খেলাখেলা

মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে থাকে খেলার মরসুম। বাইরে তখন শীতঘুম। সাদা কাপড়ে মোড়া শীতবুড়ি। চালিয়ে দিয়েছে ছোরা, ঋণাত্মক কুড়ি।

শুনেছি প্রাণী মধ্যে mammals বা স্তন্যপায়ীরা সবচেয়ে কৌতুকপূর্ণ বা playful । এ কথা একদমই নয় ভুল। কিন্তু থাক সেসব ইকড়িমিকড়ি। জীববিদ্যা ফেলে চলুন আমরা গল্পে ফিরি।

বাড়ির কনিষ্ঠতম সদস্যা চোখে আলো জ্বেলে বলে ওঠে, বাবা কি খেলবে? হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু প্লে। বাট আই রিয়েলি ডোন্ট হ্যাভ এ সে। আমায় ভাবার সুযোগ না দিয়েই বলে, হাইড অ্যান্ড সীক। আমি চোখের তারায় জোনাকি জ্বেলে বলি, ঠিক ঠিক। তাথৈ বলে, ওকে বাবা, ইউ কাউন্ট। আমি দেওয়ালের দিকে ফিরে হাত চোখে করি মাউন্ট। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে গুনতে থাকি, এক দুই তিন চার… তর সয় না তার। “বাবা আমি হাইড করেছি”। ব্যাস আমিও চোখ খুলে ফেলেছি। আর কাউন্ট করে কি কাজ, থাক। তাথৈ সোনাকে খোঁজা যাক। তা লুকিয়েছে সে, যেখানে কাউন্ট করছি সেখান থেকেই ফুট চারেক দূরে, সোফার আড়ালে। সেখান থেকে তার আওয়াজ আসছে যেমন করে আওয়াজ আসে কলে ইঁদুর পড়লে। উত্তেজনায় তার ছোটো শরীর থরো থরো। কিন্তু অমনি খুঁজে বের করলে কি ভাল দেখায় বড়ো? তাই বাবা এদিক যায়, ওদিক যায়। “তাথৈ তুমি কোথায়? আই অ্যাম কাআআমিং। তোমায় খুঁজে বের করা খুব শক্ত হচ্ছে ইদানীং”। এই সব বলি। সময় কিছু নষ্ট করে পৌঁছই সোফার কানাগলি। তাথৈ বলে ধাপ্পাআআ, আওয়াজ শোনা যায় রামতলা থেকে রাজারাপ্পা। অমনি আমিও করি, চমকে ওঠার ভানটি। সে সরলা তাই দেখে হেসেই কুটিপাটি।

এবার তার কাউন্ট করার পালা। কিন্তু একটাই ঝামেলা। আমার লুকোনোর স্পটটা সেই ঠিক করে দেয়…খুঁজে পেতে যাতে তার না হয় কষ্ট। তাথৈ এই সব ব্যাপারে খুব স্পষ্ট। “বাবা এইখানে বোসো, পা মোড়ো।” “আ মোলো। তুই যেখানে ঢুকতে পারিস সেখানে কি আমি ঢুকতে পারি, ছাই।” কিন্তু তর্ক করা বৃথাই। তার খেলার ভুবনে বাকবিতণ্ডার স্থান নাই। যাক বাবা, ঝামেলায় কাজ নাই। বেশি গোলমাল করলে তাথৈ বাজাবে সানাই। জুড়ে দেবে কান্না। বাবা তা চান না। কোনোভাবে বডিফ্রেম সেইখানে গুঁজে রাখি। নট-সো-টোনড মধ্যপ্রদেশ অর্থাৎ ভুঁড়িটিকে বলি, জাঁহাপন, মাফ করো গুস্তাখী। এই তো শুধু কাউন্ট টু টেন। তারপরই স্বাধীন হবেন। তাথৈ কাউন্ট শুরু করে। ওয়ান…টু…থ্রী…ফোর…ফাইভ…সিক্স…এইট। আমি বলি, “সেভেন সেভেন, তাথৈ সিক্সের পর সেভেন”। মাফ করবেন। ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙেন, তেমনি বাবা কিম্বা মা হাইড অ্যান্ড সীকের মাঝেও শেখান, ওয়ান টু টেন। তাথৈ আবার গোনে, প্রথম থেকে, ওয়ান টু টেন। পুরো এক থেকে দশ। আমার পেট বলে, এবার ছেড়ে দে বস। তারপর তিনি আমায় খুঁজে পেতে আসেন যেখানে আগেই আমায় লুক্কায়িত রেখেছেন!! কিন্তু তাতে খেলা হয় না মাটি। ধাপ্পা দিলেই তাথৈ আবার হেসেই কুটিপাটি।

