ভাষা – ছোটগল্প

[প্রকাশিত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত দখিনা পত্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, একটি আনন্দধারা উদ্যোগ

https://anandodhara.com/wp-content/uploads/2019/03/Dakhina.pdf  ]

ঠাম্মার একটা আঙুল নিজের আঙুলে জড়িয়ে নদীর বাঁধানো ঘাটটায় বসেছিল কাহিনী। তখন সবে সন্ধে নামছে। নদীর ওপারে ঐ দূরে লাল তামার চাকতির মত সূর্যটা গাছগাছালির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে আহ্লাদে আলো আর রঙের খেলায় মেতেছে। আকাশে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা মেঘখন্ডগুলোকে কখনো লাল, কখনো কমলা রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যেন কোন খেয়ালী চিত্রকর সমগ্র পরিবেশটাকে আরক্তিম করে তুলেছে। এইরকম সময়গুলোতে যেন কোন এক অদৃশ্য শক্তি মানুষকে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে যায়। ষোলো বছরের ফুটফুটে মেয়ে কাহিনী, সারাক্ষণ যার মুখে ফুলঝুরি ছোটে, সে অব্দি চুপ করে দেখছিল নদীর জলে আকাশের থেকে ঝরে পড়া সোনা আলো আর তার আবীর রঙের ঝিকিমিকি। কলকাতা থেকে কদিনের জন্য দেশের বাড়িতে দিদার কাছে এসেছে সে। তার কোমর লম্বা চুল মোটা ডাঁটো বিনুনি হয়ে তার সদ্যোদ্ভিন্ন বুকের ওপর আলগোছে পড়ে আছে। সন্ধের মৃদুমন্দ হাওয়ায় বিনুনির শেকল থেকে মুক্তি নিয়ে দু এক গুচ্ছ অবাধ্য চুল মুখের ওপর এসে পড়েছে। চোখের ওপর থেকে চুল সরাতে সরাতে কাহিনী জিগ্যেস করে উঠল

“আচ্ছা গ্র্যানি, শুনেছি, হোয়েন উ ওয়্যার এ কিড, তুমি আর তোমার গ্র্যানিও এই নদীর পাশে এসে বসতে।”

“হ্যাঁ রে। আমিও ঠিক তোর মত আমার ঠাম্মার হাত ধরে এই নদীর ধারে বসে কত বিকেল থেকে সন্ধে হতে দেখেছি। কিন্তু আজকাল আর এই নদীটাকে ঠিক চিনতে পারি না। অনেক বদলে গেছে।”

“কেন? সেই ছোটবেলা থেকে দেখছ। তাও চিনতে পারো না কেন?”

“আসলে নদীরা তো বহতা। সময়ের সাথে সাথে ওরা গতি পরবর্তন করে। ক্রমাগত রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যায়। আগে এর জল কেমন হাল্কা নীল ছিল। এখন কেমন ছাইরঙা হয়ে গেছে। ওপর থেকে জলের মধ্যে যে মাছগুলো দেখতে পাওয়া যেত তারও রঙ, আকৃতি, প্রকৃতি বদলে গেছে।”

“বহতা? ইউ মীন ফ্লোয়িং রাইট? কাম অন্ গ্র্যানি, তুমি না? মাঝে মাঝে কোন ভাষায় যে কথা বলো বুঝতেই পারি না। এনিওয়েজ, আচ্ছা একটা কথা বলো। তোমার গ্র্যানির সাথে তোমার গ্র্যানপার পারহ্যাপ্স লাভ ম্যারেজ তাই না?”

“ধুর বোকা। তখনকার দিনে এই আজকালকার মত প্রেম টেম হত না। আমরা, আমাদের মা ঠাকুমারা তোদের মত, ওই তোদের ভাষায়, আল্ট্রামডার্ন ছিল না। বুঝলি? কেন বল তো? তোর কেন মনে হল আমার দাদু ঠাকুমার প্রেম করে বিয়ে?”

“না মানে তোমার গ্র্যানি তো আই গেস বাঙালি না। তাই ভাবছিলাম।”

“ও মা। দিদিমা বাঙালি নয় কেন রে? দিব্যি নৈহাটির মেয়ে। অবাঙালি হতে যাবে কোন দুঃখে?”

