শব্দের জন্ম

আজকে আপনাদের কিছু শব্দের জন্মকথা নিয়ে গল্প বলব। আমি, আপনি আমরা সকলেই তো এক একটা সতন্ত্র সত্ত্বা – সকলেরই একটা গল্প আছে। তেমন শব্দদেরও আছে এক একটা নিজস্ব শরীর, মন আর ইতিবৃত্ত। কিছু কিছু শব্দের জন্মকথা ভীষণ হৃদয়গ্রাহী বা ইন্টারেস্টিং। মানুষ যখন থেকে নিজের হাত পা আর মুখের বিভিন্ন পেশীর ওপর সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে তখন থেকেই তার অন্যদের সাথে যোগাযোগের শুরু। হাসি, কান্না, কোঁচকানো ভুরু, অঙ্গুলিনির্দেশ এ সবই শব্দ বা ওয়ার্ডের সাহায্য ছাড়াই যোগাযোগ সাধনে সমর্থ। মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ কি না বলা, হাত তুলে অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা, হাততালি দিয়ে সমর্থন বা উৎসাহ প্রদান, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ বা বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কাউকে কাঁচকলা দেখানো এ সবের মাধ্যমে আমরা নিয়মিত শব্দ ছাড়াই ভাব প্রকাশ করে থাকি। তার ওপর ধরুন ক্রিকেটের মাঠে আম্পায়ার বা ফুটবল মাঠের রেফারি পুরো ম্যাচ জুড়েই কোন কথা না বলেই সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে থাকে। কোন বিস্মৃত অতীতে এই সাঙ্কেতিক ভাষা থেকে মানুষ লিখিত বা কথ্য ভাষায় উত্তীর্ন হয়েছিল ইতিহাস তার উত্তর দিতে অসমর্থ। কিন্তু তাও কিছু কিছু শব্দের জন্ম বৃত্তান্ত সন্দেহাতীত ভাবে জানা যায়। যেমন ধরুন ইংরেজি শব্দ write এসেছে writan থেকে যার আদতে মানে হল আঁচড় কাটা। গাছের বাকলে বা পাথরে কোন ছুঁচোল জিনিস দিয়ে আঁচড় কেটেই প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা প্রথম লিখিত ভাবে নিজের ভাব প্রকাশের চেষ্টা করেছিল। আর প্যাপিরাস গাছের ছাল শুকিয়ে যে প্রথম পেপার তৈরী হয়েছিল এ তথ্য আপনাদের সকলেরই জানা। ল্যাটিন শব্দ penna যার আসল মানে হল পালক তার থেকেই pen শব্দটির উৎপত্তি সেটাও বোধ হয় আপনাদের অজানা নয়। শুকোনো পাখির পালকের ডগা দিয়েই মানুষের প্রথম সাহিত্য সৃষ্টি। কিন্তু আজ আমি কিছু অন্য ইংরেজি শব্দের গল্প বলব।

 

কিন্তু তার আগে ইংরেজি শব্দের প্রথম দুই আদ্যক্ষরের জন্মকথা একটু সেরে নিই। লেবানন, সিরিয়া, গাজা, ইজরায়েলের উর্বর অববাহিকা অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল সেমিটিক সভ্যতা। ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে ওঠার কিছু পরে পরেই এই সভ্যতার পত্তন। সেই প্রাচীন ফোনেশিয়ান সভ্যতায় জাগতিক উন্নতি বা মেটিরিয়াল  প্রস্পারিটির সর্বপ্রধান সূচক ছিল Ox বা ষাঁড় যার তৎকালীন প্রতিশব্দ ছিল Aleph. এই Aleph থেকেই A শব্দের উৎপত্তি।  যেহেতু কৃষিপ্রধান সভ্যতায় ষাঁড়ের ব্যাবহারিক মূল্য ছিল অসীম, সুতরাং ইংরেজি বর্ণমালায় এটি যে আদ্যক্ষর হিসেবে স্থান পেয়েছে সেটি কিছু আশ্চর্য নয়। এমনকি শুরুর দিকে এটি লেখা হত V এর আদলে যেটা কিনা ছিল ষাঁড়ের শিং এর প্রতিরূপ। পরে গ্রীক সভ্যতায় অক্ষরটিকে উল্টে নেওয়া হয়। খাদ্য উৎপাদনের পরে মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আশ্রয়। ফোনেশিয়ান ভাষায় Beth মানে তাঁবু বা বাড়ি। তাই থেকেই আমাদের আজকের B এর জন্ম। B তে যে দুটো অর্ধবৃত্ত বা চেম্বার আছে সেটা আদতে একটি ছেলেদের ঘর আর একটি মেয়েদের ঘর – মানে আজকের দিনে আমাদের টু বেডরুম ফ্ল্যাট আর কি! অক্ষর সম্বন্ধে আরও বেশি কিছু বললে বোর হয়ে যাবেন, তাই এবার একটু শব্দে যাওয়া যাক।

 

প্রথমেই  একটা clue দিই থুড়ি মানে clue শব্দ সম্বন্ধে বলি। একটি গ্রীক পৌরাণিক গল্প থেকে এর উৎপত্তি। ক্রীট দ্বীপে মিনোটার নামে একটা আধা-ষাঁড়-আধা-মানুষ দৈত্য একটা ভুলভুলাইয়ার মধ্যে লুকিয়ে ছিল। গল্পের নায়ক থিসিয়াস তাকে মারবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার প্রেমিকা, রাজকন্যে অ্যারিয়াডনে তাকে একটা সুতো দিয়েছিল যেটার একটা প্রান্ত সে ধরে থাকবে আর সুতো ছাড়তে ছাড়তে থিসিয়াস সেই ভীষণাকার দৈত্যকে মারতে এগিয়ে যাবে যাতে দৈত্য হননের পর সে ঠিক মত বেরিয়ে আসতে পারে সেই maze বা ভুলভুলাইয়া থেকে। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন তখন থেকেই মেয়েরা তার হবু বরের সুতোটি ধরে রেখেছে। সে যাই হোক, তখনকার ভাষায় সুতোকে clewe বলা হত। তাই থেকেই clue শব্দটি এসেছে যার মানে হল যা আমাদের কোন puzzle সমাধানে সাহায্য করে।                 

 

এবারে আপনাদের বলি নিকোলাসের গল্প। নেপোলিয়ানের সৈন্যবাহিনীতে Nicholas Chauvin বলে এক সৈন্য ছিল তার প্রভুভক্তি এতই প্রবল ছিল যে ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ন বাজে ভাবে হেরে যাওয়ার পরও এই প্রচণ্ড ভাবে আহত মানুষটি সর্বত্র নেপোলিয়নের গুণগান করে ফিরত। শেষমেশ তার প্রভুভক্তি হাসির বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এবং নাট্যকার স্ক্রাইব তাকে নিয়ে ক্যারিকেচার করে একটি নাটক লেখেন। সেই থেকেই এসেছে শব্দ Chauvinism যার মানে হল কোন এক আইডিওলজি বা আদর্শর প্রতি অযৌক্তিক ও তীব্র আকর্ষণ।

 

এবার হোক জিন নিকোটের গল্প। ভাষাত্বত্ত্ববিদ এই ফরাসী মানুষটি যখন লিসবনে ফ্রান্সের অ্যাম্বাসাডার হিসেবে কাজ করতেন, তখন একটা অদ্ভুত গাছের বীজ নিয়ে এসেছিলেন যেটা কিনা একটা অতি আশ্চর্য জায়গা আমেরিকা থেকে লিসবনে এসেছে। সেই আশ্চর্য গাছের পাতার ব্যাবহার বন্ধ করতেই আজকের স্বাস্থ্যকর্মীদের যাকে বলে একেবারে নাভিশ্বাস। হ্যাঁ ওনার নামেই এই গাছের নাম দেওয়া হয় নিকোটিন।

তারপর ধরুন Assassin. আজ থেকে প্রায় আটশ বছর আগে আরবের পাহাড়ি মরুভূমিতে এক শেখ ছিল যার পোষা দুর্বৃত্তরা ওই পথ দিয়ে যাওয়া যেকোনো মানুষকে নির্দয় ভাবে হত্যা করত। আর সেই কাজের মানসিক প্রস্তুতি নিতে হ্যাসিস নামক এক ধরণের ড্রাগ নিত। এই খুনে ডাকাতদের বলা হত hassassin যার থেকে এসেছে শব্দ assassin যারা মানুষ মারার কাজ করে।

কমরেড শব্দ শুনলেই যদি আপনার কাস্তে-হাতুড়ি-তারা মনে পড়ে যায় কিম্বা মধ্যপ্রদেশের রেড করিডোর তাহলে জেনে রাখুন কমরেড শব্দের অর্থ খুবই সাধারণ আর তা হল রুমমেট অর্থাৎ যারা একই ছাদের তলায় থাকে। এসেছে ল্যাটিন শব্দ camera থেকে যার মানে হল রুম বা ঘর। ফ্রী শব্দ এসেছে freo থেকে যার আসল মানে হল কাছের মানুষ, সংস্কৃতে যা হল  প্রিয়া। তখনকার দিনে গ্রীসে দাসপ্রথার চল ছিল। অর্থাৎ প্রতি বাড়িতে ছিল কিছু কাছের মানুষ যারা কিনা  free আর কিছু দাস বা চাকর। আর কখনো যদি কোন দাস নিজের কাছের মানুষ হয়ে উঠত তাকে free করে দেওয়া হত বা প্রিয় মানুষের জায়গা দেওয়া হত। তাই থেকেই free শব্দের মানে হয় মুক্ত। পেশীর ইংরেজি প্রতিশব্দ muscle শব্দটা কিন্তু এসেছে mouse  থেকে। ঠিক ধরেছেন, কেউ যখন পেশী ফোলায় মনে হয় না একটা ছোট্ট ইঁদুর চামড়ার নিচে ওপর নিচে দৌড়াদৌড়ি করছে?  Favor শব্দের ইতিহাস খুব রোমান্টিক। মধ্যযুগে যখন নাইটরা বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টে অংশ গ্রহণ করত তখন মধ্য বয়সী মহিলারা কখনও চোখের কটাক্ষে, কখনো বা চুলের রিবন, পোশাকের অংশ, হাতের গ্লাভস ইত্যাদি দিয়ে উৎসাহিত করত এবং প্রেম নিবেদন করত। এই টোকেন গুলো নাইটেরা পোশাকের সাথে পড়ত। এগুলিকেই favor বলা হত। অর্থাৎ কিনা যার যত favor, মহিলা মহলে তিনি তত জনপ্রিয় মানে আজকের দিনে সুন্দরীদের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে পোষ্ট করার মত আর কি!

