আজ বসন্ত। দাপুটে শীতবুড়িকে এ বছরের মত অক্ষম করে দিয়ে আবার ফিরে এসেছে যুবতী বসন্ত। তার মোহময়ী যৌবনের ছোঁয়া লেগেছে সবখানে। গাছের ডালে ডালে ভিড় করে এসেছে কচি সবুজ শিশু পাতারা। বসন্তের ঋতু রঙ লেগেছে গাছেদের শরীরে। কিন্ডারগার্ডেনের একগাদা খুদে ওস্তাদের মত কচি কিশলয়রা খুশি খুশি মুখ করে ইতিউতি তাকাচ্ছে। ঘাসে ঘাসে ফুটে উঠেছে হলুদ ঘাসফুল। ড্যান্ডিলিয়ন নাম এর। ফুলেল পৃথিবীতে জাতবিচারে এরা নিতান্তই দলিত। একধরণের বুনো ফুল বলা যায়। কেউ আদর করে বাগানে লাগায় না। ভালবেসে জল দেয় না। একগোছা ড্যান্ডিলিয়ন ফুলদানিতে সাজিয়ে বা চুলে গুঁজে কেউ প্রিয় মানুষটির অপেক্ষা করে না। বরং উইড কন্ট্রোল লাগিয়ে বাগান থেকে উচ্ছেদ করারই’ রীতি। কেউ তারিফ করে না বলেই হয়তো রাস্তার ধারে ধারে অনাদরে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে এদের উদ্ধত আত্মপ্রকাশ। গাঢ় সবুজ ঘাসের বুকে হাজারে হাজারে ফুটে থাকা বাসন্তী হলুদ রঙা ড্যান্ডিলিয়নের কি যে অপরূপ শোভা তাকে শব্দে ধরা বোধ হয় আমার সাহিত্যপ্রতিভার অতীত। যেন কোন অদৃশ্য শিল্পী সবুজ ঘাস গালিচাতে হলুদ রং তুলি নিয়ে মাইলের পর মাইল জুড়ে এঁকেছে এক চোখ জুড়োন আলপনা। প্রতিটা ফুলেরই যেন একটা নিজস্ব স্বত্বা আছে, একটা পৃথক ব্যক্তিত্ব। মৃদু দখিনা হাওয়ায় খুশিতে মাথা দোলাচ্ছে কেউ কেউ। কোন কোন ফুল তার সুন্দরী সঙ্গিনীর সাথে প্রেমালিঙ্গনে বদ্ধ। কেউ ভাবুক চুপচাপ, কেউ নীরবে বাক্যালাপ করছে পার্শবর্তিনীর সাথে। অনেকক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলে একটা নেশার মত হয়। শুধু ওরাই নয়, রূপ-রঙ-রসের খেলায় মেতেছে আরও কতরকমের গাছ। ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে বিভিন্ন গুল্মরাজি – কেউ সাদা কেউ বেগুনী কেউ কমলা। ওদের চুপ ভাষায় কতরকমের ফিসফিসানি। এ বলছে আমায় দেখ, ও বলছে আমায়। নিজেকে আরও আকর্ষনীয় করে তুলতে কোন গাছ হয়তো সুগন্ধি মেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে পাশ দিয়ে গেলে অপূর্ব সুবাসে চলার গতি আপনা থেকেই শ্লথ হয়ে আসে। তখন বেশ টের পাই গাছের বুক কেমন করে গর্বে ফুলে ওঠে। ছবির মত সুন্দর ছোট ছোট একচালা বাড়িগুলোর পাশে পাশে কোথাও ফুটেছে হায়াসিন্থ, কোথাও টিউলিপ। সদ্য প্রস্ফুটিত আধো খোলা লাল হলুদ টিউলিপগুলোর মধ্যে কেমন যেন যৌবনে সবে সবে পা রাখা কিশোরীর লজ্জা। নিজেদের খুলে ধরার এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা ওদের মধ্যে। নীরব গুঞ্জনে মাথা নেড়ে নেড়ে টীনেজ টিউলিপরা একে অপরকে প্রথম প্রেমে পড়ার গল্প শোনাচ্ছে কি? হায়াসিন্থগুলো নিজেদের রঙের জৌলুসে গরবিনী। একটু কেমন চুপচাপ, একলা। হাজারে হাজারে ফুটেছে সাদা চেরি ব্লসম গুলো। এত ভিড় করে এসেছে যে মনে হচ্ছে সাদার