“বারে তুমিই তো বলেছিলে তোমার গ্র্যানির নাম, লেট মী রিমেম্বার, কুমুদিনী। রাইট? তো সেটা তো আর বাংলা নাম নয়। ইন ফ্যাক্ট বাংলাতে এরকম কোন শব্দই নেই।”

“ধুর বোকা। কুমুদিনী একদম বাংলা শব্দ। এক ধরণের ফুল। যেমন আমার নাম কথা। তোমার মায়ের নাম যেমন করবী সেরকম।”

“রিয়েলি? উ মীন কুমুদিনী ইজ এ বেঙ্গলি ওয়ার্ড? তোমার নাম, মায়ের নাম – কথা, করবী একসেটরা বাংলা শব্দ জানি। কিন্তু কুমুদিনী?” অবিশ্বাসী চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে কাহিনী।

বিরক্তিতে মাথা নাড়েন বৃদ্ধা কথা সান্যাল। “হ্যাঁ রে। সত্যি কি দিনকাল এলো। তোরা, মানে তোদের প্রজন্ম বা তার পরের পরের প্রজন্ম, তোরা কি বাংলা ভাষাটাকে পুরোপুরি ভুলে যাবি? আজ থেকে আর একশ বছর পর ভাষাটা কি সত্যিই থাকবে? তুই তো ইংরেজি শব্দ ছাড়া এক মিনিটও কথা বলতে পারিস না। আর বাংলার অর্ধেক শব্দ অব্যবহারে অপ্রচলিত হয়ে পড়ছে দেখছি। তোর দাদুর নাম ভাস্কর। সূর্যের প্রতিশব্দ। ভাস্কর তো দূরে থাক তোরা সূর্য কথাটাই ভুলতে বসেছিস।  রৌদ্রোজ্জ্বল দিন হলে সেটাকে বলিস সানি ডে। কে জানে বাবা এই বাংলা ভাষাটা থাকবে তো?”

কাহিনী মুখে মিচকে ফাজিল হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে কথার গলা জড়িয়ে ধরল। গাঢ়স্বরে ডাকল “ঠাম্মা”। সে জানে গ্র্যানিকে ঠাম্মা বলে ডাকলে তার সব রাগে জল ঢালা হয়ে যায়। কথা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন “বল”।

“তোমায় কে বলেছে এগুলো ইংরেজি শব্দ। এই যে সানি ডে, লাভ ম্যারেজ, গেস যে শব্দগুলো আমি ইউজ করেছি এতক্ষণ, এগুলো তো বাংলা শব্দই ঠাম্মা।”

“আবার ফাজলামি করছিস? এগুলো কবে থেকে বাংলা শব্দ হল শুনি?”

“ধরো যদি বলি, আজ থেকে ঠাম্মি? একটা কথা বলো। আক্কেল, আসল, এলাকা, ওজন এই শব্দগুলো বাংলা তো ঠাম্মা?

“হুম”

“আর, আর আওয়াজ, আন্দাজ, আয়না, খারাপ?”

“ও মা, ওগুলো বাংলা হবে না কেন? তুই কি বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“এই ওয়ার্ডসগুলো ঠাম্মা বাংলার পার্ট ছিল না ফর ইটার্নিটি। প্রথম চারটে শব্দ আরবি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে এসেছে। পরের চারটে ফার্সী ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে এসেছে। এলাকা শব্দের আসল আরবি শব্দ ইলাকাহ, খারাপ শব্দের ফার্সী শব্দ খারাব।”

“তুই কি বলতে চাইছিস?”

“বেঙ্গলি যদি এতদিন ধরে অন্য অন্য ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে ওয়ার্ড রিসিভ করে এসেছে তবে আজ কেন তার এক্সসেপশান হবে বলো তো? দাদু তো বলে স্যাংস্কৃট এক সময়ে এত রিজিড হয়ে গেছিল যে ইট রিফিউজড টু অ্যাডপ্ট। তাই সাধারণ মানুষ স্যাংস্কৃটে নয়, প্রাকৃতে কথা বলত। স্যাংস্কৃট থেকে যায় লেখার ভাষা হিসেবে। আর স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজটা, তোমরা যেটাকে কথ্য ভাষা বলো, সেটা গ্র্যাজুয়ালি বদলাতে থাকে। আর তার ফলেই স্যাংস্কৃটের ইভেনচুয়াল ডেথ।”

