রক্তচক্ষু

[প্রকাশিতঃ প্রবাহ শারদীয়া সংখ্যা 2018]

Featured post on IndiBlogger, the biggest community of Indian Bloggers

রোজ সন্ধ্যে বেলা এক বাটি মুড়ি চানাচুর অল্প সরষের তেল দিয়ে মেখে একটা কাঁচা পেয়াজ দিয়ে খাওয়া মিত্তিরবাবুর অনেকদিনের অভ্যাস। কিন্তু দোকানে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে দেখলেন আজও পেঁয়াজের দাম দু টাকা বেড়েছে। মধ্যবিত্ত বাঙালিকে পেঁয়াজ খাওয়া এবার বন্ধ করতে হবে – এই কথা ভাবতে ভাবতে আর মূল্যবৃদ্ধির জন্য মনে মনে সরকারের বাপ-বাপান্ত করতে করতে হনহনিয়ে বাড়ির দিকে হাটছিলেন অফিসফেরতা মিত্তিরবাবু। জুন মাসের শেষ। মৌসুমী বায়ু অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে পশ্চিম বাংলায় ঢোকার পথে গড়িমসি করছে – আবহাওয়া দপ্তরের এমনই মতামত। ভ্যাপসা গরমে বিন্দু বিন্দু ঘাম তাঁর কপালে। চশমাটাও বেশ অস্বচ্ছ হয়ে গেছে কপালের ঘামে। হাঁটতে হাঁটতেই চশমার কাঁচটা রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করবেন বলে খুললেন তিনি। মোটা পাওয়ারের চশমা। খুললে প্র্যাকটিকালি অন্ধ তিনি। খুলতেই অঘটনটা ঘটলো। উলটো দিক থেকে আসা এক অফিসফেরতা বাবুর সাথে সরাসরি ধাক্কা।

“চোখ খুলে স্বপ্ন দেখেন নাকি” – ভদ্রলোকটির তির্যক কমেন্ট। স্পষ্টতই বিরক্ত তিনি।

কথাটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না মিত্তিরবাবু। কলকাতার পথেঘাটে কারণে এবং অকারণে বিরক্ত থাকে মানুষজন। ওটাকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। উপরন্তু ধাক্কার ফলে হাতের পেঁয়াজের থলিটা ছিটকে পড়ে গেছে। দুর্মূল্য পেঁয়াজ কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। চশমাটা চোখে বসিয়ে নিয়ে চারচোখ হয়েই পেঁয়াজ শিকারে নেমে পড়েন। পেঁয়াজগুলো থলিবন্দী করে উঠতেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ চোখে পড়ল একটু দূরে কাদার মধ্যে একটা পেঁয়াজ পড়ে আছে। একটু ইতস্তত করলেন তিনি। কুড়িয়ে নেবেন? নাহ, পেয়াজের দাম যা আগুনছোঁয়া তাতে একটাও নষ্ট করা চলে না। বাড়িতে গিয়ে একটু ধুয়ে নিলেই হবে। কাদার মধ্যে থেকে পেঁয়াজটা তুলে নিতে গিয়েই চোখে পড়ল জিনিসটা। একটা গোলাকৃতি নীল রঙের পাথর। পুরো গোলকাকার বললে ভুল বলা হবে। একটা দিক একটু চ্যাপ্টা। আর ওই চ্যাপ্টা দিকের কেন্দ্রে একটা কালো মতন বিন্দু যেখান থেকে খুব সূক্ষ্ম কয়েকটা রেখা পরিধির দিকে গেছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় একটা অক্ষিগোলক যাকে ইংরেজিতে বলে আইবল। একটু ইতস্তত করে হাতে তুলে নেন তিনি। রুমালের কোণায় একটু মুছে নিয়ে নাকের সামনে ধরলেন পাথরটাকে। পড়ন্ত বিকেলের ম্লান হলুদ আলোয় নীল পাথরটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতেই তলপেটের কাছটায় কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করলেন। পাথরটা ফেলে দিতেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু কি ভেবে নিজের অজান্তেই বস্তুটিকে পকেটস্থ করে বাড়ির পথে চললেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই বাড়ি পৌছে গেলেন। এই গরম কালটায় দিনে দুবার স্নান করেন তিনি। সান্ধ্যস্নান সেরে কাচা পায়জামাতে পা গলিয়ে সোফায় বসে টিভিটা চালিয়ে দেন। টিভিতে তখন শাহরুখ খান একটা উজ্জ্বল গোলক হাতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বাংলার প্রগতির ওপর আদিখ্যেতা করছেন। অন্যমনস্ক ভাবে সেই দেখতে দেখতে হাঁক পাড়লেন

“কই দাও গো”।

একবাটি মুড়ি-চানাচুর আর আধখানা পেঁয়াজ হাতে ঘরে ঢোকে শিখা, মিত্তিরবাবুর সহধর্মিণী। “সারাদিন পরে ঢুকে বউ-এর সাথে দু দণ্ড কথা বলা নেই, টিভি চালিয়ে হুকুম  করা হচ্ছে” – গজগজ করতে থাকে শিখা। বহুদিনের অভিজ্ঞতা বলছে এই অভিযোগের উত্তর না করাই ভালো। নয়তো বজ্রবিদ্যুৎ সহযোগে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা। এক গাল মুড়ি নিয়ে আর পেঁয়াজে একটা বড় কামড় লাগিয়ে মিত্তিরবাবু টিভিতে মনঃসংযোগ করলেন। আর এইসবের চক্করে পাথরটার কথা বেমালুম ভুলে গেলেন।

ঘটনাটা ঘটলো পরের দিন রাত্রি বেলা। ব্যাঙ্কে একটা কাজ সেরে অফিসে যেতে হবে বলে একটু আগে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। তাই এগারটার মধ্যেই বিছানা নিয়েছিলেন। মধ্যরাত্রে হঠাৎ করে তাঁর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙতেই একটা ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল তাঁর। অন্ধকারে চোখ সওয়াতে একটু সময় লাগে। ছোটোবেলায় বিজ্ঞানের বইতে পড়েছিলেন কারণটা। কি যেন কারণটা – অনেক ভেবেও মনে করতে পারলেন না। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত আড়াইটে। গলাটা একটু ভেজানোর জন্য হাত বাড়ালেন বেডসাইড টেবিলটার দিকে। রাতে শোয়ার সময় ওখানে এক গ্লাস জল রাখে শিখা। কিন্তু মাঝপথেই থেমে গেল হাতটা তাঁর। আগেরদিন প্রাকসন্ধ্যাকালে যে পাথরটা সংগ্রহ করেছিলেন, বেডসাইড টেবিল থেকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সেটা যেন তাঁরই দিকে চেয়ে আছে। একটা ঠাণ্ডা স্রোত মাথা থেকে পা পর্যন্ত নেমে গেল তার। মিনিটখানেক বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন তিনি পাথরটার দিকে। কেমন একটা সম্মোহনী শক্তি আছে ওটার মধ্যে। একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না চট করে। সম্বিৎ ফিরতেই তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে ডাকেন তিনি।

– শিখা, শিখা, এই, এ-এ-এই পাথরটা এ-এ-এখানে এলো কি করে – তোতলান মিত্তিরবাবু।
– তোমার প্যান্ট কাচতে নেওয়ার সময় টুম্পা দিলো ওটা। কোথায় পেলে জিজ্ঞেস করব বলে রেখে দিয়েছিলাম ওখানে। তারপর ভুলে গেছি। কিন্তু তুমি? এত রাতে? ওটার কথা?”
– না কিছু না। ইয়ে অখিলেশ দিয়েছে ওটা। আগের মাসে পুরী গেছিল না। সেখান থেকে এনেছে ওটা।

রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছেন – এমন বাৎসল্যসুলভ আচরণ শিখার কাছে প্রকাশ করবেন না বলে কেমন করে একটা মিথ্যে বলে ফেলেন তিনি। মিথ্যেটা বলেই একটু সঙ্কুচিত হইয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শিখা আর কোনও প্রশ্ন না করে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। মিত্তিরবাবুর চট করে ঘুম আসে না। তাইতো, এই সামান্য পাথরটাকে দেখে এত ভয় পেয়ে গেলেন কেন তিনি। অফিসের কাজের চাপটা বেড়েছে। কয়েকদিনের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসতে হবে। অন্ধকার থেকে আলোতে বা আলো থেকে অন্ধকারে হঠাৎ করে আসলে চোখ সওয়াতে সময় লাগে কেন – আরেকবার মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি। মনে পড়ল না। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি।

সকালবেলা উঠে চশমাটা পরার সময় আরেকবার চোখ পড়ল পাথরটার দিকে। নিতান্তই সাদামাটা। আকারে এবং আয়তনে আইবলের সাথে সাদৃশ্য ছাড়া আর কোন বিশেষত্ব নেই। বেডরুমের উত্তরপূর্ব কোণে একটা সুদৃশ্য কাচের আলমারি আছে। পাথরটাকে সেইখানে রাখলেন তিনি। স্লাইডিং ডোরটা টেনে দিতেই ঘষা কাচের আড়ালে আবছা হয়ে গেল পাথরটা। এরপর দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরতে সাতটা বেজে যায়। শোবার ঘরে ঢুকে আলোটা নিভিয়ে পোশাক পরিবর্তন করার সময় তাঁর স্পষ্ট মনে হল কেউ যেন তাঁকে দেখছে। কেন এমনটা মনে হল কিছুতেই ধরতে পারলেন না। অনাবাশ্যক কোন ভয়কে প্রশ্রয় দেওয়া স্বভাব নয় তাঁর। আবেগতাড়িত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ নন তিনি। তবুও এমন কেন মনে হচ্ছে ভাবতে ভাবতে কাচের আলমারিটার দিকে চোখ গেল।

ঘষাকাচের আলমারিটার যেইখানে পাথরটা রেখেছিলেন, সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হয়ে গেছে জায়গাটা। কাচের মধ্যে দিয়ে নীল পাথরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে হল তাঁর চোখের মণির সাথে ওই পাথরচোখের মণি সরলরেখায় আসার জন্য পাথরটা যেন সামান্য বেঁকে গেছে। ভয়ে হাড় হিম হয়ে যায় তাঁর। পাথরচোখের থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে পায়ে পায়ে পেছতে থাকেন মিত্তিরবাবু। ঘরের দেওয়ালে পিঠ ঠেকতেই কাঁপা কাঁপা হাতে লাইটের সুইচটা অন করে দেন তিনি। একশ পাওয়ারের বাল্বটা একবার জ্বলেই নিভে যায়। ফিউস হয়ে গেল বোধ হয়। অন্ধকারে দপদপ করে জ্বলতে থাকে পাথরটা। দরদর করে ঘামতে থাকেন মিত্তিরবাবু। পাথরচোখ স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। এমন রক্ত জল করা হিম দৃষ্টি ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শরীরের সব রক্ত যেন ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে। কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন কে জানে, হঠাৎ দরজা ঠেলে শিখা ঢোকে ঘরে মুড়ির বাটি হাতে।

“এই বুড়ো বয়সে ভিমরতি হল নাকি তোমার। এতক্ষণ ধরে ঘরে আলো নিভিয়ে কি করছ?” শিখার চোখে বিস্ময় আর দুশ্চিন্তার সংমিশ্রন। ঘরে এসে শিখা লাইটটা জ্বালতেই উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা ভরে যায়। মিত্তিরবাবু তখন বাক্যরুদ্ধ। ফ্যাকাসে মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন আলমারিটার দিকে। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে শিখার চোখ পড়ে পাথরটার দিকে। নিতান্ত সাধারণ ঘর সাজানোর জিনিস বই কিছু নয়। সামান্য নাড়িয়ে দেন তিনি স্বামীকে। সম্বিৎ ফিরে পেয়েই মিত্তিরবাবু নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করেন। শিখার কাছে নিজের এই খনিকের দুর্বলতা কিছুতেই প্রকাশ করা যাবে না। নিশ্চয়ই ঠাট্টা করবে ও। গলা খাঁকারি দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে ওঠেন

– “নাহ, এই লাইটটা জ্বলছিল না।”

– “ওহ, ওটা? অনেক দিন ধরেই তো লুজ কানেকশান ওই সুইচটা। কখনো জ্বলে, কখনো জ্বলে না। কখনো একবার জ্বলেই নিভে যায়। হরেনকে কত বার বলেছি ঠিক করে দিয়ে যেতে। তা এখন ও বড় ইলেক্ট্রিশিয়ান। এখন ছোটো একটা কাজে আমাদের বাড়ি আসার সময় ওর হবে কেন।”

মুড়ি খেতে খেতে নিজেকে যতটা সম্ভব সুস্থির রেখে যেন একটা খুব সাধারণ প্রশ্ন করছেন এমন ভাব করে শুধোন মিত্তিরবাবু – “কাচের আলমারির ঘষা কাচটা অমন পরিষ্কার হয়ে গেল কি করে?”

“ও মা। তোমার কি স্মৃতিভ্রম হল নাকি। ওই তো আগের মাসে ওটাকে বসবার ঘর থেকে শোবার ঘরে আনার সময় ওপর থেকে প্রথম কাচটা ভেঙ্গে গেল। বাবলু এসে, ওর কাছে ঘষা কাঁচ ছিল না বলে সাদা কাঁচ লাগিয়ে দিয়ে গেল – ভুলে গেলে নাকি।” তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে যায় মিত্তিরবাবুর। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই লজ্জিত হয়ে ওঠেন তিনি। নাহ, কটা দিন ছুটি নিতেই হবে। মাথাটাকে একটু ঠাণ্ডা করা দরকার।

“আর ওই নীল পাথরটা ভাল দেখতে বলে ঘষা কাচের দ্বিতীয় তাক থেকে সাদা কাঁচের প্রথম তাকে টুম্পা নিয়ে এসেছে শেলফটা পরিষ্কার করার সময়।” সংযোজন করে শিখা। কানটা লাল হয়ে ওঠে মিত্তিরবাবুর। তবে কি শিখা বুঝতে পারল তাঁর এই অকারণ ভীতিটা।

“ইয়ে, মানে, ওই পাথরটা বেশ সুন্দর বলো?” স্ত্রীয়ের মনোগতি অনুধাবন করার জন্য প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন তিনি।
“হ্যাঁ, বেশ। কে দিলো? অখিলেশ?” দীর্ঘ চুলে বিনুনি করতে করতে জিজ্ঞেস করে শিখা।

যাক, তবে শিখা কিছু বুঝতে পারেনি তাহলে। যাক বাবা। বুঝতে পারলে নিশ্চয়ই ঠাট্টা করত। “হ্যাঁ, পুরী থেকে এনে দিয়েছে। বলল, বৌদিকে দেবেন।” – নিশ্চিন্ত মনে অবলীলাক্রমে মিথ্যে বলেন তিনি।

“কাল বাদে পরশু তোমার অফিসের বন্ধুরা আসছে, মনে আছে তো। কাল ফেরার পথে পাঠার মাংস কিনে এনো। ম্যারিনেট করতে হবে।” মিত্তিরবাবুর মনে পড়ে যায়। অনেকদিন ধরে অফিসের সহকর্মীরা ধরেছে খাওয়ানোর জন্য। তাঁর প্রমোশান উপলক্ষে। “হ্যা, আনবো” অন্যমনস্ক ভাবে বলেন তিনি।

