সুরপথ – রম্যরচনা

কয়েকদিন আগে একটা গানের আড্ডায় গেছিলাম। অনেক গায়েন আর বায়েনদের মেলা। বাগেশ্রী রাগে যন্ত্রসঙ্গীতের পরে আসছেন রবি কবি, রবীন্দ্রনাথের পরে আসছেন রফি সাহাব। হেমন্ত, কিশোর, ভুপেন হাজারিকা দিয়ে যাচ্ছেন ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্স। চন্দ্রবিন্দু বা হালচালের গীতিকার দেবদীপও সেখানে ব্রাত্য নয়। এই সুরের বাহারি বাগানের নাম সুরোধ্বনি। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম সঙ্গীত শিল্প মাধ্যমের কথা। মনে হল এই গান গাওয়ার সাথে আমি যে ফিল্ডে কাজ করি তার বোধ হয় বিশেষ সাদৃশ্য আছে। আমি কাজ করি ড্রাইভারলেস কার ইন্ডাস্ট্রীতে। মানুষের সাহায্য ছাড়াই একটা গাড়িকে তার গোমুখ থেকে সাগরের মোহনাতে পৌঁছে দেওয়া, তার শুরু থেকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার কৌশল নিয়ে গবেষণা করা আমার কাজ। গান গাওয়ার ব্যাপারটাও কি অনেকটা সেরকম নয়? স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং-এর মূল উপাদান দুটি। একটা নির্ভুল মানচিত্র – আমাদের ইন্ডাস্ট্রীতে একে বলে হাই ডেফিনিশান ম্যাপ আর তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গাড়ির চাকাদের সময়মত ঘোরানো আর অন্যান্য সহযাত্রী গাড়িদের সাথে নির্ভুলভাবে সমাপতিত হতে সময়মত ব্রেক ও অ্যাক্সিলেটার প্রয়োগ করে গাড়ির গতি পরিবর্তন করা যাকে আমাদের পরিভাষায় বলে maneuver technique. স্বয়ংক্রিয় গাড়িকে ছেড়ে দিয়ে আমরা আপাতত যদি মানুষচালিত গাড়ির কথা ভাবি, অনুরূপ দুটি জিনিসেরই দরকার হবে। মাথার মধ্যে থাকা বা মোবাইলের পর্দায় থাকা একটা হাই ডেফিনিশান ম্যাপ আর ম্যানুভারিং স্কিল। গাড়ি চালানো ভালভাবে জানা না থাকলে বা ম্যাপটা ভালভাবে জানা না থাকলে (ধরুন মোবাইলের সহায়তা পাচ্ছেন না, অত্যধিক ফেসবুক করে মোবাইল ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে 🙂 ) দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা। গায়ক বাদকদের ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকম। সুর যেন একটা অদৃশ্য পথ। আর সেই পথে স্বররুপী গাড়িকে চালনা করতে হবে। সেটাই চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এ পথ বড় বিপদসংকুল। প্রথম বিপদ হল, সঙ্গীতশিল্পীদের সাহায্য করার জন্য কোন ইলেক্ট্রনিক ম্যাপ নেই। হ্যাঁ, ইলেক্ট্রনিক সুরযন্ত্র, আবহ যন্ত্রসঙ্গীত ইত্যাদি মোটা পথটা বাতলে দিতে পারে কিন্তু ম্যাপের খুঁটিনাটিটা থাকতে হবে নিজেরই মাথার মধ্যে। ডুয়েট বা গ্রুপ সঙ গাওয়ার সময় সহগায়করা আর সোলো গাওয়ার সময় সহবাদকরা যেন সেই একই অদৃশ্য রাস্তায় চলতে থাকা অন্যান্য গাড়ি। ম্যাপটাকে একটু ভুল বুঝলেই সেই সহযাত্রীদের সাথে ঠোকাঠুকি, রক্তারক্তি হওয়ার সম্ভাবনা। আরও একটা বড় সমস্যা হল সুরের পথে আমাদের পার্থিব পথদের মত কয়েকটি মাত্র নির্দিষ্ট রুট নেই। প্রতিটা গানেই সুরকার তার সৃজনশীলতা দিয়ে পত্তন করেন একটা আনকোরা নতুন রাস্তা, একটা আনদেখা পথ। সঙ্গীতশিল্পীকে বুঝে নিতে হয় লেনটা ঠিক কেমনভাবে বিধৃত, ঠিক কতটা চওড়া, কতটা দৈর্ঘ অতিক্রম করার পর আচম্বিতে আসবে একটা মোড়। আমাদের হাইওয়েতে যেমন থাকে স্লো লেন, ফাস্ট লেন সেরকমই হঠাৎই কোন লাইনে কি স্ট্যাঞ্জায় বাড়াতে হবে গানের গতি। চারচাকা গাড়ি চালানোর সময় গতি দশ-মাইল-প্রতি-ঘণ্টা অব্দি উপরনিচ করার বিলাসিতা থাকে। এক্ষেত্রে সে গুড়ে বালি। যে গতি মেপে দেওয়া আছে, কাঁটায় কাঁটায় সেই গতিতেই গাড়ি চালাতে হবে। রাস্তা বরাবর সম দূরত্বে বসানো আছে একধরণের অদৃশ্য খুঁটি। সমান পরিমাণ সময় অন্তর অন্তর সেই খুঁটিটাকে ছুঁয়ে যেতে হবে – একে বলে তাল বা মিটার। যেন আপনার গতিবেগ ঠিক রাখার দক্ষতা ভুরু কুঁচকে মাপার জন্য সমান দূরত্ব অন্তর লাগানো আছে এক অদৃশ্য স্পীডোমিটার। তারপর আছে গানের স্কেল। গলার পিচ পরিবর্তন করে একই গান বিভিন্ন স্কেলে গাওয়া যায় যেন আপার মিশিগান ড্রাইভ আর লোয়ার মিশিগান ড্রাইভ দিয়ে একই গতিবেগে সমতানে গাড়ি চালানো। পথ এমনই অজস্র সমস্যা সঙ্কীর্ণ।
 
আমরা যারা লিফট-এ একা নামতে নামতে গলা খুলে গানের কলি ভাঁজি আর লিফটের দরজা খুললেই মুখে কুলুপ লাগাই অর্থাৎ আমরা যারা অ-গায়ক তাদের মধ্যে দু প্রকার লোক আছে। সুরের গোদা ম্যাপটা মোটামুটি সমস্ত মানুষই কম বেশি বুঝতে পারে। আমাদের মত সুর-নিরক্ষরদের মধ্যে এক প্রকার মানুষ হল যাদের সেই অদৃশ্য ম্যাপের সূক্ষ্মাতিসুক্ষ ব্যাপারগুলো, ফাইনার ডিটেলসগুলো ঠিক জানা থাকে না। তাই “সুর না সাজে ক্যা গাউঁ ম্যায়” অবস্থা। অন্য প্রকার এক ধরণের লোক আছে যারা সুরটা হয়তো বোঝে, অনাহত শব্দ বা অনুচ্চারিত শব্দ দিয়ে মাথার মধ্যে প্লে করতে পারে কিন্তু নিজের স্বর সাথ দেয় না। গলা দিয়ে গাইতে গেলেই দেখে রাস্তার কার্নিশে ধাক্কা খায় হামেশাই। গাড়ির এইখানটা তুবড়ে গেল, ওখানটায় স্ক্র্যাচ হল। অর্থাৎ কিনা ম্যাপটা জানে কিন্তু ম্যানুভার টেকনিকটা ভাল জানে না। স্বরসাধনা করা হয় নি। তাই নিজেই গেয়ে বুঝতে পারে ঠিক হচ্ছে না। আর একটা তৃতীয় প্রকার মানুষ অবশ্য আছে যাদের সুরের সেন্সও নেই, স্বরসাধনাও করা হয়নি। কিন্তু গানের গাড়ি চালালে এদিক ওদিক ধাক্কা যে খাচ্ছে সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই। কিন্তু তাদের কথা থাক। সুরের কথায় ফিরি। দুঃখের কথা হল এই সুরের সেন্সটা শ্রমসাধ্য নয়, কিছুটা জেনেটিক, কিছুটা জন্মসূত্রে পাওয়া। এর মানে এই নয় সুরের সেন্স ব্যাপারটা বাইনারি। হয় থাকে নয় থাকে না – এমন নয়। বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পীদের বিভিন্ন মাত্রায় সেটা থেকে থাকে। যার যত বেশি থাকে তারে তত স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভান্টেজ যেমন কার্গিল যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ছিল আর কি! অনুশীলনের মাধ্যমে কিছুটা পরিশীলন করাও সম্ভব। কিন্তু একটা বেসিক সেন্স থাকতে হয়। আর সেই বেসিক সেন্সটা কিছুতেই train করে আনা যায় না। অপরদিকে ম্যানুভার টেকনিকটা স্বরাভ্যাস বা voice training-এর মাধ্যমে পুরোপুরি শেখা সম্ভব, ক্রমশ উৎকর্ষসাধন সম্ভব আর সেটাই সঙ্গীতসাধনা। আসল গাড়ি নিয়ে রাস্তায় গড়াতে লাগে মাস তিনেক। তিন মাসের ট্রেনিং যথেষ্ট। সুরের পথে গানের গাড়ি চালাতে শিখতে তিরিশ বছরও যথেষ্ট নয়। কোন সহযাত্রীর সাথে মনমানি না করে, হর্ন না খেয়ে, ট্র্যাফিক সিগনাল মেনে, রাস্তার ধারের অদৃশ্য কঠিন দেওয়ালগুলোকে চুমু না খেয়ে, তালের স্পীডোমিটারের কাছে টিকিট না খেয়ে অব্যর্থ দক্ষতায় গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়াটা একটা বিশাল গোলমেলে ব্যাপার। অভ্যাসের সাথে সাথে সেই ড্রাইভিংটাও মসৃণ হয়, কিন্তু তারপরেও যে আপনি একবারও ফাউল করবেন না এমন নয়। এমনকি আসল গাড়ি চালানোর সময় আর একটা যেটা খেয়াল রাখতে হয় সেটা অন্য কেউ ভুল গাড়ি চালাচ্ছে কিনা খেয়াল রাখা আর চালালে নিজেকে পুনর্বিন্যস্ত করা, সেই সহযাত্রীর সাথে adjust করা। গানের ক্ষেত্রেও তবলাবাদক কি গীটার বাদক ভুল করলে আপনাকে adjust করতে হবে। রাস্তার শোল্ডারে দাঁড়িয়ে সহবাদককে শুধরে দেওয়ার সুযোগ নেই। ট্র্যাক শেষ করার আগে গান থামালে সুর তাল দুটোই কেটে যাবে। সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ভাবের যেমন বিন্যস্ত প্রকাশ হয় তেমনটা বোধ হয় অন্য কোন শিল্পতে হয় না। সঙ্গীতশিল্পকে তাই অনেক উঁচুদরের শিল্প ধরা হয়। সঙ্গীতশিল্পীদের কাজটাও সেরকমই কঠিন। মুক্তির পথ সম্বন্ধে বলা হয় “ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া দুর্গম্ পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি” অর্থাৎ মুক্তির পথ ক্ষুরের ধারের মত তীক্ষ্ণ, দুরধিগম্য ও কঠিন। সুরের পথও বোধ হয় অনেকটা সেরকম। একটু ভুলচুক হলেই সেই ক্ষুরের ধারে কেটে গিয়ে রক্তপাতের সম্ভাবনা। গান যারা করতে পারে তাদের প্রতি আমার অপার মুগ্ধতার কথা অনেকেই জানেন। শিকাগোল্যান্ডের আর আমার চেনা জানা অন্য সব সঙ্গীতশিল্পীদের প্রতি থাকুক আমার টুপি খুলে অভিবাদন।

কাগজের নৌকো – রম্যরচনা

আহা রে মন আহা রে মন আহারে মন আহারে আহা।

 