“তার মানে…”

“তার মানে, ” কাহিনী ঠাম্মার গালে একটা চুমু খেয়ে বলে উঠল “ইংলিশ ওয়ার্ডগুলোকে রিজেক্ট করে নয়, অ্যাক্সেপ্ট করেই তোমার আদরের বাংলা ভাষা বাঁচবে, মাই ডিয়ার ঠাম্মি।”

“কি বলছিস? এই এত এত ইংরেজি শব্দ আমাদের শব্দ বলে মেনে নিতে হবে?”

“ওরাও নিচ্ছে ঠাম্মা। প্রতি বছর ইংরেজিতে ঢোকে ক্লোজ টু ফাইভ টু টেন ওয়ার্ডস। ইয়োগা, বাজার, জাংগল এগুলো অক্সফোর্ড ডিকশানারিতে জায়গা পেয়েছে। ট্রু দ্যাট, ইংলিশ যত ওয়ার্ড বরো করে তার থেকে বেশি ওয়ার্ড লেন্ড করে। কিন্তু তবু নিচ্ছে তো। বাংলাও কেন নেবে না? তাছাড়া কান বন্ধ করে বসে থাকলে ভাষার ইনফিল্ট্রেশান তো তুমি স্টপ করতে পারবে না ঠাম্মা? একটা ল্যাঙ্গুয়েজের পাওয়ারের কাছে আমরা ওয়ে টু উইক। সে এক নদীর মত। নিয়ম মেনে চলা তার স্বভাব নয়। কখনো তার এক জায়গায় চড়া পড়ে, শুকিয়ে যায় আবার অন্য জায়গায় সে পাড় ভেঙ্গে নতুন পথ করে নেয়। কখনো অন্যান্য শাখানদীর জলধারা এসে মেশে। সেটাকে কনটামিনেশান না ভেবে এক্সপ্যানশান ভাবলে প্রবলেম সলভ হয়ে যায়। আমাদের বাংলার বলার ভাষা আর লেখার ভাষা যদি প্রচণ্ড ডিফারেন্ট হয়ে যায়, ঠাম্মা, তবেই বাংলা ভাষার মৃত্যু হবে। তাই স্নবের মত মুখ ঘুরিয়ে বসে না থেকে চলো এই ওয়ার্ডগুলো আমরা নিজেদের শব্দ বলে গ্রহণ করে নিই। এই আমদানি করা শব্দগুলোকে লেখার জন্য প্রপার স্পেলিং ডিভাইস করি। চলো“শব্দ” আর “ওয়ার্ড”-কে আমরা সিনোনিম, তোমরা কি যেন বলো, হ্যাঁ, সমার্থক শব্দ বলে অ্যাক্সেপ্ট করে নিই। করা যায় না ঠাম্মা?”

“কথাটাতে তোর যুক্তি আছে।”

“যুক্তি আছে। আমি লজিকাল কথাই বলছি। এই যে আমি লজিকাল ওয়ার্ডটা ইউজ করলাম, লিখতে গেলে কেন এর বাংলা ট্রান্সলেশান মনে করতে মাথার চুল ছিঁড়ব? লজিকাল ওয়ার্ডটা বহু ব্যাবহারে এখন আমাদেরই শব্দ হয়ে গেছে। লেখার ভাষা আর বলার ভাষার মধ্যে প্যারিটি থাকতে হবে, সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আমি অলরেডি বেঙ্গলি নভেলের অনেক শব্দ বুঝতে পারি না। কারণ প্রচলিত ইংলিশ শব্দ ব্যাবহার না করে তার অভিধান স্বীকৃত বাংলা শব্দ ইউজ করা হয়। এটা তো একধরনের ইউজলেস শভিনিজম বা তোমার ডিকশানে যাকে বলে অপ্রয়োজনীয় বিদগ্ধতা। তুমি এই নদীটাকে চিনতে পারো না বললে না? যদি চিনতে পারার জন্য এই নদীটার পাড় ধরে ধরে শক্ত বাঁধ দিয়ে নদীটাকে বদলাতে না দিতে তবে কে বলতে পারে হয়তো নদীটা শুকিয়ে যেত, আমরা নদীটা দেখতেই পেতাম না। তোমার সাথে নদীটার পাড়ে বসে এই সানসেটটা দেখতেই পেতাম না। তাই বলি কি…বাংলা ভাষার সো কলড ফ্ল্যাগ বিয়ারার বা ধ্বজাধারীদের বলো যে ভাষাটাকে এক্সপ্যান্ড করতে দিতে। এই নতুন শব্দগুলোকে বাঙলারই শব্দ বলে স্বীকৃতি দিতে। কথা দিচ্ছি আমার ঠাম্মির ভাষাকে আমি, আমরা মরতে দেব না। অনেক বকে ফেলেছি। এবারে আমার সুইট ঠাম্মি আমার এই গালে, হ্যাঁ ঠিক এইখানে, একটা কিসি দিয়ে দাও তো।”