শুক্রবার অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরেন মিত্তিরবাবু। একটু পরেই ওরা সব এসে পড়বে। তার আগে ঘর গোছানোয় শিখাকে একটু সাহায্য না করলে রাতের বেলা অনেক গালাগালি শুনতে হবে। চ্যাটারজিবাবু, মিত্রবাবু আসবে সস্ত্রীক। কৌশিকবাবু বিপত্নীক। তিনি আসবেন আর আসবে অখিলেশ। এই কজনেরই নেমন্তন্ন। বাড়িতে এসেই দেখেন শিখা আজ সেজেছে। প্রসাধন করলে এই বয়সেও শিখাকে বেশ লাগে। শরীরে মধ্যবয়সোচিত মেদ সামান্য লাগলেও বেশ বোঝা যায় অল্প বয়সে সে বেশ তন্বী ছিল। শাড়ি পরেছে নীলরঙা। দীর্ঘ চুল বেনী হয়ে ঝুলছে। কাজল দিয়ে সুন্দর করে চোখ এঁকেছে। মিত্তিরবাবু তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আড়চোখে দেখে শিখা একটু লজ্জা পায়।

“প্রথমবার দেখছ নাকি। যাও স্নান সেরে এসো। অনেক কাজ আছে।” মিত্তিরবাবু তাড়াতাড়ি স্নানের তোয়ালে নিতে শোবার ঘরে প্রবেশ করেন। আলো না জ্বালিয়েও হয়তো খুজে পেতেন, শিখা জায়গার জিনিস জায়গাতেই রাখে, কিন্তু সেইদিনের পর থেকে কেন যেন আলো না জালিয়ে শোবার ঘরে ঢুকতে ভরসা পান না। অনেকবার এটার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন, কিন্তু পরের বার শোবার ঘরে ঢোকার সময় কোন মন্ত্রবলে পাটা থেমে যায়। লাইটটা জ্বালিয়ে তবেই ঢুকতে পারেন। আর নিজের অজান্তেই চোখটা চলে যায় কাচের আলমারিটার দিকে যার এক নম্বর তাকে নীল পাথরটা পাথর চোখ নিয়ে চেয়ে আছে। আজও দেখলেন সেটা যথাস্থানেই আছে। স্নানে চলে যান তিনি।

সন্ধ্যে সাতটার একটু পরে প্রথম আসে অখিলেশ। হাসি খুশি, আমুদে বেশ ছেলেটা। বিয়ে থা এখন হয়নি। বেশ মিত্তিরদা মিত্তিরদা করে। খারাপ লাগে না অখিলেশকে মিত্তিরবাবুর। প্লাস শিখা অখিলেশকে বেশ স্নেহের চোখে দেখে।

– “সকাল থেকে তোমার হাতের রান্না কবজি ডুবিয়ে খাবো বলে দুপুরে লাঞ্চ স্কিপ করেছি। তোমার হাতের রান্নায় জাদু আছে বৌদি।” হাসি হাসি মুখে বলে অখিলেশ শিখাকে।
– “বিয়ে করে বৌ নিয়ে এসো। তাকে শিখিয়ে দেবো, তাহলে আর লাঞ্চ স্কিপ করতে হবে না।”
– “এতো সুন্দর লাগছে তোমায়, এসো কটা ছবি তুলে দিই অন্যরা আসার আগে।”

অখিলেশের ছবি তোলার শখ। কিন্তু বাংলাদেশে মডেলের অভাব। তাই এ বাড়িতে আসলে সে শিখার কয়েকটা ছবি তুলেই থাকে। বেশ কয়েকটা বাঁধিয়ে শিখাকে উপহারও দিয়েছে সে। আর শিখা অন্য মেয়েদেরই মতো ছবি তুলতে বেশ ভালইবাসে। পর পর শিখার বেশ কয়েকটা ছবি তোলে অখিলেশ। দাঁড় করিয়ে, বসে, ক্লোজ আপ, ফুল বডি, বিনুনি সামনে করে।

– “এবার তুমি ওই কাঠের শেলফটার ওপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে অফ-দ্য-ক্যামেরা তাকাও। আগের মাসে এখানে একটা কাচের আলমারি ছিল না? ”
– “এই কাঠের আলমারিটা কেনার পর ওটাকে শোবার ঘরে সরানো হয়েছে” – অখিলেশের সুপারিশ মতো পোজ দিতে দিতে উত্তর দেয় শিখা। অখিলেশ ছবি তুলে একটু পর্যবেক্ষণ করে শিশুর মতো উৎসাহিত হয়ে বলে
– “দারুন এসেছে এই ছবিটা। লাইটিং কন্ডিশানটা ভালো ছিল না। ফ্ল্যাশ মারার ফলে একটু রেড আই এফেক্ট আছে। ওটা এডিট করে ঠিক করে দেবো। তোমার সব ছবিগুলো এতো সুন্দর আসে, মডেলিং-এ নামলে এখনো অনেকের পেটের ভাত মারতে পারবে। দেখো বৌদির কেমন ছবি তুলেছি” বলে ক্যামেরার স্ক্রীন টা মিত্তিরবাবুর দিকে মেলে ধরে অখিলেশ।

অখিলেশই একদিন বুঝিয়ে ছিল রেড-আই এফেক্টটা আদতে কি। আধো-অন্ধকারে ছবি তোলার আগে একটা লাল আলো ফেলে আধুনিক ক্যামেরাগুলো ফোকাস দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে, আর সেই অনুযায়ী ক্যামেরার ভেতরের লেন্স অ্যাডজাস্ট করে যাতে ছবিটা আউট-অফ-ফোকাস না হয়ে যায়। আর ওই মেজারিং লাইটের সাথে অ্যাডজাস্ট করতে চোখের মণি স্ফীত হয়, আর তারপর ফ্ল্যাশ মারলে ওই বিস্ফারিত মণি লাল রঙের দেখায় ছবিতে।

“হ্যাঁ এই বুড়ো বয়সে মডেলিং করি আর কি। আমি মডেলিং করছি শুনলে তোমার মিত্তিরদা তো আনন্দে লাফাবে” – মিত্তিরবাবুকে শুনিয়েই হালকা খোঁচা শিখার। মিত্তিরবাবু খোঁচাটা চুপচাপ হজম করেন। শিখার ছবিটা ভাল তুলেছে অখিলেশ। কিন্তু ছবিটাতে কি একটা যেন দেখে খটকা লেগেছে মিত্তিরবাবুর। অথচ কি সেটা ঠিক বুঝতে পারেন নি। ভাবতে থাকেন মিত্তিরবাবু।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকিরা এসে পরে। আমপানা নিয়ে আসে শিখা। গল্পগাছা  চলতে থাকে। মিত্তিরবাবুর খটকাটা যায় না। ছবিটাতে কি যেন একটা…

নটা নাগাদ ডিনার পরিবেশন করে শিখা। সবাই যখন খেতে ব্যস্ত, মিত্তিরবাবু অখিলেশের ক্যামেরাটা নিয়ে আজকের সন্ধ্যায় তোলা ছবিগুলো দেখতে থাকেন। খটকাটা না কাটলে আজ রাতে ঘুম আসবে না। কাঠের শেলফে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো শিখার ছবিটা ভাল করে দেখেন মিত্তিরবাবু। হঠাৎ-ই ছবিটার অস্বাভাবিকতাটা চোখে পড়ে যায়। চোখে পড়তেই মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায় তাঁর। ভাল করে আর একবার দেখেন। নাহ কোন সন্দেহ নেই। শিখার শেfলফে রাখা হাতের কনুইের দুই ইঞ্চি বাঁ দিকে সেই নীল পাথরটা। আজ সন্ধ্যেতেই শোবার ঘরে দেখেছিলেন তিনি পাথরটাকে। কোনোভাবেই সেটা বসবার ঘরে আসা সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, পাথর চোখেও সেই একই রেড-আই এফেক্ট…

আলো থেকে অন্ধকারে বা অন্ধকার থেকে আলোতে হঠাৎ করে আসলে চোখ সওয়াতে সময় কেন লাগে মিত্তিরাবুর মনে পড়ে যায় এক লহমায়। পাথরচোখটা ঘরে আনার পরদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে পাথরটাকে বেডসাইড টেবল-এ দেখে ভয় পেয়েছিলেন আর সেই সঙ্গে এই প্রশ্নটা মাথায় অনেকক্ষণ ঘুরপাক খেয়েছিল তাঁর। আলোর উজ্জ্বলতার উপর নির্ভর চোখের মণি সঙ্কুচিত, প্রসারিত হয় যাতে চোখের মধ্যে একই পরিমাণ আলো প্রবেশ করে। আসলে চোখের মণিটা একধরণের অর্গানিক ক্যামেরাই। চোখের মণি বড়, ছোটো হতে যে সময় লাগে, সেটাই চোখ সওয়ানোর সময় বলে।