 

সুন্দরীদের কথায় যখন এসে পড়েছি তখন কসমেটিকসের কথাটা বলে নিতে হয়। এসেছে গ্রীক শব্দ kosmos বা cosmos থেকে। মানে হল গিয়ে বিন্যাস বা order. এই বিশ্ব বা ইউনিভার্স ভীষণ নির্দিষ্ট ভাবে বিন্যস্ত বলে একে কসমস বলা হয়। অর্থাত কিনা, মেয়েরা যখন অধীর রক্তিম করে, চোখে লাগায় মাস্কারা (আর ছেলেরা তাই দেখে পায় আস্কারা… pardon my poor sense of humor 🙂 ) তখন মেয়েরা আসলে নিজেদের সুন্দর ভাবে বিন্যস্ত করছে।  

 

Ostracize কথার মানে কাউকে একঘরে করা। এর ইতিহাসটা বেশ ইন্টারেস্টিং। প্রাচীন এথেন্সে গণতন্ত্র ছিল। সেখানে রাজ্যবাসী যদি মনে করত কোন পাবলিক ফিগার বা নেতা নিজের দায়িত্ব প্রতিপালন করছে না, তারা শহরের এক জায়গায় জড়ো হয়ে মাটির তৈরি ছোত ছোট টালিতে তার নামে লিখে ভোট নিত। এই টালির নাম ostrakon। ছয় হাজার বিপক্ষ ভোট সংগৃহীত হলে তাকে রাজ্য থেকে পাঁচ বা দশ বছরের জন্য নির্বাসন দেওয়া হত। সেই থেকেই ওয়ার্ড ostracize. Laconic শব্দের উৎপত্তি বেশ হাসির। প্রাচীন গ্রীসে ল্যাকোনিয়া বলে একটা জেলা ছিল। সেখানকার মানুষজন খুব কম কথা বলত। কথিত আছে এক অ্যাথেনিক দূত এসে  যখন তাদের বলেছিল “If we come to your city, we will raze it to the ground.” অল্প কথার মানুষ ল্যাকোনিয়ানরা শুধু উত্তর দিয়েছিল “If”. সেই থেকেই কম কথার মানুষদের বলা হয় laconic. Calculate আর Calculus শব্দের জন্ম এক ধরণের ছোট্ট পাথর calculi থেকে যা দিয়ে প্রাচীন রোমের ব্যাবসায়ীরা লাভ ক্ষতির হিসেব করত।

 

Narcissus আর echo দুটো এমনিতে unrelated শব্দ কিভাবে সম্পর্কিত জানতে আবার ফিরে যাই গ্রীক মাইথোলজিতে।  বাতাস আর মাটির মিলনে জন্মায় পরমা সুন্দরী কন্যা  Echo. Echo বড় হয়ে স্বর্গের রাণী হেরার দেখাশুনোর গুরুদায়িত্ব পেল। কিন্তু রাণী তো। একটুতেই খাপ্পা। বেশী কথা বলার জন্য ইকোকে শাস্তি দিল যে সে অন্যের কথা পুনরাবৃত্তি করা ছাড়া আর কোন কথা বলতে পারবে না। তাই echo মানে প্রতিধ্বনি। এদিকে কথা বলার দিক থেকে প্রতিবন্ধী হয়েও নবযৌবনবতী echo narcissas নামে এক সলমন খান টাইপ্স হ্যান্ডু পাবলিকের প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খেতে লাগল। নার্সিসাস হল গে একটা নিম্ফের প্রেমে পড়ে নদী দেবতার গর্ভজাত সন্তান। প্রথমে নার্সিসাসের মনেও ইকোর জন্য একটু ইয়ে ইয়ে হয়েছিল কিন্তু কথা বলতে পারে না দেখে ইকোকে সে ঝেড়ে ফেলে দিল। ব্যাস মর্মাহত ইকো ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। শুধু তার গলার স্বরটা রয়ে গেল। পরের বার পাহাড়ে গিয়ে যখন জোরে চেঁচিয়ে নিজের গলার প্রতিধ্বনি শুনবেন, আমাদের পুওর প্রেমিকা ইকোকে একটু স্মরণ করে নেবেন। এদিকে ইকোর এই অকাল মৃত্যুতে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার দেবতা নেমেসিস একেবারে রেগে আগুন তেলে বেগুন। আর তখন তো রেগে গেলেই ফটাফট অভিশাপ দিয়ে দিত দেবতারা। নেমেসিস নার্সিসাসকে অভিশাপ দিল যে সে জলে নিজেরই ছায়ার প্রেমে পড়বে। আর বলতে না বলতেই ফল। নার্সিসাস জলে নিজের ছায়া দেখে নিজের রূপেই মুগ্ধ হয়ে আর মুখ ফেরাতে পারে না। প্রতিধ্বনি ইকোকে পাত্তা না দিয়ে এখন প্রতিচ্ছবির প্রেমে পড়ে একেবারে নাস্তানাবুদ। শেষমেশ বেচারা শুকিয়ে গিয়ে ফুল হয়ে গেল। সেই ফুলেরও নাম নার্সিসাস। দেখবেন ফুলটা ঘাড় ঘুরিয়ে নিজেকেই দেখতে ব্যস্ত। আমাদের সকলের মধ্যেই অল্পবিস্তর নার্সিসাস রয়েছে। আপনাদের কথা জানি না আমি সর্বদাই নিজের প্রেমে গদগদ।

 

যাকগে যাক এবারে একটু খাওয়া দাওয়াতে আসা যাক। বাঙালি আর যাই হোক খেতে ভারি ভালোবাসে। সকালে উঠেই নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল আর ধূমায়িত কফি আপনার রসনা তৃপ্ত করে। ৪৯৬ খৃষ্ট পুর্বাব্দে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষে রোমান গ্রামাঞ্চলে যখন অনেক লোক মারা যাচ্ছে তখন পুরোহিতরা এসে বলে এক নতুন দেবী Ceres এর আরাধনা করতে হবে, তবেই বৃষ্টি হবে আর ফসল ফলবে। সেই ফসলের দেবী Ceres আমাদের আজকের শব্দ Cereal এর জন্মদাতা। আর মোটামুটি নবম শতকে কাল্ডি নামে এক মেষপালক দেখে তার ভেড়াগুলো একটা গাছের পাতা খেয়ে অদ্ভুত আচরণ করছে। ব্যাপারটাকে সরেজমিনে তদন্ত করতে পাতা আর ফল বেটে সেও একটু খেয়ে দেখে বেড়ে জিনিস। ধীরে সেই বেরী গুলোকে শুকিয়ে নির্যাস বের করে পান পর্ব শুরু। আরবরা তার নাম দিল qahwe. দীর্ঘ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জেগে থাকার জন্য এর সদব্যাবহার হতে লাগল। ব্যাস ধর্মগুরুরা করে দিল ব্যান। সেই পানীয় আরব থেকে ফ্রান্সে এসে নাম নিলো cafe. তার থেকে coffee. এবারে আসি অন্য তরলে। রাত বাড়লে আপনার মন যদি একটু whiskey-র বোতলের দিকে ছুক ছুক করে লজ্জার কিছু নেই। নেক্সট টাইম বোতল খুলে বসার আগে ভেবে নেবেন সঞ্জীবনী জল খাচ্ছেন। না না প্রবোধ দিচ্ছি না। আক্ষরিক অর্থে ওর মানে হল water of life ওরফে সঞ্জীবনী জল। আসল শব্দটা ছিল uisge beatha. স্কচ আর আইরিশরা বানায় প্রথমে। রাজা অষ্টম হেনরি খেয়ে ভারি সুখ পান ও জনপ্রিয় করেন।  পরে ধীরে ধীরে সহবতি পরিবর্তিত হয়ে usquebaugh, শেষে whiskeybaugh হয়ে শুধু whiskey.   

 

আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক কিছু শব্দে আসা যাক। ব্যালট বা  ballot এসেছে বল (ball) থেকে। প্রাচীন গ্রীকরা কোন প্রার্থীকে সমর্থন করতে একটা বক্সে একটা সাদা বল ফেলত, আর বিরোধিতা করতে একটা কালো বল। bribe মানে শুধুমাত্র একটা পাউরুটির টুকরো যা কাউকে দেওয়া হত। কারও কাছ থেকে কিছু favor পেতে কিছু দেওয়া – এই negative connotation যুক্ত হয়েছে অনেক পরে। Curfew এসেছে couvre feu থেকে ফরাসী ভাষায় যার মানে হল cover the fire. রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে রাস্তার ও বাড়ির সব বাতি নিভিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছিল। হ্যাঁ energy conservation এর জন্য। সেই থেকেই এসেছে curfew. গ্রেনেড দেখেছেন? আহা ঘাবড়াবেন না, সত্যিকারের দেখে না থাকলেও সিনেমা থিয়েটারে তো দেখেছেন। দেখতে অনেকটা বেদানার মত না? ঠিক সেই জন্যই pomegranate থেকে এসেছে grenade.