কাহিনীর দৃষ্টিকোণটা দেখে অশীতিপর বৃদ্ধা কথার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বাংলা ভাষা বাঁচবে। তার আদরের নাতনি কাহিনীর, কাহিনীদের হাত ধরেই বাঁচবে। বিদেশী শব্দ গ্রহণ করে ওরা বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। ওরা ওদের মাতৃভাষা, মাদার টাঙকে মরতে দেবে না। পরম আদরে চুমু খান তিনি তার চোখের মণি নাতনিটিকে।

ঠাকুমা-নাতনি, কথা ও কাহিনী, অনেকক্ষণ গললগ্ন হয়ে থাকে। ততক্ষণে গোধূলির আলোর খেলা মিলিয়ে গিয়ে সন্ধে নেমেছে। নদী সংলগ্ন গাছগুলো স্থির হয়ে কোন সুগম্ভীরের ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছে। ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে কাহিনী বলে ওঠে “ঠাম্মা এই রিভারটার নাম কি বলেছিলে?”

“এটা তো একটা ছোট নদী। সেরকম কোনো নাম নেই। আমাদের এই লক্ষীকান্তপুরে এটাকে সবাই ভাসা নদী বলে। অন্য গ্রামে অন্য নাম।”

ইয়ার্কির লেশমাত্র নেই এমন একটা গাঢ়, প্রায়-অচেনা স্বরে কাহিনী বলে ওঠে “গ্র্যানি আমার মনে হয় লোকমুখে নদীটার নাম ভাসা হয়ে গেছে। নদীটার আসল নাম বোধ হয় ছিল “ভাষা”।”

কথা চোখ তুলে নদীটার দিকে তাকান। যেন এক নতুন আঙ্গিকে দেখতে পান নদীটিকে। তারপর অপলক দৃষ্টিতে নাতনির দিকে চেয়ে থাকেন আর তার ঘন ঝালর চুলের মধ্যে বিলি কাটতে থাকেন।

মুক্তি

প্রণবেশ সাধু ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন মাথার কাছে একটা লোক হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। অন্য কেউ হলে হয়তো চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করত কিমবা পুলিশকে টেলিফোন করার জন্য সেন্টার টেবিল হাতড়াত, কিন্তু প্রণবেশ সাধুর নামটা গালভারী হলেও মেজাজটা নেহাতই অমায়িক। কোনো কিছুতেই অধিক উত্তেজিত বা আনন্দিত অথবা যারপরনাই দুঃখিত হন না। যাকে বলে একেবারেই “দুঃখেষুনুদবিগ্নমনা সুখেষুবিগতস্পৃহ”। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে পাশে অচেনা কাউকে বসে থাকতে দেখলে চা-শরবত দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করার রীতি নেই। তাই চোখ পড়া মাত্র ধড়মড় করে উঠে বসতে যাবেন, লোকটা বলল “এ হে হে, সাম্‌লে কত্তা সাম্‌লে। এই বয়সে অতো দৌড় ঝাঁপ করবেন না।”