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি বউ বাড়ি নেই। দূরভাষযোগে জানা গেল মিশিগান হ্রদের সৈকতে হাওয়া খেতে গেছে। শীতের দেশে এই গরম কালের চারটে মাস সকলেরই ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। আমার এই শহরতলিতে তখন ফুরফুরে হাওয়ে বইছে। মিঠে। বাতাসে প্রথম প্রেমে পড়ার শিরশিরানি। কোএড কোচিং-এ পড়তে যাওয়ার আগে দশ-ক্লাস-অব্দি-বয়েজ-স্কুলে-পড়া মনের উথালপাতাল মনে। বাড়ির বাইরে মেঘের নরম তুলোট আদরে ঢেকে থাকা সুয্যিমামার লাজুক হাসি। মনের মধ্যে শবেবরাতের সন্ধে নামার খুশি। সবে এক কাপ চা বানিয়ে এমন গোধূলি লগনটাকে উপভোগ করতে বারান্দায় বেরিয়েছি, কাপের গরম সবুজ তরলে ঠোঁটের আলগা স্নেহ ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই ঝুপুস বৃষ্টি নামলো। সারাদিনের ফ্যা ফ্যা রোদ্দুরে বাড়ি-লাগোয়া কাঠফাটা কাঠের  উঠোনে বৃষ্টিকণাদের লুটোপুটি আর হুল্লুড় শুরু বিনা নোটিশে। বড় বড় ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে মাটি। শুষে নিচ্ছে সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদ। মনে পড়ে যাচ্ছে ছেলেবেলা। সেই খড়গপুরের ছোট্ট কোয়ার্টার। যেখানে জায়গা ছিল কম। শান্তি ছিল বেশি। মনে পড়ে যাচ্ছে হু হু রোদ-পোড়া দিনের শেষে কালবৈশাখী। ফটাফট্‌ অঙ্ক খাতার পাতা ছিঁড়ে সেই আয়তাকৃতি প্যাপিরাস দিয়ে বানিয়ে ফেলা কাগজের নৌকো। যেন কোন পূর্বজন্মের কথা। ভাঙাফাটা সিমেন্টের উঠোনের পশ্চিম দিকটা দিয়ে অঝোরে বয়ে যাচ্ছে জল। তখন আমার কাঁচা বয়স। অপু মন। সেই ঝরঝরিয়ে বয়ে চলা হঠাৎ-নির্ঝরিণীতে ভাসিয়ে দিচ্ছি পাটিগণিতের নৌকো। কেশব চন্দ্র নাগ দুলতে দুলতে ভেসে যাচ্ছে ঐ দূরে। এই জলে ভরে উঠল আমার মাঝিবিহীন কাগজের নৌকোর সংক্ষিপ্ত পরিসর। সে বেচারা ওপরের আর নিচের জলের চাপে পানকৌড়ি-ডুব দিল জলের মাঝে। আবার আর একটা নৌকো ছাড়লাম। এলোমেলো হাওয়া বয়ে চলেছে হরিণ শিশুর মত। সেই হাওয়ার অবিমৃষ্যকারিতায় একবার জলের ছাঁট এদিক থেকে আসে, তো পরের বার আসে ওদিক থেকে। তারে শুকোতে দেওয়া ভিজে জামা কাপড় ভিজে জাব। দে টান দে টান। সাগরের ওপার থেকে ভেসে আসছে মায়ের গলা- “বাবাই ঢুকিয়ে আন জামাকাপড় গুলো। সব ভিজে গেল রে। ঘরের সব জানলা বন্ধ কর রে”। তড়িঘড়ি ব্যস্ততা। কিন্তু সে সব মায়ের কাজ। আমার তাতে মন নেই। আমি আমার নৌকোর ভয়েজ দেখতে ব্যস্ত। ওই শুরু হল শিল পড়া। এক ছুট্টে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কদম গাছের নিচে। ঘন গন্ধ নিয়ে কদম ফুল গুলো ঝরে ঝরে পড়বে। ঝরে পড়বে কৃষ্ণচূড়া কুঁড়ি। সেই পুষ্পবৃষ্টির মাঝে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কোঁচড় ভরে কুড়িয়ে আনতে হবে। সারা সন্ধে ধরে বাড়িতে বসে আলতো নখের আদরে ফুটিয়ে তুলব ফুলগুলোকে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসবে খিচুড়ি-ডিমভাজার সুবাস আর একটা মা-মা গন্ধ। ওই তো ঝরঝরিয়ে শিল পড়া শুরু। তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মত কুড়োচ্ছি আর মুখে পুরছি। সত্যি, বরফেরও ওরকম স্বাদ হয়? পৃথিবীর আর এক প্রান্তে মৌরুসিপাট্টা জমিয়ে বসেছি। কিন্তু এই সাঁইত্রিশ বছরে দেখা চোদ্দটা ফ্রিজের কোনটার বরফে অতো স্বাদ পাইনি। কচরমচর করে চেবাও। মুখে অনাবিল আনন্দের ঝিলিক। বাড়িতে ঢুকেই শঙ্কিত-মায়ের-কড়া-বকুনির-সম্ভাবনার তৃপ্তি লেগে থাকে মুখে। একটা বড়সড় গোছের শিল মাথায় ঠাঁই করে পড়লেই ফুলে চাঁই। ওই যে শিউলিদের আম গাছটা থেকে টুকটাক করে পড়তে আরম্ভ করেছে শিশু ফল গুলো। ওদের অকালপ্রয়াণে আমার বালক মন আনন্দে শিহরিত। ছুট ছুট ছুট। আমগাছটার তলায় এসে ফটাফট্‌ দক্ষ হাতে কাঁচা আম কুড়োনোর বর্ষাপিয়াসী প্রসন্নতা। বাড়িতে ঢুকেই বৃষ্টি-অর্জিত সেই অমূল্য সম্পদগুলোকে ছাল ছাড়িয়ে হাল্কা নুনে জারিয়ে আমাদের সেই ছোট্ট ফ্রিজে শীতল শয়ন দেওয়া। আগামিকাল স্কুল থেকে ফিরে তার অম্লরসে জিভের স্বাদকোরকগুলোকে বিয়ে-বাড়ির-ফুর্তি-আর-রোশনাই প্রেরণ। সেই ছোট্টবেলার আমার শহরের জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচুড়া রাধাচূড়ার মত এই দূর প্রবাসেও আমার প্রতিবেশী, আমার দোরগোড়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চিরসখা দুটো দেবদারু গাছ। এখানে আদর করে ওদের বলে ক্রিস্টমাস ট্রি। কিন্তু সেই নামে ডাকলে আমার বাঙালি শহরতলীয় পরাণে কি দেবদারু নামের রোমান্টিকতা আসে? হাত-পা ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে গাছ দুটো একমনে। যেন এই মুহুর্তে বৃষ্টিতে ভেজাই ওদের একমাত্র কর্তব্য। পাতায় জলসিঞ্চন করা ছাড়া আর কোনো কাজেই তাদের উৎসাহ নেই।

 

হুড়ুদ্দুম করে ছপ্পড় ফাড়কে চিলগতিতে মিনিট পনের ধরে নেমে আসার পরে মেঘেদের ফাটল ফুড়ুত করে বন্ধ। আর তৎক্ষণাৎ শুরু এ পাড়ার পাখিদের বর্ষামঙ্গল গীতি। গোধূলির ঈষৎ রক্তিম আলোয় আর আর্দ্র মলয় সমীরে শরীর জুড়িয়ে গলা ফেড়ে একে অপরকে ডাকাডাকি। ওদের অবোধ্য ভাষায় ওরাও কি কাগজের নৌকোর কথাই বলছে? ভাবতে গিয়ে হঠাৎ বুঝতে পারলাম ছোটবেলার সেই কাগজের নৌকো বানানোর ম্যাজিক পদ্ধতিটা এই সুদীর্ঘ পথচলার কোনো বাঁকে ফেলে এসেছি, বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছি। এমন একটা প্রবাসী ক্ষণস্থায়ী কালবৈশাখী আমার জন্য অপেক্ষায় আছে জানলে কি ভুলতে পারতাম? যাই হোক কোই পরোয়া নেহি। পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারের বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে গেছে। ইউটিউবে ঢুকে ওরিগামি বলে খোঁজ করলে কাগজের নৌকো বানানোটা কি আর একবার মনে করিয়ে দেবে না? হয়তো বা। এখানে বাড়ির উঠোনে জল জমে না। বৃষ্টি হলে উঠোন-বাগান খরস্রোতা নদী হয়ে ওঠে না। তাতে কি? নৌকোটা আজ না ভাসিয়ে যদি পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিই? যদি আমার ডানা লোকানো ছোট্ট পরী, আমার কন্যাকে উপহার দিই? নিশ্চয় ও ওর বড় বড় খুশির ঝিলিক-ওলা চোখ নিয়ে হাত পেতে নেবে আর মিনমিনে অশ্রুত-প্রায় আধোআধো গলায় বলবে “হ্যাঁ বোত”।

আহা রে মন আহা রে মন আহারে মন আহারে আহা।

[ছবির নৌকোটা কিন্তু আমার এই লেখার পরে ইউটিউব ঘেঁটে আজই বানানো]

প্রবাস যন্ত্রণা – কবিতা

তোমারও কি প্রবাস যন্ত্রণা?

তোমারও কি মাঝে মাঝে

মন লাগে না কোনো কাজে

তাল কেটে যায় সুর লাগে না বীণায়?

 

তোমারও কি একলা বিকেল বেলায়

বাড়ির গলি মনে পড়ে

সামান্য মন কেমন করে

পসরা সাজিয়ে ভাসো স্মৃতির ভেলায়?

 

তোমারও কি ভোর বেলাতে কোনো

ঘুম চোখে ঘুম জড়িয়ে থাকে

হঠাৎ মনে পরে মা’কে

বিষণ্ন বিণ কোথায় বাজে যেন?

আজ বসন্ত – রম্যরচনা

আজ বসন্ত। দাপুটে শীতবুড়িকে এ বছরের মত অক্ষম করে দিয়ে আবার ফিরে এসেছে যুবতী বসন্ত। তার মোহময়ী যৌবনের ছোঁয়া লেগেছে সবখানে। গাছের ডালে ডালে ভিড় করে এসেছে কচি সবুজ শিশু পাতারা। বসন্তের ঋতু রঙ লেগেছে গাছেদের শরীরে। কিন্ডারগার্ডেনের একগাদা খুদে ওস্তাদের মত কচি কিশলয়রা খুশি খুশি মুখ করে ইতিউতি তাকাচ্ছে। ঘাসে ঘাসে ফুটে উঠেছে হলুদ ঘাসফুল। ড্যান্ডিলিয়ন নাম এর। ফুলেল পৃথিবীতে জাতবিচারে এরা নিতান্তই দলিত। একধরণের বুনো ফুল বলা যায়। কেউ আদর করে বাগানে লাগায় না। ভালবেসে জল দেয় না। একগোছা ড্যান্ডিলিয়ন ফুলদানিতে সাজিয়ে বা চুলে গুঁজে কেউ প্রিয় মানুষটির অপেক্ষা করে না। বরং উইড কন্ট্রোল লাগিয়ে বাগান থেকে উচ্ছেদ করারই’ রীতি। কেউ তারিফ করে না বলেই হয়তো রাস্তার ধারে ধারে অনাদরে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে এদের উদ্ধত আত্মপ্রকাশ। গাঢ় সবুজ ঘাসের বুকে হাজারে হাজারে ফুটে থাকা বাসন্তী হলুদ রঙা ড্যান্ডিলিয়নের কি যে অপরূপ শোভা তাকে শব্দে ধরা বোধ হয় আমার সাহিত্যপ্রতিভার অতীত। যেন কোন অদৃশ্য শিল্পী সবুজ ঘাস গালিচাতে হলুদ রং তুলি নিয়ে মাইলের পর মাইল জুড়ে এঁকেছে এক চোখ জুড়োন আলপনা। প্রতিটা ফুলেরই যেন একটা নিজস্ব স্বত্বা আছে, একটা পৃথক ব্যক্তিত্ব। মৃদু দখিনা হাওয়ায় খুশিতে মাথা দোলাচ্ছে কেউ কেউ। কোন কোন ফুল তার সুন্দরী সঙ্গিনীর সাথে প্রেমালিঙ্গনে বদ্ধ। কেউ ভাবুক চুপচাপ, কেউ নীরবে বাক্যালাপ করছে পার্শবর্তিনীর সাথে। অনেকক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলে একটা নেশার মত হয়। শুধু ওরাই নয়, রূপ-রঙ-রসের খেলায় মেতেছে আরও কতরকমের গাছ। ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে বিভিন্ন গুল্মরাজি – কেউ সাদা কেউ বেগুনী কেউ কমলা। ওদের চুপ ভাষায় কতরকমের ফিসফিসানি। এ বলছে আমায় দেখ, ও বলছে আমায়। নিজেকে আরও আকর্ষনীয় করে তুলতে কোন গাছ হয়তো সুগন্ধি মেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে পাশ দিয়ে গেলে অপূর্ব সুবাসে চলার গতি আপনা থেকেই শ্লথ হয়ে আসে। তখন বেশ টের পাই গাছের বুক কেমন করে গর্বে ফুলে ওঠে। ছবির মত সুন্দর ছোট ছোট একচালা বাড়িগুলোর পাশে পাশে কোথাও ফুটেছে হায়াসিন্থ, কোথাও টিউলিপ। সদ্য প্রস্ফুটিত আধো খোলা লাল হলুদ টিউলিপগুলোর মধ্যে কেমন যেন যৌবনে সবে সবে পা রাখা কিশোরীর লজ্জা। নিজেদের খুলে ধরার এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা ওদের মধ্যে। নীরব গুঞ্জনে মাথা নেড়ে নেড়ে টীনেজ টিউলিপরা একে অপরকে প্রথম প্রেমে পড়ার গল্প শোনাচ্ছে কি? হায়াসিন্থগুলো নিজেদের রঙের জৌলুসে গরবিনী। একটু কেমন চুপচাপ, একলা। হাজারে হাজারে ফুটেছে সাদা চেরি ব্লসম গুলো। এত ভিড় করে এসেছে যে মনে হচ্ছে সাদার আগুন লেগে গেছে চেরি গাছগুলোয়। কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে চোখ যেন ধুঁধলে যায়। গা ভর্তি পাতা আর ফুলের গয়না পড়ে অগুনতি গাছ আজ বসন্তে এই বিউটি কনটেস্টে নাম লিখিয়েছে। তিলোত্তমা উপাধি পেতে সবাই যেন বদ্ধ পরিকর। রং শুধু প্রকৃতির বুকে লাগে নি, রং লেগেছে পাখিদেরও মনে। কিচিরমিচির করে একটানা কথা বলে যাচ্ছে যেন এক যুগ ধরে তারা নীরব ছিল। একটা সবজে রঙা পাখি কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কোন ডালটায় বসা উচিত। ব্যস্ত হয়ে একডাল থেকে আর এক ডালে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। শীতের ঝাঁঝ কমার ফলেই ওদের উৎসাহে জোয়ার লেগেছে নতুন করে। আর একটা হলদে-গলা পাখি গাছের উঁচু ডালে বসে সমানে টিঁউ টিঁউ করে ডেকে যাচ্ছে। নির্লজ্জ ভঙ্গিতে গলা ফুলিয়ে সঙ্গিনীদের সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। একটা উৎসাহী কাঠবিড়ালি গাছের গুঁড়ি বেয়ে নেমে একবার করে জুলজুল চোখে তাকাচ্ছে, আবার কি ভেবে, বোধ করি সাহসের অভাবেই, গাছের গুঁড়ি বেয়ে আবার নিজের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাচ্ছে। এমন ত্রস্ত ভাব যেন কাউকেই তেমন বিশ্বাস করে না। সব মিলিয়ে প্রাণ লেগেছে সবখানে। প্রকৃতির পাত্র কানায় কানায় ভরে উঠেছে। প্রাণে টইটুম্বুর। শুরু হয়েছে এক অত্যাশ্চর্য মিলনখেলা। কালো ভোমরাগুলো সৃষ্টির বীজ নিয়ে ফুল থেকে ফুলে ঘুরছে। ফুলেদের গর্ভনিষেক হলেই তো আসবে পরবর্তী উদ্ভিদ প্রজন্ম। পৃথিবীর প্রাণের ইতিহাসে এই মানুষই নবীনতম প্রাণী। মানুষ আসার আগেও হাজার হাজার বছর ধরে নীল্গ্রহে এসেছে নির্জন বসন্ত। প্রকৃতি এরকমই রূপের ডালি সাজিয়ে বসেছে। কার জন্য? কোন মুগ্ধ চোখের অপেক্ষায়? আসলে এর পেছনেও আছে সিসৃক্ষা, সৃজনের ইচ্ছা। সৃষ্টি করার ইচ্ছাই বোধ হয় এই সৃষ্টির সবচেয়ে পাওয়ারফুল মোটিভ, সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাইভিং ফোর্স। প্রতিরূপ তৈরী করার ইচ্ছে নিয়েই প্রোটিন সেল কোষবিভাজন পদ্ধতিতে এক থেকে দুই হয়েছিল কোন এক বিস্মৃত অতীতে। সেই থেকে সমানে চলেছে। আসলে গাছেরা ফুলের ডালি সাজিয়ে বসে, ফুলেরা গন্ধ আতর মেখে বসে এক আদিম সৃজনেচ্ছা থেকেই। ওদের চোখের ভাষায় যে আহ্বান লেখা থাকে তা ইতিহাসের একেবারে শেষ অধ্যায়ে আসা মানুষ প্রজাতির মনোরঞ্জনের জন্য নয়। ওরা তো আকর্ষণ করতে চায় ঐ ভোমরাদের যারা ফুল থেকে ফুলে রেণু ছড়িয়ে দেবে। আর তার থেকে সৃষ্টি হবে নতুন প্রজন্ম। নতুনকে সৃষ্টি করার ইচ্ছে নিয়েই, প্রতিরূপ গড়ার ইচ্ছে থেকেই তাদের এই নির্লজ্জ আত্মবিপণন। পৃথিবীতে নতুনকে আনার জন্য আর সেই নতুনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা তো সকলেই রোজ নিজেকে বিক্রি করতে পসরা সাজিয়ে বসি। চাষজমির মাঠে, কারখানার ফ্লোরে শ্রম বিক্রি হয়, বহুতল অফিস বিল্ডিঙের ফ্লোরে বিক্রি হয় মেধা। নিজের থেকে উদ্ভিন্ন প্রাণকে আরও প্রবলতর মুক্তিবেগ দিতেই আমরা নিজেদেরকে আরও বেশি করে আকর্ষণীয় করে তুলি। সেই অর্থে তো আমাদের রোজই বসন্ত। তবু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বেড়াজালে আমাদের মুগ্ধতাকে তো বেঁধে ফেলা যায় না। তাই প্রতি বসন্তেই কবিরা কবিতা বাঁধে, কবিয়ালরা গান। যা কিছু নিঃশেষ, যা কিছু আবর্জনা তাকে পেছনে ফেলে রেখে প্রাচুর্যের আতিশয্যে সাজে আমাদের অন্তর, আমাদের বাহির।  