 

আমাদের অ্যালজেবরা কিন্তু আসলে একটা সার্জিকাল টার্ম। আরবিক শব্দ al মানে The, jebr মানে যা ভেঙ্গে গেছে তাকে জোড়া। ভাঙ্গা হাড় জোড়ার ব্যাপারেই বেশি ব্যাবহৃত হত শব্দটা। পরে আরব গণিতজ্ঞরা সমীকরণের বীজ ভাঙ্গা জোড়াকে বোঝাতে নতুন শব্দ চয়ন করেন ilm al-jebr wa’l-muq-abalah. শব্দটা অত বড় থাকলে ক্লাস সেভেনেই উচ্চারণ করতে আমাদের একটি করে দাঁত ভেঙ্গে যেত। ভাগ্যের ব্যাপার ইটালিয়ানরা শব্দটা নেওয়ার সময় ওই দ্বিতীয় আর তৃতীয় অংশটুকুই নিয়েছে। ভাগ্যিস…কি বলেন?  Chemistry তো এসেছে al-kimia থেকে। alchemist বলে একদল লোক লোহাকে সোনা বানানোর জন্য নাওয়া খাওয়া ভুলে উঠে পড়ে লেগেছিল। তারাই আজকের রসায়ন বিদ্যা বা কেমিস্ট্রির উদ্ভাবক। Honeymoon শব্দটা খুব মিষ্টি কিন্তু অর্থটা বেশ নিরাশাজনক। বেসিক্যালি এটা বিয়ের পরের এক মাসের প্রেম। moon মানে চাঁদ। প্রেমের সাথে চাঁদের সম্পর্ক চিরন্তন। ধরুন আপনার বিয়ের দিনটা পূর্ণিমা। আপনি আপনার significant other এর মুখ মিলনাকাঙ্খায় উন্মুখ। হৃদয়ে পূর্ণিমার জোছনা জলের পূর্ণ দীঘি। মন গুনগুন করছে “তেরি বিন্দিয়া রে”। পনের দিনের মধ্যেই সেই ভালবাসার রশনচৌকিতে বেসুরো সুর বাজবে। আপনার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে অমাবস্যার অন্ধকার। চাঁদের বাড়া-কমার মতি দাম্পত্য প্রেম নিয়মিত বাড়ে কমে। চিন্তা করবেন না। আজ অমাবস্যা হলে কি হবে? আবার পনের দিন পরে পূর্ণিমা তো আসছেই।           

 

আর একটা শব্দের কথা বলেই আজকের মত আপনাদের ক্ষ্যামা দেব। Glamour শব্দটা এখন খুব চলে। Tollywood, bollywood, hollywood এবং আরও সব “wood” এই glam girl দের রমরমা। মেয়েরা, এমনকি ছেলেরাও লুকিয়ে লুকিয়ে পার্লারে গিয়ে ভালোই মাঞ্জা মারছে গ্ল্যামার বাড়ানোর জন্য। শব্দটা এসেছে বোরিং ওয়ার্ড grammar থেকে। বিশ্বাস হচ্ছে না? ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং। প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিতরা লেখা এবং পড়ার দক্ষতাকে সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে রাখত। ক্ষমতা বেদখল হওয়ার ভয়ে এবং নিজদের ক্যারিস্মা বজায় রাখতে গোপনে মন্দিরে গিয়ে বিদ্যাভ্যাস করত। এমন কি ষোড়শ শতাব্দীতে ইংলন্ডেও  অল্প সংখ্যক কিছু মানুষ নিজেদের মধ্যে ল্যাটিন ভাষায় কথা বলত যাতে ইংরেজি বলা সাধারণ মানুষ তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে। অশিক্ষিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ মনে করত যারা ল্যাটিন গ্রামার জানে তাদের ম্যাজিকাল পাওয়ার বা যাদুবিদ্যা জানা আছে। সেই grammar থেকেই ভেঙ্গে উৎপত্তি glamour যার আসল অর্থ ছিল ম্যাজিকাল চার্ম। আজকের দিনেও গ্ল্যমারাস গার্ল হল সে যার মনমোহিনী রূপ বা ব্যক্তিত্ব আছে – মোটের ওপর যে পুরুষের মনের ওপর যাদু করতে পারে।  

 

আরও অনেক শব্দের জন্ম নিয়ে অনেক মনোগ্রাহী গল্প আছে। সব লিখতে গেলে আপনারা আমাকে টাটা বাই বাই করে কেটে পড়বেন। আপাতত ইংরেজি হল, অন্য একদিন বাংলা শব্দ নিয়েও বলা যাবে। আপাতত এখানেই ইতি টানছি। উপসংহারে বলি, শব্দ দিয়ে গল্প লিখি আমরা। আবার শব্দদেরও গল্প থাকে। ভাষা সম্বন্ধে লেখা হয় যে ভাষায় তাকে “অধিভাষা” বলে। শব্দ নিয়ে লেখা এই শব্দ গুলোকে অধিশব্দ বলা যাবে কি?

রবিবাসরীয়

happy-sunday-quotes-sunday-humorরবিবার সকালবেলা কোথায় সদ্য ভাজা গরম মুচমুচে চিঁড়ে ভাজার মত আবহাওয়া থাকবে, কোথায় শরতের মেঘের মত হালকা খুশি ভাসবে বাতাসে, মার্চ মাসের ভোরের মত না-গরম-না-ঠান্ডা একটা ফুরফুরে মেজাজ বাড়িতে ঘুর ঘুর করবে তা না, সকাল থেকে শ্রাবণের জলদ গম্ভীর আকাশের মত হাল বাড়ির। বৃষ্টি কখন নামে তার ঠিক নেই। ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ আছে। শমীক টিভিটা খুলে দেখবে কিনা সেই নিয়ে বেশ খানিক চিন্তা করে আপাতত না দেখাই ঠিক হবে ডিসিশান নিয়েছে। মোবাইল খুলে অফিসের মেল চেক করার নাম করে ক্রিকইনফো ডট কম থেকে লেটেস্ট স্কোরটা দেখে নিচ্ছে। আর মুখটা যারপরনাই গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছে। রবিবার দুপুরে একটু কচি পাঠার ঝোল খাবে বলে কাল থেকে মনের মধ্যে কাঠবিড়ালি টাইপস হালকা খুশি তিড়িক তিড়িক করে চড়ে বেড়াচ্ছিল। সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠেই বিল্টুর দোকান থেকে নিয়েও এসেছে। কিন্তু সেই মাংসের ব্যাগ রান্নাঘরের এক কোনায় পড়ে আছে। অনাদৃত। এতক্ষনে তাদের কড়াইতে পেয়াজ টোমাটোর কার্পেটে শুয়ে গরম তেলের জাকুজিতে হট বাথ নেওয়ার কথা। ছাল ছাড়ানো নুন মাখানো অবস্থায় পড়ে আছে মাংসের আলুরা। মানে যাদের মাংসের ঝোলে সিক্ত হয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনে রসনার মধ্যে অদ্ভুত সঙ্গীত সৃষ্টি করবার কথা ছিল। বাবাই বই-এর পাতা খুলে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। শমীক জানে তার এখন এক বিন্দুও পড়ায় মন নেই। চুপচাপ বসে বাড়ির সিচুয়াশানটা জাজ করার চেষ্টা করছে। কারণ এতক্ষনে তার বারোয়ারি তলার মাঠে বল পিটতে যাওয়ার কথা। এমনকি চারপেয়ে ভুলোও কি বুঝে বেশি ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই করছে না। আর এ বাড়ির হাইকমান্ড ওরফে হোমে মিনিস্টার ওরফে শমীকের স্ত্রী, অন্তরা, গম্ভীর মুখে বসে টিভিতে কি একটা সিরিয়াল দেখছে। চোখের কোনে একটু জল শুকিয়ে আছে। শমীক আড়চোখে একবার দেখে নিয়েছে। এটা সেই সিরিয়ালটা। একটা ভীষণ ভাল বউমা সংসারের সব কাজকর্ম বিনা বাক্যব্যয়ে করে ফেলছে। শাশুরি-ননদ সকলেই তার সাথে অত্যন্ত ঢ্যামনাগিরি করলেও বউমার সাত চড়ে মুখে রা নেই। দুদিন বাদে বাদেই তাকে গয়না চুরির অপবাদ দিলেও সে শুধু মাত্র সংসারের মঙ্গল চিন্তা করে। এমন সহমর্মিতার প্রতিমুর্তি দেখলে ভগবান বুদ্ধ-ও বোধ করি লজ্জা পেতেন। এমন ক্ষমার ক্ষমতা দেখে মেজাজ চটকে গিয়ে গান্ধিজীও বোধ হয় একটি চড় কষিয়ে দিতেন বউমাটিকে – মনে মনে ভাবে শমীক। নর্মাল দিনে সে সিরিয়াল চললে পাশ থেকে টিপ্পুনি কেটে থাকে। কিন্তু আজ সিচুয়েশান খুব চাপের। কি থেকে ঝামেলা শুরু হয় তার ঠিক নেই। তাই সে ক্রিক-ইনফোতে মনোনিবেশ করে আবার।