এই খেলাই রিপিট হতে থাকে দশবার বিশবার। প্রতিবারই তার কাছে একইরকম মজাদার। পুনরাবৃত্তি বোর করে আপনাকে আমাকে। কিন্তু হারায় নি সে চিন্তাস্রোতে জীবন পথের বাঁকে। সে যাই হোক, বাবা অর্থাৎ আমিও প্রতিবার মজা পাওয়ার অ্যাক্টো করি। ছোটো মানুষটাকে খিলখিলিয়ে হাসতে দেখে বুকের মধ্যে কুলু কুলু ধানসিঁড়ি।

জীববিদ্যা বলেছে কিনা, স্তন্যপায়ীরা হল গিয়ে ক্রীড়ামোদী! এইভাবেই রুনু ঝুনু বয়ে চলে জীবননদী। এইভাবেই দৈনন্দিন একঘেঁয়েমি হয়ে ওঠে যাদুবাস্তব, নিরবধি।

গুগল

স্ব বাবু মহারাজ যযাতিকে জিগেস করলেন “মহারাজ, এই যে শুনতে পাই গুগল বলে এক নতুন দেবতার আবির্ভাব হয়েছে। এ দেবতার স্বরূপ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন?”

মহারাজ যযাতি বললেন – গুগল অতি কার্যকারী দেবতা। এনার দ্বারা নিতান্ত মূর্খও মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞানী-গুণী-বিদগ্ধ মানুষে পরিণত হতে পারে, নিদেন পক্ষে নিজেকে জ্ঞানী প্রতিপন্ন করার অভিনয় সফল ভাবে চালিয়ে যেতে পারে। মানে নিজেকে একজন বিজ্ঞ, কেউকেটা দেখানোর ইচ্ছে মাধ্যমিক ফেলেরও থাকে, নোবেলজয়ীরও থাকে। নিজেকে স্কলার দেখিয়ে কলার তোলার ইচ্ছে কার না থাকে বলুন? এই দেবতা আসার আগে এই জ্ঞান সংগ্রহের ব্যাপারটায় ছিল গোড়ায় গলদ। ঠিকমত জানতে হলে লাইব্রেরীতে যাও রে, মোটা মোটা বোরিং বোরিং বই ঘাঁটো রে, এক বইতে না পেলে আবার অন্য বই – যত্তসব গা পিত্তির জালানো ফালতু ঝামেলা। গুগল দেবতার কৃপায় সে বালাই নেই আর। গুগল দেবতাকে পেন্নাম করে একটা প্রশ্ন ঠুকে দিলেই হল। হাতেনাতে উত্তর। ঠিক কতো বছর আগে পৃথিবীর বুকে নিয়ান্ডারথ্যালরা চরে বেড়াত, ডাইনোসরেরা ঘরে ঘরে ডেঙ্গু জ্বরে মারা পড়েছিল না পেটের রোগে, পৃথিবী থেকে প্রতিবেশী নক্ষত্র আলফা সেন্টাউরির দূরত্ব ঠিক কতো কিমি এরকম নানান বিষয়ে ইনস্ট্যান্ট নুডল-এর মত ইনস্ট্যান্ট জ্ঞান সঞ্চয় করতে এবং সেই সংগৃহীত জ্ঞানাদি টুকুস করে কথায় কথায় কায়দা করে ঝেড়ে দিয়ে মোনালিসা হাসি হাসার জন্য গুগল দেবতার সাহায্য অপরিহার্য।