ফল – রম্যরচনা

[জানুয়ারী ২০, ২০১৮ -র স্মৃতিচারণ ]

পড়ার ব্যাপারে আমার একটা অসামান্য দক্ষতা আছে, একটা অবিশ্বাস্য নৈপুণ্য। এ কথা আমি বুক বাজিয়ে বলতে পারি। না না, পড়া মানে পড়াশুনোর কথা বা রীডিং স্কিলের কথা ভাববেন না। আমি যে পড়ার কথা বলছি সেটা মাটিতে পড়া। ইংরেজিতে যাকে বলে “ফল”। Fall বলতেই মনে পড়ল কোন এক গুরুতর ব্যক্তি বলেছিলেন “Don’t fall in love. Rise in love.” কিন্তু সে সব গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে আমরা এখন মাথা ঘামাব না। আমরা সকলেই সময়ে অসময়ে অল্প বিস্তর প্রেমে পড়ে থাকি। কোথায় কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসবে। তাই ওসব কথা থাক। আমি বলছিলাম ধপাস করে পড়ার কথা। হ্যাঁ এই বিষয়ে আমার বিস্তর জ্ঞানগম্যি, কিছু অনতিক্রম্য রেকর্ডও আছে। আমি জীবনে বহুবার পড়েছি। কখনো গাছের ডাল থেকে, কখন বাড়ির ছাদ থেকে, কখনো খাট থেকে, কখনো সিঁড়ি থেকে। কিন্তু সপাটে পড়ার ফলস্বরুপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাতে পায়ে প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে যে একটা গোদা মতন ভাস্কর্য শিল্প করা হয় সেটা কৌশলে এড়িয়ে গেছি। অর্থাৎ প্রভূত পরিমাণ পড়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও অঙ্গহানি হয়নি, হাত পা ভাঙে নি কখনো। যে নারী সূর্যের মুখ দেখেনি তাকে যদি অসূর্যম্পশ্যা বলা হয়, তাহলে আমার হাত-পা গুলোকে অ-প্লাস্টার-পশ্যা বলা যেতে পারে। নির্দয় পাঠক যদি এতক্ষণে নাক সিঁটকে বলছেন যে “তাহলে আপনি পড়ার মত করে পড়েন নি কখনো” – তাহলে ভুল ভাবছেন। কয়েকটা উদাহরণ দিই। পুরাণমতে বালখিল্য মুনিরা গাছে ঝুলে থাকত। তো তাই থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে কিনা কে জানে, বাল্যকালে আমি একটা বালখিল্যপনা প্রায়ই করে থাকতাম। একটা তেঁতুল গাছের টঙে চড়ে তার একটা ডালে জড়িয়ে থাকা একটা মোটাসোটা লতার ওপর বসে দোল খেতাম। লতাটা বার্ধক্যজনিত কারণে একটু দুর্বল হয়ে পড়লেও আমার অত্যাচার নীরবে সহ্য করত। উপায়ই বা কি? মানুষের মত চেঁচিয়ে নিজের অধিকার আদায় করতে আর কোন জীবই বা পারে। মুস্কিল হল একদিন দোল খেতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম। লতা (না না মঙ্গেস্কর নয়, তিনি দীর্ঘজীবি হন এই কামনা করি) দেহ রাখল। সঙ্গে সঙ্গে আমি নিউটনের আপেলের মত পুরো 9.8 m/s^2  ত্বরণের সাথে এসে মাটি ছুঁলাম তা প্রায় দোতলা বাড়ির মত উচ্চতা থেকে। জামাটামা ছিঁড়ে, পিঠে হাতে ছড়েটড়ে গিয়ে যাকে বলে আমার তখন একেবারে নববধুর মত রক্তিম অবস্থা। কিন্তু না অঙ্গহানি হয় নি। হাত পা কোমর ইত্যাদি ইন ট্যাক্ট। যেই কে সেই। অন্য একটা মনে পড়ছে। স্কুল কম্পাউন্ডে লুকোচুরি খেলা হচ্ছে। আমি চোর। বাকি বন্ধুরা বিভিন্ন অভুতপূর্ব জায়গায় লুকিয়ে অতর্কিতে ধাপ্পা দেওয়ার জন্য প্রহর গুনছে। একটা কমন জায়গা ছিল স্কুলের বাথরুমের ছাদ। না, সেখানে যাওয়ার জন্য সিঁড়িটিড়ি কিছু ছিল না। একটা পাঁচিল, তার এই পাশে বাথরুম, আর ঐ পাশে একটা পুকুর। ওই পাঁচিলে উঠে ছাদের থেকে দাঁত বের করে থাকা দুটো ইঁটকে ধরে ঝুলে পড়ে একটা পা কোন মতে বাথরুমের ছাদে রাখতে পারলেই হাঁটু আর দুই হাতের চাপে বাকি বডিটাকে ছাদে টেনে তুলে ফেলা যেত। হ্যাঁ এই ধরনের কাজকর্ম তো কুঁচোকাঁচারা করেই থাকে। না হলে তাদের যে অবশ্য কর্তব্য, বাবা মাদের চিন্তায় ফেলা, সেটা করতে কিভাবে সমর্থ হবে? এ তো গেল যারা লুকোচ্ছে তাদের কথা। যে চোর সে ওইভাবে ওপরে উঠতে গেলে অবধারিত ধাপ্পা হয়ে যাবে। যে লুকিয়েছে তার সেটাই strategic advantage। কার্গিলের যুদ্ধে পাক সেনাদের যেমন ছিল আর কি! তাই চোরকে ওই ইঁট দুটো ধরেই পাঁচিলের ওপর থেকে ছোট ছোট লাফ দিয়ে ছাদে কেউ লুকিয়ে আছে কিনা আর থাকলে সেটা কে বুঝতে হবে। ধাপ্পা হয়ে গিয়ে পুনরায় চোর জন্ম আর কেই বা চায়। তো সেবারে আমি চোর। তো ইঁট ধরে দিলাম ছোট্ট লাফ। কিন্তু ইঁট দুটো বহুল ব্যাবহারে বোধ হয় প্রায় খুলে এসেছিল। লাফের উর্ধগতি শেষ হয়ে যখন অধঃপতন শুরু হল দেখলাম ইঁট দুটো ছাদের কার্নিশ থেকে খুলে আমার সাথেই fall করছে বা আমাকে follow করছে বলা যেতে পারে। স্বভাবতই দু খানা আধলা ইঁট দু হাতে নিয়ে নামতে হবে এমনটা ভেবে লাফটা শুরু করিনি। হিসেবে গরমিল হয়ে পা দুটো পাঁচিলের ওপরে নেমে আর স্থির হল না। পাঁচিলের ওধারে পুকুরের দিকে তরতরিয়ে নেমে চলল। ফলাফল আমি পাঁচিলের ওপর উপুর হয়ে, পা পুকুরের দিকে আর মাথা স্কুল কম্পাউন্ডের বাথরুমের দিকে, হাতে দুটো আধলা ইঁট শক্ত করে ধরা। দুখানা ইঁটের সাথে এমনতর সহপতনে কোমর-টোমর অনেক সময়েই…বাট না। As usual, No অঙ্গহানি। এ ছাড়া আরও অনেক বাঁদরামির ফলে বিভিন্ন রকম “ফ্রী ফল”-এর সম্মুখিন হয়েছি। একটা বকুল গাছের ডাল ছিল বেশ স্থিতিস্থস্পক। ওটা ধরে ঝুলে পড়লে স্কুলের ছাদ থেকে বেশ তাড়াতাড়ি নেমে আসা যেত। নিচে নেমে ছেড়ে দিলেই ডালটা ব্যাক টু ছাদ। ছোটবেলায় সময়ের বড়ই অভাব ছিল। তাই ওই করে প্রায়ই কিছু সময়ের সাশ্রয় করতাম। সে পাজি ডালখানাও একদিন বিশ্বাসঘাতকতা করে ভেঙ্গে গিয়ে মাটিতে সজোরে ফেলেছিল। এ ছাড়া খাট থেকে পড়েছি। সিঁড়ি থেকে আকছার পড়েছি। সবক্ষেত্রেই হাত-পা-মাথা ইত্যাদি যে অঙ্গগুলো প্রায়ই কাজে লাগে সেগুলো ইন-ট্যাক্ট রেখেছি।

 

যাক গে যাক, প্রশ্ন হল পড়ার প্রসঙ্গ এল কেমনে? এই জন্য এল যে আজকে আবার পড়েছি। একেবারে যাকে বলে সজোরে, সপাটে। না, লুকোচুরি কি কুমিরডাঙা খেলতে গিয়ে কি গাছে উঠে দোল খেতে গিয়ে নয়, সে সুখের দিনগুলো বোধ হয় আর ফিরে আসবে না। লাগামহারা শৈশবের দিনগুলোকে আজীবনের মত দ্বীপান্তরে পাঠিয়েছি সে বহুকাল হল। এখন শুধু কর্তব্যেস্মিন কুরু। সকাল সকাল রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে অদৃশ্য কর্পোরেট মুখোশ পড়ে বেরিয়ে পড়লাম অফিসের পথে। বাড়ি থেকে বড় রাস্তা মোটে দু তিন মিনিট। সেখান থেকে বাস। গতকাল সকালেও এই রাস্তাটুকু সাদা নরম পালকের মত বরফের চাদরে ঢাকা ছিল। সেই কচি-কাঁচা বরফেরা আজ পেকেছে অর্থাৎ জমে হয়ে গেছে “ব্ল্যাক আইস”। সাপের পিঠে চড়েছেন? চড়েন নি? আমিও চড়ি নি। আশীর্বাদ করবেন যেন সেরকম ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা না হয়। কিন্তু সে জীবটি যেভাবে সরসরিয়ে ভূমিপথে যায় তাতে মনে হয় ওদের ত্বকটা লোভনীয় রকমের পিচ্ছিল। আজ রাস্তার অবস্থা তার থেকেও বাজে। আনকোরা নতুন পাথরের মেঝেতে খানিকটা মোবিল ঢেলে দিলে ঠিক যেমনটা হবে আর কি? প্রতি মুহুর্তে পদস্খলনের সম্ভাবনা। ছিঁচকে চোরেদের মত পা টিপে টিপে চলেও গড়ে প্রতি চারটে পদক্ষেপের একটা ঠিক প্ল্যানমাফিক হচ্ছে না। ফেলার সাথে সাথেই সাপের মত সরসরিয়ে আর একটু এগিয়ে যাচ্ছে। টীনএজার ছেলেমেয়েদের যেভাবে সামলে সুমলে রাখতে হয় সেই ভাবে পা দুটোকে  কড়া শাসনে রেখেও তাদের মতিস্থির রাখা যাচ্ছে না। অনেক কসরত আর জিমনাস্টিক-এর সাহায্যে বাসস্টপে পৌঁছে গেলাম। প্রায় গোটা সাত আটেক বার ভূমির আকর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তখন আমি ভূমায় উড়ছি। ভাবলাম আজকের মত ফাঁড়া কাটল। কিন্তু বিধি বাম। রাস্তায় কালো বরফের এমনই মসৃন পাতলা আবরণ, যে গাড়িরা সকলেই গজগামিনী আজ – ৪৫ মাইলের রাস্তায় মেরেকেটে ২০ তে চালাচ্ছে। এদিক ওদিক থেকে গাড়ি স্কিড করার আওয়াজ ভেসে আসছে। যে বাসটা আমায় রেল স্টেশান অব্দি বহন করে সে সুন্দরী যুবতীর মতই মুডি। কোনদিন সাতটা পঞ্চাশে দর্শন দেয় তো কোনদিন আটটায়। যাদের বিদেশ সম্বন্ধে এই ধারণা আছে যে ট্রেন বাস সব সময়মত চলে তাঁরা ধারণাটা এই বেলা বদলে নিন। এই হিমেল শীতের দিনে বাসটার গরম বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়ার জন্য যতই আকুলিবিকুলি করি ও ততই দেরি করে কাছে আসে। আজকেও মিনিট দশেক অপেক্ষার পর সে সুন্দরীর দর্শন মিলল। কাছে এসে সে কিন্তু না দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলল। বুঝলাম বাস-এর ব্রেক ধরছে না। ফুট কতক এগিয়ে গিয়ে সবে যখন সে থামবে থামবে করছে, আর আমিও প্রিয়ার বুকের গরম নিতে পিচ রাস্তায় নেমে পড়েছি, তখনি ঘটনাটা ঘটল। ডান পা-টা আমার নির্দেশ উপেক্ষা করে সরসরিয়ে সোজা সামনে খানিক এগিয়ে তারপর উর্ধমুখে চলল আর আমার কোমর থেকে মাথা অব্দি চলল নিচের দিকে। একেবারে যাকে বলে পিছলে পপাত ধরণী তলে। পুরো ধরাশয়ী হওয়ার পরেও দেখলাম আমার গতিরুদ্ধ হয়নি। আমি পিছলে বাস-এর পেছনের চাকার নিচে চলে গেছি প্রায়। এরপর না থামলে রীতিমত রসিকতা হয়ে যাবে। বাসপৃষ্ট হয়ে পথচারীর মৃত্যুর খবরটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই প্রাণপনে হাত দিয়ে হ্যাঁচড়-পাঁচড় করে ঐ বরফাবৃত রাস্তাকে আঁচড়ে-কামড়ে শরীরটা বাসের চাকার তলায় যাওয়ার যে বিপজ্জনক প্রবণতা দেখিয়েছিল সেটাকে রুখলাম। গতিরুদ্ধ হল বটে কিন্তু ঘটনাটার আকস্মিকতায় আর অভিনবত্বে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বহু কষ্টে উঠে যখন বাসের ভেতরে সেঁধোলাম, ততক্ষনে স্নায়ু পেশী ইত্যাদি জানান দিচ্ছে যে এই অকস্মাৎ অধঃপতন তাদের মোটেই পছন্দ হয় নি। বাস ড্রাইভার দিদি গম্ভীর মুখ করে জানতে চাইলেন “Do u need medical attention?” মুখ দিয়ে আমার বাক্যস্ফুর্তি হল না। মাথা নেড়ে জানালাম “না”। কোমর আর ডান হাতের কনুই তখন ঝালায় বাজচ্ছে। স্টেশান অব্দি মিনিট পাঁচেকের বাসযাত্রা আমার। বাস-এ আসন গ্রহণ করে ভাবলাম স্টেশানে পৌঁছে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারি তখন ডাক্তার সন্দর্শনে যাওয়া যাবে। বাস থামলে নিজের পায়েই দাঁড়ালাম। ট্রেন ধরে শহরে পৌঁছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অফিস পথগামী হয়ে এত আনন্দ হল যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জলতরঙ্গ বাজাচ্ছিল যে পথশিল্পীটা তাকে একটা কড়কড়ে এক ডলারের নোট দিয়ে ফেললাম। ততক্ষণে পুরো ডানদিক টাটিয়ে গেছে। প্রথমের যে যন্ত্রণা ঝিনিক ঝিনিক করে বাজছিল সেটা চলে গিয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকের মত একটা একটানা একঘেয়ে যন্ত্রণা। সে হোক। হাত-পা-কোমর তো এবারেও ভাঙেনি। পড়ে হাত-পা না ভাঙার রেকর্ডটা এখনো অক্ষত। তার থেকেও বড় ব্যাপার – বাসের চাকার তলাতেও শরীরের দুচারটে পার্ট খোয়াইনি। সব কিছুর ইতিবাচক দিকটা দেখলেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। কোন এক গুণীজন বলেছিলেন মানুষের সবচেয়ে বেশি মনোবেদনার কারণগুলোকে নিয়ে রসিকতা করলে বেদনার ভার লাঘব হয়। অফিস থেকে ফিরে এখন আমার সারা গায়ে প্রবল ব্যাথা। একটা পেনকিলার খেয়েছিলাম অফিসেই। তা ভাবলাম গুনীজনেদের উপদেশ অনুসরণ করে আমার এই গাত্রবেদনা নিয়ে রসিকতা করে এটা কিছু কমানো যায় কিনা। পেনকিলার না খেয়ে শুধু রসিকতা করেই যদি এই গাত্রদাহ কিছু কমে তবে মন্দ নয়, কি বলুন?

