ঠাম্মার একটা আঙুল নিজের আঙুলে জড়িয়ে নদীর বাঁধানো ঘাটটায় বসেছিল কাহিনী। তখন সবে সন্ধে নামছে। নদীর ওপারে ঐ দূরে লাল তামার চাকতির মত সূর্যটা গাছগাছালির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে আহ্লাদে আলো আর রঙের খেলায় মেতেছে। আকাশে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা মেঘখন্ডগুলোকে কখনো লাল, কখনো কমলা রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যেন কোন খেয়ালী চিত্রকর সমগ্র পরিবেশটাকে আরক্তিম করে তুলেছে। এইরকম সময়গুলোতে যেন কোন এক অদৃশ্য শক্তি মানুষকে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে যায়। ষোলো বছরের ফুটফুটে মেয়ে কাহিনী, সারাক্ষণ যার মুখে ফুলঝুরি ছোটে, সে অব্দি চুপ করে দেখছিল নদীর জলে আকাশের থেকে ঝরে পড়া সোনা আলো আর তার আবীর রঙের ঝিকিমিকি। কলকাতা থেকে কদিনের জন্য দেশের বাড়িতে দিদার কাছে এসেছে সে। তার কোমর লম্বা চুল মোটা ডাঁটো বিনুনি হয়ে তার সদ্যোদ্ভিন্ন বুকের ওপর আলগোছে পড়ে আছে। সন্ধের মৃদুমন্দ হাওয়ায় বিনুনির শেকল থেকে মুক্তি নিয়ে দু এক গুচ্ছ অবাধ্য চুল মুখের ওপর এসে পড়েছে। চোখের ওপর থেকে চুল সরাতে সরাতে কাহিনী জিগ্যেস করে উঠল
“আচ্ছা গ্র্যানি, শুনেছি, হোয়েন উ ওয়্যার এ কিড, তুমি আর তোমার গ্র্যানিও এই নদীর পাশে এসে বসতে।”
“হ্যাঁ রে। আমিও ঠিক তোর মত আমার ঠাম্মার হাত ধরে এই নদীর ধারে বসে কত বিকেল থেকে সন্ধে হতে দেখেছি। কিন্তু আজকাল আর এই নদীটাকে ঠিক চিনতে পারি না। অনেক বদলে গেছে।”
“কেন? সেই ছোটবেলা থেকে দেখছ। তাও চিনতে পারো না কেন?”
“আসলে নদীরা তো বহতা। সময়ের সাথে সাথে ওরা গতি পরবর্তন করে। ক্রমাগত রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যায়। আগে এর জল কেমন হাল্কা নীল ছিল। এখন কেমন ছাইরঙা হয়ে গেছে। ওপর থেকে জলের মধ্যে যে মাছগুলো দেখতে পাওয়া যেত তারও রঙ, আকৃতি, প্রকৃতি বদলে গেছে।”
“বহতা? ইউ মীন ফ্লোয়িং রাইট? কাম অন্ গ্র্যানি, তুমি না? মাঝে মাঝে কোন ভাষায় যে কথা বলো বুঝতেই পারি না। এনিওয়েজ, আচ্ছা একটা কথা বলো। তোমার গ্র্যানির সাথে তোমার গ্র্যানপার পারহ্যাপ্স লাভ ম্যারেজ তাই না?”
“ধুর বোকা। তখনকার দিনে এই আজকালকার মত প্রেম টেম হত না। আমরা, আমাদের মা ঠাকুমারা তোদের মত, ওই তোদের ভাষায়, আল্ট্রামডার্ন ছিল না। বুঝলি? কেন বল তো? তোর কেন মনে হল আমার দাদু ঠাকুমার প্রেম করে বিয়ে?”
“না মানে তোমার গ্র্যানি তো আই গেস বাঙালি না। তাই ভাবছিলাম।”
“ও মা। দিদিমা বাঙালি নয় কেন রে? দিব্যি নৈহাটির মেয়ে। অবাঙালি হতে যাবে কোন দুঃখে?”
“বারে তুমিই তো বলেছিলে তোমার গ্র্যানির নাম, লেট মী রিমেম্বার, কুমুদিনী। রাইট? তো সেটা তো আর বাংলা নাম নয়। ইন ফ্যাক্ট বাংলাতে এরকম কোন শব্দই নেই।”
“ধুর বোকা। কুমুদিনী একদম বাংলা শব্দ। এক ধরণের ফুল। যেমন আমার নাম কথা। তোমার মায়ের নাম যেমন করবী সেরকম।”
“রিয়েলি? উ মীন কুমুদিনী ইজ এ বেঙ্গলি ওয়ার্ড? তোমার নাম, মায়ের নাম – কথা, করবী একসেটরা বাংলা শব্দ জানি। কিন্তু কুমুদিনী?” অবিশ্বাসী চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে কাহিনী।
বিরক্তিতে মাথা নাড়েন বৃদ্ধা কথা সান্যাল। “হ্যাঁ রে। সত্যি কি দিনকাল এলো। তোরা, মানে তোদের প্রজন্ম বা তার পরের পরের প্রজন্ম, তোরা কি বাংলা ভাষাটাকে পুরোপুরি ভুলে যাবি? আজ থেকে আর একশ বছর পর ভাষাটা কি সত্যিই থাকবে? তুই তো ইংরেজি শব্দ ছাড়া এক মিনিটও কথা বলতে পারিস না। আর বাংলার অর্ধেক শব্দ অব্যবহারে অপ্রচলিত হয়ে পড়ছে দেখছি। তোর দাদুর নাম ভাস্কর। সূর্যের প্রতিশব্দ। ভাস্কর তো দূরে থাক তোরা সূর্য কথাটাই ভুলতে বসেছিস। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন হলে সেটাকে বলিস সানি ডে। কে জানে বাবা এই বাংলা ভাষাটা থাকবে তো?”