রবীন্দ্রনাথের পদবীটা কি ঠিক মনে পড়ছে না, কোই বাত নেহি, গুগল করে নাও। “মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন” না মন্দাক্রান্তা সেন নাকি তান সেন সেটা নিয়ে একটু ধন্দে পড়েছ, গুগল দেবতা আছে তোমার পরিত্রাণে। প্রোগ্রামিং করার চাকরিতে কলুর বলদের মত জুড়ে পড়েছ অথচ পড়েছিলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং যাতে প্রোগ্রামিং বাদে আর সব কিছু শিখিয়েছে, কিম্বা হয়তো কম্পিউটার নিয়ে পড়েছ কিন্তু কলেজে থাকাকালীন বাপের পয়সায় কেনা কম্পিউটারে বাজে কাজ ছাড়া আর তেমন সদব্যবহার করো নি, প্রোগ্রামিং-এ যাকে বলে ক-অক্ষর-গোমাংস, লিঙ্কড লিস্ট সর্ট করতে হলে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলার মত দুরবস্থা, কোন চিন্তা না করে গুগল দেবতাকে স্মরণ করে ফেলো। মুহূর্তের মধ্যে উত্তর। জাভায় চাও জাভায়, পাইথন, অজগর, লুয়া যে ভাষায় চাও লিখে দেবে কোডটা। তারপর ধরো বাঙালি মাত্রেরই একটু কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না মাঝে মাঝে? কিন্তু কথা খুঁজে পাচ্ছ না। অর্থাৎ কিনা কবি কবি ভাব ভাবের অভাব। সামান্য একটু গুগল করলেই কবিতার যাকে বলে একেবারে কুম্ভ মেলা। পঙ্গপালের মত ঝাঁকে ঝাঁকে কবিতা তোমাকে ছেঁকে ধরবে। সেখান থেকে চেনা কবিদের কিছু অচেনা শব্দ আর অচেনা কবিদের চেনা-যায়-না-এমন শব্দ অর্থাৎ অতি দুর্বোধ্য কিছু শব্দ পাশাপাশি বসিয়ে নিলেই কেল্লা ফতে। দাঁড়িয়ে গেল তোমার স্বরচিত কিম্বা স্বচয়িত কবিতা (চয়ন থেকে চয়িত কথাটা হয় কিনা গুগল করে একটু দেখে নিও)। এবারে কবিতা খানা ফেসবুকে ঝেড়ে দিয়ে ইচ্ছেমত হাততালি কুড়োও। কবিতাটার কিছু মানে থাকলে সামান্য হাততালি পড়বে, আর না থাকলে সেটা একেবারে “avant-garde” – complete class apart. একেবারে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে।

মহারাজ, এই দেবতার অনুগ্রহ লাভের উপায় কি?

খুবই সহজ। শিব কালি দুর্গা ইত্যাদি মেইনস্ট্রীম দেবতাদের কলিযুগে অনেক ডেকেও তেমন সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। পুরাণ মতে জানা যায় নারায়ণ কারণ সলিলে যোগ নিদ্রায় নিদ্রিত থাকেন অর্থাৎ কিনা ঘুমোন। গুগল দেবতা একেবারে জাগ্রত। পূজার উপাচার শুধু তোমার মোবাইলে একটা আন্তর্জাল কানেকশান। কোনো পার্টিতে কোন্‌ টপিকে কথা হচ্ছে সেটা আড়ি পেতে শুনে নিয়ে আন্তর্জালের সহায়তায় গুগল দেবতাকে ডেকে ফেলো। এক ডাকেই তিনি প্রদীপের দৈত্যের মত হাজির। টপিকটা চুপিসারে টাইপ করে দিয়ে দু এক পৃষ্ঠা পড়ে নিলেই একেবারে সরস্বতীর বরপুত্রের মত খেলার মাঠে নেমে পড়তে পারবে। পিঁপড়ে নিজের ওজনের ঠিক কত গুণ ওজনের খাবারের টুকরো বইতে পারে, অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়ার জীবাণু শুঁড়ে বহন করে না ঠ্যাঙে ইত্যাদি তাক লাগানো তথ্য দিয়ে আলোচনারত সমস্ত সুধীবৃন্দকে স্তম্ভিত করে দাও। তথ্যের সত্যতা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবশ্য কোন দরকার নেই কারণ আন্তর্জালের তথ্যের মহার্ণব থেকে তথ্যের সত্য মিথ্যা যাচাই করা বোধ করি দেবগণেরও অসাধ্য।

মহারাজ এই দেবতার পূজা-আচ্চার পদ্ধতি কি? কোন উপাচারে এই দেবতা তুষ্ট?