ট্রেনপথে – রম্যরচনা

[২০ নভেম্বর, ২০১৭-এর স্মৃতিচারণ ]

 

কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়লেই চোখে পড়ে বাংলার সবুজ সুন্দর সহজিয়া রুপ। আমাদের মত  যারা কর্পোরেট কালচারে অভ্যস্ত ব্যস্ত শহুরে প্রাণী, তাদের এই বর্ধমান কি দুর্গাপুর যাওয়ার পথে, ঐ আকাশের পাড় পর্যন্ত আঁকা সবুজে আল্পনার থেকে বেশি প্রকৃতিস্নান ভাগ্যে লেখা নেই। একটা কংক্রিট জঙ্গল থেকে আর একটাতে যাওয়ার পথে উপোসী চোখ দিয়ে জানালা পথে যতটুকু সবুজের সন্ধান করে ফেরা সম্ভব আর কি! তাও চারচাকা বাহনটির বদান্যতা মিললে সেটুকুও হয়ে ওঠে না। সে বড় উদ্ধত যান। তার ভিতরে ঢুকলেই ঘষা কাচ তুলে দিয়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মিঠে স্নেহপরশ মেখে চোখ মুদে থাকি। অধিকাংশ সময়েই বিশ্বস্ত বাহনটি হাজির থাকে। কিন্তু এবারে বাড়ির গাড়িটা না পাওয়া যাওয়ায় অগত্যা ট্রেন পথে বর্ধমানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নারকেল গাছের সঙ্গে কলাগাছ জড়াজড়ি, মাখামাখি করে মিলেমিশে আছে যেন কতো প্রাচীন এক বন্ধুত্ব। পানায় ভরা পুকুর রেল লাইনের ধারে ধারে। তাতে অজস্র শালুক ফুল অযত্নে ফুটে আছে। কি একটা অজানা কারণে এই অনন্য রুপসী ফুলগুলো মানুষের সর্বগ্রাসী গৃধ্নুতার হাত থেকে আজও বেঁচে আছে। বাজারের ফুলের দোকানে এদের দেখা মেলে না। মাতৃক্রোড় থেকে তুলে নিলেই ফুলগুলো বড় তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। তাই বোধ হয় বাজারি মর্যাদা পায় নি। আমরা যারা মফস্বলের মানুষ তারা বোধ হয় ছোট বেলায় বকুল, কদম, শালুক ফুল নিজের হাতে তোলার আনন্দ পেয়েছে। যারা কলকাতায় মানুষ, বড় শহরে মানুষ, তারা আর্সালানের বিরিয়ানি, পার্ক স্ট্রীটের পিটার ক্যাটের চেলো কাবাব খেতে খেতে অনেক কিছু, অনেক কিছু মিস করে গেছে। একটু এগোতেই দেখা গেল টালির চালের বাড়ি। ওপরে কুমড়ো লতা। তাতে একটা হলদে কুমড়ো ফুল লাজুক চোখে চেয়ে আছে। আহা তার কি শোভা। অন্যান্য কবিদের মত বাংলাকে যদি কখনও কোনো নারীরূপে কল্পনা করি, যে মেয়েটার ছবি মনে আসে সে ফর্সা, উজ্জল, গৌরবর্ণা চটকদার সুন্দরী নয়, ডানাকাটা পরী নয় – শ্যামলা রঙের ডাগর চোখের মিতভাষী কোনো মেয়ে। জানি এই গ্রাম বাংলার মানুষগুলো আর এই মায়াময় রুপসী প্রকৃতির মত সুন্দর নির্বিবাদী নয়। বিশ্বায়ন, বাণিজ্যায়ন, রাজনীতি, বহির্বিশ্বের হাতছানি প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে জনজীবনের রুপরেখা। কিন্তু এই যে গাছ, ধানখেত, মেঠো রাস্তা, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা বক যারা ইন্টারনেটের তীব্র দহনে নিত্য ব্যতিব্যস্ত নয়, তাদের মধ্যে দিয়ে বোধ হয় আজ সেই মাথায় এক ঢাল চুলওলা ছিপছিপে সুন্দরী বাঙালি মেয়েটা, বাংলার স্বত্বাটি বসে থাকবে। এই মায়ারই আকর্ষণে কবিরা বারে বারে সৃষ্টি করেছে নীরা, বনলতা সেনদের। যাবতীয় নাগরিক ক্লান্তি আর শহুরে বিষাদ থেকে দু দণ্ডের শান্তি পেতে বারে বারে ছুটে যেতে চেয়েছেন এই মায়াবী মানবীর কাছে। এখন বর্ষাকাল নয়। কিন্তু বঙ্গোপসাগর ব্যাপী নিম্নচাপ অসময়ে সঘন মেঘমালায় আকাশ ছেয়ে দিয়েছে। সদ্যবৃস্টিস্নাত সর্ষে খেতে যেন কোনো সদ্য যুবতীর মুগ্ধ চোখের মাদকতা। তাল আর নারকেল গাছেরা এক জলজ বিষণ্নতা চোখে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। পাশেই একটা ছোট্ট জলা জায়গা। ডোবা বলা চলে। একটা মাছরাঙ্গা পাখি তার পাড়ে সন্ধানী চোখে চুপ করে বসে আছে। চোখে তার আলগোছে টানা রূপটান। আর একটু এগোতেই রেললাইনের ধারে একটা ছোট্ট গ্রাম। কিছু একচালা বাড়ি। একটা পুকুর। কিছু হাস মুর্গি পুকুর পাড়ে দল বেধে বসে গুষ্ঠিসুখ উপভোগ করছে। অকালবৃষ্টিতে পর্যুদস্ত সদ্য বোনা ধানের চারাগুলো তাদের কচি মাথা দোলাচ্ছে। পুকুরপাড়ে কিছু পঁচিশ-তিরিশ বছরের বিবাহিত মেয়ে বসে বাসন মাজছে। আটোসাঁটো করে পরা শাড়ীর ভিতর থেকে লাউডগার মত লকলকে যৌবন চলকে পড়ছে। হয়ত এর মধ্যে কোনো কাব্য নেই। হয়তো এ কঠোর জীবনসংগ্রাম। কিন্তু সেইভাবে দেখতে গেলে এই ক্রুরা কঠোরা পৃথিবী সবটাই কঠোর গদ্যময়। এর মধ্যে যেটুকু কাব্য আমরা খুঁজে নিই সেইটুকু আমাদের নিজেদেরই প্রয়োজন, নিজেরই মনের স্নানের জল জোগানোর প্রয়োজনে।

এইসবই হাবিজাবি ভাবছিলাম। হঠাৎ এক অন্ধ বেসুরো গায়কের গানের আওয়াজে  ঘোর কাটল।

“সে যে গান শুনিয়ে ছিল হয় নি সেদিন শোনা। সে গানের পরশ লেগে হৃদয় হল সোনা।

চেনা শোনা জানার মাঝে কিছুই চিনি না যে। অচেনায় হারাল মন আবার ফিরে এসে।”

আজ হঠাৎ গানটা বড়ো প্রাসঙ্গিক মনে হল। সামান্য আর্থিক সঙ্গতি বাড়লেই এই কলকাতা-বর্ধমান কি কলকাতা-খড়গপুর টাইপ স্বল্প দূরত্বের ট্রেনপথগুলো অচেনা হয়ে যায়। সেই অচেনা পথেই যদি একদিন সফর করা হয়, সুর হারাব বলেই যদি একদিন গান সুরে বাঁধা হয় সেটাকে উপভোগ করার মন কি আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি? boyhood থেকে adulthood-এ পৌঁছনোর ঠিক কোন বাঁকে আমাদের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা, মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতাটুকু ফেলে রেখে আসি সেইটে শুধু ভেবে পাই না। Antibiotic খাওয়ার সাথে সাথে যেমন শরীরমধ্যস্থ ব্যাকটেরিয়াদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে থাকে ঠিক সেভাবেই মুগ্ধ হওয়ার যে সহজাত ক্ষমতা একটা শিশুর থাকে, বয়ঃপ্রাপ্তির সাথে সাথে মন যত পেকে ঝুনো হয়, ততই মন রূপ-resistant হয়ে যায়। তখন মানালি শহরে বিপাশার জলে পা ডুবিয়ে মনে হয় আল্পস না দেখলে পাহাড়ের রূপ কিছু দেখাই হল না। গোয়ার সমুদ্র সৈকতে বসে মনে হবে ফুকেটে সমুদ্রস্নান না করলে কোনো মজা নেই। Way of living-এর ওপর অনেক talk শুনেছেন, সপ্তাহখানেকের কোর্সও কেউ কেউ attend করেছেন। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানেন, বয়সের সাথে সাথে মুগ্ধতা, বিস্ময় এ সবের প্রতি আমাদের যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, ওটাকে রুখে দেওয়ার সচেতন বা অবচেতন নিয়ত চেষ্টা করাই রক্তচাপ, irritability, hypertension কমানোর সব চেয়ে ভাল উপায়। মনটাকে আর একটু গ্রহণক্ষম, receptive রাখলেই দেখবেন অজস্র ছোট্ট রঙ্গিন জলফড়িঙদের মত খুচরো খুচরো আনন্দের উৎস আপনার চারপাশে লুকোচুরি খেলছে। Quality আনন্দ একেবারে বিনামূল্যে অফার করাই আছে আপনাকে। খুঁজে নিতে পারলেই হল। যদি আমাদের কোন পুরনো স্মৃতিই না থাকত, প্রতিদিনই যদি একটা আনকোরা নতুন দিন হত, প্রতিটা সূর্যোদয় দেখেই যদি সেই প্রথম সূর্যোদয় দেখার মত শিহরণ হত, তবে কি ভালই না হত। তাই না?