কাহিনী মুখে মিচকে ফাজিল হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে কথার গলা জড়িয়ে ধরল। গাঢ়স্বরে ডাকল “ঠাম্মা”। সে জানে গ্র্যানিকে ঠাম্মা বলে ডাকলে তার সব রাগে জল ঢালা হয়ে যায়। কথা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন “বল”।
“তোমায় কে বলেছে এগুলো ইংরেজি শব্দ। এই যে সানি ডে, লাভ ম্যারেজ, গেস যে শব্দগুলো আমি ইউজ করেছি এতক্ষণ, এগুলো তো বাংলা শব্দই ঠাম্মা।”
“আবার ফাজলামি করছিস? এগুলো কবে থেকে বাংলা শব্দ হল শুনি?”
“ধরো যদি বলি, আজ থেকে ঠাম্মি? একটা কথা বলো। আক্কেল, আসল, এলাকা, ওজন এই শব্দগুলো বাংলা তো ঠাম্মা?
“হুম”
“আর, আর আওয়াজ, আন্দাজ, আয়না, খারাপ?”
“ও মা, ওগুলো বাংলা হবে না কেন? তুই কি বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“এই ওয়ার্ডসগুলো ঠাম্মা বাংলার পার্ট ছিল না ফর ইটার্নিটি। প্রথম চারটে শব্দ আরবি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে এসেছে। পরের চারটে ফার্সী ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে এসেছে। এলাকা শব্দের আসল আরবি শব্দ ইলাকাহ, খারাপ শব্দের ফার্সী শব্দ খারাব।”
“তুই কি বলতে চাইছিস?”
“বেঙ্গলি যদি এতদিন ধরে অন্য অন্য ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে ওয়ার্ড রিসিভ করে এসেছে তবে আজ কেন তার এক্সসেপশান হবে বলো তো? দাদু তো বলে স্যাংস্কৃট এক সময়ে এত রিজিড হয়ে গেছিল যে ইট রিফিউজড টু অ্যাডপ্ট। তাই সাধারণ মানুষ স্যাংস্কৃটে নয়, প্রাকৃতে কথা বলত। স্যাংস্কৃট থেকে যায় লেখার ভাষা হিসেবে। আর স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজটা, তোমরা যেটাকে কথ্য ভাষা বলো, সেটা গ্র্যাজুয়ালি বদলাতে থাকে। আর তার ফলেই স্যাংস্কৃটের ইভেনচুয়াল ডেথ।”
“তার মানে…”
“তার মানে, ” কাহিনী ঠাম্মার গালে একটা চুমু খেয়ে বলে উঠল “ইংলিশ ওয়ার্ডগুলোকে রিজেক্ট করে নয়, অ্যাক্সেপ্ট করেই তোমার আদরের বাংলা ভাষা বাঁচবে, মাই ডিয়ার ঠাম্মি।”
“কি বলছিস? এই এত এত ইংরেজি শব্দ আমাদের শব্দ বলে মেনে নিতে হবে?”
“ওরাও নিচ্ছে ঠাম্মা। প্রতি বছর ইংরেজিতে ঢোকে ক্লোজ টু ফাইভ টু টেন ওয়ার্ডস। ইয়োগা, বাজার, জাংগল এগুলো অক্সফোর্ড ডিকশানারিতে জায়গা পেয়েছে। ট্রু দ্যাট, ইংলিশ যত ওয়ার্ড বরো করে তার থেকে বেশি ওয়ার্ড লেন্ড করে। কিন্তু তবু নিচ্ছে তো। বাংলাও কেন নেবে না? তাছাড়া কান বন্ধ করে বসে থাকলে ভাষার ইনফিল্ট্রেশান তো তুমি স্টপ করতে পারবে না ঠাম্মা? একটা ল্যাঙ্গুয়েজের পাওয়ারের কাছে আমরা ওয়ে টু উইক। সে এক নদীর মত। নিয়ম মেনে চলা তার স্বভাব নয়। কখনো তার এক জায়গায় চড়া পড়ে, শুকিয়ে যায় আবার অন্য জায়গায় সে পাড় ভেঙ্গে নতুন পথ করে নেয়। কখনো অন্যান্য শাখানদীর জলধারা এসে মেশে। সেটাকে কনটামিনেশান না ভেবে এক্সপ্যানশান ভাবলে প্রবলেম সলভ হয়ে যায়। আমাদের বাংলার বলার ভাষা আর লেখার ভাষা যদি প্রচণ্ড ডিফারেন্ট হয়ে যায়, ঠাম্মা, তবেই বাংলা ভাষার মৃত্যু হবে। তাই স্নবের মত মুখ ঘুরিয়ে বসে না থেকে চলো এই ওয়ার্ডগুলো আমরা নিজেদের শব্দ বলে গ্রহণ করে নিই। এই আমদানি করা শব্দগুলোকে লেখার জন্য প্রপার স্পেলিং ডিভাইস করি। চলো“শব্দ” আর “ওয়ার্ড”-কে আমরা সিনোনিম, তোমরা কি যেন বলো, হ্যাঁ, সমার্থক শব্দ বলে অ্যাক্সেপ্ট করে নিই। করা যায় না ঠাম্মা?”