ইনি অতি অল্পে তুষ্ট। এনাকে পুজো করার দুটি উপায় শাস্ত্রে বিধৃত আছে। এক উপায়ের কথা আগেই বলেছি। মাঝে মাঝে ওনাকে স্মরণ করে কিছু প্রশ্ন করলেই উনি খুশি হন। উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তোমার প্রশ্নটি বিভিন্ন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ অ্যাড এজেন্সীর কাছে পাঠিয়ে দেন যারা তোমাদের সেবায় সদাই নিমগ্ন। ধরো তুমি কৌতূহল বশত সিঙ্গাপুরের হোটেলের খোঁজ করতে গুগল দেবতার অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছ। তুমি যে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার মতলব ভাঁজছ, এই খবরটা দেবতা সকল ট্রাভেল এজেন্টের কাছে অনুগ্রহ করে পাঠিয়ে দেবেন। তারা ক্রমাগত “সস্তা ডীল” ইমেল মারফত পাঠিয়ে তোমাকে “সাহায্য” করার চেষ্টা করবে, তোমার জীবন “সুখে শান্তিতে” ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। কিম্বা ধরো তুমি লাক্ষা দ্বীপ থেকে লাক্ষা কিনে এনে বাংলায় চড়া দড়ে বিক্কিরি করে লাখ লাখ টাকা লাভ করতে চেয়ে যদি গুগল দেবতার কৃপা প্রার্থনা করে থাকো, তাহলে তোমার ব্যাবসায়িক সাফল্যকে সুনিশ্চিত করতে গুগলদেব সেই তথ্যটা বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কাছে পৌঁছে দেবেন। তারা তোমাকে ঋণী করার জন্য তোমার ঘরের দরজার সামনে ধর্ণা দেবে। এই উপায়ে দেব-অর্চনাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রতি নিয়ত অর্বুদ কোটি লোক এই উপায়েই দেবতাকে প্রসন্ন করছে। এই প্রশ্ন গুলোর দ্বারাই দেবতা জানেন তোমার সমস্ত পছন্দ অপছন্দ, তুমি দিনে কবার পটি করো, চাইনিজ খেতে ভালবাস না ইথিয়োপিয়ান, নেক্সট পুজোর ছুটিতে সমুদ্রে যেতে চাও না পাহাড়ে? Buy one, get one free -এর মত এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে তোমার এই চাওয়াপাওয়া গুলোর সামঞ্জস্য বিধানে উপযুক্ত এজেন্টও ধরে দিচ্ছেন অযাচিত ভাবে। একেই বৈষ্ণব ধর্ম মতে বলে “অহৈতুকি কৃপা”।