এই ভাবে সবুজের বুক চিরে ট্রেন যখন বর্ধমান ছুঁলো তখন স্বপ্নভঙ্গের মত ঘুম ভাঙ্গাল কর্কশ গলায় চিৎকার “ভাঁড়ে চা ভাঁড়ে চা।” বর্ধমান স্টেশানে তড়িঘড়ি নেমে টোটো করে যাত্রা শ্বশুরবাড়ির পথে। ছোটবেলায় মা বলত “পড়াশুনো নেই, খালি টোটো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”এই বুড়ো বয়সে কথাটা যেভাবে আক্ষরিক অর্থে ফলে গেছে তাতে মাকে নস্ত্রাদামুস-এর ছোটবোন বলা যেতেই পারে।এই বায়ুদুষণরহিত, শব্দদুষণরহিত battery driven ত্রিচক্রযানটি শহরতলি অঞ্চলে বহুল জনপ্রিয় এখন। তিন-পেয়ে অটোর এই নির্বিবাদী ছোট ভাইকে মানুষ আদর করে নাম দিয়েছে টোটো। সারাদিন তাই অনায়াসেই এখন টোটো করে যত্রতত্র ঘোরা যায়। যাওয়ার পথে একটা বাড়ির নাম চোখে পড়লো “মুকুল-রাঙা”। মিস্টি নামখানা। ইঁট-কাঠ-পাথরের শুকনো মরুভূমির মধ্যে সুন্দর নামখানা নিয়ে মরূদ্যানের মত দাঁড়িয়ে আছে যেন বাড়িখানা। অনেকক্ষন ধরে ঐ সুন্দর নামখানা মনের মধ্যে সুর ছড়াতে লাগলো। এই বাড়িটার বাসিন্দারাও কি বাড়ির নামের মতই সুন্দর না জীবন যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত, irritated? কে জানে। অন্তত সেই মানুষটা, যিনি বাড়ির নামখানা মুকুল-রাঙা রেখেছিলেন, তিনি অন্তত কালবৈশাখীর ঝড়ে কুচো আম কুড়োতে বেরোন কি আজও? এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পৌছে গেলাম গন্তব্যে। বেশ কাটলো ঘন্টা খানেক। মানুষের কাছাকাছি। মানুষের পাশাপাশি।

****

বাধ্যতামূলক সতর্কীকরণঃ যযাতির ঝুলির সব লেখাই শতাধিক বার ফেসবুকে শেয়ার হয় সেটা তো সুধী পাঠক বা প্রিয়দর্শিনী পাঠিকা নিচের ফেসবুক শেয়ার বাটন দেখে বুঝতেই পারছেন। এত অকুণ্ঠ ভালবাসা দেওয়ার জন্য পাঠক পাঠিকাকে যযাতির আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আপনিও শেয়ার করুন। কিন্তু শেয়ার করার আগে নিচের কমেন্ট বক্সে (বেনামী হোক বা নাম সহ) একটি মন্তব্য ছেড়ে যান যাতে যযাতি তার যজমানদের একটু চিনতে পারে। যযাতি তার ফেসবুক পেজের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। পোস্ট ভাল না লাগলে আপনাকে ছাড় দেওয়া হবে, কিন্তু ভাল লাগলে কমেন্ট না করে শুধু শেয়ার করলে যযাতির অভিশাপে (বিবাহিত হলে দাম্পত্য কলহজনিত কারণে আর অবিবাহিত হলে বাবা মার দাম্পত্য কলহজনিত কারণে) আগামী রবিবার রবিবাসরীয় লুচি তরকারি থেকে বঞ্চিত হবেন।

 
যযাতির ঝুলি টাটকা তাজা
ইমেলে পেলে ভারি মজা

 

সাইকেল বিহার – রম্যরচনা

[এই স্মৃতিচারণটি আমার নিজের শহর রামরাজাতলার ওপর। কিন্তু যেকোনো শহরতলির মানুষ আশা করি রিলেট করতে পারবেন। ১৫ নভেম্বর, ২০১৭-এর স্মৃতিচারণ ]

কদিন হল নিজের শহরে এসেছি। আজ সারাদিন বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোই নি। পুরোদিন বাড়িতে বসে শুষে নিয়েছি স্মৃতিগন্ধবাহী রূপকথাদের।

সারাদিন বাড়িতে বসে বসে হাতে পায়ে কেমন একটা জং ধরে যায় না? বেরিয়ে পড়লাম আমার প্রিয় সাইকেলটা নিয়ে। আমি ছাড়া আমাদের বাড়িতে আর কেউ সাইকেল চালানোর নেই। আগে বাবা চালাতো। এখন বয়স হয়েছে। আর সাইকেল চালায় না। বাবার এখন পদব্রজেই বিস্তার। দাদাও সঙ্গত কারণেই মোটর বাইকে শিফট করে গেছে। তাই প্রতি বছর দেশে ফিরলেই দেখি সাইকেলটা দুয়োরানির মত এক কোণে পড়ে আছে। কালিঝুলি মাখা জীর্ণ অবস্থা। আমি সাইকেলটাকে যা একটু প্যাম্পার করি। নিয়ে গিয়ে বাচ্চুদার দোকানে ফেললেই এক বেলার মধে চক্‌চকে স্মার্ট। এন-আর-আই  দেখে বাচ্চুদাও একশো টাকা হাঁকিয়ে বসে। দরাদরি করাটা কোনোদিনই আমি ঠিক ভাল পারি না। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে একটি পাতা ধরিয়ে বাহনটিকে হস্তগত করি। সেই সাইকেলটা নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাব কিছু ঠিক না করেই প্যাডেলে চাপ দিয়ে আমি সাইকেল আরোহি। বিনা কারণেই দুবার বেলটা টিপে দিই। টুং টুং টুং টুং। কি মিঠে শব্দটা। পথচারীদের পথ ছেড়ে দেওয়ার জন্য কি সুশীল, বিনীত অনুরোধ। যেন দুটো টুনটুনির ফিরিঙ ফিরিঙ প্রেমালাপ। বাইকের উদ্ধত হর্ন যদি ইয়ো ইয়ো হানি সিং হয় তবে এ যেন রাখালিয়া বাঁশি। এই সাইকেল চালানোটা আসলে আমার একটা style statement। মায়ের বুকের স্তন্যদুগ্ধের মত এই সবুজ গ্রহের বুক থেকে শুষে আনা ফসিল ফুয়েলের অবিরত অপচয়ের সামনে দাড়িয়ে এই যে মন্দগতি অথচ শব্দদুষণ, বায়ুদুষণরহিত যানটি – এ যেন এই উত্তুঙ্গ, তিল তিল করে আত্মহননের পথযাত্রী সভ্যতার বুকে একটা কড়া থাপ্পড়। আমি যখন সাইকেল আরোহি, দেখি এক অদৃশ্য placard লাগানো আছে আমার handle-এ “এই পৃথিবী আমায় একটু বেশি  ভালবাসে কারণ আমি আমার চলার পথের পাথেয় স্বততই তার স্তন্যদুগ্ধ পান করে সংগ্রহ করি না”।

 

আমাদের রামতলার রাস্তায় সাইকেল চালানোর জন্য যে gymnastic skill আয়ত্ত করার দরকার পড়ে সেটা রীতিমতো আয়াসসাধ্য – দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়ে সেটা আয়ত্ত করতে হয়। আপনার সাইকেলের পূর্ব-পশ্চিম-ঈশান-নৈঋত সব দিশাতেই ইঞ্চিখানেকের দূরত্বে নিশ্বাস ফেলছে বাইক, রিকশা, চারচাকা আর পদচারীরা। হাওড়ার গলিগালা, বড়রাস্তা সকলই কিঞ্চিত সরু, অপরিসর। এ কথা সকলেই জানে। আর বহুতল ফ্ল্যাটবাড়িগুলো আগমনের সাথে সাথে মানুষ যেভাবে বেড়েছে সেভাবে রাস্তাগুলো পেটমোটা হবার সুযোগ পায় নি। নিজেদের শীর্ণ ক্লীশ শরীর নিয়ে মানুষের পদভারে নীরবে ত্রাহি ত্রাহি করছে তারা। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বরূপ ইদানিং যোগ হয়েছে টোটো। শব্দহীন এই ত্রিচক্রযানটিও আপনার আগে-পিছে-ডাইনে-বাঁয়ে, শিশু প্রহ্লাদের ইষ্ট নারায়ণের মতই, সর্বত্র বিদ্যমান। এ হেন পরিস্থিতিতে গতিশীল সবরকম যানবাহনের মধ্যে একটা নির্ভুল সুষমা বজায় রেখে এবং অভিকর্ষের নিরন্তর ডাককে উপেক্ষা করে এই দ্বিচক্রযানের পিঠে করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা শিল্পকলা বললে বোধ হয় সত্যের অপলাপ হবে না। আমি নিশ্চিত রামতলায় যারা সাইকেল চালাতে পারে তাদের কোন বিলিতি সার্কাসে ওই দড়ির ওপর দিয়ে সাইকেল চালানো ইত্যাদি খেলায় অবলীলায় সুযোগ মিলতে পারে। তার ওপর আছে পান থেকে চুন খসলেই যাকে বলে হেভি বাওয়াল। এই দ্রুতগতি জীবনের সাথে পা মিলিয়ে চলতে থাকা অসহিষ্ণু ক্লান্ত মানুষগুলির মুখ থেকে একটু এদিক ওদিক হলেই বেরিয়ে পড়ছে দু অক্ষরের সেই লিঙ্গসূচক শব্দটি। মনুষ্যজাতীয় প্রাণীর সাথে যদি বা সমতান বজায় রাখতে পারেন, চতুষ্পদদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রাখা আর একটা শিল্প। একটু ফাঁকা গলি হলেই এ পাড়া ভার্সেস ও পাড়ার কুকুর মন্ডলীর gang fight-এর মধ্যে পড়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। আপনাকে “ইস্পাতের মত মজবুত আর ঠান্ডা স্নায়ু” যাকে বলে “নার্ভ অফ স্টীল” বজায় রেখে শক্ত হাতে একটা optimum স্পিড-এ তাদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এরা সাধারণত কামড়ায় না কিন্তু যেভাবে উচ্চৈঃস্বরে নিজের এলাকার দখলদারির সরব দাবি জানায় তাতে কামড়াবে না এই ভরসা রাখাটা যে সহজ নয় সেটা সহজেই অনুমেয়।

 

এইভাবে হেমন্তের মিঠে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে সাইকেলে চেপে পথ বাইতে বাইতে রামতলা বাজার পেরিয়ে সাঁতরাগাছি মোড় পেরিয়ে নতুন রাস্তার মোড়। তখন পথের নেশা চেপে বসেছে। প্যাডেল করতে করতে দালালপুকুর। কয়েকটা অতিকায় গাছ ঝুঁকে পড়ে ঐ ক্ষুদ্র জলাশয়টিকে যেন সভ্যতার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থেকে সশস্ত্র প্রহরীর মতই রক্ষা করছে। আর একটু এগিয়ে গেলে কিছু বছর আগে হলেও পেতেন পার্বতী সিনেমা আর তার একটু পরে শ্যামাশ্রী সিনেমা। কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পপকর্ন সমৃদ্ধ multiplex – এর যুগে আজকাল এই ধরনের একক ছবিঘরেরা, whatsup এর যুগে নিতান্ত টেলিগ্রামের মতই, outdated। আমাদের রামতলার শ্যামলী সিনেমা, যেখানে আমার মনে থাকা বয়সের প্রথম ছায়াছবি kingkong and godzilla দেখেছি, তার মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। এই সিনেমা হল দুটো বৃদ্ধ হেঁপো রুগির মত বেঁচে থাকার লড়াইটা চালিয়েছিল অনেকদিন। সভ্যতার অভিঘাতে মারা গেছে বছর দুয়েক হল। স্বর্গত শ্যামাশ্রী সিনেমা পেরিয়ে চলতে চলতে যখন মল্লিক ফটক পৌঁছলাম তখন মনে হল এতদূর এলাম যখন গঙ্গার ঘাটটা দেখে যাব না? অতএব ফের প্যাডেলে চাপ। মল্লিকফটক পেরিয়ে গঙ্গাগামী হলেই আপনি দেখবেন একটা সম্পূর্ণ অন্য সভ্যতা, এক অচেনা পরিবেশ। আলো ঝলমল, দোকানে দোকানে ছয়লাপ শহুরে সভ্যতা হঠাৎ যেন মৃত্যুগর্ভে বিলীন। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। এই এলাকাটি মূলতঃ হিন্দি ভাষাভাষী অবাঙ্গালী অধ্যুষিত। বিহার থেকে জীবিকার সন্ধানে কয়েক পুরুষ আগে এরা এখানে এসেছে। এই কয়েক পুরুষেও জীবন যুদ্ধে খুব একটা সফল যে হতে পারেনি তার পরিচয় মিলবে বাড়ি-ঘর-দোর-দোকানপাটের চেহারা দেখে। আর্থিকভাবে অনুন্নত এই এলাকাটা একটা মিনি বিহার বলা চলে। পার্থক্য একটাই। এরা প্রায় প্রত্যেকেই ঝরঝরে বাংলা বলতে পারে প্রয়োজনে। সন্ধ্যে নটার পরে গেলে যদি কান খাড়া রাখেন দু এক কলি “রামা হৈ” কি হনুমান চালিশা শুনতে পাবেন। কিছু নির্বিবাদী মানুষ খালি গায়ে বসে লিট্টী সহযোগে নৈশভোজ সম্পন্ন করছে দেখতে পাবেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই গোটা ছয়েক ছাতুর সরবতের স্টল স্পট করে ফেলতে অসুবিধে হবে না। কখনো সুযোগ হলে একবার চেখে দেখবেন। আমাদের Cafe Coffee Days-এর চারশো টাকার পানীয়ের তুলনায় এই দশ টাকার (এখন বোধ হয় কুড়ি) ছাতুর শরবৎ লেবু আর মশলার ঝাঁজে খুব একটা কম সুস্বাদু নয়। শেষমেশ একটু-আধটু রাস্তা গুলিয়ে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা বাঁক ঘুরতেই আসন্ন সেই সুবিস্তীর্ণ গঙ্গা। সাইকেলটাকে stand করে দাঁড়াই। এখানে গঙ্গার রূপ কিন্তু স্বচ্ছসলিলা, পূণ্যতোয়া নয়। সেই হরদুয়ার থেকে এই আগ্রাসী সভ্যতার উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করতে করতে এইখানে এসে তার ক্লান্ত জীর্ণ রূপটি চোখে পড়ে। হরিদ্বারের পায়ে নূপুর পরা কিশোরী গঙ্গা এইখানে এসে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েছে। পুরো এক জীবনের অবসাদ। কিন্তু তাতে কি? এই যে সুদীর্ঘ পাচ হাজার বছর ধরে এই আর্য-অনার্য সভ্যতাকে মায়ের মত মমতায় লালন করল? সেই মাতৃস্বরূপার পরম স্নেহপরশটি পেতে হলে বুক ভরে শ্বাস নিন। নিঃশ্বাসের সঙ্গে মনের সব জঞ্জাল বের করে ঐ গঙ্গাজলে মনে মনে সঁপে দিন। সারা উত্তর ভারতের জঞ্জাল নিয়েছেন যিনি আপনারটাও নেবেন। নিরাশ করবেন না।  আজ আবার কার্তিক পূজোর বিসর্জনের দিন। একটা বড়সড় কার্তিক ঠাকুর এল ভ্যানে করে। ধুপ ধুনো দিয়ে হাতে মিস্টির প্যাকেট ধরিয়ে চিবুকে চুমু খেয়ে তাকে বিদায় করছে বিবাহিত মহিলারা। এই মাটির প্রতিমার প্রতি কি অপ্রতিম সন্তান স্নেহ। এখন সঙ্গত কারণেই জলে প্রতিমা বিসর্জন নিষেধ। গঙ্গাপাড়ে নামিয়ে যাওয়াই দস্তুর। যতক্ষণ এই বিদায়পর্ব চলল চারটে অর্ধনগ্ন ছেলে এসে দাড়িয়ে রইলো যেন মৃত্যুপথযাত্রী কোনো প্রাণীর আশেপাশে ভিড় করা শকুন। জীবনযুদ্ধে পরাভূত সমাজের প্রতিনিধি এরা মৃন্ময় দেবতার হাতে মিস্টির প্যাকেটের বিলাসিতা সহ্য করতে অপারগ। বিসর্জনে আসা মানুষগুলো চলে গেলেই কার্তিক ঠাকুরকে দেওয়া সব জাগতিক সম্পদ এই জ্যান্ত কার্তিকরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। বিসর্জনে আসা মানুষগুলোর কথাবার্তা একটু আধটু কানে এল। কানে এল বললে একটু মিথ্যে বলা হবে। আমার একটু আড়ি পাতা স্বভাব আছে। বিশ্বাস করুন কারও ক্ষতি করার জন্য নয়, অন্যের বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরী করতে সম্পূর্ণ অচেনা লোকেদের কথা কখনো সখনো চেখে থাকি।  ধর্মবিশ্বাসী লোকগুলো বলাবলি করছে কার বাড়িতে জোড়া কার্তিক ফেলার ফলে যমজ ছেলে হয়েছে। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় কিন্তু সভ্যতার আলো যত উজ্জ্বলতর হয়েছে তত এই ধরণের কার্য-কারণ সম্বন্ধে আস্থা রাখা হয়েছে দুঃসাধ্য।