সকাল পর্যন্ত সব ঠিক-ই ছিল। ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাবাই এর সাথে অন্তরার “দাঁতটা মাজ না রে বাঁদর। দুধটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে না” টাইপস স্নেহ সম্ভাষণে বোঝা যাচ্ছিল একটা নর্মাল দিন। বাজারে যাওয়ার সময়েও অন্তরা বলল “একদম হাড়-ওলা মাংস আনবে না। আর শোনো মেটে নিয়ো তো।” শমীক বলল “কেউই যদি হাড়-ওলা মাংষ না নেয় তাহলে মাংসের দোকানদারদের এবার থেকে জেনেটিকালি মডিফায়েড বোনলেস পাঁঠা প্রোডিউস করার কথা ভাবতে হবে”। এটা শমীকের প্রি-ডিফেন্স। সে জানে সে যতই চেষ্টা করুক না কেন ঠিক হাড়ওলা মাংসই তার কপালে জুটবে। অন্তত অন্তরার সেরকমই বক্তব্য হবে। অন্তরা নিজে গিয়ে নিয়ে আসলে মাংসের গুণমান, কোয়ালিটি ইত্যাদি ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের মত ঝকঝকে হয়ে যায় কেমন করে একটা। এই অব্দি সব ঠিক ছিল। বাজার থেকে ফিরে শুনলো কেস গড়বড়। অন্তরার তার কেটে গেছে। কেমন একটা তড়িৎপৃষ্ট মুখ। কি না সকালের ডেইলি এফ বি ডায়েট করতে গিয়ে অন্তরা দেখেছে ওর মা চন্দ্রানির এফবি স্ট্যাটাস

“শঙ্কুর পা মচকে গেছে। হাড় ভেঙ্গেছে কিনা জানা যাবে ডাক্তার দেখালে। ফীলিং স্যাড।”

শঙ্কু অন্তরার বাবার নাম। তখন থেকেই অন্তরার ভীষন দুশ্চিন্তা। দুবার ফোনও করেছে। কিন্তু মা ফোন ধরে নি। নিশ্চয়ই এখন ডাক্তার-হসপিটাল-নার্সিং হোম করছে। শমীক মনে মনে ভাবে, ভদ্রলোক আর দিন পেলেন না। থেকে থেকে এই রোব্বার সকালেই পা মচকালেন। এর জন্য মৃত পাঁঠা ওনাকে কোন দিন ক্ষমা করবে না। সোমবার কি মঙ্গল বার করে পা মচকালে বিশাল মহাভারত অশুদ্ধ হত? আর শাশুড়ি মার বলিহারি। সামান্য পা মচকেছে তাতে ঘটা করে স্ট্যাটাস আপডেট দেওয়ার দরকার কি? ডাক্তার দেখিয়ে পা ভেঙ্গেছে জেনে দিলে তাও একটা কথা ছিল। সব সময় মেয়েদের বাবা-মারাই বেশি স্মার্ট হয় কেন শামীক বোঝেনা। শত শত বার চেষ্টা করেও নিজের বাবা-মাকে স্মার্ট ফোন ধরাতে পারেনি। রোব্বার এই এগারটা নাগাদ দ্বিতীয় বার কফি খায় সে। অনেক চেষ্টা করেও কফিটা অন্তরার মত বানাতে পারে না। বিবাহোত্তর জীবন যে মেয়েরা  “জিনিয়াস” হয় এটা শমীক সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করে। কিন্তু আজ অন্তরার হাতের কফি তো দুরের কথা, নিজেও যে বানাতে যাবে, সেটাতেও ভরসা পাচ্ছে না। হঠাৎ যদি “আমার বাবার পা ভেঙ্গেছে তোমার কোন মাথা ব্যাথাই নেই” শুরু করে দেয় তাহলে নিজেকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে প্রবল মাথা ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা। এই সময় বিরাট কোহলি না খেলে রাহুল দ্রাবিড় খেলাই ভাল। বল আসলেই ডট। ডট। ডট। লম্বা খেলতে হলে দু একটা ওভার মেডেন ছাড়তেই হয়।

এই সময় বিরাট কোহলি না খেলে রাহুল দ্রাবিড় খেলাই ভাল। বল আসলেই ডট। ডট। ডট। লম্বা খেলতে হলে দু একটা ওভার মেডেন ছাড়তেই হয়।

এমন সময় ফোনটা এল। অন্তরার মায়ের ফোন।

কি রে ফোন করেছিলি নাকি? দু-তিনটে কল দেখলাম

বাবা এখন কি করছে? আমি তো চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।।

কি আবার করবে? যা করে এই সময়। বিন্দাস শুয়ে আছে। আর আমার হয়ে গেছে বাঁশ।

ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছ কখন?

দেখি দু-এক দিন পরে নিয়ে যাব। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।

এখনো নাও নি? তুমি কি গো? পড়ল কি করে?

সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল। ওটা তো ওরকমই। সারাক্ষণ ফুটছে।

এই বয়সে বাবা লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। বাবার কি ভীমরতি হল নাকি?

তোর বাবা কেন নামবে? নামছিল আমার নতুন সোনামোনাটা। ও তুই বোধ হয় একে দেখিস নি। মাস খানেক আগে একদিন রাস্তায় দেখলাম ডাস্টবিন ঘাঁটছে। খেতে না পেয়ে রোগা। গায়ে ঘা। আমি তো জানিস-ই পশুপ্রেমী। এই সব দেখলেই চোখে জল চলে আসে। তা কুকুরটাকে বাড়ি আনলাম। সবে খাইয়ে, ভেটেরিনারি ডাক্তার দেখিয়ে একটু সুস্থ করে তুলেছি, আজকে দেখ না পড়ে গিয়ে পা টা মচকে বসে আছে। লেংড়ে হাঁটছে। আমার কপাল। সারা জীবন অন্যদের সেবা শুশ্রুষা করেই গেল।

ঊফফ মা। এইটা ঘটা করে এফবি আপডেট দিয়েছ?

কেন? তুই দিস না। শমীকের জন্মদিনে একই ঘরে থেকেও এফ বি তে “হ্যাপি বার্থ ডে মাই লাভ” দিস না? তুই দিলে সেটা ফেসবুক স্ট্যাটাস আর আমি দিলে আদিখ্যেতা?

আঃ মা ঝগড়া কোরো না তো! কিন্তু তুমি শেষে বাবার নামে কুকুর পুষেছ? বাবার সাথে তোমার ঝগড়া-টগড়া এইভাবে পাবলিক করার কোন দরকার ছিল?

বাবার নামে কেন পুষতে যাব? ওই নামের একটা মানুষকে সামলাতেই সারা জীবন হিমসিম খেয়ে গেলাম। আবার আর একটা? আমি পাগল নাকি? ওর নাম তো রেখেছি বঙ্কু। আমাদের ছেলের মতই তো। তাই তোর বাবার নামের সাথে মিলিয়েই রাখলাম।

ঊফফ মা। তুমি না? মানে কিছু বলার নেই। তাহলে এফবি তে দিয়েছ কেন শঙ্কুর পা ভেঙ্গে গেছে বোধ হয়।

ও শঙ্কু লিখেছি বুঝি। ওটা বঙ্কু হবে। এই ফোনটাও বলিহারি? আগে ব্যাবহার করা ওয়ার্ড ফট করে রিপ্লেস করে দেয়।

অন্তরা মায়ের সাথে আরও কিছু ঝগড়া করে ফোন রাখল। মুখে হাসি ফুটেছে। টিভিতে তখন সেই সুপারলক্ষী বৌটি পরাধীন ফ্রান্সের সেই কিংবদন্তী কৃষককন্যা জোন অব আর্ক-এর মত তার শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কোন এক দুষ্টু লোককে শাস্তি দিতে যুদ্ধ যাত্রা করেছে। রিমোটের একটা বাটনের আঘাতে সে ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে যায়। অন্তরা এবার রান্নাঘর মুখো। শমীক স্পষ্ট দেখতে পায় ব্যাগ-এর মধ্যে থাকা মাংসের টুকরোর মুখ উজ্জল হয়। মনে হচ্ছে দুটো-আড়াইটের মধ্যে মাংসের ঝোলটা দাঁড়িয়ে যাবে। বাবাইও সুযোগ বুঝে বলে ওঠে “মা আমি খেলতে যাই?” ভুলো লাফিয়ে সোফায় উঠে রাজার বেটা ঘুগনিওলার মত বসে পড়ে। শমীকও রিমোটটা নিয়ে টিভিটা চালিয়ে ফেলে। ম্যাচের বাকিটা এবার আরাম করে সোফায় বসে টিভিতেই দেখা যাবে। কোহলি ততক্ষণে পিটিয়ে ম্যাচটাকে প্রায় মেরে এনেছে।

নীড়ে ফেরা

অরিত্র মোবাইলে দেশের খবর পড়তে পড়তে চায়ের কাপটায় লম্বা চুমুক লাগায়। আজ মনটা তার বেজায় খুশি খুশি। শিরায় উপশিরায় ধমনিতে যেন একটা গঙ্গাফড়িঙ তির তির করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোটবেলায় অ্যানুয়াল পরীক্ষার শেষ দিনে পরীক্ষা দিয়ে আসার পর যেমনটা হত।  এই সবে লং ডিস্ট্যান্স ফোনটা শেষ করেছে সে। ডীলটা পাকা হয়ে গেল। অনেক পুরুষ ধরে বিশুদ্ধ কলকাতাবাসী সে। তার কোন ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ঢাকা শহর থেকে গুটিয়ে বাটিয়ে কলকাতা চলে এসেছিল। বাসা বিনিময় করেছিল কোন এক তাহের আলির সঙ্গে। অরিত্রকেও যে সেইরকমই একটা কান্ড করতে হবে কে জানত। কিন্তু ঠাকুরের কৃপায় পাওয়া গেছে একজনকে। ভদ্রলোকের নাম বিনিত আগরওয়াল। মাড়োয়ারি। কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না প্রথমে। ব্যাটা বানিয়া বলছিল

“আপনার বাড়ি আমার পসন্দ আছে কিন্তু ওখানে গিয়ে হামি বেবসা জমাতে না পারলে আমার কি হোবে” এই সব। অরিত্র ওকে অনেক স্তোকবাক্য দিয়েছে।

“আপনার কাপড়ের দোকান এখানে রমরম করে চলবে। অনেক ঘর বাঙ্গালি আছে। অর্থাৎ কিনা শাড়ির ব্যাবসা চলতে বাধ্য। সেরম কোন শাড়ির দোকানও এখানে নেই। আপনি কলকাতা থেকে শাড়ি কিনে আনবেন আর এখানে তিন গুন দামে বিক্কিরি করবেন। এক বছরের মধ্যে আপনার বৌয়ের গলায় শেকলের মত মত মোটা সীতাহার বাঁধা। একদম অচলা লক্ষী আপনার বাড়িতে” ইত্যাদি।

ব্যাটা তাও গাঁইগুই করে। শেষমেষ ব্রহ্মাস্ত্রটা ছাড়ে অরিত্র। সঙ্গে সঙ্গে রাজি বিনিত। চায়ে আর এক চুমুক লাগিয়ে ঈপ্সিতাকে ডাকে সে। “ও গো শুনছো, পাকা কথা হয়ে গেল। আসছে বছরের মাঝামাঝি করে বিনিত-এর চৌরঙ্গির বাড়িটার পজেশান পাচ্ছি। আর এ বাড়িটা ওর। কদ্দিন পরে কলকাতা ফিরব..উফফ ভাবতেই পারছি না। প্যাকিং-ট্যাকিং চালু করো।”

এখন থেকে কি? দেরি আছে তো।

কই আর দেরি। যেতে সময় লাগবে না?