তা তুমি বাপু কে? বিরক্ত হলেও ভদ্রতার মাত্রা অতিক্রম না করে বললেন সাধু বাবু।

“কে জানে? সে বহুকাল আগের ব্যাপার যখন আমি একটা কিছু ছিলাম। এখন মনে টনে নেই। আর মনে রাখার দরকারও তেমন পড়ে না। আমি কে সেই নিয়ে আমাদের এ তল্লাটে তেমন কারু মাথা ব্যাথা নেই। যে যার নিজের মতো আছে। বুঝলেন কিনা। আমাকে স্রেফ হাওয়া বলতে পারেন।” বলে লোকটা একটা বিচ্ছিরি পান খাওয়া দাঁত নিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগলো।

সাধুবাবু এর মধ্যে বিশেষ হাসির কিছু পেলেন না। কথাটার মানেও যে বিশেষ বুঝলেন তা নয়। বিশেষত “এই তল্লাটের” ব্যাপারটা।

রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বললেন “আহ বাপু বিনা কারণে হাসছ কেন? তো আমার এখানে কি দরকার? বিশেষত আমার বেডরুম-এ। চোর-টোর নও তো?

লোকটা এক হাত জিভ কেটে বলল “আজ্ঞ্যে না কত্তা। কি যে বলেন। আমি এক্কেরে যাকে বলে কুলীন বামুন। অ্যাই অ্যাই দেখুন পৈতে। পুরো দেড় হাত। কথায় বলে পৈতের দৈর্ঘ দেখে বামুনের ব্রহ্মতেজ বোঝা যায়” বলেই লোকটা আবার হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগলো।

মাঝ রাত্তিরে এরকম বাজে রসিকতা সাধু বাবুর একেবারেই পছন্দ হল না। বললেন “দেখ বাপু ঠিকঠাক বলো তুমি কে নয়ত কিন্তু …” কিন্তু যে কি করা উচিৎ নিতান্ত নিরীহ সাধু বাবু সেটা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারলেন না।

এই “নয়ত কিন্তু” তে কিন্তু বোধ হয় একটু কাজ হল। লোকটা মুখটা নিতান্ত দুখি দুখি করে বলল “মাইরি বলছি, আমার পিতৃদত্ত নামটা আমার আজকাল একদম মনে পড়ে না। আসলে কেউ কাউকে নাম ধরে ডাকে না যে। আপনিও বছর কয়েক আমার তল্লাটে থেকে দেখুন, দেখবেন আপনার নাম ধাম বংশপরিচয় সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

“আমি খামোকা তোমাদের তল্লাটে গিয়ে থাকতে যাব কেন? আমি আমার পৈত্রিক বাড়িতে গিন্নি সমেত বেশ আছি।”

“ও হো আপনি এখনো বুঝতে পারেন নি। তাই না?” বলেই লোকটা আবার ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে লাগলো।

“তুমি আমার বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করেছ আর মাঝরাত্তিরে বিনা কারণে হেসে আমার হাড় ভাজা ভাজা করছো। এতে আর বোঝবার কি আছে?”

“হে, হে এমনটা সক্কলের হয়। আমারই হয়েছিল জানেন। শুধু শরীরটা একটু হাল্কা লাগত। আর বিশেষ কিছুই তফাত ধরতে পারিনি প্রথমটায়। কখন বুঝলাম জানেন? যখন দেখলাম  মানুষগুলো আস্তে আস্তে ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বৌ বাচ্ছা সব। আর নতুন লোক যাদের দেখতে পাচ্ছিলাম তারা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হল। আসলে ভূতেদের নামে মিছেই নিন্দা মন্দ করে মানুষেরা। ভূতেরা তো আদতে মানুষদের দেখতেই পায় না। আর মানুষ যেমন ভুত দেখে চম্‌কে ওঠে, ভূতেরাও হঠাৎ করে কোনভাবে মানুষ দেখতে পেয়ে গেলে রীতিমতো খাবি খায়।”

“থামো থামো, কি-কি-কি আবোলতাবোল বকছ? তু-তুমি বলছ আ-আমি ম-মরে গেছি” এবার যৎসামান্য উত্তেজনায় তোতলাতে থাকেন সাধু বাবু।

“তা বলে নিজেকে চিমটি কেটে দেখবেন না যেন। প্রথম প্রথম চিমটি কাটলে ঠিক-ই লাগবে। যারা বলে মরে গেছি কিনা দেখতে নিজেকে চিমটি কেটে দেখা উচিৎ, তারা নিতান্তই নির্বোধ। আসলে অনেকদিনের অভ্যাস তো ওগুলো। সহজে যাবে না। শরীরবোধটা আস্তে আস্তে যাবে।”