“কথাটাতে তোর যুক্তি আছে।”
“যুক্তি আছে। আমি লজিকাল কথাই বলছি। এই যে আমি লজিকাল ওয়ার্ডটা ইউজ করলাম, লিখতে গেলে কেন এর বাংলা ট্রান্সলেশান মনে করতে মাথার চুল ছিঁড়ব? লজিকাল ওয়ার্ডটা বহু ব্যাবহারে এখন আমাদেরই শব্দ হয়ে গেছে। লেখার ভাষা আর বলার ভাষার মধ্যে প্যারিটি থাকতে হবে, সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আমি অলরেডি বেঙ্গলি নভেলের অনেক শব্দ বুঝতে পারি না। কারণ প্রচলিত ইংলিশ শব্দ ব্যাবহার না করে তার অভিধান স্বীকৃত বাংলা শব্দ ইউজ করা হয়। এটা তো একধরনের ইউজলেস শভিনিজম বা তোমার ডিকশানে যাকে বলে অপ্রয়োজনীয় বিদগ্ধতা। তুমি এই নদীটাকে চিনতে পারো না বললে না? যদি চিনতে পারার জন্য এই নদীটার পাড় ধরে ধরে শক্ত বাঁধ দিয়ে নদীটাকে বদলাতে না দিতে তবে কে বলতে পারে হয়তো নদীটা শুকিয়ে যেত, আমরা নদীটা দেখতেই পেতাম না। তোমার সাথে নদীটার পাড়ে বসে এই সানসেটটা দেখতেই পেতাম না। তাই বলি কি…বাংলা ভাষার সো কলড ফ্ল্যাগ বিয়ারার বা ধ্বজাধারীদের বলো যে ভাষাটাকে এক্সপ্যান্ড করতে দিতে। এই নতুন শব্দগুলোকে বাঙলারই শব্দ বলে স্বীকৃতি দিতে। কথা দিচ্ছি আমার ঠাম্মির ভাষাকে আমি, আমরা মরতে দেব না। অনেক বকে ফেলেছি। এবারে আমার সুইট ঠাম্মি আমার এই গালে, হ্যাঁ ঠিক এইখানে, একটা কিসি দিয়ে দাও তো।”
কাহিনীর দৃষ্টিকোণটা দেখে অশীতিপর বৃদ্ধা কথার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বাংলা ভাষা বাঁচবে। তার আদরের নাতনি কাহিনীর, কাহিনীদের হাত ধরেই বাঁচবে। বিদেশী শব্দ গ্রহণ করে ওরা বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। ওরা ওদের মাতৃভাষা, মাদার টাঙকে মরতে দেবে না। পরম আদরে চুমু খান তিনি তার চোখের মণি নাতনিটিকে।
ঠাকুমা-নাতনি, কথা ও কাহিনী, অনেকক্ষণ গললগ্ন হয়ে থাকে। ততক্ষণে গোধূলির আলোর খেলা মিলিয়ে গিয়ে সন্ধে নেমেছে। নদী সংলগ্ন গাছগুলো স্থির হয়ে কোন সুগম্ভীরের ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছে। ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে কাহিনী বলে ওঠে “ঠাম্মা এই রিভারটার নাম কি বলেছিলে?”
“এটা তো একটা ছোট নদী। সেরকম কোনো নাম নেই। আমাদের এই লক্ষীকান্তপুরে এটাকে সবাই ভাসা নদী বলে। অন্য গ্রামে অন্য নাম।”
ইয়ার্কির লেশমাত্র নেই এমন একটা গাঢ়, প্রায়-অচেনা স্বরে কাহিনী বলে ওঠে “গ্র্যানি আমার মনে হয় লোকমুখে নদীটার নাম ভাসা হয়ে গেছে। নদীটার আসল নাম বোধ হয় ছিল “ভাষা”।”
কথা চোখ তুলে নদীটার দিকে তাকান। যেন এক নতুন আঙ্গিকে দেখতে পান নদীটিকে। তারপর অপলক দৃষ্টিতে নাতনির দিকে চেয়ে থাকেন আর তার ঘন ঝালর চুলের মধ্যে বিলি কাটতে থাকেন।
রোজ সন্ধ্যে বেলা এক বাটি মুড়ি চানাচুর অল্প সরষের তেল দিয়ে মেখে একটা কাঁচা পেয়াজ দিয়ে খাওয়া মিত্তিরবাবুর অনেকদিনের অভ্যাস। কিন্তু দোকানে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে দেখলেন আজও পেঁয়াজের দাম দু টাকা বেড়েছে। মধ্যবিত্ত বাঙালিকে পেঁয়াজ খাওয়া এবার বন্ধ করতে হবে – এই কথা ভাবতে ভাবতে আর মূল্যবৃদ্ধির জন্য মনে মনে সরকারের বাপ-বাপান্ত করতে করতে হনহনিয়ে বাড়ির দিকে হাটছিলেন অফিসফেরতা মিত্তিরবাবু। জুন মাসের শেষ। মৌসুমী বায়ু অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে পশ্চিম বাংলায় ঢোকার পথে গড়িমসি করছে – আবহাওয়া দপ্তরের এমনই মতামত। ভ্যাপসা গরমে বিন্দু বিন্দু ঘাম তাঁর কপালে। চশমাটাও বেশ অস্বচ্ছ হয়ে গেছে কপালের ঘামে। হাঁটতে হাঁটতেই চশমার কাঁচটা রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করবেন বলে খুললেন তিনি। মোটা পাওয়ারের চশমা। খুললে প্র্যাকটিকালি অন্ধ তিনি। খুলতেই অঘটনটা ঘটলো। উলটো দিক থেকে আসা এক অফিসফেরতা বাবুর সাথে সরাসরি ধাক্কা।
কথাটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না মিত্তিরবাবু। কলকাতার পথেঘাটে কারণে এবং অকারণে বিরক্ত থাকে মানুষজন। ওটাকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। উপরন্তু ধাক্কার ফলে হাতের পেঁয়াজের থলিটা ছিটকে পড়ে গেছে। দুর্মূল্য পেঁয়াজ কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। চশমাটা চোখে বসিয়ে নিয়ে চারচোখ হয়েই পেঁয়াজ শিকারে নেমে পড়েন। পেঁয়াজগুলো থলিবন্দী করে উঠতেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ চোখে পড়ল একটু দূরে কাদার মধ্যে একটা পেঁয়াজ পড়ে আছে। একটু ইতস্তত করলেন তিনি। কুড়িয়ে নেবেন? নাহ, পেয়াজের দাম যা আগুনছোঁয়া তাতে একটাও নষ্ট করা চলে না। বাড়িতে গিয়ে একটু ধুয়ে নিলেই হবে। কাদার মধ্যে থেকে পেঁয়াজটা তুলে নিতে গিয়েই চোখে পড়ল জিনিসটা। একটা গোলাকৃতি নীল রঙের পাথর। পুরো গোলকাকার বললে ভুল বলা হবে। একটা দিক একটু চ্যাপ্টা। আর ওই চ্যাপ্টা দিকের কেন্দ্রে একটা কালো মতন বিন্দু যেখান থেকে খুব সূক্ষ্ম কয়েকটা রেখা পরিধির দিকে গেছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় একটা অক্ষিগোলক যাকে ইংরেজিতে বলে আইবল। একটু ইতস্তত করে হাতে তুলে নেন তিনি। রুমালের কোণায় একটু মুছে নিয়ে নাকের সামনে ধরলেন পাথরটাকে। পড়ন্ত বিকেলের ম্লান হলুদ আলোয় নীল পাথরটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতেই তলপেটের কাছটায় কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করলেন। পাথরটা ফেলে দিতেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু কি ভেবে নিজের অজান্তেই বস্তুটিকে পকেটস্থ করে বাড়ির পথে চললেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই বাড়ি পৌছে গেলেন। এই গরম কালটায় দিনে দুবার স্নান করেন তিনি। সান্ধ্যস্নান সেরে কাচা পায়জামাতে পা গলিয়ে সোফায় বসে টিভিটা চালিয়ে দেন। টিভিতে তখন শাহরুখ খান একটা উজ্জ্বল গোলক হাতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বাংলার প্রগতির ওপর আদিখ্যেতা করছেন। অন্যমনস্ক ভাবে সেই দেখতে দেখতে হাঁক পাড়লেন
“কই দাও গো”।
একবাটি মুড়ি-চানাচুর আর আধখানা পেঁয়াজ হাতে ঘরে ঢোকে শিখা, মিত্তিরবাবুর সহধর্মিণী। “সারাদিন পরে ঢুকে বউ-এর সাথে দু দণ্ড কথা বলা নেই, টিভি চালিয়ে হুকুম করা হচ্ছে” – গজগজ করতে থাকে শিখা। বহুদিনের অভিজ্ঞতা বলছে এই অভিযোগের উত্তর না করাই ভালো। নয়তো বজ্রবিদ্যুৎ সহযোগে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা। এক গাল মুড়ি নিয়ে আর পেঁয়াজে একটা বড় কামড় লাগিয়ে মিত্তিরবাবু টিভিতে মনঃসংযোগ করলেন। আর এইসবের চক্করে পাথরটার কথা বেমালুম ভুলে গেলেন।
ঘটনাটা ঘটলো পরের দিন রাত্রি বেলা। ব্যাঙ্কে একটা কাজ সেরে অফিসে যেতে হবে বলে একটু আগে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। তাই এগারটার মধ্যেই বিছানা নিয়েছিলেন। মধ্যরাত্রে হঠাৎ করে তাঁর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙতেই একটা ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল তাঁর। অন্ধকারে চোখ সওয়াতে একটু সময় লাগে। ছোটোবেলায় বিজ্ঞানের বইতে পড়েছিলেন কারণটা। কি যেন কারণটা – অনেক ভেবেও মনে করতে পারলেন না। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত আড়াইটে। গলাটা একটু ভেজানোর জন্য হাত বাড়ালেন বেডসাইড টেবিলটার দিকে। রাতে শোয়ার সময় ওখানে এক গ্লাস জল রাখে শিখা। কিন্তু মাঝপথেই থেমে গেল হাতটা তাঁর। আগেরদিন প্রাকসন্ধ্যাকালে যে পাথরটা সংগ্রহ করেছিলেন, বেডসাইড টেবিল থেকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সেটা যেন তাঁরই দিকে চেয়ে আছে। একটা ঠাণ্ডা স্রোত মাথা থেকে পা পর্যন্ত নেমে গেল তার। মিনিটখানেক বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন তিনি পাথরটার দিকে। কেমন একটা সম্মোহনী শক্তি আছে ওটার মধ্যে। একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না চট করে। সম্বিৎ ফিরতেই তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে ডাকেন তিনি।
– শিখা, শিখা, এই, এ-এ-এই পাথরটা এ-এ-এখানে এলো কি করে – তোতলান মিত্তিরবাবু।
– তোমার প্যান্ট কাচতে নেওয়ার সময় টুম্পা দিলো ওটা। কোথায় পেলে জিজ্ঞেস করব বলে রেখে দিয়েছিলাম ওখানে। তারপর ভুলে গেছি। কিন্তু তুমি? এত রাতে? ওটার কথা?”
