ্তি লেগে থাকে মুখে। একটা বড়সড় গোছের শিল মাথায় ঠাঁই করে পড়লেই ফুলে চাঁই। ওই যে শিউলিদের আম গাছটা থেকে টুকটাক করে পড়তে আরম্ভ করেছে শিশু ফল গুলো। ওদের অকালপ্রয়াণে আমার বালক মন আনন্দে শিহরিত। ছুট ছুট ছুট। আমগাছটার তলায় এসে ফটাফট্‌ দক্ষ হাতে কাঁচা আম কুড়োনোর বর্ষাপিয়াসী প্রসন্নতা। বাড়িতে ঢুকেই বৃষ্টি-অর্জিত সেই অমূল্য সম্পদগুলোকে ছাল ছাড়িয়ে হাল্কা নুনে জারিয়ে আমাদের সেই ছোট্ট ফ্রিজে শীতল শয়ন দেওয়া। আগামিকাল স্কুল থেকে ফিরে তার অম্লরসে জিভের স্বাদকোরকগুলোকে বিয়ে-বাড়ির-ফুর্তি-আর-রোশনাই প্রেরণ। সেই ছোট্টবেলার আমার শহরের জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচুড়া রাধাচূড়ার মত এই দূর প্রবাসেও আমার প্রতিবেশী, আমার দোরগোড়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চিরসখা দুটো দেবদারু গাছ। এখানে আদর করে ওদের বলে ক্রিস্টমাস ট্রি। কিন্তু সেই নামে ডাকলে আমার বাঙালি শহরতলীয় পরাণে কি দেবদারু নামের রোমান্টিকতা আসে? হাত-পা ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে গাছ দুটো একমনে। যেন এই মুহুর্তে বৃষ্টিতে ভেজাই ওদের একমাত্র কর্তব্য। পাতায় জলসিঞ্চন করা ছাড়া আর কোনো কাজেই তাদের উৎসাহ নেই।

 

হুড়ুদ্দুম করে ছপ্পড় ফাড়কে চিলগতিতে মিনিট পনের ধরে নেমে আসার পরে মেঘেদের ফাটল ফুড়ুত করে বন্ধ। আর তৎক্ষণাৎ শুরু এ পাড়ার পাখিদের বর্ষামঙ্গল গীতি। গোধূলির ঈষৎ রক্তিম আলোয় আর আর্দ্র মলয় সমীরে শরীর জুড়িয়ে গলা ফেড়ে একে অপরকে ডাকাডাকি। ওদের অবোধ্য ভাষায় ওরাও কি কাগজের নৌকোর কথাই বলছে? ভাবতে গিয়ে হঠাৎ বুঝতে পারলাম ছোটবেলার সেই কাগজের নৌকো বানানোর ম্যাজিক পদ্ধতিটা এই সুদীর্ঘ পথচলার কোনো বাঁকে ফেলে এসেছি, বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছি। এমন একটা প্রবাসী ক্ষণস্থায়ী কালবৈশাখী আমার জন্য অপেক্ষায় আছে জানলে কি ভুলতে পারতাম? যাই হোক কোই পরোয়া নেহি। পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারের বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে গেছে। ইউটিউবে ঢুকে ওরিগামি বলে খোঁজ করলে কাগজের নৌকো বানানোটা কি আর একবার মনে করিয়ে দেবে না? হয়তো বা। এখানে বাড়ির উঠোনে জল জমে না। বৃষ্টি হলে উঠোন-বাগান খরস্রোতা নদী হয়ে ওঠে না। তাতে কি? নৌকোটা আজ না ভাসিয়ে যদি পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিই? যদি আমার ডানা লোকানো ছোট্ট পরী, আমার কন্যাকে উপহার দিই? নিশ্চয় ও ওর বড় বড় খুশির ঝিলিক-ওলা চোখ নিয়ে হাত পেতে নেবে আর মিনমিনে অশ্রুত-প্রায় আধোআধো গলায় বলবে “হ্যাঁ বোত”।

আহা রে মন আহা রে মন আহারে মন আহারে আহা।

[ছবির নৌকোটা কিন্তু আমার এই লেখার পরে ইউটিউব ঘেঁটে আজই বানানো]

Leave a Reply