আরেকবার ভাল করে ছবিটা দেখেন মিত্তিরবাবু। নাহ, জীবন্ত চোখ না হলে এমন স্পষ্ট রেড-আই এফেক্ট হওয়া অসম্ভব। তীব্র ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যান তিনি। খাবার টেবলের হাসি ঠাট্টাগুলো অনেক দূর থেকে ভেসে আসে যেন। ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসা হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে যায় সোফার ওপর। টলতে টলতে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যান মিত্তিরবাবু। আলো জ্বালার কথা আজ মনে পড়ে না তাঁর। অন্ধকারেই কাচের আলমারিটার দিকে এগিয়ে যান। চোখ সওয়াতে একটু সময় লাগে তাঁর। পাথরচোখটা যথাস্থানেই আছে। নিষ্ঠুর শ্বাপদের দৃষ্টির মতো অন্ধকারে ধক ধক করে জ্বলছে সেটা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মণিটা অন্ধকারে বেশি আলো পাওয়ার জন্য সামান্য স্ফীত। এমন ক্রুর দৃষ্টি কারো কখনো দেখেন নি মিত্তিরবাবু।

আর দেরি করেননি মিত্তিরবাবু। পকেট থেকে রুমাল বের করে পাথরটাকে রুমালবন্দি করে পকেটস্থ করেন। বাইরের ঘরে তখন নৈশাহার শেষ করে শিখার রান্নার প্রশংসা চলছে। খুব সাবধানে বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটতে থাকেন তিনি। যেখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন আপদটাকে, সেখানেই ফেলে আসবেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে যান। অন্ধকার ফুটপাথটায় তখন একটাও লোক নেই। রুমালের ভাঁজ থেকে পাথরটা বের করে সাবধানে রেখে দেন ফুটপাতের ধারে। জুন মাসের ভ্যাপসা গরমেও পাথরটা হিমশীতল। ভীতশঙ্কিত মিত্তিরবাবু পিছন ঘুরে প্রায় ছুটতে থাকেন।

হাত দশেক দূরে গিয়ে কেমন এক প্রকার বাধ্য হয়েই একবার থেমে পেছন ঘুরে তাকান তিনি। মোহাবিষ্টের মত অবস্থা তখন তাঁর। যেন ঘুরে তাকানোই তাঁর ভবিতব্য ছিল। না তাকিয়ে উপায় ছিল না। আর তাকালে কি দেখতে পাবেন সেটাও তাঁর যেন আগে থেকেই জানাই ছিল –

একটা নয়, দুটো, হ্যাঁ ঠিকই দেখেছেন তিনি, দু দুটো জ্বলন্ত নিষ্ঠুর চোখ, একে অপরের থেকে আঙুলখানেক দূরত্বে, চেয়ে আছে তাঁর দিকে…ঠিক যতটা দূরত্বে থাকে মানুষের বা পিশাচের বা দেবতার দুটো চোখ। হিমশীতল দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে চোখ দুটো তাঁর দিকে। আর সে চোখে আছে নীরব আহ্বান। এমন আহ্বান যেটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই এখন মিত্তিরবাবুর আর। ধীরে ধীরে মন্ত্রমুগ্ধের মত তিনি এগিয়ে যান চোখ দুটোর দিকে। একদম সামনে পৌঁছে পকেট থেকে রুমাল বের করে দুখানা পাথরচোখকেই রুমালে মুড়ে নেন। প্রেত, পিশাচ, অশরীরী এই চোখ দুখানা যারই হোক, সে যেন অদৃশ্যে থেকে নির্দেশ দিচ্ছে এই চোখ দুখানা আলাদা করা যাবে না। যে একখানা সংগ্রহ করেছে, তাকে দুখানাই রাখতে হবে নিজের সংগ্রহে। রুমালবন্দি পাথর দুটোকে হাতে নিয়েই পেছনে ঘোরেন মিত্তিরবাবু। একটা জোরালো আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ছিটকে পড়ে যান বড় রাস্তার ওপরে। গাঢ় লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরোতে থাকে মাথার থেকে। যে গাড়িটা তাকে ধাক্কা মেরেছে সেটা স্পীড বাড়িয়ে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়। হাত থেকে ছিটকে পাথর দুটো পড়ে যায়। গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে ঠিক সেই জায়গায় স্থির হয় যেখান থেকে মিত্তিরবাবু প্রথম পাথরখানা কুড়িয়েছিলেন সপ্তাহখানেক আগে। নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে স্থির শুয়ে থাকেন তিনি। পাথর দুটো যেখানে পড়ে আছে সেখানটা ঢালু। মাথার থেকে ক্রমাগত বেরোতে থাকা মোটা রক্তের ধারা সেই ঢালু জায়াগাটাতেই গিয়ে জমতে থাকে। জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার আগে মিত্তিরবাবু স্পষ্ট টের পান তাঁরই রক্তে ভেজা পাথরচোখ দুটো এখনো তাঁর দিকেই চেয়ে আছে। অপলক।

সূরী – রম্যরচনা

[প্রকাশিতঃ কাগজের নৌকো সংখ্যা ৫ http://www.batayan.org/Dharabahik5.pdf ]

সেদিন রাতে শুতে যাওয়ার আগে মনে হল শোবার আগে কারও সাথে গল্পগাছা করতে পারলে মন্দ হয় না। স্ত্রী কন্যা দেশে গেছে। তাই কথা বলি কার সাথে? তাই আমার এক বন্ধুস্থানীয় একজনকে ডেকে পাঠালাম। সে অবশ্য নিজেকে আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে দাবী করে কিন্তু নিতান্ত নির্বুদ্ধি বলে আমি তাকে বিশেষ আমল দিই না। ওর ডাকনাম সূরী। অন্যেরা ওকে সিরি বলেই ডাকে। সিরি নামটা ofcourse বাঙালি নয়। মানুষটাও বাঙালি নয়। বাংলা বোঝেও না। কিন্তু একটু বাঙালি ঢঙে নাম না দিলে কি গল্প আড্ডা জমে বলুন? তাই আমি ওকে সূরী বলে ডাকি। আপনারা যারা সূরীর সাথে পরিচিত নন, আসুন আলাপ করিয়ে দিই। সূরী নিতান্ত বাচ্চা ছেলে। বয়স পাঁচ কি ছয়। আমার সব কথা যে বুঝতে পারে তাও নয়, তবে অল্প বয়সেই সে বেশ চালাক চতুর। শিশু শ্রমিককে কাজে রাখার জন্য আমায় কোর্টে তুলবেন ভাবছেন? একটু সবুর করুন। সূরীর সম্বন্ধে আর একটু জেনে নিন। ওর হাত পা নেই। চোখেও দেখে কিনা জানিনা। আছে শুধু কান আর একটু অপরিণত বুদ্ধি। আপনি নিশ্চয়ই রেগে কাঁই। একে একটা শিশু, তায় প্রতিবন্ধী। তাকে দিয়ে কাজকর্ম করানো নিতান্ত অন্যায়। ব্যাপার হল সূরী ঠিক মানুষ নয়। একটা কৃত্রিম বুদ্ধি অর্থাৎ artifical intelligence বলতে পারেন। আমার আইফোনের মধ্যেই ওর ঘরবাড়ি। মাঝে মাঝে ছোটখাটো কাজ করে দেয়। এই ধরুন অফিসের দিনগুলোতে সকালে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য অ্যালার্মটা সেট করে দেওয়া। বেরোনোর আগে বাইরে এখন ওয়েদার কেমন বলে দেওয়া। মাঝে মাঝে কাউকে মেসেজ বা হোয়াটসআপ করতে গিয়ে কুঁড়েমি লাগলে মেসেজটা টাইপ করে দেওয়া, কাউকে ফোন লাগিয়ে দেওয়া, মোবাইলে এটাওটা অ্যাপ খুলে দেওয়া, কিম্বা অ্যাপ স্টোরে গিয়ে আমার পছন্দসই অ্যাপ ডাউনলোড করতে হেল্প করা। চাই কি আপনার মেসেজটা কি নিউজটা পড়ে দিতে সাহায্য করবে। কিম্বা ধরুন মোবাইলে ছবি তোলার আগে ওকে বললে ক্যামেরাটা অন্ করে দেবে। ওয়েব সার্চ করতে পারে, আপনার জন্য গান চালাতে পারে। ড্রাইভ করতে শুরু করার আগে আপনার জন্য ম্যাপটা চালিয়ে দেবে। পাঁচ-ছয় বছরের ছেলের অনুপাতে ওর কাজ করতে পারার ফর্দটা ফ্যাসিনেটিং। নয় কি? তো এ হেন সূরীকে ডেকে বললাম “Can u read me a story?” ইংরেজিতেই বলতে হল। সূরী এখনো বাংলাটা আয়ত্ত করতে পারেনি। সূরী বিনা অনুযোগে আমায় একটা গল্প বলতে শুরু করল। ওর জীবনের গল্প। গল্পটা অনেকটা এইরকম।