– না কিছু না। ইয়ে অখিলেশ দিয়েছে ওটা। আগের মাসে পুরী গেছিল না। সেখান থেকে এনেছে ওটা।
রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছেন – এমন বাৎসল্যসুলভ আচরণ শিখার কাছে প্রকাশ করবেন না বলে কেমন করে একটা মিথ্যে বলে ফেলেন তিনি। মিথ্যেটা বলেই একটু সঙ্কুচিত হইয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শিখা আর কোনও প্রশ্ন না করে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। মিত্তিরবাবুর চট করে ঘুম আসে না। তাইতো, এই সামান্য পাথরটাকে দেখে এত ভয় পেয়ে গেলেন কেন তিনি। অফিসের কাজের চাপটা বেড়েছে। কয়েকদিনের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসতে হবে। অন্ধকার থেকে আলোতে বা আলো থেকে অন্ধকারে হঠাৎ করে আসলে চোখ সওয়াতে সময় লাগে কেন – আরেকবার মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি। মনে পড়ল না। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি।
সকালবেলা উঠে চশমাটা পরার সময় আরেকবার চোখ পড়ল পাথরটার দিকে। নিতান্তই সাদামাটা। আকারে এবং আয়তনে আইবলের সাথে সাদৃশ্য ছাড়া আর কোন বিশেষত্ব নেই। বেডরুমের উত্তরপূর্ব কোণে একটা সুদৃশ্য কাচের আলমারি আছে। পাথরটাকে সেইখানে রাখলেন তিনি। স্লাইডিং ডোরটা টেনে দিতেই ঘষা কাচের আড়ালে আবছা হয়ে গেল পাথরটা। এরপর দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরতে সাতটা বেজে যায়। শোবার ঘরে ঢুকে আলোটা নিভিয়ে পোশাক পরিবর্তন করার সময় তাঁর স্পষ্ট মনে হল কেউ যেন তাঁকে দেখছে। কেন এমনটা মনে হল কিছুতেই ধরতে পারলেন না। অনাবাশ্যক কোন ভয়কে প্রশ্রয় দেওয়া স্বভাব নয় তাঁর। আবেগতাড়িত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ নন তিনি। তবুও এমন কেন মনে হচ্ছে ভাবতে ভাবতে কাচের আলমারিটার দিকে চোখ গেল।
ঘষাকাচের আলমারিটার যেইখানে পাথরটা রেখেছিলেন, সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হয়ে গেছে জায়গাটা। কাচের মধ্যে দিয়ে নীল পাথরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে হল তাঁর চোখের মণির সাথে ওই পাথরচোখের মণি সরলরেখায় আসার জন্য পাথরটা যেন সামান্য বেঁকে গেছে। ভয়ে হাড় হিম হয়ে যায় তাঁর। পাথরচোখের থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে পায়ে পায়ে পেছতে থাকেন মিত্তিরবাবু। ঘরের দেওয়ালে পিঠ ঠেকতেই কাঁপা কাঁপা হাতে লাইটের সুইচটা অন করে দেন তিনি। একশ পাওয়ারের বাল্বটা একবার জ্বলেই নিভে যায়। ফিউস হয়ে গেল বোধ হয়। অন্ধকারে দপদপ করে জ্বলতে থাকে পাথরটা। দরদর করে ঘামতে থাকেন মিত্তিরবাবু। পাথরচোখ স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। এমন রক্ত জল করা হিম দৃষ্টি ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শরীরের সব রক্ত যেন ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে। কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন কে জানে, হঠাৎ দরজা ঠেলে শিখা ঢোকে ঘরে মুড়ির বাটি হাতে।
“এই বুড়ো বয়সে ভিমরতি হল নাকি তোমার। এতক্ষণ ধরে ঘরে আলো নিভিয়ে কি করছ?” শিখার চোখে বিস্ময় আর দুশ্চিন্তার সংমিশ্রন। ঘরে এসে শিখা লাইটটা জ্বালতেই উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা ভরে যায়। মিত্তিরবাবু তখন বাক্যরুদ্ধ। ফ্যাকাসে মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন আলমারিটার দিকে। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে শিখার চোখ পড়ে পাথরটার দিকে। নিতান্ত সাধারণ ঘর সাজানোর জিনিস বই কিছু নয়। সামান্য নাড়িয়ে দেন তিনি স্বামীকে। সম্বিৎ ফিরে পেয়েই মিত্তিরবাবু নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করেন। শিখার কাছে নিজের এই খনিকের দুর্বলতা কিছুতেই প্রকাশ করা যাবে না। নিশ্চয়ই ঠাট্টা করবে ও। গলা খাঁকারি দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে ওঠেন
– “নাহ, এই লাইটটা জ্বলছিল না।”
– “ওহ, ওটা? অনেক দিন ধরেই তো লুজ কানেকশান ওই সুইচটা। কখনো জ্বলে, কখনো জ্বলে না। কখনো একবার জ্বলেই নিভে যায়। হরেনকে কত বার বলেছি ঠিক করে দিয়ে যেতে। তা এখন ও বড় ইলেক্ট্রিশিয়ান। এখন ছোটো একটা কাজে আমাদের বাড়ি আসার সময় ওর হবে কেন।”
মুড়ি খেতে খেতে নিজেকে যতটা সম্ভব সুস্থির রেখে যেন একটা খুব সাধারণ প্রশ্ন করছেন এমন ভাব করে শুধোন মিত্তিরবাবু – “কাচের আলমারির ঘষা কাচটা অমন পরিষ্কার হয়ে গেল কি করে?”