আগুন লেগে গেছে চেরি গাছগুলোয়। কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে চোখ যেন ধুঁধলে যায়। গা ভর্তি পাতা আর ফুলের গয়না পড়ে অগুনতি গাছ আজ বসন্তে এই বিউটি কনটেস্টে নাম লিখিয়েছে। তিলোত্তমা উপাধি পেতে সবাই যেন বদ্ধ পরিকর। রং শুধু প্রকৃতির বুকে লাগে নি, রং লেগেছে পাখিদেরও মনে। কিচিরমিচির করে একটানা কথা বলে যাচ্ছে যেন এক যুগ ধরে তারা নীরব ছিল। একটা সবজে রঙা পাখি কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কোন ডালটায় বসা উচিত। ব্যস্ত হয়ে একডাল থেকে আর এক ডালে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। শীতের ঝাঁঝ কমার ফলেই ওদের উৎসাহে জোয়ার লেগেছে নতুন করে। আর একটা হলদে-গলা পাখি গাছের উঁচু ডালে বসে সমানে টিঁউ টিঁউ করে ডেকে যাচ্ছে। নির্লজ্জ ভঙ্গিতে গলা ফুলিয়ে সঙ্গিনীদের সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। একটা উৎসাহী কাঠবিড়ালি গাছের গুঁড়ি বেয়ে নেমে একবার করে জুলজুল চোখে তাকাচ্ছে, আবার কি ভেবে, বোধ করি সাহসের অভাবেই, গাছের গুঁড়ি বেয়ে আবার নিজের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাচ্ছে। এমন ত্রস্ত ভাব যেন কাউকেই তেমন বিশ্বাস করে না। সব মিলিয়ে প্রাণ লেগেছে সবখানে। প্রকৃতির পাত্র কানায় কানায় ভরে উঠেছে। প্রাণে টইটুম্বুর। শুরু হয়েছে এক অত্যাশ্চর্য মিলনখেলা। কালো ভোমরাগুলো সৃষ্টির বীজ নিয়ে ফুল থেকে ফুলে ঘুরছে। ফুলেদের গর্ভনিষেক হলেই তো আসবে পরবর্তী উদ্ভিদ প্রজন্ম। পৃথিবীর প্রাণের ইতিহাসে এই মানুষই নবীনতম প্রাণী। মানুষ আসার আগেও হাজার হাজার বছর ধরে নীল্গ্রহে এসেছে নির্জন বসন্ত। প্রকৃতি এরকমই রূপের ডালি সাজিয়ে বসেছে। কার জন্য? কোন মুগ্ধ চোখের অপেক্ষায়? আসলে এর পেছনেও আছে সিসৃক্ষা, সৃজনের ইচ্ছা। সৃষ্টি করার ইচ্ছাই বোধ হয় এই সৃষ্টির সবচেয়ে পাওয়ারফুল মোটিভ, সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাইভিং ফোর্স। প্রতিরূপ তৈরী করার ইচ্ছে নিয়েই প্রোটিন সেল কোষবিভাজন পদ্ধতিতে এক থেকে দুই হয়েছিল কোন এক বিস্মৃত অতীতে। সেই থেকে সমানে চলেছে। আসলে গাছেরা ফুলের ডালি সাজিয়ে বসে, ফুলেরা গন্ধ আতর মেখে বসে এক আদিম সৃজনেচ্ছা থেকেই। ওদের চোখের ভাষায় যে আহ্বান লেখা থাকে তা ইতিহাসের একেবারে শেষ অধ্যায়ে আসা মানুষ প্রজাতির মনোরঞ্জনের জন্য নয়। ওরা তো আকর্ষণ করতে চায় ঐ ভোমরাদের যারা ফুল থেকে ফুলে রেণু ছড়িয়ে দেবে। আর তার থেকে সৃষ্টি হবে নতুন প্রজন্ম। নতুনকে সৃষ্টি করার ইচ্ছে নিয়েই, প্রতিরূপ গড়ার ইচ্ছে থেকেই তাদের এই নির্লজ্জ আত্মবিপণন। পৃথিবীতে নতুনকে আনার জন্য আর সেই নতুনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা তো সকলেই রোজ নিজেকে বিক্রি করতে পসরা সাজিয়ে বসি। চাষজমির