 

অবশেষে গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া অনেকটা ফুসফুসে ভরে নিয়ে ফেরতা পথে সাইকেল ধরলাম। হিসেব করে দেখলাম ফেরার পথটা হবে পাঁচ কিমির কিছু বেশি। যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় দশ কিমি। ভাবছেন উরিব্বাস এ তো অনেকটা পথ? আমি কোনো অতিমানব নই, sportsman-ও নই, বছরে একবারই দেশে ফিরে সাইকেলে চড়ি – আসলে দশ কিমি সাইকেল চালানোটা আদৌ কোনো শক্ত ব্যাপার নয়। মেন্টাল ব্লক আর আপনার ভটভটি অর্থাৎ মোটর বাইকটিকে একদিনের জন্য নির্বাসন দিলেই দেখবেন কাজটা জলের মত সোজা। আর ঐ যে বললাম – দূষণ না ছড়ানোর জন্য এই পৃথিবীই আপনাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করবে, সাহস জোগাবে। ফেরার পথে আর একটা procession দেখলাম যে মিছিলটায় আমাদের সবাইকে একদিন না একদিন সামিল হতে হয়। যত খেদ, ঘৃণা মানসিক কলুষ, যত মিথ্যা জৌলুস সব পিছনে ফেলে রেখে হরিধ্বনি দিতে দিতে আর  বিন্নি খৈ ছড়াতে ছড়াতে আমাদের সবাইকে উত্তর পুরুষ পৌছে দেবে আমদের অন্তিম শয়ানে। তবে কেন এত হিংসা, প্রতিযোগিতা শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান? রামতলা বাজার দিয়ে ফেরার পথে হঠাৎই চোখে পড়ে গেল নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে দোকানের নাম “জয়নগরের মোয়া”। সাইকেলের ব্রেকটা কোন শালা টিপল ঠিক জানিনা। কিন্তু দেখলাম দোকানের সামনে আমি সাইকেল থেকে নেমে দণ্ডায়মান। আশি টাকায় আটটা জয়নগরের মোয়া (মানে আদতে রামতলারই। কিন্তু ঐটুকু ব্র্যান্ডিং না করলে আমি দাঁড়াতাম বলুন?) কিনে বাড়ি ঢুকলাম যখন তখন সাড়ে নটা। দেড় ঘন্টার সাইকেল সফরে প্রাণ-মন চাঙ্গা। আজকাল শপিং মল-এ হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে আনন্দ কেনাই দস্তুর। তার বিরুদ্ধে সওয়াল করছি না। কিন্তু মাঝে মাঝে এ ভাবেও আনন্দ কেনা যায়। সাইকেলের maintenance cost টা যদি না ধরেন, মোট খরচা আশি টাকা আর বেশ কিছুটা ক্যালরি যেটা কিনা আমার মধ্যপ্রদেশের প্রগতি রুখতে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে। অবিশ্যি মোয়াগুলো খেয়ে সেটা মেকআপ হয়ে যাবে। কারণ বাঙালির প্রায় পরিচয়পত্র স্বরূপ নোয়াপাতি ভুঁড়ি নিয়ে যাকে বলে “No Compromise”!!

আঠেরোর শুভেচ্ছা

দেখতে দেখতে একটা বছর ঘুরে গেল আবারও
কেমন কাটলো? দুই শুন্যি সতের?
যযাতির ঝুলির বছর কাটলো…মন্দ না তা ভালই
পাঠকের ভালবাসায় ভিজে যযাতি জমকালোই।
সংগে থাকুন, তুলুন গাছে গল্পগরু স্বেচ্ছায়
আঠেরো সাল হেসে কাটুক যযাতির শুভেচ্ছায়।।

যযাতির ঝুলির প্রথম পোষ্ট হয়েছিল ৩১ শে জানুয়ারী, ২০১৭। অতএব যযাতির ঝুলি এখনো এক বছর পূর্ণ করে নি। এর মধ্যেই যযাতির ঝুলি পাঠকদের অভুতপূর্ব ভালবাসা পেয়েছে। জুন কিম্বা জুলাই-এর গোড়ার দিকে ব্লগস্পট থেকে ওয়ার্ডপ্রেসে নিয়ে আসা হয়েছিল যযাতির ঝুলি। এর মধ্যেই শুধু ওয়ার্ডপ্রেসে যযাতির ঝুলি ভিজিট করেছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি পাঠক-পাঠিকা। অর্থাৎ কিনা ব্লগস্পটের ভিজিট আর ওয়ার্ডপ্রেসের ভিজিট যোগ করলে দশ হাজার পেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। অফিসিয়াল ফেসবুক শেয়ার বাটন বলছে বেশিরভাগ লেখাই শতাধিক বার শেয়ার হয় এফ-বি তে। পঞ্চাশের ওপর ডাইরেক্ট ফলোয়ার আছে। এফ-বি পেজ ফলো করেন সহস্রাধিক।

যে সকল সুধী পাঠক ও পাঠিকারা যযাতির ঝুলিকে এত ভালবাসা দিলেন তাদের সকলকে যযাতির তরফ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং নতুন বছরের শুভেচ্ছা। যযাতির এই সামান্য প্রচেষ্টায় আপনাদের উৎসাহই একমাত্র পাথেয়। আশা করি আগামী দিনেও আপনারা পাশে থাকবেন। যযাতির ঝুলির লেখায় মন্তব্য করে ভুল-ঠিক ধরিয়ে দেবেন। কি ধরণের লেখা পড়তে আগ্রহী সে বিষয়ে যযাতিকে ফিডব্যাক দেবেন। সর্বোপরি আপনি যদি ব্লগটিকে ডাইরেক্ট ইমেল সাবস্ক্রাইব করতে চান সাইড বারে কি বটম বারে তার সুযোগ পাবেন। ভয় নেই – মাসে দু থেকে তিনটে পোস্টই করা হয়। একগাদা বস্তাপচা লেখা আপনার মেলবক্সে পাঠিয়ে বিরক্ত করা হবে না কোনদিনও – এটা যযাতির প্রতিশ্রুতি। আর যদি নিতান্তই তা না করতে চান যযাতির ঝুলির ফেসবুক পেজে জুড়ে যান কিম্বা আর-এস -এস ফীড সাবস্ক্রাইব করুন যাতে নতুন পোস্টের খবর পেতে পারেন। যদিও যযাতি চায় তার ফেসবুক পেজের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে।

এইরকমই অকৃত্রিম ভালবাসার সাথে নতুন বছরেও সঙ্গে থাকুন যযাতির ঝুলির। আর সঙ্গে থাকুন মানুষের – ধর্ম-জাতি-বর্ণ বিভেদ ভুলে :-)। আমি, আপনি, আমরা সবাই সাহিত্যচর্চা করি এই আশা নিয়ে যে একদিন সমস্ত বিভেদ, অসূয়া ভুলে মানুষ ঈশ্বর হবেই। যাই হোক, আপনাদের জন্য ঝুলি থেকে কোয়ালিটি গল্প, কবিতা, রম্যরচনা, স্মৃতিকথা বেরোবে নিয়মিত। আবারও বলি নিয়মিত লেখা দেওয়া হবে কিন্তু ঘন ঘন দেওয়া হবে না কারণ যযাতির ঝুলি এত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে যে লেখার গুণগত মান নিয়ে সচেতন থাকা আবশ্যিক। তাই ইচ্ছে হলে ইমেল কি আর-এস-এস ফীড সাবস্ক্রাইব করতেই পারেন। স্প্যাম করা হবে না।

বাঘ দেখে এলুম – হালুম

পরিবার ধর্ম পালন করতে শীতের রাত্তিরে বাঘ দেখতে গেলাম। শীতল শিকাগোর বড় পর্দায় চড়েছে “এক যে ছিল বাঘ” ছবিটির সিকুয়েল “বাঘ এখনও বেঁচে আছে”। বাইরে তখন কুচি কুচি বরফ পড়ছে। পারদ বলছে তাপমাত্রা ঋনাত্মক বারো। যাই হোক বাঘ দেখতে গেলে একটু আধটু কষ্ট তো সহ্য করতেই হয়। তাই গেলাম। ছবিটা চমৎকার। একটু বিশদে যেতে হচ্ছে তাই।