“ও মা। তোমার কি স্মৃতিভ্রম হল নাকি। ওই তো আগের মাসে ওটাকে বসবার ঘর থেকে শোবার ঘরে আনার সময় ওপর থেকে প্রথম কাচটা ভেঙ্গে গেল। বাবলু এসে, ওর কাছে ঘষা কাঁচ ছিল না বলে সাদা কাঁচ লাগিয়ে দিয়ে গেল – ভুলে গেলে নাকি।” তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে যায় মিত্তিরবাবুর। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই লজ্জিত হয়ে ওঠেন তিনি। নাহ, কটা দিন ছুটি নিতেই হবে। মাথাটাকে একটু ঠাণ্ডা করা দরকার।
“আর ওই নীল পাথরটা ভাল দেখতে বলে ঘষা কাচের দ্বিতীয় তাক থেকে সাদা কাঁচের প্রথম তাকে টুম্পা নিয়ে এসেছে শেলফটা পরিষ্কার করার সময়।” সংযোজন করে শিখা। কানটা লাল হয়ে ওঠে মিত্তিরবাবুর। তবে কি শিখা বুঝতে পারল তাঁর এই অকারণ ভীতিটা।
“ইয়ে, মানে, ওই পাথরটা বেশ সুন্দর বলো?” স্ত্রীয়ের মনোগতি অনুধাবন করার জন্য প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন তিনি।
“হ্যাঁ, বেশ। কে দিলো? অখিলেশ?” দীর্ঘ চুলে বিনুনি করতে করতে জিজ্ঞেস করে শিখা।
যাক, তবে শিখা কিছু বুঝতে পারেনি তাহলে। যাক বাবা। বুঝতে পারলে নিশ্চয়ই ঠাট্টা করত। “হ্যাঁ, পুরী থেকে এনে দিয়েছে। বলল, বৌদিকে দেবেন।” – নিশ্চিন্ত মনে অবলীলাক্রমে মিথ্যে বলেন তিনি।
“কাল বাদে পরশু তোমার অফিসের বন্ধুরা আসছে, মনে আছে তো। কাল ফেরার পথে পাঠার মাংস কিনে এনো। ম্যারিনেট করতে হবে।” মিত্তিরবাবুর মনে পড়ে যায়। অনেকদিন ধরে অফিসের সহকর্মীরা ধরেছে খাওয়ানোর জন্য। তাঁর প্রমোশান উপলক্ষে। “হ্যা, আনবো” অন্যমনস্ক ভাবে বলেন তিনি।
শুক্রবার অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরেন মিত্তিরবাবু। একটু পরেই ওরা সব এসে পড়বে। তার আগে ঘর গোছানোয় শিখাকে একটু সাহায্য না করলে রাতের বেলা অনেক গালাগালি শুনতে হবে। চ্যাটারজিবাবু, মিত্রবাবু আসবে সস্ত্রীক। কৌশিকবাবু বিপত্নীক। তিনি আসবেন আর আসবে অখিলেশ। এই কজনেরই নেমন্তন্ন। বাড়িতে এসেই দেখেন শিখা আজ সেজেছে। প্রসাধন করলে এই বয়সেও শিখাকে বেশ লাগে। শরীরে মধ্যবয়সোচিত মেদ সামান্য লাগলেও বেশ বোঝা যায় অল্প বয়সে সে বেশ তন্বী ছিল। শাড়ি পরেছে নীলরঙা। দীর্ঘ চুল বেনী হয়ে ঝুলছে। কাজল দিয়ে সুন্দর করে চোখ এঁকেছে। মিত্তিরবাবু তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আড়চোখে দেখে শিখা একটু লজ্জা পায়।
“প্রথমবার দেখছ নাকি। যাও স্নান সেরে এসো। অনেক কাজ আছে।” মিত্তিরবাবু তাড়াতাড়ি স্নানের তোয়ালে নিতে শোবার ঘরে প্রবেশ করেন। আলো না জ্বালিয়েও হয়তো খুজে পেতেন, শিখা জায়গার জিনিস জায়গাতেই রাখে, কিন্তু সেইদিনের পর থেকে কেন যেন আলো না জালিয়ে শোবার ঘরে ঢুকতে ভরসা পান না। অনেকবার এটার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন, কিন্তু পরের বার শোবার ঘরে ঢোকার সময় কোন মন্ত্রবলে পাটা থেমে যায়। লাইটটা জ্বালিয়ে তবেই ঢুকতে পারেন। আর নিজের অজান্তেই চোখটা চলে যায় কাচের আলমারিটার দিকে যার এক নম্বর তাকে নীল পাথরটা পাথর চোখ নিয়ে চেয়ে আছে। আজও দেখলেন সেটা যথাস্থানেই আছে। স্নানে চলে যান তিনি।
সন্ধ্যে সাতটার একটু পরে প্রথম আসে অখিলেশ। হাসি খুশি, আমুদে বেশ ছেলেটা। বিয়ে থা এখন হয়নি। বেশ মিত্তিরদা মিত্তিরদা করে। খারাপ লাগে না অখিলেশকে মিত্তিরবাবুর। প্লাস শিখা অখিলেশকে বেশ স্নেহের চোখে দেখে।
– “সকাল থেকে তোমার হাতের রান্না কবজি ডুবিয়ে খাবো বলে দুপুরে লাঞ্চ স্কিপ করেছি। তোমার হাতের রান্নায় জাদু আছে বৌদি।” হাসি হাসি মুখে বলে অখিলেশ শিখাকে।
– “বিয়ে করে বৌ নিয়ে এসো। তাকে শিখিয়ে দেবো, তাহলে আর লাঞ্চ স্কিপ করতে হবে না।”
– “এতো সুন্দর লাগছে তোমায়, এসো কটা ছবি তুলে দিই অন্যরা আসার আগে।”