মাঠে, কারখানার ফ্লোরে শ্রম বিক্রি হয়, বহুতল অফিস বিল্ডিঙের ফ্লোরে বিক্রি হয় মেধা। নিজের থেকে উদ্ভিন্ন প্রাণকে আরও প্রবলতর মুক্তিবেগ দিতেই আমরা নিজেদেরকে আরও বেশি করে আকর্ষণীয় করে তুলি। সেই অর্থে তো আমাদের রোজই বসন্ত। তবু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বেড়াজালে আমাদের মুগ্ধতাকে তো বেঁধে ফেলা যায় না। তাই প্রতি বসন্তেই কবিরা কবিতা বাঁধে, কবিয়ালরা গান। যা কিছু নিঃশেষ, যা কিছু আবর্জনা তাকে পেছনে ফেলে রেখে প্রাচুর্যের আতিশয্যে সাজে আমাদের অন্তর, আমাদের বাহির।
Tag: প্রকৃতি চেতনা
বন-পাহাড়ি
কদিন আগেই বন্ধুবান্ধব মিলে গেছিলাম Smokey Mountain। রূপসী ধূম্র পাহাড়-এর এক চন্দ্রালোকিত সন্ধ্যায় বসে লিখেছিলাম।
********
আজ আকাশে আঁকা তারার আলপনা
আজকে রাতে হোক কবিতা। গল্প না।
পাহাড়-পথে পড়ছে ঝরে জোছনা জল
আজ এ রাতে আমার সাথে থাকবি বল!
গাছের পাতায় কুয়াশাদের চুপ সোহাগ
জড়িয়ে – যেন উপগতার পূর্বরাগ।
আজকে নিবিড় আশ্রয় তোর নরম বুক
কথারা আজ ঠোঁটের নিচে চুপ থাকুক।
আজকে শরীর খুঁজুক শরীর। উষ্ণতা।
দীর্ণ হৃদয় খুঁজে ফিরুক ক্লিন্নতা।
তোর ঠোঁটের আর তোর ঐ চোখের মুগ্ধতা
বন-পাহাড়ি সব্জে, অবুঝ বন্যতায়
আজকে খুঁজে ফিরুক সুজন, অলীক সুখ
তোর গহীনে ঠাঁই দে আমায়। আগন্তুক।
ওভারশুট ডে
শোচনীয় সিচুয়েশানে শ্যামবাজারের শ্যামলা
বলল হেঁকে “আর পারিনে, এবার তোরা সামলা।
মরবি তোরা মরবি এবার, এবার পাবি অক্কা
সারা বছরের রসদ তোদের আগাস্ট মাসেই ফক্কা?
এই গ্রহ যা দিতে পারে এক বছরের খাবার
খিদে তোদের এতই যে সব আগাস্ট মাসেই সাবাড়?
তেল পোড়ানো কমাতে হবে যতই বলি তোদের
শুনবি না গরিবের কথা। দেখ ফলাফল জেদের –
এক শতাব্দীতে মানুষ ডাবল কিন্তু বলে রাখি
আটান্ন পার্সেন্ট হয়েছে মাছ আর পশু পাখি
বৃষ্টিবাদলা কমছে ক্রমেই চেঞ্জ হচ্ছে ক্লাইমেট
এ চললে ঠিক লোপ পাবে সব মানুষ, বাঁদর, প্রাইমেটস
আমিষ খাওয়া কমা, তোরা তেল পোড়ানো কমা
নয়তো আর এক শতক শেষে কাঁদবি “ছেড়ে দে মা”
বাঁচতে চাস তো কন্ট্রোল কর কার্বন এমিশান
নয়তো এ রেলগাড়ি পৌঁছবে শেষের ইস্টিশান
এই পৃথিবী বাঁচাবো আমরা – আয়নার সামনে
প্রতিজ্ঞা কর। আজ বছরের ওভারশুট ডে”
★★★
সব শুনেটুনে বলল সবাই লোকটা বোধ হয় পাগল
নয় মাওয়িস্ট নয়তো নেতা কিম্বা নিছক গাড়োল
“Living within the means of one planet is technologically possible, financially beneficial, and our only chance for a prosperous future”
We used all resources that we will be able to replenish throughout the year by August 2, this year. August 2 is the overshoot day for this year.
https://www.cnbc.com/2017/08/02/its-earth-overshoot-day-weve-used-more-resources-than-nature-can-regenerate-in-2017.html