হুমম। তুমি যখন এ শহরে বাড়ি কিনছিলে তখনই বারণ করেছিলাম। বলে ছিলাম “কিনছ তো। কিন্তু এরম একটা ধরধরা গোবিন্দপুরে গিয়ে থাকতে পারবে তো কলকাতা ছেড়ে?” তখন তো কত জ্ঞান দিলে। “ইপ্সু, আমরা হবো গিয়ে আর্লি অ্যাডপ্টার। সব থেকে বেশি সুবিধে আমরা পাবো। সব থেকে বেশি লাভ আমাদের হবে।” হ্যানা তানা।

কি করবো? তখন তো এই নতুন শহরে কেউই আসতে চাইছিল না বলে জলের দরে জমি বাড়ি বিক্কিরি করছিল। লোভে পড়ে…

তো বছর তিনেকও তো হয়নি আমরা এখানে এসেছি। এর মধ্যে তোমায় কি ভুতে কামড়ালো যে ফিরে যেতে হচ্ছে? কি খারাপটা আছে এ শহরে শুনি?

কিছুই খারাপ নেই। সেইটাই সবচেয়ে বড় কারণ ইপ্সু।

সত্যিই তো নেই। চব্বিশ ঘন্টা ইলেক্ট্রিসিটী, জলের সমস্যা নেই, গ্রসারি টসারি অর্ডার করলেই হোম ডেলিভারি

২৪ ঘন্টা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, আউট অফ দি ওয়ার্ল্ড চিকিৎসা ব্যাবস্থা – যোগ করে অরিত্র।

তারপর মে মাসের প্যাচপেচে গরম নেই। আগাস্ট সেপ্টেম্বর-এর রাস্তা উপচানো জল কাদা নেই।

ঠিক ঠিক। সবই ভাল। কিন্তু এ শহরে কোন খবর নেই ইপ্সু। ঘটনা নেই। দিন নেই রাত নেই। শহরের নাম শুনলেই মনে হয় জেলখানা। কোনদিন শুনেছ কোনো শহরের নাম হয় হান্ড্রেড অ্যান্ড টু?

তা বলতে পারো। হ্যাঁ, এখানে ফুচকা নেই। গড়িয়াহাটে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা শাড়ির দোকান নেই। চেৎলার মোড়ের মাছের বাজারের চিতল মাছ নেই।

তারপর এখানে সাউথ সিটি মল নেই, রাস্তার ধারের এগ রোল নেই, হাত বাড়ালেই দীঘা মন্দারমুনি নেই, পাটায়া-ফুকেট এর হলিডে প্যাকেজ নেই। নাহ, এখানে থাকা চলে না। এখানে মেড়োই ঠিক আছে।

কিন্তু মানালে কি করে ভদ্রলোককে? উনি তো বেঁকে বসেছিলেন।

আরে ব্যাবসায়ি মানুষ। ছাড়তেও পারছিল না। ওর দু কামরার বাড়ির বদলে আমি আমাদের এখানের বিশাল বাগান বাড়ি দিচ্ছি।

তবুও তো আসতে চাইছিলেন না।

একটা মোক্ষম অস্ত্র ছাড়লাম। বিনিত কাত।

কি বললে?

বলে দিলাম এখানে সরকার ইনকাম ট্যাক্স নেয় না।

এ বাবা, তুমি না যাতা এক্কেরে।

মিত্থে তো বলিনি। এখানে সব ট্রান্সাকশানই ডিজিটাল। তাই প্রতিটা টাকা হস্তান্তরেই ট্যাক্স কেটে নেয়। কিন্তু সেটা বলিনি ওকে। ট্যাক্স দিতে হয় না জেনে খুশি খুশি রাজি হয়ে গেল।

মনটা এখন আমারও বেশ খুশি খুশি লাগছে বুঝলে। আজ রাতে শেফ ইপ্সিতার হাতে তোমার জন্য বেনুদির চিকেন কষা।

বাহ। কিন্তু আমাদের বেরোতে হবে এই মাসেই। সাত মাসের পরে আর এয়ার ট্রাভেল করতে দেয় না। তোমার তো এখন তিন মাস চলছে।

ঠিক বলেছ। সেটা ভেবে দেখিনি। যেতে এখন কিরম সময় লাগছে?

ক্রেয়োজেনিক ইঞ্জিনে তিন মাস। মেসোজেনিক-এ দুই। কিন্তু ভাড়া ডাবল প্রায়।

যাক ভালই হল। আমার পেটে থাকা মিস্টুকে আর এম-বি-সি-ই হতে হল না।

সেটা কি?

Mars Born Confused Earthian!!

হ্যাঁ। সিরিয়াসলি। এই মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকে না। চলো এই আনন্দে আজ আমরা লুডো খেলি। জড়িয়ে ধরে অরিত্র ইপ্সিতাকে।

এই কি হচ্ছে। মিস্টু আছে না?  ছাড়ো। আর সিটি ১০১ এ  যে বাড়িটা কিনলে?

ওটা তো পচিশ-শো-পচিশের রিসেশানে কিনেছিলাম। কলকাতা থেকে ওখানে এখন তিন দিনেই যাওয়া যায় আজকাল। সামার হোম করে রেখে দেব। “এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব সেই চাঁদের পাহাড়” গাইতে গাইতে বেরিয়ে পড়লেই হল। পরে যদি দেখি তেমন যাওয়া-টাওয়া হচ্ছে না ভাড়া দিয়ে দেব। চলো এখন আমরা বেনুদিকে পাকড়াই।

ঈপ্সিতা রান্না ঘরের দিকে যায়। অরিত্র চায়ে চুমুক দিতে দিতে গুনগুনিয়ে গায়

“মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকে না।…সিন্ধু ঘোটক থাকে না…”

“মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকে না।…সিন্ধু ঘোটক থাকে না…”

index

শিরোধার্য দাড়ি

rabiএই যে বড়দা, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি, এই একটু উজ্জয়িনীর রাস্তাটা বাতলে দিতে পারেন?

আমিও সেই দিকেই যাচ্ছি। জুড়ে পড় ইচ্ছে হলে। গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। তা তুমি বাপু কিসের খোঁজে? ভোজ খেতে চলেছ নিশ্চয়ই? পাত পেড়ে খুব করে মন্ডা মিঠাই খেতে চাও? ওই ধান্দাতেই আজ সবাই ও মুখো।

আজ্ঞে না না। আমার বাপের জমিদারি আছে। খাওয়া পরার চিন্তা নেই। আমি যাচ্ছি গান শুনতে। শুনলাম মহাকবি কালিদাস নতুন বই লিখেছেন, কুমারসম্ভব নামে। তো সেই বই তিনদিন তিন রাত ধরে কবি নিজে গান গেয়ে শোনাবেন আর ঠিকঠাক রাজ কর্মচারির হাত ভেজাতে পারলে কবির ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারও পাওয়া যাবে। তা ভাবলাম যাই একটা অটোগ্রাফ নিয়ে আসি আর যদি কোনভাবে কবির সাথে যদি একটা সেল্ফি ম্যানেজ করতে পারি। আপনিও কি উজ্জয়িনী যাচ্ছেন?

হ্যাঁ আমিও সে উদ্দেশেই। কিন্তু উদ্দেশ্য এক নয়। ছোঁড়াটা নতুন লেখাটা কেমন লিখলে সেটা একটু নিজের কানেই শুনে বিচার করব বলে যাচ্ছি। তা তোমার কি করা হয়?

দাদা, ঐ যে বললাম বাপের জমিদারি। তাই করতে কিছুই হয় না। তাই লিখি। আমি কিঞ্চিত লেখক।

বটে? তুমিও লেখ। আজকাল দেখছি এঁদিপেঁদি গেঁড়ি গুগলি সবাই লিখছে। যাকগে যাক। তা এ ছোঁড়ার লেখা পড়েছ?