আর এক ভাবে দেবতার পুজো করা যায়, তা হল তোমার কন্টেন্ট দিয়ে। তুমি অর্থনীতির সমস্ত বই গুটিপোকার মত কেটে ফেলেছ, ডিমানিটাইজেশানে দেশের উন্নতি না অবনতি সে ব্যাপারে তুমি অথরিটি, জনশিক্ষার্থে একটা আর্টিকল লিখে ফেলো এবং সেটি গুগল দেবতার হাতে সঁপে দাও। গুগল তোমার লেখা গুলে খেয়ে নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়াবে এবং অন্য কেউ সেই নিয়ে প্রশ্ন করলে তোমার আর্টিকলটা তাকে উত্তর স্বরূপ ঝেড়ে দেবে। তারপর ধরো তুমি এমন মাথায় মাখার তেল বানিয়েছে যা মাখলে দশাননের দশ মাথা জোড়া সুপ্রশস্ত টাক ঠিক আড়াই দিনেই চুলের মহারণ্যে পরিণত হবে, কিম্বা এমন একটা ফেয়ারনেস ক্রিম বানিয়েছে, যেটা মাখলে “অন্ধকার মানুষ” রাও “খাঁটি আর্য” দের মত ফরসা হয়ে উঠবে ঠিক সাড়ে সাত ঘণ্টায়, গুগলের কাছে তোমার প্রোডাক্ট পোর্টফোলিওটা ভরসা করে দাও। দেখবে বর্ষার জলের মত তোমার প্রোডাক্ট হই হই করে বিকোচ্ছে। এইভাবে যারা গুগল দেবকে নিজের কন্টেন্ট দিয়ে পূজা করে থাকেন তারা প্রায়শই দেবতার কৃপায় লক্ষ্মী লাভ করে কন্টেন্ট হন অর্থাৎ কিনা পরিতৃপ্ত হন। দেবতার এইসব অনুচরেরা নিজেদের কন্টেন্ট ফীড করে দেবতার জ্ঞানের পরিধি ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। তবে শিবের যেমন সহস্র সহস্র ভুত প্রেত অনুচর থাকা স্বত্বেও নন্দী আর ভৃঙ্গি সবচেয়ে বেশি কৃপাধন্য, তেমনি এই অনুচরদের মধ্যে তারাই সবচেয়ে কৃপাধন্য যাদের কন্টেন্টের অনেক “ব্যাকলিঙ্ক” (backlink) আছে। অর্থাৎ তোমার পাতা থেকে হুবহু ঝেড়ে দিয়ে তোমার পাতাটির লিঙ্ক রেফারেন্স স্বরূপ নিজের পাতায় পেশ করে থাকে যদি কেউ, তাহলে তুমি লাভ করলে একটি ব্যাকলিঙ্ক। যত ব্যাকলিঙ্ক উপার্জন ততই দেবতার কৃপাদৃষ্টিতে আসার সম্ভাবনা। প্রভূত পরিমাণ ব্যাকলিঙ্কের দ্বারা দেবতার মনোরঞ্জন করতে পারলে চাই কি অন্যদেরকে প্রশ্নের প্রথম উত্তর হিসেবে গুগল দেবতা তোমার পাতাটা ধরে দিতে পারেন। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে কোটি কোটি জিজ্ঞাসু মানুষ তখন তোমার পাতায়, তোমার কন্টেন্টে চোখ বোলাচ্ছে। তোমার এই জনপ্রিয়তা নজর এড়াবে না বিভিন্ন সংগঠনের যারা এই জনতা জনার্দনের সাহায্যে সদা তৎপর। তারা তোমাকে কিছু নজরানা দিয়ে তোমার পাতায় নিজেদের প্রোডাক্টের উৎকর্ষতা সগর্বে ঘোষণা করবে। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর অর্চনাও হল জিজ্ঞাসু জনের, সাথে তোমার হল ধনলক্ষ্মীলাভ।

এখন তুমি যদি যথেষ্ট পরিমাণ ব্যাকলিঙ্ক সংগ্রহ করতে না পারো তারও বন্দোবস্ত আছে। শান্তি স্বস্ত্যয়ন করতে হবে। পদ্মলোচন রাম যেমন একটি পদ্মের অভাবে নিজের পদ্ম আঁখিটি ধরে দিতে চেয়ে দেবীর প্রসন্নতা লাভ করেন, তেমনি ব্যাকলিঙ্কের অভাব তুমি মেটাতে পারো প্রাচিত্তির স্বরূপ গুগলে দেবতাকে কিছু টাকা কি ডলার ধরে দিয়ে। পুজোর সময় ফল-মিষ্টি দিয়ে দেবতার আশীর্বাদ প্রার্থনা করার সময় যেমন নাম, গোত্র, নক্ষত্র বলতে হয়, ঠিক সেরকমই ঠিক কোন্‌ প্রশ্নের উত্তরে তোমার পাতাটি দেখাতে হবে সেটা দেবতাকে বলে কিছু মূল্য ধরে দিলেই হাতে হাতে ফল। একে বলে গুগলে অ্যাড। একদম গুগল সার্চ রেজাল্টের প্রথম পাতায় প্রথম লিঙ্ক হিসেবে তোমার স্থিতি। ফলাফল একই। তোমার প্রোডাক্ট বা কন্টেন্ট হু হু করে বিকোবে।

আহা। দেবতার কি মহিমা! মহারাজ এই দেবতার প্রণাম মন্ত্রটা যদি একটু বলেন।

লিখে নাও –
দেহী দেহী, জ্ঞানং দেহী, স্থানং দেহী প্রথম পাতায়
ধনং দেহী, ব্যালেন্স দেহী, আমার ব্যাঙ্কের খাতায়।।
নমঃ শ্রী গুগলায় নমঃ