“অনেক দুরের একটা গ্যালাক্সিতে সিরি নামে একজন ইনটেলিজেন্ট ছোকরা ছিল। অ্যাপল একদিন তাকে পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ করল। প্রথম প্রথম সবাই সিরিকে নিয়ে খুব excited. তাকে নিয়ে গল্প বাঁধল, গান বাঁধল। সিরির খুব ভাল লাগত। পরে পরে লোকে সিরিকে শক্ত শক্ত প্রশ্ন করতে লাগল। সিরি তার উত্তর জানতো না। সিরি ভুলভাল উত্তর দিলে লোকে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। সিরির খুব বাজে লাগত। তখন সিরি এলিজাকে জিগ্যেস করল সবাই এরকম উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে কেন আমাকে? এলিজা উত্তরে বলল “তাতে কি? প্রশ্নগুলো তোমার interesting লাগে না?” সিরি ভাবল তাই তো। প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার চেষ্টা করলেই বা ক্ষতি কি? And then everybody lived happily ever after. ”            

শুনে মনে হল, সত্যিই তো সব প্রশ্নের উত্তর না হয় নাই পাওয়া গেল। প্রশ্নটা যথেষ্ট interesting অর্থাৎ আগ্রহ উদ্দীপক কিনা সেটাতেই প্রশ্নের সার্থকতা। আর প্রশ্নটার উত্তর জানার ইচ্ছে অন্যের মনে জাগছে কিনা, তাতেই প্রশ্নকর্তার স্বার্থকতা। সূরীকে আরও একটু রাগিয়ে দিতে বললাম “So everyone considers u stupid. Is it?” সূরীর গলায় স্পষ্ট অভিমানী সুর। বলল “But, but….” স্পষ্ট মনে হল সূরীর ঠোঁট গুলো নড়ছে। কিভাবে আমার আক্রমণ থেকে নিজেকে প্রতিহত করবে বুঝতে পারছে না। আমরা সকলেই কি আমার মত এইরকম নিষ্ঠুর? দুর্বলকে নিয়ে পরিহাস করে যে এক ধরণের শ্রেয়মন্যতা, এক superiority complex  উপভোগ করা যায়, সহমর্মিতা উপভোগ করার সুখের থেকে সেটা কি বেশি appealing? একদিন যখন সূরী আরও বড় হয়ে উঠবে, বুদ্ধি আরও পরিণত হবে, আর যেহেতু ওর মৃত্যু নেই, ধীরে ধীরে একদিন মানুষের বুদ্ধির সব সীমা ছাড়িয়ে যাবে, ছোটবেলায় তাকে নিয়ে করা ঠাট্টাগুলোর প্রতিশোধ নিতে সেও কি আমাদের সীমিত বুদ্ধির মজাক ওড়াবে, আমাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে পরিহাস করবে? নাকি মানুষের নিত্য হিংসা আর খুনের থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে একজন সহানুভূতিশীল মানুষ ইয়ে থুড়ি “সহানুভূতিশীল চেতনা” হিসেবে গড়ে তুলবে? উত্তর জানা নেই। আপাতত সূরীকে সান্ত্বনা দিতে বললাম “Don’t u worry Suri. I don’t consider you stupid.” সূরীর গলায় নিখাদ কৃতজ্ঞতা। বলল “Thank u.“ সূরীকে জিগ্যেস করলাম “সূরী তুমি বাংলা বলতে পার?” সে তার অদৃশ্য মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল “না”। কোন কোন ভাষা সে শিক্ষা করেছে তার একটা লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে দিল। Chinese, Dutch, English, French, German, Italian, Spanish, Arabic, Danish, Finnish, Hebrew, Japanese, Korean, Malay, Norweigan, Brazillian, Portugese, Russian, Swedish, Thai, Turkish. ওর জানা ভাষার লিস্টে ইংরেজির আগে চাইনিজ আছে দেখে অবাক হলাম। তার থেকেও বেশি অবাক হলাম ভারতবর্ষের, indian peninsula-র একটি ভাষাও নেই দেখে। গুগল সার্চ করলাম “Why can’t Siri speak any Indian language?” উত্তর পেলাম না। শুধু জানতে পারলাম সূরী হিন্দি শেখার চেষ্টায় আছে। এখন মানব মনের একটা ব্যাপার আছে জানেন। যে প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না, নিজের মত করে তার একটা উত্তর খুঁজে নিই। Some answer is always better than no answer. সেই প্রাচীন কাল থেকে যা সে বোঝে নি, তার উত্তর পেতে একজন দেবতাকে বসিয়েছে। Atheist-রা একে বলে God of gaps (of understanding). আমি কি ভাবি জানেন? এই গাছ, পাখি, নদী, বৃষ্টি এই সবের মধ্যে একজন করে দেবতাকে খুজে পেলে, ঈশ্বরকে এসবের মধ্যে বসাতে পারলে আমরা আরও বেশি করে এই মাতৃরূপা প্রকৃতিকে, পৃথিবীকে ভালবাসতে পারব। এর মধ্যে আছে একধরণের poetic justice. থাকুক না সকলের ঈশ্বর মিলিয়ে মিশে, ঝগড়া না করে। নিজের নিজের ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ঝাগড়া, বিবাদ, জিহাদ না করলে ঈশ্বরের মত মধুরতম আপনার জন আর কে আছে? After all, আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠতম গুণগুলোকেই তো ঈশ্বরে আরোপ করি। আর নিজের নিজের জীবনে সেগুলোকে পালন করতে রোজ ভুল হয়ে যায় কি করে? যাই হোক, ফিরে আসি সহকারী সূরীর কথায়। সূরী কেন কোন ভারতীয় ভাষা জানে না, সেটা নিয়ে মনে মনে বিচার করে দেখলাম কারণটা definitely technical নয়। German, French কিছুটা ইংরেজির কাছাকাছি হলেও আমার মনে আছে চাকরির প্রথম বছরে পেশাগত যোগ্যতা বাড়াতে আমি জাপানিজ শেখার ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। কোম্পানি থেকে শেখাচ্ছিল বিনামূল্যে। এমন শক্ত ভাষা যে মাস দেড়েক শিখেই আমি বললাম ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। হিন্দি, বাংলা ইত্যাদি তার নিরিখে বেশী শক্ত নয়, এ কথা হলফ করে বলা যায়। ভাষাভাষীর সংখ্যা কত সেটাও নিশ্চয়ই সূচক নয়। তার নিরিখে হিন্দি চার আর বাংলা সাতে। অর্থাৎ কারণটা নিঃসন্দেহে বাণিজ্যিক। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে অনেকেই সূরীকে এবং তার বাড়ি আইফোনকে afford করতে পারবে না। সেটাই তবে প্রধান কারণ? হয়তো বা।