“যত সব ঢ-ঢ-ঢপবাজি। একটা বর্ণ-ও বিশ্বাস করি না।”

“আপনি বরং এক কাজ করেন কত্তা। দুধ কা দুধ পানি কা পানি হয়ে যাবে। ওই জানলার গরাদগুলো আমি খুলে আনছি। ওই পথে এই দোতলা থেকে সোজা একটা ঝাঁপ দিয়ে দেন। মাটিতে পড়লে একটু লাগবে, অনেক দিনের অভ্যাস তো। কিন্তু দেখবেন আদতে একটুও লাগে নি। গট গট করে আবার দেওয়াল বেয়ে উঠে ঐ জানলা পথে ঘরে ফিরে আসুন।”

“না না। ও ও সব আমি পারব না। মরেছি কিনা প্রমাণ পেতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণটা খোয়াই আর কি।” এইবার সাধুবাবু একটু ভয় পেয়েছেন। বিশেষত জানলার লোহার গরাদটা এই বেয়াক্কেলে লোকটা কি করে খুলে আনল সে কথা ভেবে।

“হুম্ম্। আপনার দেখছি সময় লাগবে। এই এই দেখুন আমি করে দেখাচ্ছি।” বলেই লোকটা কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জানলা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার বাইরের দেওয়াল বেয়ে উঠে এসে জানলায় পা ঝুলিয়ে বসে ফ্যাক ফ্যাক  করে সেই বিরক্তিকর হাসিটা হাসতে লাগলো।

“এইবার বলুন কত্তা। বেঁচে থাকাকালীন আমার মত অশরীরীর দেখা কখনো পেয়েছেন? আমায় দেখেছেন কি মরেছেন।”

কথাটা যুক্তি সঙ্গত। সারা জীবন শুনেছেন অনেক, কিন্তু ভুতের দেখা তো কখনো পান নি।

“তবে আপনি ভাগ্যবান। ঘুমের মধ্যেই হৃদয়ে সামান্য দোলাচল আর আপনি সোজা অক্কা। আপনি সাধু টাইপ মানুষ বলে শরীরটা সহজে ছাড়তে পেরেছেন। অনেকের দেখি খুব ভোগান্তি হয়। যাকগে যাক। আপনার এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হয় নি তো। আসেন। এইখানটায় এসে দাঁড়ান। এবার পা দুটোকে মাটি থেকে ওপরে তুলে শূন্যে ভেসে থাকার চেষ্টা করুন। পারছেন না তো? হুম্ম্। প্রথম প্রথম পারবেন না। আপনার মনে এখনো অভিকর্ষের প্রভাব। এই দেখুন?” বলেই লোকটা হাত দুয়েক শূন্যে উঠে ভাসতে লাগলো আর ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে লাগলো।

সাধুবাবু নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরও একবার চেষ্টা করে ফেললেন এবং ব্যর্থ হলেন। কিন্তু এই মানুষটা তো শূন্যে ভেসে থেকেছে মিনিট খানেক। স্বচক্ষে দেখেছেন তিনি। একটু ধন্দে পরে যান। তবে কি এ সত্যি না-মানুষ? সত্যি কি তবে তিনি মরে গেছেন?

“এখনও বিশ্বাস হয় নি তো আপনার? আচ্ছা বলুন এ বাড়িতে এই মুহুর্তে আর কে কে আছে? আসলে আজকাল আমি আর মানুষ দেখতে পাই না। আপনি সদ্য সদ্য দেহ ছেড়েছেন। আপনি পাবেন।”

“কেন আমার স্ত্রী আছেন। ওই তো, ঐ তো ঘুমিয়ে আছেন বিছানায়। তাছাড়াও আমার চারপেয়ে assistant ভুলু। নিচের তলায়।”