অখিলেশের ছবি তোলার শখ। কিন্তু বাংলাদেশে মডেলের অভাব। তাই এ বাড়িতে আসলে সে শিখার কয়েকটা ছবি তুলেই থাকে। বেশ কয়েকটা বাঁধিয়ে শিখাকে উপহারও দিয়েছে সে। আর শিখা অন্য মেয়েদেরই মতো ছবি তুলতে বেশ ভালইবাসে। পর পর শিখার বেশ কয়েকটা ছবি তোলে অখিলেশ। দাঁড় করিয়ে, বসে, ক্লোজ আপ, ফুল বডি, বিনুনি সামনে করে।
– “এবার তুমি ওই কাঠের শেলফটার ওপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে অফ-দ্য-ক্যামেরা তাকাও। আগের মাসে এখানে একটা কাচের আলমারি ছিল না? ”
– “এই কাঠের আলমারিটা কেনার পর ওটাকে শোবার ঘরে সরানো হয়েছে” – অখিলেশের সুপারিশ মতো পোজ দিতে দিতে উত্তর দেয় শিখা। অখিলেশ ছবি তুলে একটু পর্যবেক্ষণ করে শিশুর মতো উৎসাহিত হয়ে বলে
– “দারুন এসেছে এই ছবিটা। লাইটিং কন্ডিশানটা ভালো ছিল না। ফ্ল্যাশ মারার ফলে একটু রেড আই এফেক্ট আছে। ওটা এডিট করে ঠিক করে দেবো। তোমার সব ছবিগুলো এতো সুন্দর আসে, মডেলিং-এ নামলে এখনো অনেকের পেটের ভাত মারতে পারবে। দেখো বৌদির কেমন ছবি তুলেছি” বলে ক্যামেরার স্ক্রীন টা মিত্তিরবাবুর দিকে মেলে ধরে অখিলেশ।
অখিলেশই একদিন বুঝিয়ে ছিল রেড-আই এফেক্টটা আদতে কি। আধো-অন্ধকারে ছবি তোলার আগে একটা লাল আলো ফেলে আধুনিক ক্যামেরাগুলো ফোকাস দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে, আর সেই অনুযায়ী ক্যামেরার ভেতরের লেন্স অ্যাডজাস্ট করে যাতে ছবিটা আউট-অফ-ফোকাস না হয়ে যায়। আর ওই মেজারিং লাইটের সাথে অ্যাডজাস্ট করতে চোখের মণি স্ফীত হয়, আর তারপর ফ্ল্যাশ মারলে ওই বিস্ফারিত মণি লাল রঙের দেখায় ছবিতে।
“হ্যাঁ এই বুড়ো বয়সে মডেলিং করি আর কি। আমি মডেলিং করছি শুনলে তোমার মিত্তিরদা তো আনন্দে লাফাবে” – মিত্তিরবাবুকে শুনিয়েই হালকা খোঁচা শিখার। মিত্তিরবাবু খোঁচাটা চুপচাপ হজম করেন। শিখার ছবিটা ভাল তুলেছে অখিলেশ। কিন্তু ছবিটাতে কি একটা যেন দেখে খটকা লেগেছে মিত্তিরবাবুর। অথচ কি সেটা ঠিক বুঝতে পারেন নি। ভাবতে থাকেন মিত্তিরবাবু।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকিরা এসে পরে। আমপানা নিয়ে আসে শিখা। গল্পগাছা চলতে থাকে। মিত্তিরবাবুর খটকাটা যায় না। ছবিটাতে কি যেন একটা…
নটা নাগাদ ডিনার পরিবেশন করে শিখা। সবাই যখন খেতে ব্যস্ত, মিত্তিরবাবু অখিলেশের ক্যামেরাটা নিয়ে আজকের সন্ধ্যায় তোলা ছবিগুলো দেখতে থাকেন। খটকাটা না কাটলে আজ রাতে ঘুম আসবে না। কাঠের শেলফে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো শিখার ছবিটা ভাল করে দেখেন মিত্তিরবাবু। হঠাৎ-ই ছবিটার অস্বাভাবিকতাটা চোখে পড়ে যায়। চোখে পড়তেই মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায় তাঁর। ভাল করে আর একবার দেখেন। নাহ কোন সন্দেহ নেই। শিখার শেfলফে রাখা হাতের কনুইের দুই ইঞ্চি বাঁ দিকে সেই নীল পাথরটা। আজ সন্ধ্যেতেই শোবার ঘরে দেখেছিলেন তিনি পাথরটাকে। কোনোভাবেই সেটা বসবার ঘরে আসা সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, পাথর চোখেও সেই একই রেড-আই এফেক্ট…
আলো থেকে অন্ধকারে বা অন্ধকার থেকে আলোতে হঠাৎ করে আসলে চোখ সওয়াতে সময় কেন লাগে মিত্তিরাবুর মনে পড়ে যায় এক লহমায়। পাথরচোখটা ঘরে আনার পরদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে পাথরটাকে বেডসাইড টেবল-এ দেখে ভয় পেয়েছিলেন আর সেই সঙ্গে এই প্রশ্নটা মাথায় অনেকক্ষণ ঘুরপাক খেয়েছিল তাঁর। আলোর উজ্জ্বলতার উপর নির্ভর চোখের মণি সঙ্কুচিত, প্রসারিত হয় যাতে চোখের মধ্যে একই পরিমাণ আলো প্রবেশ করে। আসলে চোখের মণিটা একধরণের অর্গানিক ক্যামেরাই। চোখের মণি বড়, ছোটো হতে যে সময় লাগে, সেটাই চোখ সওয়ানোর সময় বলে।