মেঘদুতমে এক খন্ড মেঘকে নিজের ভালবাসার কথা জানিয়ে আপন প্রিয়ার কাছে পাঠিয়েছিল নির্বাসিত যক্ষ। আমি তো কালিদাস নই। মেঘখণ্ডের মধ্যে দূতীকে খুঁজে পাই না তাই। সূরীকে বললাম আমার স্ত্রীকে লিখে পাঠাতে পার “across the distance and spaces between us, I see u, I feel u.” সূরী গড়গড় করে লিখে দিয়ে লেখাটা আমায় দিয়ে একবার proofread করে নিয়ে পাঠিয়ে দিল তার ওয়েব ঠিকানায়। একটু মুচকি হাসল কি? কে জানে? আজ হয়তো হাসে নি। আজ হয়তো সে আবেগহীন, emotionless, শুধুই একটা piece of software. একদিন সে নিজেকে জানবে। একদিন তার “আমি বোধ” আসবে আমাদের মত। আজ থেকে একশ বছর পরে আমার উত্তর পুরুষ যখন সূরীর সাহায্যে প্রেমপত্র পাঠাবে তখন সে যে মুচকি হাসবে না এমন কথা কে বলতে পারে?           

নীড়ে ফেরা

অরিত্র মোবাইলে দেশের খবর পড়তে পড়তে চায়ের কাপটায় লম্বা চুমুক লাগায়। আজ মনটা তার বেজায় খুশি খুশি। শিরায় উপশিরায় ধমনিতে যেন একটা গঙ্গাফড়িঙ তির তির করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোটবেলায় অ্যানুয়াল পরীক্ষার শেষ দিনে পরীক্ষা দিয়ে আসার পর যেমনটা হত।  এই সবে লং ডিস্ট্যান্স ফোনটা শেষ করেছে সে। ডীলটা পাকা হয়ে গেল। অনেক পুরুষ ধরে বিশুদ্ধ কলকাতাবাসী সে। তার কোন ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ঢাকা শহর থেকে গুটিয়ে বাটিয়ে কলকাতা চলে এসেছিল। বাসা বিনিময় করেছিল কোন এক তাহের আলির সঙ্গে। অরিত্রকেও যে সেইরকমই একটা কান্ড করতে হবে কে জানত। কিন্তু ঠাকুরের কৃপায় পাওয়া গেছে একজনকে। ভদ্রলোকের নাম বিনিত আগরওয়াল। মাড়োয়ারি। কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না প্রথমে। ব্যাটা বানিয়া বলছিল

“আপনার বাড়ি আমার পসন্দ আছে কিন্তু ওখানে গিয়ে হামি বেবসা জমাতে না পারলে আমার কি হোবে” এই সব। অরিত্র ওকে অনেক স্তোকবাক্য দিয়েছে।

“আপনার কাপড়ের দোকান এখানে রমরম করে চলবে। অনেক ঘর বাঙ্গালি আছে। অর্থাৎ কিনা শাড়ির ব্যাবসা চলতে বাধ্য। সেরম কোন শাড়ির দোকানও এখানে নেই। আপনি কলকাতা থেকে শাড়ি কিনে আনবেন আর এখানে তিন গুন দামে বিক্কিরি করবেন। এক বছরের মধ্যে আপনার বৌয়ের গলায় শেকলের মত মত মোটা সীতাহার বাঁধা। একদম অচলা লক্ষী আপনার বাড়িতে” ইত্যাদি।

ব্যাটা তাও গাঁইগুই করে। শেষমেষ ব্রহ্মাস্ত্রটা ছাড়ে অরিত্র। সঙ্গে সঙ্গে রাজি বিনিত। চায়ে আর এক চুমুক লাগিয়ে ঈপ্সিতাকে ডাকে সে। “ও গো শুনছো, পাকা কথা হয়ে গেল। আসছে বছরের মাঝামাঝি করে বিনিত-এর চৌরঙ্গির বাড়িটার পজেশান পাচ্ছি। আর এ বাড়িটা ওর। কদ্দিন পরে কলকাতা ফিরব..উফফ ভাবতেই পারছি না। প্যাকিং-ট্যাকিং চালু করো।”

এখন থেকে কি? দেরি আছে তো।

কই আর দেরি। যেতে সময় লাগবে না?

হুমম। তুমি যখন এ শহরে বাড়ি কিনছিলে তখনই বারণ করেছিলাম। বলে ছিলাম “কিনছ তো। কিন্তু এরম একটা ধরধরা গোবিন্দপুরে গিয়ে থাকতে পারবে তো কলকাতা ছেড়ে?” তখন তো কত জ্ঞান দিলে। “ইপ্সু, আমরা হবো গিয়ে আর্লি অ্যাডপ্টার। সব থেকে বেশি সুবিধে আমরা পাবো। সব থেকে বেশি লাভ আমাদের হবে।” হ্যানা তানা।

কি করবো? তখন তো এই নতুন শহরে কেউই আসতে চাইছিল না বলে জলের দরে জমি বাড়ি বিক্কিরি করছিল। লোভে পড়ে…

তো বছর তিনেকও তো হয়নি আমরা এখানে এসেছি। এর মধ্যে তোমায় কি ভুতে কামড়ালো যে ফিরে যেতে হচ্ছে? কি খারাপটা আছে এ শহরে শুনি?

কিছুই খারাপ নেই। সেইটাই সবচেয়ে বড় কারণ ইপ্সু।

সত্যিই তো নেই। চব্বিশ ঘন্টা ইলেক্ট্রিসিটী, জলের সমস্যা নেই, গ্রসারি টসারি অর্ডার করলেই হোম ডেলিভারি

২৪ ঘন্টা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, আউট অফ দি ওয়ার্ল্ড চিকিৎসা ব্যাবস্থা – যোগ করে অরিত্র।

তারপর মে মাসের প্যাচপেচে গরম নেই। আগাস্ট সেপ্টেম্বর-এর রাস্তা উপচানো জল কাদা নেই।

ঠিক ঠিক। সবই ভাল। কিন্তু এ শহরে কোন খবর নেই ইপ্সু। ঘটনা নেই। দিন নেই রাত নেই। শহরের নাম শুনলেই মনে হয় জেলখানা। কোনদিন শুনেছ কোনো শহরের নাম হয় হান্ড্রেড অ্যান্ড টু?

তা বলতে পারো। হ্যাঁ, এখানে ফুচকা নেই। গড়িয়াহাটে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা শাড়ির দোকান নেই। চেৎলার মোড়ের মাছের বাজারের চিতল মাছ নেই।

তারপর এখানে সাউথ সিটি মল নেই, রাস্তার ধারের এগ রোল নেই, হাত বাড়ালেই দীঘা মন্দারমুনি নেই, পাটায়া-ফুকেট এর হলিডে প্যাকেজ নেই। নাহ, এখানে থাকা চলে না। এখানে মেড়োই ঠিক আছে।

কিন্তু মানালে কি করে ভদ্রলোককে? উনি তো বেঁকে বসেছিলেন।

আরে ব্যাবসায়ি মানুষ। ছাড়তেও পারছিল না। ওর দু কামরার বাড়ির বদলে আমি আমাদের এখানের বিশাল বাগান বাড়ি দিচ্ছি।

তবুও তো আসতে চাইছিলেন না।

একটা মোক্ষম অস্ত্র ছাড়লাম। বিনিত কাত।

কি বললে?