“আপনি যদি একটা জবরদস্ত প্রমাণ খুজছেন যে আপনি শরীর ছেড়েছেন, এক কাজ করুন আপনার স্ত্রীকে ঘুম থেকে তুলে একটু খাস গপ্প করার চেষ্টা করে দেখুন কত্তা। দেখবেন আপনি ওনাকে তুলতেই পারবেন না। আসলে আপনার শরীর নেই তো। গলার স্বরও নেই।”

সাধু বাবু তখুনি উচ্চ স্বরে “ওগো শুনছো” বার কয়েক চেঁচিয়ে, হাত ধরে টেনে, নাকে পায়ে সুড়সুড়ি কোনভাবেই স্ত্রীকে জাগাতে পারলেন না।

“এইবার ভুলোকেও একবার চেষ্টা করে দেখবেন নাকি কত্তা?”

“না থাক” হাল ছেড়ে দেন সাধুবাবু। তাঁর এবার বেশ বিশ্বাস হচ্ছে তিনি মরেই গেছেন।

“শরীর গেছে বলে দুঃখ করবেন না। আপনার তো সেই অর্থে পিছুটান বলে তেমন কিছু ছিল না। এবার ঠিক করুন। থাকবেন না যাবেন?”

“মা-মানে? কোথায় যাব?”

“না মানে আপনি এ বাড়িতেও গেঁড়ে বসে থাকতে পারেন, আবার ও পারে চলেও যেতে পারেন। আমি আসলে যাকে বলে ঘোর সংসারী ছিলাম। তাই আর ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয় নি। এখানেই ঘুরে ঘুরে বেড়াই। দেশ দুনিয়া দেখি। আপনি চাইলে ওপারে চলেও যেতে পারেন। এক যদি কোনো কিছুর প্রতি প্রবল আকর্ষণ না থেকে থাকে।”

সাধু বাবু একটু ভেবে বললেন “হ্যাঁ মানে চলে যেতে পারলে মন্দ হয় না। এই রোজকার ঝঞ্ঝাটের থেকে মুক্তি পেতে কে না চায়? জাগতিক আকর্ষন বলতে আমার ঐ বিয়ের আংটি, সোনার বোতাম আর রোলেক্স ঘড়িটা..আর ঠাকুর্দা আমায় আমার ১৮ বছরের জন্মদিনে দিয়েছিলেন একটা সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো ছিলিম…সেইটে। ওই আলমারিতে আছে।”

“হুম্ম্ মুস্কিল। এ জগৎ মায়া প্রপঞ্চময়। মায়ার বাঁধন তাই খুব বাধা দেবে আপনাকে। আপনি যেই ছেড়েছুড়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, অমনি টেনে নামিয়ে আনবে। ঐ আলমারিটার আশেপাশে ঘুর ঘুর করবেন। সে ভারী যন্ত্রণা।”

“তাহলে আমার এখন কি করা উচিৎ?”

“কি যে করবেন? টান মেরে যে কোথাও গিয়ে ফেলে আসবেন তার জো নেই। সেখানেই আপনার অ-শরীরটা ঘুর ঘুর করবে। এক কাজ করেন। ও গুলো আমায় দিয়ে দেন। আমার শরীর তো এই জাগতিক ফাঁদে আটকা পড়েই আছে, আমি বরং দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসি। আপদগুলোর হদিস না জানলে দেখবেন মায়া কাটাতে আপনার সুবিধে হবে।”

সাধুবাবু খানিক ভেবে দেখলেন আইডিয়াটা মন্দ না। আংটি, বোতাম, ঘড়ি আর ঠাকুর্দার ছিলিম তিনি আলমারি খুলে বের করে লোকটার হাতেই তুলে দিলেন। দিতেই মনটা বেশ হাল্কা আর প্রসন্ন হয়ে উঠল। যাক আর কোনো পিছুটান রইলো না। “নিয়ে যাও বাপু। অনেক উপকার করলে। এবার মনে হচ্ছে হাত পা ছড়িয়ে পরপারে যেতে পারব।”