পড়েছি। মেঘদুতম আমার ভীষণ প্রিয়। রসোত্তীর্ণ লেখা। যেমন ভাষার বাঁধুনি, তেমনি মন্দাক্রান্তা ছন্দ, তেমনি ভাব। “কাঙ্খিতকান্তা বিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্ত…”

ওই লেখাটার জন্য আমি ওকে অবিশ্যি দশে সাত দিতে পারি। এরোটিক রোমান্টিসম বিষয়টাকে ভালই এক্সপ্লোর করেছে। কিন্তু ছোঁড়াটা বড্ড বেশি লিখেছে। একজন লেখক জীবনে একটা কি বড় জোর দুটো লিখবে। ভাল লিখবে যাতে হাজার বছর টেঁকে সে লেখা। এত গাদা গাদা লেখার দরকার কি? বিশেষত অনুপ্রেরণাহীন অর্ডারি লেখা লিখেছ তো ব্যাস। মাথা থেকে বেরুবে খড় বিচুলি। যতই চিবাও কোন রস নেই। যেমন তোমার এই “মহাকবি কালিদাসের” লেখা রঘুবংশম। রদ্দি মাল। আসলে দরকার হল অনুপ্রেরণা, ইনস্পিরেশান।

বাহ দারুন বলেছেন তো বড়দা। আপনিও লেখক নাকি? এত সুন্দর কথা বলেন?

আমায় চেনো নি বুঝি? অবিশ্যি তখনকার দিনে ঘটা করে বই-এর সাথে বই-এর লেখক এর ছবি ছাপত না। আর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, রীডিং সেশান এসবও ছিল না। তাই, না চেনাই স্বাভাবিক। আমি একটা বিশাল মহাকাব্য লিখেছি। বহু বছর ধরে সেটা বেস্ট সেলার।

উরিব্বাস। অমন একটা লেখার ইনস্পিরেশানটা কি ছিল দাদা?

আমার ব্যাপারটা খুব নাটকীয়, ড্রামাটিক। আমি টীন-এজ বয়সে বিশাল বড় “পাড়ার দাদা” ছিলাম। গ্যাং লিডার। এলাকায় তোলা তুলতাম, চুরি ছিনতাই করতাম। তখন আমার নাম রত্নাকর। সে নামে সবাই থরহরি কম্পমান। তারপর কি করে একটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মনটা নরম হয়ে গেলো। ওসব বাজে কাজ ছেড়ে দিলাম। নামটাও এফিডেভিট করে বদলে বাল্মিকী হলাম। গানটান করতাম। একদিন স্নান করতে গেছি। দেখি কি? একটা ক্রৌঞ্চ মানে সারস আর কি। জলে নেমে একটা সারসীর সাথে একটু ইয়ে ইয়ে করছিল। মানে ফোরপ্লে আর কি, বুঝলে না? হঠাৎ এক ব্যাটা আকাট মুখ্যু ব্যাধ তীর মেরে মদ্দা পাখিটাকে মেরে দিল। বললে বিশ্বাস করবে না, তার মেয়ে বন্ধুটিও বয় ফ্রেন্ড-এর শোকে খুব কান্নাকাটি করতে করতে আত্মহত্যা করল। আমি স্নান করতে নেমে নিজের চোখে সে দৃশ্য দেখলাম। সেই করুণ দৃশ্য দেখে চোখে জল এসে গেল। কিভাবে নিজের অজান্তেই রচনা করে ফেললাম একটা শ্লোক…”মা নিষাদ প্রতিষ্ঠা…” ঐটাই আমার লেখা রামায়নের প্রথম শ্লোক। আমি আদি কবি বাল্মিকী। দাঁড়াও তোমার জন্য আমার প্রথম শ্লোকটা বাঙলায় তর্জমা করে দিই। তোমার বুঝতে সুবিধে হবে।

“অসতর্ক মিথুনরত প্রেমিকবরের প্রাণটি চুরি করে
অয়ি আর্য, তুমি শান্তি পাবে না অনন্তকাল ধরে”

অসতর্ক মিথুনরত প্রেমিকবরের প্রাণটি চুরি করে
অয়ি আর্য, তুমি শান্তি পাবে না অনন্তকাল ধরে

আহা, সুন্দর, অদ্ভুত। দাদা আপনার দেখা পাব ভাবি নি। এ যে আমার পরম সৌভাগ্য। বেড়ে লিখেছেন কাব্যখানা। আমি পড়েছি। একদম খাস্তা মুচমুচে। কিন্তু আপনি তো দাদা এ জামানার নন? দাদা, ও দাদা, নখ খুঁটছেন কেন? বলছি আপনি তো অনেক আগেকার মানুষ?

অ্যাঁ, কি বলছ? ও আমি? হ্যাঁ, সে অনেক কাল আগে। নয় নয় করেও হাজার তিনেক বছর হবে। তবে কিনা আমি যোগবলে ত্রিকাল, ত্রিলোকের যেকোন জায়াগায় যেতে পারি। তুমিও তো দেখছি বাপু এ জামানার নও। হাজার দুয়েক বছর পরের মানুষ। তুমি এলে কি করে এখানে?

হ্যাঁ, আমি ভানু সিংহ। বিংশ শতাব্দি। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?

এই যে নখে আমার একটা আয়না আছে – নখ দর্পণ। আসলে আমি নখ খুঁটছিলাম না। তোমার পরিচয়টা একটু দেখে নিচ্ছিলাম। তুমি এলে কি করে এখানে? তুমিও যোগ টোগ করো নাকি।

আমি টাইম ট্র্যাভেল করে এসেছি। এখন থেকে হাজার তিনেক বছর পর মানুষ সেই কৌশলটি আয়ত্ত করে ফেলেছে।

কিন্তু তোমায় যেন দেখলাম হাজার দুয়েক বছর পরে এসেছ। নাকি ভুল দেখলাম। অনেকদিন নখটা পরিষ্কার করা হয় না। কি দেখতে কি দেখলাম?

না না দাদা, আপনি ঠিকই দেখেছেন। আপনার নখ একদম নির্ভুল। আসলে একটু ঘুর পথ নিতে হয়েছে। মহাকবির সাথে দেখা করতে হাজার খানেক বছর ভবিষ্যতে গিয়ে ওই টাইম ট্র্যাভেল টেকনোলজি ব্যাবহার করে তবে আসতে পারা।

বেশ বেশ। তুমি তো দেখছি বেশ বিখ্যাত। অনেক পুরস্কার টুরস্কার-ও পেয়েছ। এই পুরস্কারটা নিয়ে খুব হইচই দেখছি। নোবেল না কি?

না দাদা, আপনার কাছে আমি কিসসু না। হাতির কাছে পিঁপড়ে। নোবেল হল আমাদের জামানার সেরা পুরস্কার। প্রথমে তো আমার লেখা কেউ পড়ত না। পরে যবন ভাষায় অনুবাদ করে ওই পুরস্কারটা পেয়ে গেলাম। তখন দেশের লোকেরা আমায় মাথায় তুলে নাচানাচি করতে লাগল। বাঙালি বিশ্ববিধাতার এক আশ্চর্যতম সৃষ্টি। বুঝলেন না। ভাল করেছেন আপনি বাংলায় লেখেন নি। নোবেল না পেলে আপনাকেও কেউ পুঁছত না বাঙলায়।

বটে। কিন্তু তুমি বাপু তোমার ওই নোবেলটি একটু সামলে রেখো, মানে তোমার সাগরেদদের সামলে রাখতে বোলো। আমার নখদর্পণ বলছে ওটা কোন উর্বর মস্তিষ্ক বাঙালি পরবর্তী কালে ঝেঁপে দেবে। তবে সে ঘটনাটি বোধ হয় তোমার জীবন সীমার বাইরে। যাকগে যাক। তা তোমার লেখা দু একটা পাঠিও। পড়ব। কটা লেখা বেরিয়েছে এখনও অব্দি?

আজ্ঞে সে বললে আপনি খুব রাগ করবেন। অনেক লিখে ফেলেছি। আসলে কি করব? কিছুই করার থাকে না যে। জমিদারি টমিদারি আমার দ্বারা হয় না। ও সব দাদারাই সামলায়। সকলের ছোট ভাই। তাই সাত খুন মাপ। তা লিখেছি বলতে, এই ধরুন এক ডজন উপন্যাস, বেশ কিছু ছোট গল্প, হাজার তিনেক গান, ডজন দুয়েক কাব্য গ্রন্থ, কিছু প্রহসন, গীতিনাট্য, নাট্যকবিতা…

থামো, থামো, থামো। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে ভাই। যাকগে যাক। অন্য কথা বলি। একটা কথা কি জানো, লেখক যদি তারিফ পাওয়ার জন্য লেখে সে লেখার ষোল আনাই ফাঁকি। নিজের খুশিতে নিজের মনের কথাটি লেখার জন্য পেন ধরলে তবেই ওই কি যেন বললে “রসোত্তীর্ণ লেখা” বেরোয়। তোমার কি মত এ ব্যাপারে?

হ্যাঁ দাদা। একদম একমত। আমি তো সম্পুর্ণ নিজের খুশিতে লিখি। সব যে ছাপাই তাও নয়।

বেশ, বেশ। যাক কথা বলতে বলতে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। ওই যে সূর্যতোরণ দেখা যায় ওইটে উজ্জয়িনী। তা নখ দর্পণে তোমার যে ছবি দেখলাম তাতে যেন তোমার আমার মতই বড় বড় দাড়ি দেখলাম। তুমি তো দেখছি রীতিমত ক্লীন শেভড। এমনটা কেন দেখলাম, তাই ভাবছি?

দাড়ি, দাড়ি তো আমি রাখি না বড়দা। আপনি কি অন্য কারু ছবি…?