প্রথমেই বলি মানুষের নাম বাঘ, সিংহ, হাতি, গরু, ছাগল ইত্যাদি মনুষ্যেতর জীব হোক – এ আমার ঘোরতর অপছন্দ। তাই আপনাদের অনুমতি নিয়ে টাইগার ওরফে বাঘবাবুকে আমি এখন থেকে বাগবাবু বলে ডাকব। বেশ একটা বাঙ্গালি বাঙ্গালি নাম হবে। সিরিয়ার বর্ডারে তখন ভীষণ সিরিয়াস কেস। পঁচিশ জন ভারতীয় আর পনেরটা পাকিস্তানি সেবিকাকে দিয়ে নিজের সেবা করিয়ে নিচ্ছেন বাগের দাদি, আই মীন, বাগদাদি। উনি যে সে কেউ নন, আই-এস-সি বলে এক সন্ত্রাস সংস্থার পুরপ্রধান। না না আই-এস-সি মানে ইন্ডিয়ান স্কুল সার্ভিস টাইপ্স কিছু নয়, এটা গল্প লেখকের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত আইসিস-এর ছদ্মনাম। এদিকে মার্কিন মন্ত্রক মাত্র সাত দিন সময় দিয়েছে। সাত দিন পরে বোম মেরে পুরো শহর উড়িয়ে দেবে। সাতদিনের মধ্যে উদ্ধার করতে না পারলে বন্দী নার্সরা সব ছবি হয়ে যাবে। তো আমাদের বাগবাবু হলেন গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা raw-এর এজেন্ট। তবে প্রাক্তন আর কি! এখন চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় উনি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আই-এস-আই-এর এক প্রাক্তন এজেন্ট এক ক্ষীণকটি সুন্দরীকে সাত পাকে বেঁধে মানে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করে ইউরোপের কোন এক “ছবির মত সুন্দর” শহরে কিঞ্চিত দাম্পত্য অশান্তিতে আর কিঞ্চিত সুন্দরীসঙ্গলাভ জনিত সুখে কালাতিপাত করছিলেন। বাগদাদির কবলে পড়া নার্সদের দুর্গতি দূর করতে আমাদের বাগবাবু ছাড়া তো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার গতি নেই। তাই তলব পড়ে তাঁর। ওদিকে বাগবাবু তখন “বাঘের বাচ্চা”-কে নিয়ে অর্থাত কিনা জুনিয়র টাইগারকে নিয়ে পাহাড়ে স্কিয়িং করতে গিয়ে নেকড়ের কবলে পড়ে সিংহ বিক্রমে (“বাঘবিক্রমে” বলে কথা হয় কি? হলে সেটাই উপযুক্ত হবে) লড়াই করে শেষমেশ গোটা দশেক (সংখ্যাটা ভুল হলে মাপ করবেন, ঠিক গুনিনি) নেকড়েকে মেরে ফ্ল্যাট করে দিলেন। “লাস্ট বাট নট দি লীস্ট নেকড়ে”-টাকে যখন গাড়িবন্দি করে ফেললেন ততক্ষণে রক্ত পুরো গরম যাকে বলে পিয়োর অ্যাড্রিনালিন রাস। ওদিকে ওনার ক্ষীণকটি সুন্দরী সহধর্মিণী কিছু কম ক্যারিস্মাটিক নন। সি সি টি ভি ক্যামেরা একদিক থেকে আর একদিকে ঘুরে তাঁর দিকে ফিরে আসতে যতটুকু সময় লাগে সেইটুকু সময়ের মধ্যে গোটা চারেক ছিনতাইকারীকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করে ফেললেন একটা মুদিখানার দোকানে। সি-সি-টি-ভি তে সুন্দরীর জিরো ফুটেজ। নো এভিডেন্স। প্রাক্তন হোক কি বর্তমান, এজেন্ট যখন তখন কিছু গোপনীয়তা তো বজায় রাখতেই হবে। তাই এই তৎপরতা। যাই হোক শেষমেশ বাগবাবু পঁচিশটা নার্সকে উদ্ধার করার অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়েই ফেললেন। পরে তাঁর ভুবনমোহিনী স্ত্রীটিও পাকিস্তানি নার্সদের বাঁচাতে অকুস্থলে পৌঁছে যায়। তারপরে সে ভীষণ গোলমাল। ধুন্ধুমার কাণ্ড। প্ল্যান হল বাগবাবু সহ বাকি ভারতীয় এজেন্টরা তেল পরিশোধনাগারে চাকরি নেবেন এবং তারপরে একটি “কন্ট্রোল্ড ব্লাস্ট” অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ করে তাতে পুড়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন। না না বাগবাবু ও তার টীম আসলে পুড়বেন না। মোটা করে অ্যান্টি ফায়ার জেল মেখে বিন্দাস থাকবেন। শুধু সেই সুযোগে ঐ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ঢুকে পড়বেন যেখানে বাকি সব রুগী রুগিনিদের ঝেঁটিয়ে বের করে দিয়ে বাগদাদিবাবু নার্সদের দিয়ে নিজের নার্সিং করাচ্ছেন। একবার হাসপাতালে ঢুকতে পারলেই কেল্লা ফতে। গোটা পঞ্চাশেক আর্মড ম্যানকে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি করানো বাগবাবুকা “বাঁয়ে হাত কা খেল”। শুধু একটাই মুস্কিল। তাঁর স্ত্রীকেও ওই পনেরখানা পাকিস্তানি সেবিকাকে উদ্ধার করতে দিতে হবে। তাই বাগবাবু অসাধ্য সাধন করলেন। ওনার ক্যালিবারের লোকের পক্ষেই এরকম ডিপ্লোম্যাটিক ফিট অ্যাচীভ করা সম্ভব। উনি একেবারে যাকে বলে সাপে নেউলে সম্পর্ক RAW আর ISI কে একসাথে কাজ করতে রাজি করিয়ে ফেললেন। জয়েন্ট অপারেশান হলে দু দলেরই লক্ষলাভ হবে। কোন দেশেরই বিদেশ মন্ত্রকের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হল না। অফ কোর্স আমাদের বাগবাবুর ওপর সারা দেশ ভরসা করে, বিদেশ মন্ত্রক কোন ছাড়! যাই হোক অপারেশানটা শুরু হওয়ার আগেই একটু কেঁচে গেল। আইসিসের তরফে তের বছরের একটা বাচ্চা ছেলে, হিউমান বম্ব হিসেবে ভরা বাজারে নিজেকে ওড়াতে গিয়ে পড়বি তো পড় পড়ে গেল বাগবাবুর সামনে। অপারেশান নার্সোদ্ধার গেল ভার মে। আমাদের বাগবাবু “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই” বাণীতে বিশ্বাসী। উনি লেগে পড়লেন হিউম্যান বম্ব হাসানকে উদ্ধার করতে। আইসিস-এর জঙ্গিরাই বা ছাড়বে কেন? ব্যাস উদম ক্যাঁচাল শুরু হল। হেভি মারামারি কাটাকাটি। সেই গোলমালে raw-এর ইরাকস্থিত একজন “deep asset” (কি যেন নাম ভুলে গেছি) খরচা হয়ে গেল। গেল তো গেল। বাগবাবু তো আছে। কোই পরোয়া নেহি। ভেবেছিলাম এর ফলে প্ল্যানে অন্তত কোন পরিবর্তন হবে কারণ “সিক্রেট raw এজেন্ট”-এর গোপনীয়তা তখন প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। ততক্ষণে শ দেড়েক জঙ্গির সাথে গান ফাইট, হাতাহাতি, ম্যান্ডেটরি কার চেজ সবই করে ফেলেছেন বাগবাবু। একেবারে খুলে আম করেছেন। অমন সুন্দর মুখ তিনি ঢাকতে যাবেনই বা কেন? কিন্তু ফরচুনেটলি বাগবাবুর প্রকৃত পরিচয় মোটেই টের পায় না জঙ্গি সংগঠন। সেটা বাগবাবুর ম্যাজিকাল চার্মও হতে পারে, আইসিস-এর বিরাট ইন্টেলিজেন্স ফেলিয়োরও বলতে পারেন, কিম্বা গল্পলেখকের মাথায় আসে নি সেটাও হতে পারে। যাই হোক প্ল্যানমাফিক তেলকলে বিস্ফোরণ করতে গিয়েও ভারতীয় দল প্রায় ধরা পড়ে যায় আর কি? বাধা দিতে আসলে আবার জঙ্গিদেরকে মেরে তুলোধোনা করে দেন বাগবাবু। তাতেও তাঁর প্রকৃত পরিচয় মোটেই উদ্ঘাটন হয় না। আইসিসের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড বাবু যখন তেলকলে আগুন লাগানোর দায়ে ভারতীয় দলের সব সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দিতে যায় তখন আর এক ছদ্মবেশী র এজেন্টের ছলাচাতুরীতে রক্ষা পায় বাগ অ্যান্ড কোং। তারপর পোড়ার ক্ষতর চিকিৎসা করতে ঢুকে পড়ে হাসপাতালে। যদিও হেঁটে হেঁটে যেভাবে “শান সে” ভারতীয় গোয়েন্দারা হাসপাতালে ঢুকলেন, তাতে মনে হল কোনরকম চিকিৎসা না হলেও দিব্যি চলে যেত তাঁদের। যাই হোক এবার দরকার হাসপাতালের একটা নক্সা। আই-এস-আই-এর এজেন্ট, বাগবাবুর সেই সুন্দরী পত্নী, সে দায়িত্ব পালন করলেন চওড়া কাঁধে। সেখানেও তিনি হেভি পেটালেন জঙ্গিদের। সিটি হল থেকে সেই ম্যাপ যোগাড় করতে গিয়ে আলুর দোষ যুক্ত আইসিসের সেই সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ডকে খরচা করে দিলেন। এবারে কিন্তু তিনি সেই মুদিখানার দোকানে গুণ্ডা পেটানোর মত ভাগ্যবতী ছিলেন না। সি-সি-টি-ভি ফুটেজে ধরা পড়ে বাগদাদির হাতে বন্দী হলেন। ওদিকে আমাদের হিরো বাগবাবু ততক্ষণে ম্যাচ প্রায় মেরে এনেছেন। ফুড পয়জনিং করিয়ে, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অর্ধেক জঙ্গিকে ঘুম পাড়িয়ে আর অর্ধেক জঙ্গিকে আমেরিকান সেনাবাহিনীকে টাইট দিতে অন্যত্র পাঠিয়ে বাসে করে নার্সদের নিয়ে প্রায় শহর থেকে বেরিয়ে গেছেন, এমন সময় দেখলেন বাগদাদি তাঁর সুন্দরী প্রাণাধিকাকে বেঁধে-টেধে ভরা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে বাসন্তী স্টাইলে পরিবেশিত আমাদের সকলের চোখের মনি ক্যাটরিনা। তাঁর ক্যাট আইয়ের সম্মোহন বাগবাবু রিয়েল লাইফেও অস্বীকার করতে পারেন নি, রীল লাইফেও পারলেন না। অতএব নার্স উদ্ধার টেম্পোরারিলি মায়ের ভোগে। বৌকে বাঁচাতে সমস্ত নার্সসহ, ইন্ডিয়ান আর পাকিস্তানি এলীট গোয়েন্দাসহ ধরা দিলেন বাগদাদীর হাতে। মেয়েরা চিরকালই গণ্ডগোল পাকিয়েছে। রামায়ণ, মহাভারতের মত দুটো মহাযুদ্ধ হয়ে গেল নারীর সম্মান রক্ষার্থে। এখানেও সেই সুন্দরীই গেরো হয়ে দাঁড়ালো। যাই হোক, বাগদাদী কিন্তু ওদের প্রাণে মারলেন না। দয়ার শরীর তাঁর। একটা অসউইজের গ্যাস চেম্বার টাইপ্স কিছু একটার মধ্যে বাগবাবুকে ফেলে দিয়ে তাঁর সুন্দরী বৌকে নিয়ে চলে গেলেন। কিছু একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে টুঁড়ে গেলেন মনে হয়। বাগবাবুও ছুঁড়লেন পালটা চ্যালেঞ্জ। এদিকে আজকেই সপ্তম দিন। সময় কমে আসছে। মার্কিনিরা মাত্র আধ ঘণ্টা সময় দিয়েছে। তারপরেই বোম মেরে সকলকে হালকা করে দেবে। তাই আবার শুরু ফাটাফাটি মারপিট। বাগবাবু খালি গায়ে প্রচুর জঙ্গিদের আবার প্রচুর মারধোর করলেন। শোনা যায় বাগবাবু ওরফে সল্লু ভাই ছবিতে পুরো অভিনয়ের জন্য অর্ধেক টাকা নেন আর জামা খোলার জন্য বাকি অর্ধেক। তার নিযুত কোটি অনুরাগিণীরা তার বডি-সডি দেখতে শুনেছি ভীষণ ভালবাসেন। সে অন্য কথা। শেষমেশ বাগ দাদা বাগদাদীকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেললেন। তারপর সব নার্স, হোস্টেজ সকলকে ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি এজেন্টদের হাতে দিয়ে বাগ দাদা গেলেন বৌকে বাঁচাতে। মার্কিনি মিসাইলের ধ্বংসলীলা শুরু হওয়ার মিনিট খানেক আগে ফাইনালি বাস ভর্তি সকলে সেফ জোনে পৌঁছে যান বাগবাবুকে ছাড়াই। সেখানে ইন্ডিয়ান পাকিস্তানি এজেন্টদের একেবারে গলাগলি মাখামাখি ভাব। ISI-এর এজেন্ট ভারতের পতাকা তুলছে, RAW-এর এজেন্টরা  পাকিস্তানি পতাকা তুলতে উৎসাহ দিচ্ছে – সে একেবারে জমে ক্ষীর। বাগবাবু এদিকে তাঁর ক্যাট-আই প্রাণাধিকাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন হাসপাতালের গোপন গহ্বরে। পরিচালক অবশ্যই বাগবাবুকে মেরে ফেলে আপামর ভারতবাসীকে চোখের জলে ভাসাতে চান নি। তাছাড়া প্রযোজকবাবু নিশ্চয়ই আর একটা “ব্লক ব্লাস্টার সিকুয়েল”-এর স্বপ্ন দেখছিলেন। তবে হুড়মুড় করে বোম পড়তে থাকা শহর থেকে বাগবাবু কিভাবে উদ্ধার পাবেন সেটা দেখানোর চাপ পরিচালক মশাই অবিশ্যি আর নেননি। ভালই হয়েছে। অলরেডি বাগবাবুর বিক্রম দেখে ফেলেছি প্রায় ঘণ্টা তিনেক। আরও দেখলে গুরুপাক হয়ে যেত। শুধু বছর ঘুরলে দেখা যায় সস্ত্রীক বাগবাবু অন্য এক ইউরোপিয়ান শহরে নদীর জলে পা ডুবিয়ে ফুর্তি করছেন। ছবি সমাপ্ত।

নাম দেখানোর সময় একটু নাচাগানা হল। ক্যাটরিনাদেবী সারা বছর ধরে দিনে শুধু দুটো করে লঙ্কা পোড়া খেয়ে অমন মোহিনী শরীর বানিয়েছেন, অমন লোভনীয় পাতলি কোমর বানিয়েছেন – তা ওনারও তো একটু সখ হতে পারে একটু গানের তালে কোমর দোলানোর। তাছাড়া নার্সরাও সব উদ্ধার পেয়ে গেছে। অতঃপর ঢিঙ্কা চিকা।

সব মিলিয়ে ভীষণই মনোরঞ্জক ছবি – টাইগার জিন্দা হ্যায়। শুধু টাইগারবাবু হেভি গান ফাইটের সময় একটু বুলেট প্রুফ টুফ পরে নিলে, আইসিস-এর একেবারে খোদ মুলুকে গিয়ে শুরু থেকেই হাঙ্গামা না মাচিয়ে আর একটু গোপনীয়তা অবলম্বনের চেষ্টা করলে এমনকি সন্ত্রাস সংস্থার প্রধান বাগদাদীবাবু যিনি কিনা মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার জন্য একেবারে “হাই ভ্যালু টার্গেট” তিনি যদি একেবারে খুলে-আম রাস্তায় না ঘুরতেন, একটু গোপনীয়তা অবলম্বনের চেষ্টা করতেন তবে হয়তো ছবিটা আরেকটু সহ্য করা যেত।      

****   

বাধ্যতামূলক সতর্কীকরণঃ যযাতির ঝুলির সব লেখাই শতাধিক বার ফেসবুকে শেয়ার হয় সেটা তো সুধী পাঠক বা প্রিয়দর্শিনী পাঠিকা নিচের ফেসবুক শেয়ার বাটন দেখে বুঝতেই পারছেন। এত অকুণ্ঠ ভালবাসা দেওয়ার জন্য পাঠক পাঠিকাকে যযাতির আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আপনিও শেয়ার করুন। কিন্তু শেয়ার করার আগে নিচের কমেন্ট বক্সে (বেনামী হোক বা নাম সহ) একটি মন্তব্য ছেড়ে যান যাতে যযাতি তার যজমানদের একটু চিনতে পারে। যযাতি তার ফেসবুক পেজের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। পোস্ট ভাল না লাগলে আপনাকে ছাড় দেওয়া হবে, কিন্তু ভাল লাগলে কমেন্ট না করে শুধু শেয়ার করলে যযাতির অভিশাপে (বিবাহিত হলে দাম্পত্য কলহজনিত কারণে আর অবিবাহিত হলে বাবা মার দাম্পত্য কলহজনিত কারণে) আগামী রবিবার রবিবাসরীয় লুচি তরকারি থেকে বঞ্চিত হবেন। 🙂 🙂

মুক্তি

প্রণবেশ সাধু ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন মাথার কাছে একটা লোক হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। অন্য কেউ হলে হয়তো চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করত কিমবা পুলিশকে টেলিফোন করার জন্য সেন্টার টেবিল হাতড়াত, কিন্তু প্রণবেশ সাধুর নামটা গালভারী হলেও মেজাজটা নেহাতই অমায়িক। কোনো কিছুতেই অধিক উত্তেজিত বা আনন্দিত অথবা যারপরনাই দুঃখিত হন না। যাকে বলে একেবারেই “দুঃখেষুনুদবিগ্নমনা সুখেষুবিগতস্পৃহ”। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে পাশে অচেনা কাউকে বসে থাকতে দেখলে চা-শরবত দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করার রীতি নেই। তাই চোখ পড়া মাত্র ধড়মড় করে উঠে বসতে যাবেন, লোকটা বলল “এ হে হে, সাম্‌লে কত্তা সাম্‌লে। এই বয়সে অতো দৌড় ঝাঁপ করবেন না।”

তা তুমি বাপু কে? বিরক্ত হলেও ভদ্রতার মাত্রা অতিক্রম না করে বললেন সাধু বাবু।

“কে জানে? সে বহুকাল আগের ব্যাপার যখন আমি একটা কিছু ছিলাম। এখন মনে টনে নেই। আর মনে রাখার দরকারও তেমন পড়ে না। আমি কে সেই নিয়ে আমাদের এ তল্লাটে তেমন কারু মাথা ব্যাথা নেই। যে যার নিজের মতো আছে। বুঝলেন কিনা। আমাকে স্রেফ হাওয়া বলতে পারেন।” বলে লোকটা একটা বিচ্ছিরি পান খাওয়া দাঁত নিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগলো।

সাধুবাবু এর মধ্যে বিশেষ হাসির কিছু পেলেন না। কথাটার মানেও যে বিশেষ বুঝলেন তা নয়। বিশেষত “এই তল্লাটের” ব্যাপারটা।

রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বললেন “আহ বাপু বিনা কারণে হাসছ কেন? তো আমার এখানে কি দরকার? বিশেষত আমার বেডরুম-এ। চোর-টোর নও তো?