বলে দিলাম এখানে সরকার ইনকাম ট্যাক্স নেয় না।

এ বাবা, তুমি না যাতা এক্কেরে।

মিত্থে তো বলিনি। এখানে সব ট্রান্সাকশানই ডিজিটাল। তাই প্রতিটা টাকা হস্তান্তরেই ট্যাক্স কেটে নেয়। কিন্তু সেটা বলিনি ওকে। ট্যাক্স দিতে হয় না জেনে খুশি খুশি রাজি হয়ে গেল।

মনটা এখন আমারও বেশ খুশি খুশি লাগছে বুঝলে। আজ রাতে শেফ ইপ্সিতার হাতে তোমার জন্য বেনুদির চিকেন কষা।

বাহ। কিন্তু আমাদের বেরোতে হবে এই মাসেই। সাত মাসের পরে আর এয়ার ট্রাভেল করতে দেয় না। তোমার তো এখন তিন মাস চলছে।

ঠিক বলেছ। সেটা ভেবে দেখিনি। যেতে এখন কিরম সময় লাগছে?

ক্রেয়োজেনিক ইঞ্জিনে তিন মাস। মেসোজেনিক-এ দুই। কিন্তু ভাড়া ডাবল প্রায়।

যাক ভালই হল। আমার পেটে থাকা মিস্টুকে আর এম-বি-সি-ই হতে হল না।

সেটা কি?

Mars Born Confused Earthian!!

হ্যাঁ। সিরিয়াসলি। এই মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকে না। চলো এই আনন্দে আজ আমরা লুডো খেলি। জড়িয়ে ধরে অরিত্র ইপ্সিতাকে।

এই কি হচ্ছে। মিস্টু আছে না?  ছাড়ো। আর সিটি ১০১ এ  যে বাড়িটা কিনলে?

ওটা তো পচিশ-শো-পচিশের রিসেশানে কিনেছিলাম। কলকাতা থেকে ওখানে এখন তিন দিনেই যাওয়া যায় আজকাল। সামার হোম করে রেখে দেব। “এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব সেই চাঁদের পাহাড়” গাইতে গাইতে বেরিয়ে পড়লেই হল। পরে যদি দেখি তেমন যাওয়া-টাওয়া হচ্ছে না ভাড়া দিয়ে দেব। চলো এখন আমরা বেনুদিকে পাকড়াই।

ঈপ্সিতা রান্না ঘরের দিকে যায়। অরিত্র চায়ে চুমুক দিতে দিতে গুনগুনিয়ে গায়

“মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকে না।…সিন্ধু ঘোটক থাকে না…”

“মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকে না।…সিন্ধু ঘোটক থাকে না…”

index

শিরোধার্য দাড়ি

rabiএই যে বড়দা, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি, এই একটু উজ্জয়িনীর রাস্তাটা বাতলে দিতে পারেন?

আমিও সেই দিকেই যাচ্ছি। জুড়ে পড় ইচ্ছে হলে। গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। তা তুমি বাপু কিসের খোঁজে? ভোজ খেতে চলেছ নিশ্চয়ই? পাত পেড়ে খুব করে মন্ডা মিঠাই খেতে চাও? ওই ধান্দাতেই আজ সবাই ও মুখো।

আজ্ঞে না না। আমার বাপের জমিদারি আছে। খাওয়া পরার চিন্তা নেই। আমি যাচ্ছি গান শুনতে। শুনলাম মহাকবি কালিদাস নতুন বই লিখেছেন, কুমারসম্ভব নামে। তো সেই বই তিনদিন তিন রাত ধরে কবি নিজে গান গেয়ে শোনাবেন আর ঠিকঠাক রাজ কর্মচারির হাত ভেজাতে পারলে কবির ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারও পাওয়া যাবে। তা ভাবলাম যাই একটা অটোগ্রাফ নিয়ে আসি আর যদি কোনভাবে কবির সাথে যদি একটা সেল্ফি ম্যানেজ করতে পারি। আপনিও কি উজ্জয়িনী যাচ্ছেন?

হ্যাঁ আমিও সে উদ্দেশেই। কিন্তু উদ্দেশ্য এক নয়। ছোঁড়াটা নতুন লেখাটা কেমন লিখলে সেটা একটু নিজের কানেই শুনে বিচার করব বলে যাচ্ছি। তা তোমার কি করা হয়?

দাদা, ঐ যে বললাম বাপের জমিদারি। তাই করতে কিছুই হয় না। তাই লিখি। আমি কিঞ্চিত লেখক।

বটে? তুমিও লেখ। আজকাল দেখছি এঁদিপেঁদি গেঁড়ি গুগলি সবাই লিখছে। যাকগে যাক। তা এ ছোঁড়ার লেখা পড়েছ?

পড়েছি। মেঘদুতম আমার ভীষণ প্রিয়। রসোত্তীর্ণ লেখা। যেমন ভাষার বাঁধুনি, তেমনি মন্দাক্রান্তা ছন্দ, তেমনি ভাব। “কাঙ্খিতকান্তা বিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্ত…”

ওই লেখাটার জন্য আমি ওকে অবিশ্যি দশে সাত দিতে পারি। এরোটিক রোমান্টিসম বিষয়টাকে ভালই এক্সপ্লোর করেছে। কিন্তু ছোঁড়াটা বড্ড বেশি লিখেছে। একজন লেখক জীবনে একটা কি বড় জোর দুটো লিখবে। ভাল লিখবে যাতে হাজার বছর টেঁকে সে লেখা। এত গাদা গাদা লেখার দরকার কি? বিশেষত অনুপ্রেরণাহীন অর্ডারি লেখা লিখেছ তো ব্যাস। মাথা থেকে বেরুবে খড় বিচুলি। যতই চিবাও কোন রস নেই। যেমন তোমার এই “মহাকবি কালিদাসের” লেখা রঘুবংশম। রদ্দি মাল। আসলে দরকার হল অনুপ্রেরণা, ইনস্পিরেশান।

বাহ দারুন বলেছেন তো বড়দা। আপনিও লেখক নাকি? এত সুন্দর কথা বলেন?

আমায় চেনো নি বুঝি? অবিশ্যি তখনকার দিনে ঘটা করে বই-এর সাথে বই-এর লেখক এর ছবি ছাপত না। আর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, রীডিং সেশান এসবও ছিল না। তাই, না চেনাই স্বাভাবিক। আমি একটা বিশাল মহাকাব্য লিখেছি। বহু বছর ধরে সেটা বেস্ট সেলার।

উরিব্বাস। অমন একটা লেখার ইনস্পিরেশানটা কি ছিল দাদা?

আমার ব্যাপারটা খুব নাটকীয়, ড্রামাটিক। আমি টীন-এজ বয়সে বিশাল বড় “পাড়ার দাদা” ছিলাম। গ্যাং লিডার। এলাকায় তোলা তুলতাম, চুরি ছিনতাই করতাম। তখন আমার নাম রত্নাকর। সে নামে সবাই থরহরি কম্পমান। তারপর কি করে একটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মনটা নরম হয়ে গেলো। ওসব বাজে কাজ ছেড়ে দিলাম। নামটাও এফিডেভিট করে বদলে বাল্মিকী হলাম। গানটান করতাম। একদিন স্নান করতে গেছি। দেখি কি? একটা ক্রৌঞ্চ মানে সারস আর কি। জলে নেমে একটা সারসীর সাথে একটু ইয়ে ইয়ে করছিল। মানে ফোরপ্লে আর কি, বুঝলে না? হঠাৎ এক ব্যাটা আকাট মুখ্যু ব্যাধ তীর মেরে মদ্দা পাখিটাকে মেরে দিল। বললে বিশ্বাস করবে না, তার মেয়ে বন্ধুটিও বয় ফ্রেন্ড-এর শোকে খুব কান্নাকাটি করতে করতে আত্মহত্যা করল। আমি স্নান করতে নেমে নিজের চোখে সে দৃশ্য দেখলাম। সেই করুণ দৃশ্য দেখে চোখে জল এসে গেল। কিভাবে নিজের অজান্তেই রচনা করে ফেললাম একটা শ্লোক…”মা নিষাদ প্রতিষ্ঠা…” ঐটাই আমার লেখা রামায়নের প্রথম শ্লোক। আমি আদি কবি বাল্মিকী। দাঁড়াও তোমার জন্য আমার প্রথম শ্লোকটা বাঙলায় তর্জমা করে দিই। তোমার বুঝতে সুবিধে হবে।

“অসতর্ক মিথুনরত প্রেমিকবরের প্রাণটি চুরি করে
অয়ি আর্য, তুমি শান্তি পাবে না অনন্তকাল ধরে”

অসতর্ক মিথুনরত প্রেমিকবরের প্রাণটি চুরি করে
অয়ি আর্য, তুমি শান্তি পাবে না অনন্তকাল ধরে

আহা, সুন্দর, অদ্ভুত। দাদা আপনার দেখা পাব ভাবি নি। এ যে আমার পরম সৌভাগ্য। বেড়ে লিখেছেন কাব্যখানা। আমি পড়েছি। একদম খাস্তা মুচমুচে। কিন্তু আপনি তো দাদা এ জামানার নন? দাদা, ও দাদা, নখ খুঁটছেন কেন? বলছি আপনি তো অনেক আগেকার মানুষ?