আরেকবার ভাল করে ছবিটা দেখেন মিত্তিরবাবু। নাহ, জীবন্ত চোখ না হলে এমন স্পষ্ট রেড-আই এফেক্ট হওয়া অসম্ভব। তীব্র ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যান তিনি। খাবার টেবলের হাসি ঠাট্টাগুলো অনেক দূর থেকে ভেসে আসে যেন। ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসা হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে যায় সোফার ওপর। টলতে টলতে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যান মিত্তিরবাবু। আলো জ্বালার কথা আজ মনে পড়ে না তাঁর। অন্ধকারেই কাচের আলমারিটার দিকে এগিয়ে যান। চোখ সওয়াতে একটু সময় লাগে তাঁর। পাথরচোখটা যথাস্থানেই আছে। নিষ্ঠুর শ্বাপদের দৃষ্টির মতো অন্ধকারে ধক ধক করে জ্বলছে সেটা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মণিটা অন্ধকারে বেশি আলো পাওয়ার জন্য সামান্য স্ফীত। এমন ক্রুর দৃষ্টি কারো কখনো দেখেন নি মিত্তিরবাবু।
আর দেরি করেননি মিত্তিরবাবু। পকেট থেকে রুমাল বের করে পাথরটাকে রুমালবন্দি করে পকেটস্থ করেন। বাইরের ঘরে তখন নৈশাহার শেষ করে শিখার রান্নার প্রশংসা চলছে। খুব সাবধানে বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটতে থাকেন তিনি। যেখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন আপদটাকে, সেখানেই ফেলে আসবেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে যান। অন্ধকার ফুটপাথটায় তখন একটাও লোক নেই। রুমালের ভাঁজ থেকে পাথরটা বের করে সাবধানে রেখে দেন ফুটপাতের ধারে। জুন মাসের ভ্যাপসা গরমেও পাথরটা হিমশীতল। ভীতশঙ্কিত মিত্তিরবাবু পিছন ঘুরে প্রায় ছুটতে থাকেন।
হাত দশেক দূরে গিয়ে কেমন এক প্রকার বাধ্য হয়েই একবার থেমে পেছন ঘুরে তাকান তিনি। মোহাবিষ্টের মত অবস্থা তখন তাঁর। যেন ঘুরে তাকানোই তাঁর ভবিতব্য ছিল। না তাকিয়ে উপায় ছিল না। আর তাকালে কি দেখতে পাবেন সেটাও তাঁর যেন আগে থেকেই জানাই ছিল –
একটা নয়, দুটো, হ্যাঁ ঠিকই দেখেছেন তিনি, দু দুটো জ্বলন্ত নিষ্ঠুর চোখ, একে অপরের থেকে আঙুলখানেক দূরত্বে, চেয়ে আছে তাঁর দিকে…ঠিক যতটা দূরত্বে থাকে মানুষের বা পিশাচের বা দেবতার দুটো চোখ। হিমশীতল দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে চোখ দুটো তাঁর দিকে। আর সে চোখে আছে নীরব আহ্বান। এমন আহ্বান যেটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই এখন মিত্তিরবাবুর আর। ধীরে ধীরে মন্ত্রমুগ্ধের মত তিনি এগিয়ে যান চোখ দুটোর দিকে। একদম সামনে পৌঁছে পকেট থেকে রুমাল বের করে দুখানা পাথরচোখকেই রুমালে মুড়ে নেন। প্রেত, পিশাচ, অশরীরী এই চোখ দুখানা যারই হোক, সে যেন অদৃশ্যে থেকে নির্দেশ দিচ্ছে এই চোখ দুখানা আলাদা করা যাবে না। যে একখানা সংগ্রহ করেছে, তাকে দুখানাই রাখতে হবে নিজের সংগ্রহে। রুমালবন্দি পাথর দুটোকে হাতে নিয়েই পেছনে ঘোরেন মিত্তিরবাবু। একটা জোরালো আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ছিটকে পড়ে যান বড় রাস্তার ওপরে। গাঢ় লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরোতে থাকে মাথার থেকে। যে গাড়িটা তাকে ধাক্কা মেরেছে সেটা স্পীড বাড়িয়ে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়। হাত থেকে ছিটকে পাথর দুটো পড়ে যায়। গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে ঠিক সেই জায়গায় স্থির হয় যেখান থেকে মিত্তিরবাবু প্রথম পাথরখানা কুড়িয়েছিলেন সপ্তাহখানেক আগে। নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে স্থির শুয়ে থাকেন তিনি। পাথর দুটো যেখানে পড়ে আছে সেখানটা ঢালু। মাথার থেকে ক্রমাগত বেরোতে থাকা মোটা রক্তের ধারা সেই ঢালু জায়াগাটাতেই গিয়ে জমতে থাকে। জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার আগে মিত্তিরবাবু স্পষ্ট টের পান তাঁরই রক্তে ভেজা পাথরচোখ দুটো এখনো তাঁর দিকেই চেয়ে আছে। অপলক।