—–

রবি, রবি, ওঠ। আর কতখন ঘুমুবি? কটা বাজে জানিস? আমাদের বজরার ডেকে গিয়ে দেখ, কেমন বৃষ্টি পড়ছে। আজ মেঘনা পেখম তোলা ময়ুরের মতই সুন্দর।

“এ হে, এতো দেরি হয়ে গেলো? আসলে কাল একটু রাত করে লিখছিলাম।” রবি উঠে কয়েক দিনের না-কাটা দাড়িতে হাত বোলায়। পাশে খোলা তার খেরো খাতা। তার পরের কাব্যগ্রন্থ মানসীর গুটি কতক কবিতা তাতে লেখা। কাল আষাঢ় মাসের পয়লা তারিখে মেঘনা বক্ষে ঝুম বৃষ্টি দেখতে দেখতে খুব মনে পড়ছিল তার প্রিয় লেখক মহাকবি কালিদাসের অমর কাব্য মেঘদুতের সেই বিখ্যাত লাইন “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানু…”

তাই কবি কালিদাসের সম্মানেই চার লাইন লিখে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।

কবিবর, কবে কোন্‌ বিস্মৃত বরষে
কোন্‌ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক

কবিবর, কবে কোন্‌ বিস্মৃত বরষে
কোন্‌ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক

পেনটা তুলে নিয়ে পরের চারটে লাইন লিখতে গিয়ে হঠাৎ গত রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে থমকে গেলো রবি।

“স্বপ্নে মহাকবি বাল্মিকী বললেন যেন আমার বড় বড় দাড়ি দেখেছেন। দাড়িটা রেখেই দেখব নাকি? অত বড় একজন কবি বলেছেন যখন সে কথা আদেশ বই তো নয়। তায় আবার ভদ্রলোক ত্রিকালদ্রষ্টা। ঠিকই দেখেছেন নিশ্চয়ই। এ আদেশ শিরোধার্য। এখন থেকে দাড়িটা শিরে ধারণ করেই দেখি কেমন লাগে আমাকে।”

অমিয়র আত্মহত্যা

কাল সন্ধে থেকেই অমিয়-র মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। সন্ধেবেলা পাশের বাড়ির পরাশর কাকু এসেছিল। সাথে মিনিও। পরাশর কাকু বলল ওরা কাল-ই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওনার নাকি দিল্লি ট্রান্সফার হয়ে গেছে। একমাত্র মিনির সঙ্গই এ পাড়ায় ভাল লাগত অমিয়র। বেশ সুশ্রী আর ছিপছিপে। আর একটু শান্তশিষ্ট লাজুক মতন। ওদের দুজনের মধ্যে কত কথা হয়। লোকাল পলিটিক্স থেকে বলিউড পর্যন্ত। মিনির ওপর কেমন একটা অধিকার বোধ জন্মে গেছিল অমিয়র। এই তো সেদিন সে একটা পার্টিতে গেছিল। মিনিরাও ছিল সেখানে। অরিত্র বলে একটা হুমদো ছেলে খুব ঢলে ঢলে কথা বলছিল মিনির সাথে। একদম সহ্য হয় নি অমিয়র। পরে মিনিকে সে ঐ সব আটভাট ছেলেদের সাথে মিশতে বারণ-ও করে দিয়েছিল।  সেই মিনিরাই কিনা চলে যাবে আজ। আর কোন যোগাযোগ থাকবে না। ভেবে কাল রাতেও লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে সে।


সকালবেলা উঠে একটু গুটিসুটি মেরে বসে টিভিতে মিকি মাউস-এর একটা পর্ব দেখছিল অমিয়। কি বোকা বোকা গল্প…কোন মানে হয়? ভীষণ বিরক্তিকর। ছোটখাট বলে আমাদেরকে এরা কি ভাবে কে জানে? আনমনা হয়ে ভাবছিল অমিয়। রবিবারের সকালে ছুটির মেজাজটা ঘরের আনাচে কানাচে ফাল্গুনি হাওয়ার মত তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে।  অমিত কাকু বেরোচ্ছে বাজারে। কাকিমা চেঁচিয়ে বলছে “পাঁঠার মাংসটা দেখে নিও, গেল রোববার হাড়-ই সার ছিল। আর বুড়ো লাউ একদম আনবে না, আনলে ওটা তোমার মাথাতে ভাঙব।” প্রতি রবিবার এই এক-ই চিরাচরিত ছবি। কি বিরক্তিকর? উফফ…অমিয় আবার কার্টুনে মনোনিবেশ করে। সবে টিভিতে মিকি মিনিকে কি একটা পাকে ফেলেছে, এমন সময় অন্তুদা এসে, কথা নেই বার্তা নেই, বললো “কি মিস্টার হুলুস্থুলু, সকাল সকাল বসে বসে কার্টুন দেখা হচ্ছে। বলেই ওকে এক ঝটকায় তুলে নিয়ে সোফায় ওর জায়গাটাই দখল করে বসল। আর তারপর অমিয়কে কোলে বসিয়ে ওর গালে গাল ঘষতে লাগল। এই কোলে বসা আর গালে-গাল-ঘষা আদর একদম পছন্দ নয় অমিয়র। সেটা তাও মানা যায় কিন্তু এই হুলুস্থুলু নামটা? মোটেই পছন্দ নয় তার। সে খেলার সময় এমন কিছু হুলুস্থুলু কান্ড করে না যে তাকে হুলুস্থুলু বলে ডাকতে হবে। অন্তুদার বয়স কত আর? সাত হবে। অমিয়রও বয়স নয় নয় করে পাঁচ হয়ে গেছে। এই মাত্র দু-এক বছরের বড় দাদার এই জ্যাঠামো মোটেই সহ্য হয় না। অন্তুদা না হয় ছোটো। সে তো আর ছোটো নয়, রীতিমতো প্রাপ্ত বয়স্ক। কোল থেকে নেমে অমিয় এক ছুটে নিচের রান্না ঘরে। অনু কাকিমা মাছ ভাজছে। এই মাছ ভাজার গন্ধটা শুঁকলেই অমিয়র ভেতরটা কেমন একটা করে..খুব ভালবাসে ও মাছ ভাজা খেতে। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে গিয়ে একটা মাছ ভাজা নেওয়ার চেস্টা করেছিল। কিন্তু অনু কাকিমা দেখতে পেয়েই এমন তাড়া দিল যে ওকে তর তর করে পালাতে হল। যাক গে যাক। পরে নিশ্চয়ই একটা পাওয়া যাবে। ও তো আর আদেখলে নয়। এখন গিয়ে কোথাও খেলা-টেলা যাক। রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে অমিয় ঠাকুরঘরে এল। এটা ওর ভারি প্রিয় জায়গা। অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস আছে এখানে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে দেখার জন্য। ঠাকুরের থালা গ্লাস গুলো বেশ ছোট ছোট।

ঠাকুররা যদি এত বড়, তবে তাদের খাবারের থালাগুলো এত ছোট ছোট হয় কেন কে জানে? thinking

শুনেছে ঠাকুররা নাকি অনেক বড় হয়। সারা আকাশ জুড়ে থাকে। কিন্তু ওদের খাবার থালা বাসন এত ছোট হয় কেন বোঝে না অমিয়। যাকগে যাক। সে ছোটখাট মানুষ। তাই এই ছোট ছোট থালা গ্লাস গুলো তার পছন্দের। সে প্রথমেই পেড়ে ফেলল প্রসাদ রাখার ছোট্ট থালাটা। দুটো নকুলদানা গলে আটকে ছিল। নখ দিয়ে খুঁটে খেয়ে ফেলল। নকুলদানা বেশ ভাল খেতে। কিছুক্ষণ ওটা নিয়ে খেলার পর ঠাকুরের একটা সিংহাসন ছিল সেইটা পেড়ে ফেলল। সেটাকে নিয়ে উলটে পালটে কিছুক্ষণ খেলা হল। ঠাকুরের আসনটা গলায় জড়িয়ে আর খুলে আরও খানিকক্ষণ কাটলো। এরপর বোর হয়ে গেলো। বিরক্তিটা আবার ফিরে আসছে। মিনি চলে যাবে। ছাদে যাওয়া যাক। ছাদে গিয়ে মিনিকে ডাকলে নিশ্চয়ই ও ও বাড়ির ছাদে উঠে আসবে। কিন্তু বিধি বাম! ঠাকুর ঘর থেকে বেরনোর সময় কান্ডটা ঘটল। বসার ঘরের মধ্যে দিয়ে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি। হঠাৎ করে পায়ে লেগে বসার ঘরের দরজার সামনে থাকা দামি ফুলদানিটা পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে চুরচুর। আর যায় কোথায়? অনু কাকিমা ছুটে এল। সে কি বকুনি! একটা দুটো চড়-থাপ্পড়ও পড়ল পেছনে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সবাই খারাপ। কেউ ভালবাসে না। অমিত কাকু ফিরে এসে ভাঙ্গা ফুলদানিটা দেখে তো রেগে আগুন। প্রচণ্ড বকাবকি করল। এমন কি শাস্তি স্বরুপ শোবার ঘরে এক ঘন্টা বন্ধ করে রাখলো। আর অন্তুদা ওর বকুনি দেখে কিনা পুরো সময়টা ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল? অমিয় বুঝে গেছে। সে তো এ বাড়ির ছেলে নয়। তাই। অন্তুদার পায়ে লেগে ফুলদানি ভাঙলে এই ভাবে বকতে, শাস্তি দিতে পারতো ওরা? কক্ষনো না। বলত “কতই বা বয়স। পায়ে লেগে পড়ে গেছে। ছেড়ে দাও।” অমিয় জানে অনেক ছোটবেলায় তাকে এ বাড়িতে একটা অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই থেকে সে এই বাড়িতেই আছে ছেলের মত। মুখে যতই দেখাক না কেন, এরা কখনই অমিয়কে বাড়ির ছেলে ভাবে না। সৎ ছেলে সে। তাই এত বকুনি। অন্তুদারও সৎ ভাই। তাই অমন করে হাসতে পারল সে ওর দুর্দশা দেখে। ধুৎ, এই অনাথ, আশ্রিত মার্কা জীবন বাঁচার কোন মানেই হয় না। তাও মিনি চলে যাবে আজ। জীবনের কোন মুল্যই নেই আর। কার জন্য বাঁচবে সে? কিসের জন্য বাঁচবে?  আত্মহত্যা..হ্যাঁ আত্মহত্যা-ই করতে হবে। কোন একটা সিনেমায় দেখেছিল অমিয়। আত্মহত্যা। এই তো অমিয়দের এই বাড়িটাই তেতলা। চারতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলে নিশ্চয়ই মরতে পারবে সে। রাগটা থাকতে থাকতেই করতে হবে। নয়তো মনের জোরটা পাওয়া যায় না। এখনই অন্তুদা কিম্বা অনুকাকিমা এসে আদর করে দিলে রাগটা পড়ে যাবে। দেরি করা যাবে না। ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে চার তলার ছাদে উঠে যায় অমিয়। ছাদের রেলিংটার ওপরে ওঠে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে। ওপর থেকে নিচের রাস্তাটা একবার দেখে অমিয়। কি ছোট ছোট খুদে লাগছে সব কিছু। দূর থেকে দেখলে সবই ছোট। না, এসব ভাবলে চলবে না। অনু কাকিমার মারটা মনে পড়ে। অমিত কাকুর বকুনিটা। অন্তুদার হাসি। মিনির ঢলো ঢলো মুখটা। নাহ বেঁচে থাকা অনর্থক। মরতে তাকে হবেই। চোখ বুজে নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে দেয় অমিয়। তীব্র গতিতে তার তুলতুলে শরীরটা এসে মাটি ছোঁয়। ধুপ করে একটা শব্দ। তারপর সব চুপ।