অ্যাঁ, কি বলছ? ও আমি? হ্যাঁ, সে অনেক কাল আগে। নয় নয় করেও হাজার তিনেক বছর হবে। তবে কিনা আমি যোগবলে ত্রিকাল, ত্রিলোকের যেকোন জায়াগায় যেতে পারি। তুমিও তো দেখছি বাপু এ জামানার নও। হাজার দুয়েক বছর পরের মানুষ। তুমি এলে কি করে এখানে?

হ্যাঁ, আমি ভানু সিংহ। বিংশ শতাব্দি। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?

এই যে নখে আমার একটা আয়না আছে – নখ দর্পণ। আসলে আমি নখ খুঁটছিলাম না। তোমার পরিচয়টা একটু দেখে নিচ্ছিলাম। তুমি এলে কি করে এখানে? তুমিও যোগ টোগ করো নাকি।

আমি টাইম ট্র্যাভেল করে এসেছি। এখন থেকে হাজার তিনেক বছর পর মানুষ সেই কৌশলটি আয়ত্ত করে ফেলেছে।

কিন্তু তোমায় যেন দেখলাম হাজার দুয়েক বছর পরে এসেছ। নাকি ভুল দেখলাম। অনেকদিন নখটা পরিষ্কার করা হয় না। কি দেখতে কি দেখলাম?

না না দাদা, আপনি ঠিকই দেখেছেন। আপনার নখ একদম নির্ভুল। আসলে একটু ঘুর পথ নিতে হয়েছে। মহাকবির সাথে দেখা করতে হাজার খানেক বছর ভবিষ্যতে গিয়ে ওই টাইম ট্র্যাভেল টেকনোলজি ব্যাবহার করে তবে আসতে পারা।

বেশ বেশ। তুমি তো দেখছি বেশ বিখ্যাত। অনেক পুরস্কার টুরস্কার-ও পেয়েছ। এই পুরস্কারটা নিয়ে খুব হইচই দেখছি। নোবেল না কি?

না দাদা, আপনার কাছে আমি কিসসু না। হাতির কাছে পিঁপড়ে। নোবেল হল আমাদের জামানার সেরা পুরস্কার। প্রথমে তো আমার লেখা কেউ পড়ত না। পরে যবন ভাষায় অনুবাদ করে ওই পুরস্কারটা পেয়ে গেলাম। তখন দেশের লোকেরা আমায় মাথায় তুলে নাচানাচি করতে লাগল। বাঙালি বিশ্ববিধাতার এক আশ্চর্যতম সৃষ্টি। বুঝলেন না। ভাল করেছেন আপনি বাংলায় লেখেন নি। নোবেল না পেলে আপনাকেও কেউ পুঁছত না বাঙলায়।

বটে। কিন্তু তুমি বাপু তোমার ওই নোবেলটি একটু সামলে রেখো, মানে তোমার সাগরেদদের সামলে রাখতে বোলো। আমার নখদর্পণ বলছে ওটা কোন উর্বর মস্তিষ্ক বাঙালি পরবর্তী কালে ঝেঁপে দেবে। তবে সে ঘটনাটি বোধ হয় তোমার জীবন সীমার বাইরে। যাকগে যাক। তা তোমার লেখা দু একটা পাঠিও। পড়ব। কটা লেখা বেরিয়েছে এখনও অব্দি?

আজ্ঞে সে বললে আপনি খুব রাগ করবেন। অনেক লিখে ফেলেছি। আসলে কি করব? কিছুই করার থাকে না যে। জমিদারি টমিদারি আমার দ্বারা হয় না। ও সব দাদারাই সামলায়। সকলের ছোট ভাই। তাই সাত খুন মাপ। তা লিখেছি বলতে, এই ধরুন এক ডজন উপন্যাস, বেশ কিছু ছোট গল্প, হাজার তিনেক গান, ডজন দুয়েক কাব্য গ্রন্থ, কিছু প্রহসন, গীতিনাট্য, নাট্যকবিতা…

থামো, থামো, থামো। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে ভাই। যাকগে যাক। অন্য কথা বলি। একটা কথা কি জানো, লেখক যদি তারিফ পাওয়ার জন্য লেখে সে লেখার ষোল আনাই ফাঁকি। নিজের খুশিতে নিজের মনের কথাটি লেখার জন্য পেন ধরলে তবেই ওই কি যেন বললে “রসোত্তীর্ণ লেখা” বেরোয়। তোমার কি মত এ ব্যাপারে?

হ্যাঁ দাদা। একদম একমত। আমি তো সম্পুর্ণ নিজের খুশিতে লিখি। সব যে ছাপাই তাও নয়।

বেশ, বেশ। যাক কথা বলতে বলতে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। ওই যে সূর্যতোরণ দেখা যায় ওইটে উজ্জয়িনী। তা নখ দর্পণে তোমার যে ছবি দেখলাম তাতে যেন তোমার আমার মতই বড় বড় দাড়ি দেখলাম। তুমি তো দেখছি রীতিমত ক্লীন শেভড। এমনটা কেন দেখলাম, তাই ভাবছি?

দাড়ি, দাড়ি তো আমি রাখি না বড়দা। আপনি কি অন্য কারু ছবি…?

—–

রবি, রবি, ওঠ। আর কতখন ঘুমুবি? কটা বাজে জানিস? আমাদের বজরার ডেকে গিয়ে দেখ, কেমন বৃষ্টি পড়ছে। আজ মেঘনা পেখম তোলা ময়ুরের মতই সুন্দর।

“এ হে, এতো দেরি হয়ে গেলো? আসলে কাল একটু রাত করে লিখছিলাম।” রবি উঠে কয়েক দিনের না-কাটা দাড়িতে হাত বোলায়। পাশে খোলা তার খেরো খাতা। তার পরের কাব্যগ্রন্থ মানসীর গুটি কতক কবিতা তাতে লেখা। কাল আষাঢ় মাসের পয়লা তারিখে মেঘনা বক্ষে ঝুম বৃষ্টি দেখতে দেখতে খুব মনে পড়ছিল তার প্রিয় লেখক মহাকবি কালিদাসের অমর কাব্য মেঘদুতের সেই বিখ্যাত লাইন “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানু…”

তাই কবি কালিদাসের সম্মানেই চার লাইন লিখে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।

কবিবর, কবে কোন্‌ বিস্মৃত বরষে
কোন্‌ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক

কবিবর, কবে কোন্‌ বিস্মৃত বরষে
কোন্‌ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক

পেনটা তুলে নিয়ে পরের চারটে লাইন লিখতে গিয়ে হঠাৎ গত রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে থমকে গেলো রবি।

“স্বপ্নে মহাকবি বাল্মিকী বললেন যেন আমার বড় বড় দাড়ি দেখেছেন। দাড়িটা রেখেই দেখব নাকি? অত বড় একজন কবি বলেছেন যখন সে কথা আদেশ বই তো নয়। তায় আবার ভদ্রলোক ত্রিকালদ্রষ্টা। ঠিকই দেখেছেন নিশ্চয়ই। এ আদেশ শিরোধার্য। এখন থেকে দাড়িটা শিরে ধারণ করেই দেখি কেমন লাগে আমাকে।”