লোকটা এক হাত জিভ কেটে বলল “আজ্ঞ্যে না কত্তা। কি যে বলেন। আমি এক্কেরে যাকে বলে কুলীন বামুন। অ্যাই অ্যাই দেখুন পৈতে। পুরো দেড় হাত। কথায় বলে পৈতের দৈর্ঘ দেখে বামুনের ব্রহ্মতেজ বোঝা যায়” বলেই লোকটা আবার হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগলো।

মাঝ রাত্তিরে এরকম বাজে রসিকতা সাধু বাবুর একেবারেই পছন্দ হল না। বললেন “দেখ বাপু ঠিকঠাক বলো তুমি কে নয়ত কিন্তু …” কিন্তু যে কি করা উচিৎ নিতান্ত নিরীহ সাধু বাবু সেটা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারলেন না।

এই “নয়ত কিন্তু” তে কিন্তু বোধ হয় একটু কাজ হল। লোকটা মুখটা নিতান্ত দুখি দুখি করে বলল “মাইরি বলছি, আমার পিতৃদত্ত নামটা আমার আজকাল একদম মনে পড়ে না। আসলে কেউ কাউকে নাম ধরে ডাকে না যে। আপনিও বছর কয়েক আমার তল্লাটে থেকে দেখুন, দেখবেন আপনার নাম ধাম বংশপরিচয় সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

“আমি খামোকা তোমাদের তল্লাটে গিয়ে থাকতে যাব কেন? আমি আমার পৈত্রিক বাড়িতে গিন্নি সমেত বেশ আছি।”

“ও হো আপনি এখনো বুঝতে পারেন নি। তাই না?” বলেই লোকটা আবার ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে লাগলো।

“তুমি আমার বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করেছ আর মাঝরাত্তিরে বিনা কারণে হেসে আমার হাড় ভাজা ভাজা করছো। এতে আর বোঝবার কি আছে?”

“হে, হে এমনটা সক্কলের হয়। আমারই হয়েছিল জানেন। শুধু শরীরটা একটু হাল্কা লাগত। আর বিশেষ কিছুই তফাত ধরতে পারিনি প্রথমটায়। কখন বুঝলাম জানেন? যখন দেখলাম  মানুষগুলো আস্তে আস্তে ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বৌ বাচ্ছা সব। আর নতুন লোক যাদের দেখতে পাচ্ছিলাম তারা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হল। আসলে ভূতেদের নামে মিছেই নিন্দা মন্দ করে মানুষেরা। ভূতেরা তো আদতে মানুষদের দেখতেই পায় না। আর মানুষ যেমন ভুত দেখে চম্‌কে ওঠে, ভূতেরাও হঠাৎ করে কোনভাবে মানুষ দেখতে পেয়ে গেলে রীতিমতো খাবি খায়।”

“থামো থামো, কি-কি-কি আবোলতাবোল বকছ? তু-তুমি বলছ আ-আমি ম-মরে গেছি” এবার যৎসামান্য উত্তেজনায় তোতলাতে থাকেন সাধু বাবু।

“তা বলে নিজেকে চিমটি কেটে দেখবেন না যেন। প্রথম প্রথম চিমটি কাটলে ঠিক-ই লাগবে। যারা বলে মরে গেছি কিনা দেখতে নিজেকে চিমটি কেটে দেখা উচিৎ, তারা নিতান্তই নির্বোধ। আসলে অনেকদিনের অভ্যাস তো ওগুলো। সহজে যাবে না। শরীরবোধটা আস্তে আস্তে যাবে।”

“যত সব ঢ-ঢ-ঢপবাজি। একটা বর্ণ-ও বিশ্বাস করি না।”

“আপনি বরং এক কাজ করেন কত্তা। দুধ কা দুধ পানি কা পানি হয়ে যাবে। ওই জানলার গরাদগুলো আমি খুলে আনছি। ওই পথে এই দোতলা থেকে সোজা একটা ঝাঁপ দিয়ে দেন। মাটিতে পড়লে একটু লাগবে, অনেক দিনের অভ্যাস তো। কিন্তু দেখবেন আদতে একটুও লাগে নি। গট গট করে আবার দেওয়াল বেয়ে উঠে ঐ জানলা পথে ঘরে ফিরে আসুন।”

“না না। ও ও সব আমি পারব না। মরেছি কিনা প্রমাণ পেতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণটা খোয়াই আর কি।” এইবার সাধুবাবু একটু ভয় পেয়েছেন। বিশেষত জানলার লোহার গরাদটা এই বেয়াক্কেলে লোকটা কি করে খুলে আনল সে কথা ভেবে।

“হুম্ম্। আপনার দেখছি সময় লাগবে। এই এই দেখুন আমি করে দেখাচ্ছি।” বলেই লোকটা কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জানলা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার বাইরের দেওয়াল বেয়ে উঠে এসে জানলায় পা ঝুলিয়ে বসে ফ্যাক ফ্যাক  করে সেই বিরক্তিকর হাসিটা হাসতে লাগলো।

“এইবার বলুন কত্তা। বেঁচে থাকাকালীন আমার মত অশরীরীর দেখা কখনো পেয়েছেন? আমায় দেখেছেন কি মরেছেন।”

কথাটা যুক্তি সঙ্গত। সারা জীবন শুনেছেন অনেক, কিন্তু ভুতের দেখা তো কখনো পান নি।

“তবে আপনি ভাগ্যবান। ঘুমের মধ্যেই হৃদয়ে সামান্য দোলাচল আর আপনি সোজা অক্কা। আপনি সাধু টাইপ মানুষ বলে শরীরটা সহজে ছাড়তে পেরেছেন। অনেকের দেখি খুব ভোগান্তি হয়। যাকগে যাক। আপনার এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হয় নি তো। আসেন। এইখানটায় এসে দাঁড়ান। এবার পা দুটোকে মাটি থেকে ওপরে তুলে শূন্যে ভেসে থাকার চেষ্টা করুন। পারছেন না তো? হুম্ম্। প্রথম প্রথম পারবেন না। আপনার মনে এখনো অভিকর্ষের প্রভাব। এই দেখুন?” বলেই লোকটা হাত দুয়েক শূন্যে উঠে ভাসতে লাগলো আর ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে লাগলো।

সাধুবাবু নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরও একবার চেষ্টা করে ফেললেন এবং ব্যর্থ হলেন। কিন্তু এই মানুষটা তো শূন্যে ভেসে থেকেছে মিনিট খানেক। স্বচক্ষে দেখেছেন তিনি। একটু ধন্দে পরে যান। তবে কি এ সত্যি না-মানুষ? সত্যি কি তবে তিনি মরে গেছেন?

“এখনও বিশ্বাস হয় নি তো আপনার? আচ্ছা বলুন এ বাড়িতে এই মুহুর্তে আর কে কে আছে? আসলে আজকাল আমি আর মানুষ দেখতে পাই না। আপনি সদ্য সদ্য দেহ ছেড়েছেন। আপনি পাবেন।”

“কেন আমার স্ত্রী আছেন। ওই তো, ঐ তো ঘুমিয়ে আছেন বিছানায়। তাছাড়াও আমার চারপেয়ে assistant ভুলু। নিচের তলায়।”

“আপনি যদি একটা জবরদস্ত প্রমাণ খুজছেন যে আপনি শরীর ছেড়েছেন, এক কাজ করুন আপনার স্ত্রীকে ঘুম থেকে তুলে একটু খাস গপ্প করার চেষ্টা করে দেখুন কত্তা। দেখবেন আপনি ওনাকে তুলতেই পারবেন না। আসলে আপনার শরীর নেই তো। গলার স্বরও নেই।”

সাধু বাবু তখুনি উচ্চ স্বরে “ওগো শুনছো” বার কয়েক চেঁচিয়ে, হাত ধরে টেনে, নাকে পায়ে সুড়সুড়ি কোনভাবেই স্ত্রীকে জাগাতে পারলেন না।

“এইবার ভুলোকেও একবার চেষ্টা করে দেখবেন নাকি কত্তা?”

“না থাক” হাল ছেড়ে দেন সাধুবাবু। তাঁর এবার বেশ বিশ্বাস হচ্ছে তিনি মরেই গেছেন।

“শরীর গেছে বলে দুঃখ করবেন না। আপনার তো সেই অর্থে পিছুটান বলে তেমন কিছু ছিল না। এবার ঠিক করুন। থাকবেন না যাবেন?”

“মা-মানে? কোথায় যাব?”

“না মানে আপনি এ বাড়িতেও গেঁড়ে বসে থাকতে পারেন, আবার ও পারে চলেও যেতে পারেন। আমি আসলে যাকে বলে ঘোর সংসারী ছিলাম। তাই আর ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয় নি। এখানেই ঘুরে ঘুরে বেড়াই। দেশ দুনিয়া দেখি। আপনি চাইলে ওপারে চলেও যেতে পারেন। এক যদি কোনো কিছুর প্রতি প্রবল আকর্ষণ না থেকে থাকে।”

সাধু বাবু একটু ভেবে বললেন “হ্যাঁ মানে চলে যেতে পারলে মন্দ হয় না। এই রোজকার ঝঞ্ঝাটের থেকে মুক্তি পেতে কে না চায়? জাগতিক আকর্ষন বলতে আমার ঐ বিয়ের আংটি, সোনার বোতাম আর রোলেক্স ঘড়িটা..আর ঠাকুর্দা আমায় আমার ১৮ বছরের জন্মদিনে দিয়েছিলেন একটা সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো ছিলিম…সেইটে। ওই আলমারিতে আছে।”

“হুম্ম্ মুস্কিল। এ জগৎ মায়া প্রপঞ্চময়। মায়ার বাঁধন তাই খুব বাধা দেবে আপনাকে। আপনি যেই ছেড়েছুড়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, অমনি টেনে নামিয়ে আনবে। ঐ আলমারিটার আশেপাশে ঘুর ঘুর করবেন। সে ভারী যন্ত্রণা।”

“তাহলে আমার এখন কি করা উচিৎ?”

“কি যে করবেন? টান মেরে যে কোথাও গিয়ে ফেলে আসবেন তার জো নেই। সেখানেই আপনার অ-শরীরটা ঘুর ঘুর করবে। এক কাজ করেন। ও গুলো আমায় দিয়ে দেন। আমার শরীর তো এই জাগতিক ফাঁদে আটকা পড়েই আছে, আমি বরং দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসি। আপদগুলোর হদিস না জানলে দেখবেন মায়া কাটাতে আপনার সুবিধে হবে।”

সাধুবাবু খানিক ভেবে দেখলেন আইডিয়াটা মন্দ না। আংটি, বোতাম, ঘড়ি আর ঠাকুর্দার ছিলিম তিনি আলমারি খুলে বের করে লোকটার হাতেই তুলে দিলেন। দিতেই মনটা বেশ হাল্কা আর প্রসন্ন হয়ে উঠল। যাক আর কোনো পিছুটান রইলো না। “নিয়ে যাও বাপু। অনেক উপকার করলে। এবার মনে হচ্ছে হাত পা ছড়িয়ে পরপারে যেতে পারব।”

“এই বার শুয়ে পড়ুন। শুয়ে শুয়ে চেষ্টা করুন। অনেক সময় কিন্তু ততক্ষনাত যাওয়া যায় না। দু-এক দিন লাগে। সেই দু-এক দিনে দেখবেন অনেকরকম জাগতিক বাধা এসে আপনার পথ রোধ করবে। দেখবেন আপনার স্ত্রী ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলছে, আপনার বোতাম, ঘড়ি চুরি যে হয়েছে তার অকাট্য প্রমাণ দাখিল করছে। ওসবে একদম ঘাবড়াবেন না। আপনি ঠান মেরে রাখুন আপনাকে মুক্তি পেতেই হবে। বোঝলেন কিনা…নয়তো কিন্তু আমার মত অশরীরী হয়ে ঘুরঘুর করতে হবে কত্তা..” বলেই লোকটা সুরুত করে জানালা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

*********

সকাল বেলা হৈ হৈ রই রই রব। পাড়া প্রতিবেশী সব হাজির। সাধনবাবুর বাড়িতে রাত্তির বেলা আলমারি খুলে  সোনার আংটি, বোতাম, ছিলিম, ঘড়ি সব নিয়ে গেছে চোরে। সংগে একটা চিঠি রেখে গেছে

সাধু বাবু,

এখনও আপনি না মরলেও, অচিরেই একদিন শরীর ছাড়তে হবে। তখন এই মায়া গুলো বড় আটকাবে আপনাকে মুক্তির পথে। তাই আপনার মুক্তির পথটা সুগম করতেই এ কটা নিয়ে গেলাম। গ্রন্থিগুলো ছিন্ন করে গেলাম। আমরা বংশ পরম্পরায় চোর। তাই দোতলা থেকে লাফ দেওয়া, দেওয়াল বেয়ে ওঠা এগুলো ভালই জানা আছে। আর আমার পিসি ছিল এক ডাকিনী, আজকের দিনে যাদের ডাইনি বলে আর কি। তার কাছ থেকে ঐ শূন্যে ভাসার দৃষ্টি বিভ্রম তৈরী করার কৌশলটা শিখেছিলাম। আর বেড-সাইড টেবিল-এ ঘুমের ওষুধের কৌটো দেখেই বুঝলাম আজ রাত্তিরে আপনার স্ত্রীকে শত ডাকলেও উঠবেন না। আর জানলার লোহার গরাদ তো কেটে ঐ পথেই ঢুকেছিলাম। ভালবাসা নেবেন।

                              আপনার অনুগত,

                                       স্রেফ হাওয়া

সাধুবাবুর স্ত্রী শেফালি বরকে শাপশাপান্ত করে বাড়ি মাথায় করছে। “শেষমেশ বুড়ো বয়সে তোমার এই ভীমরতি ধরলো গো? নিজের হাতে করে একটা ছিঁচকে চোরের হাতে সোনার আংটি, বোতাম তুলে দিলে?” ইত্যাদি ইত্যাদি…

*********

পাড়াপ্রতিবেশীর মতামত, বৌ-এর ধাঁতানি অনেক্ষণ ধরে বসে ভ্যাবলাকান্তের মত খেয়ে বাথরুমে ঢুকলেন সাধুবাবু। দরজাটা লক করে দিয়েই চট করে একবার শূন্যে ভাসার চেষ্টা করলেন। ব্যর্থ হলেন।

“হবে হবে। লোকটা তো বলেই গেছে এরকম অনেক বাধাবিপত্তি আসবে মুক্তির পথে। বাইরে যা চিতকার চেচাঁমেচি হচ্ছে, এ সবই তাঁর মানসিক বিভ্রম। এগুলোতে বিশ্বাস করেছেন কি ঠকেছেন। ওই লোকটার মত আটকে থেকে যাবেন তাহলে। আসলে তাঁর শরীর ছাড়া হয়ে গেছে কাল রাত্তিরেই।” স্থির নিশ্চিত সাধুবাবু।

নিজেকে চিমটি কেটে দেখলেন। হ্যাঁ এখন অনেকটা কম লাগছে। আর একটা ব্যাপার-ও তো সত্যি। পাড়া প্রতিবেশী, স্ত্রী সবাইকে অলরেডি ঝাপসা দেখছেন তিনি। আর সবচেয়ে ভাল ব্যাপার ঐ ঘড়ি-আংটির মায়া ত্যাগ করতে পেরে তাঁর শরীর-মন দুটোই এখন বেশ ফুরফুরে হাল্কা লাগছে। শূন্যে ভাসতে পারার আর বেশি দেরি নেই।

 

theif