মাটিতে পড়ার পর বিশ সেকেণ্ড মতো পড়ে থাকে অমিয়। হুমম, এতক্ষণে নিশ্চয়ই মরে গেছে সে। একবার উঠে দাঁড়াতে চেস্টা করলেই বোঝা যাবে। এক লাফে উঠে দাঁড়ায় অমিয়। ঠিক বুঝতে পারে না মরেছে কিনা। পরীক্ষা করতে নিজের গায়ে একটা আঁচড় কাটে। লাগছে। তবে কি সে বেঁচে আছে? নাকি মরা লোকেদেরও ব্যাথা বেদনা থাকে? বেঁচে থাকলে যন্ত্রণা হওয়া উচিত এত উঁচু থেকে পড়লে। হাতে পায়ে মাথায় সব জায়গায় ব্যাথা অনুভব করার চেস্টা করে। নাহ কোথাও কোন ব্যাথা নেই। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে সে বেঁচেই আছে।
“মরণ!!! আমার মরণ-ও নেই। বেড়ালরা বোধ হয় যমেরও অরুচি।” মনে মনে বলে অমিয়। আর ভেবে কি হবে? রাগটাও এবার বেশ পড়ে এসেছে। তাই আজ আর চেস্টা করা যাবে না। “যাইগে, মিনির সাথে একবার দেখা করে আসি। মানুষদের ফেসবুক-এর মত বেড়ালদের একটা social networking site আছে। কিটিবুক বলে। ওখানে মিনিকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। তাহলে ওর সাথে পরেও যোগাযোগ রাখা যাবে।” ল্যাজ দিয়ে গায়ের ধুলো ঝেড়ে অমিয় মিনির বাড়ির দিকে যায়। “ও হ্যাঁ, ওকে বলে দিতে হবে যেন কিটিবুকে ঐ হুমদো হুলো অরিত্রটার friend request একদম  accept না করে।” মনে মনে ভাবে সে।

সমাপ্ত

cat

ডাবল খাওয়া দাওয়া

foodওগো শুনছ, হ্যাঁ, আমি তোমাকেই বলছি। বলি, আজকে বাটি চচ্চড়ি বানিয়েছ তো?  বাটি চচ্চড়িটার জন্যই আর একবার তোমায় বিয়ে করতে পারি।


হ্যাঁ বানিয়েছি গো বানিয়েছি..জানি না আবার। বাটি চচ্চড়ি না হলে তোমার তো জন্মদিনের খাবার মুখে রুচবে না। হাড়মাস তো সারা জীবন জ্বালিয়ে খেলে..

কি ঐ ভেজিটেবিল তেলে নাকি?

না গো, বাবা না। একদম কাচ্চি ঘানি সর্ষের তেলে কাঁচালঙ্কা ছিঁড়ে ফোড়ন দিয়ে বেশ কষিয়ে রেঁধেছি। তোমার যে রকম পছন্দ।। খুশি?

বাহ বেশ বেশ। আর আলু পোস্ত?

তাও হয়েছে। তোমার আর আজকের দিনে সাধ অপূর্ণ থাকে কেন? আলু খাওয়া তোমার মানা। তাও বানালাম। লোভের মাথায় এক বাটি খেয়ে বোসো না।

উফফ, জমে যাবে আজকের খাওয়াটা। ভাবতেই পারছি না। আর ছানার পায়েস?

সে আর বলতে। ছানার পায়েস তো তোমার বরাবরই হট ফেভারিট। সেই একুশ বছর বয়স থেকে নেই নেই করে আজ আমার হয়ে গেল চুরাশি। কোনো জন্মদিনে ছানার পায়েস পাওনি, এমনটা হয়েছে? আর আজ তো তোমার শুধু জন্মদিন নয় দু-দুটো স্পেশাল অকেশান। তাই ছানার পায়েস না করে উপায় কি বলো?

আহা ঐ একটি পদ তুমি মায়ের থেকেও ভাল রাঁধো..সেই আমার ২৮ বছর বয়স থেকে খেয়ে আসছি। তবে আজকাল তেমন স্বাদ হয় না। না, না তোমার দোষ নয়। সুগার-ফ্রী দিয়ে ছানার পায়েস যেন রায়তা দেওয়া ফুচকা..

তুমি বাপু বুড়ো ভাম হয়ে গেলে। তাও নোলাটা একটুও কমল না। বাচ্ছা ছেলের মত আবদার করছ। যাকগে যাক। আজ বেশ করে চিনি দিয়েই তোমার পসন্দমাফিক পায়েস বানিয়েছি, বুঝলেন মিস্টার হ্যাংলা??

উফফ, জিভে জল এসে যাচ্ছে। চনচনে খিদেটাও পাচ্ছে। কিন্তু তুমি বুড়ো ভাম কাকে বলছ হ্যাঁ? গেল সোমবার পর্যন্ত আমি দু ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে আসিনি।

সেটা কোন কৃতিত্বের কম্ম নয়। পরিতোষ ডাক্তার হাজার বার বারণ করেছে অত ভারি ব্যাগ বইতে..

প্রতি রবিবার পিকলু বাবুকে সাইকেলে করে ঘুরিয়ে নিয়ে আসিনা? তারপর আমাদের বাগানে ওর সাথে ঝাড়া ১০ ওভার-এর ক্রিকেট খেলি..ও ছোট বলে ওর দুটো আউট-এ আউট হয় আর আমি ওকে জেতাতে ইচ্ছে করে আউট হয়ে যাই। শুধু ওর খুশি মুখে “দাদু তুমি হেরে গেছো, হেরে গেছো” শোনার জন্য।

“দাদু তুমি হেরে গেছো, হেরে গেছো”

হুম, বিশাল বাহাদুরির কাজ করো। এই বয়সে অত দৌড়ঝাঁপ ভাল? আচ্ছা তুমি কোন আক্কেলে পিকলুকে কাঁধে তুলে গাছ থেকে বাতাবি লেবুটা পাড়তে গেলে বলো তো? যদি পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙতে, তাহলে কি হত হ্যাঁ? সেই তো এই শর্মাকেই সেবা শুশ্রুষা করতে হত নাকি?

আরে কি করব? জানো তো ওর আব্দারের কাছে আমি চিরকালই অসহায়..ওর মুখের খুশির ঝলকানিটা দেখার লোভটা সামলাতে পারলাম না। বায়না করল  “দাদু, বাতাবি লেবু পাড়ব চল না”। তাই গেলাম..অনেক চেষ্টা করেও আঁকশি দিয়ে ডালটার নাগাল পেলাম না..দাদুভাই এর মুখটা ছোট হয়ে গেল। তাই বললাম “দাদু ভাই, তুমি আমার কাঁধে চড়বে আর আমি বীর হনুমানের মত এক লাফাব। তুমি চট করে ডালটা ধরে টেনে আনবে নিচে। তারপর আমরা বাতাবি লেবুটা ছিঁড়ে নিয়ে তোমার দিম্মাকে দেব..দিম্মা ভাল করে নুন, লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে মেখে ফ্রীজে রেখে দেবে। আমরা সন্ধেবেলা খাব। কেমন আইডিয়া, দাদুভাই?

খুব মজা হবে দাদু..

তাহলে বলে দাও বাতাবি লেবুর ইংরেজি আর সংস্কৃত নাম কি..কি শিখিয়েছিলাম?

দাদু, ইংরেজি হল গ্রেপফ্রুট আর সংস্কৃত হল…উমম…মধুকর্কটিকা।

“That’s my boy” বলে ওকে কাঁধে তুলে লাফালাম উঁচু ডালটা লক্ষ করে। নামার সময় একটু বেসামাল হয়ে গেলাম। তাও দাদুভাইকে সাবধানে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়েছিলাম। ঠিক ডালটা ধরতে পারেনি দাদুভাই। তাই বাতাবি লেবুটা…বুকে খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল। তোমার মুখটা মনে পড়ছিল। দশ দিনের জন্য বিরানব্বইটা কমপ্লিট করতে পারলাম না। সে যাক। ”জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কথা কবে”। বিধান বাবুর শুনেছি জন্মদিন আর মৃত্যু দিন একই দিনে। আমার জন্মদিন আর কাজের দিনটা একদিনে হল। সে এক যা হোক ভালই হল। ডাবল খাওয়া দাওয়া।smoke