“এই বার শুয়ে পড়ুন। শুয়ে শুয়ে চেষ্টা করুন। অনেক সময় কিন্তু ততক্ষনাত যাওয়া যায় না। দু-এক দিন লাগে। সেই দু-এক দিনে দেখবেন অনেকরকম জাগতিক বাধা এসে আপনার পথ রোধ করবে। দেখবেন আপনার স্ত্রী ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলছে, আপনার বোতাম, ঘড়ি চুরি যে হয়েছে তার অকাট্য প্রমাণ দাখিল করছে। ওসবে একদম ঘাবড়াবেন না। আপনি ঠান মেরে রাখুন আপনাকে মুক্তি পেতেই হবে। বোঝলেন কিনা…নয়তো কিন্তু আমার মত অশরীরী হয়ে ঘুরঘুর করতে হবে কত্তা..” বলেই লোকটা সুরুত করে জানালা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

*********

সকাল বেলা হৈ হৈ রই রই রব। পাড়া প্রতিবেশী সব হাজির। সাধনবাবুর বাড়িতে রাত্তির বেলা আলমারি খুলে  সোনার আংটি, বোতাম, ছিলিম, ঘড়ি সব নিয়ে গেছে চোরে। সংগে একটা চিঠি রেখে গেছে

সাধু বাবু,

এখনও আপনি না মরলেও, অচিরেই একদিন শরীর ছাড়তে হবে। তখন এই মায়া গুলো বড় আটকাবে আপনাকে মুক্তির পথে। তাই আপনার মুক্তির পথটা সুগম করতেই এ কটা নিয়ে গেলাম। গ্রন্থিগুলো ছিন্ন করে গেলাম। আমরা বংশ পরম্পরায় চোর। তাই দোতলা থেকে লাফ দেওয়া, দেওয়াল বেয়ে ওঠা এগুলো ভালই জানা আছে। আর আমার পিসি ছিল এক ডাকিনী, আজকের দিনে যাদের ডাইনি বলে আর কি। তার কাছ থেকে ঐ শূন্যে ভাসার দৃষ্টি বিভ্রম তৈরী করার কৌশলটা শিখেছিলাম। আর বেড-সাইড টেবিল-এ ঘুমের ওষুধের কৌটো দেখেই বুঝলাম আজ রাত্তিরে আপনার স্ত্রীকে শত ডাকলেও উঠবেন না। আর জানলার লোহার গরাদ তো কেটে ঐ পথেই ঢুকেছিলাম। ভালবাসা নেবেন।

                              আপনার অনুগত,

                                       স্রেফ হাওয়া

সাধুবাবুর স্ত্রী শেফালি বরকে শাপশাপান্ত করে বাড়ি মাথায় করছে। “শেষমেশ বুড়ো বয়সে তোমার এই ভীমরতি ধরলো গো? নিজের হাতে করে একটা ছিঁচকে চোরের হাতে সোনার আংটি, বোতাম তুলে দিলে?” ইত্যাদি ইত্যাদি…

*********

পাড়াপ্রতিবেশীর মতামত, বৌ-এর ধাঁতানি অনেক্ষণ ধরে বসে ভ্যাবলাকান্তের মত খেয়ে বাথরুমে ঢুকলেন সাধুবাবু। দরজাটা লক করে দিয়েই চট করে একবার শূন্যে ভাসার চেষ্টা করলেন। ব্যর্থ হলেন।

“হবে হবে। লোকটা তো বলেই গেছে এরকম অনেক বাধাবিপত্তি আসবে মুক্তির পথে। বাইরে যা চিতকার চেচাঁমেচি হচ্ছে, এ সবই তাঁর মানসিক বিভ্রম। এগুলোতে বিশ্বাস করেছেন কি ঠকেছেন। ওই লোকটার মত আটকে থেকে যাবেন তাহলে। আসলে তাঁর শরীর ছাড়া হয়ে গেছে কাল রাত্তিরেই।” স্থির নিশ্চিত সাধুবাবু।

নিজেকে চিমটি কেটে দেখলেন। হ্যাঁ এখন অনেকটা কম লাগছে। আর একটা ব্যাপার-ও তো সত্যি। পাড়া প্রতিবেশী, স্ত্রী সবাইকে অলরেডি ঝাপসা দেখছেন তিনি। আর সবচেয়ে ভাল ব্যাপার ঐ ঘড়ি-আংটির মায়া ত্যাগ করতে পেরে তাঁর শরীর-মন দুটোই এখন বেশ ফুরফুরে হাল্কা লাগছে। শূন্যে ভাসতে পারার আর বেশি দেরি নেই।

 

theif