বাঘ দেখে এলুম – হালুম

পরিবার ধর্ম পালন করতে শীতের রাত্তিরে বাঘ দেখতে গেলাম। শীতল শিকাগোর বড় পর্দায় চড়েছে “এক যে ছিল বাঘ” ছবিটির সিকুয়েল “বাঘ এখনও বেঁচে আছে”। বাইরে তখন কুচি কুচি বরফ পড়ছে। পারদ বলছে তাপমাত্রা ঋনাত্মক বারো। যাই হোক বাঘ দেখতে গেলে একটু আধটু কষ্ট তো সহ্য করতেই হয়। তাই গেলাম। ছবিটা চমৎকার। একটু বিশদে যেতে হচ্ছে তাই।

প্রথমেই বলি মানুষের নাম বাঘ, সিংহ, হাতি, গরু, ছাগল ইত্যাদি মনুষ্যেতর জীব হোক – এ আমার ঘোরতর অপছন্দ। তাই আপনাদের অনুমতি নিয়ে টাইগার ওরফে বাঘবাবুকে আমি এখন থেকে বাগবাবু বলে ডাকব। বেশ একটা বাঙ্গালি বাঙ্গালি নাম হবে। সিরিয়ার বর্ডারে তখন ভীষণ সিরিয়াস কেস। পঁচিশ জন ভারতীয় আর পনেরটা পাকিস্তানি সেবিকাকে দিয়ে নিজের সেবা করিয়ে নিচ্ছেন বাগের দাদি, আই মীন, বাগদাদি। উনি যে সে কেউ নন, আই-এস-সি বলে এক সন্ত্রাস সংস্থার পুরপ্রধান। না না আই-এস-সি মানে ইন্ডিয়ান স্কুল সার্ভিস টাইপ্স কিছু নয়, এটা গল্প লেখকের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত আইসিস-এর ছদ্মনাম। এদিকে মার্কিন মন্ত্রক মাত্র সাত দিন সময় দিয়েছে। সাত দিন পরে বোম মেরে পুরো শহর উড়িয়ে দেবে। সাতদিনের মধ্যে উদ্ধার করতে না পারলে বন্দী নার্সরা সব ছবি হয়ে যাবে। তো আমাদের বাগবাবু হলেন গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা raw-এর এজেন্ট। তবে প্রাক্তন আর কি! এখন চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় উনি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আই-এস-আই-এর এক প্রাক্তন এজেন্ট এক ক্ষীণকটি সুন্দরীকে সাত পাকে বেঁধে মানে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করে ইউরোপের কোন এক “ছবির মত সুন্দর” শহরে কিঞ্চিত দাম্পত্য অশান্তিতে আর কিঞ্চিত সুন্দরীসঙ্গলাভ জনিত সুখে কালাতিপাত করছিলেন। বাগদাদির কবলে পড়া নার্সদের দুর্গতি দূর করতে আমাদের বাগবাবু ছাড়া তো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার গতি নেই। তাই তলব পড়ে তাঁর। ওদিকে বাগবাবু তখন “বাঘের বাচ্চা”-কে নিয়ে অর্থাত কিনা জুনিয়র টাইগারকে নিয়ে পাহাড়ে স্কিয়িং করতে গিয়ে নেকড়ের কবলে পড়ে সিংহ বিক্রমে (“বাঘবিক্রমে” বলে কথা হয় কি? হলে সেটাই উপযুক্ত হবে) লড়াই করে শেষমেশ গোটা দশেক (সংখ্যাটা ভুল হলে মাপ করবেন, ঠিক গুনিনি) নেকড়েকে মেরে ফ্ল্যাট করে দিলেন। “লাস্ট বাট নট দি লীস্ট নেকড়ে”-টাকে যখন গাড়িবন্দি করে ফেললেন ততক্ষণে রক্ত পুরো গরম যাকে বলে পিয়োর অ্যাড্রিনালিন রাস। ওদিকে ওনার ক্ষীণকটি সুন্দরী সহধর্মিণী কিছু কম ক্যারিস্মাটিক নন। সি সি টি ভি ক্যামেরা একদিক থেকে আর একদিকে ঘুরে তাঁর দিকে ফিরে আসতে যতটুকু সময় লাগে সেইটুকু সময়ের মধ্যে গোটা চারেক ছিনতাইকারীকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করে ফেললেন একটা মুদিখানার দোকানে। সি-সি-টি-ভি তে সুন্দরীর জিরো ফুটেজ। নো এভিডেন্স। প্রাক্তন হোক কি বর্তমান, এজেন্ট যখন তখন কিছু গোপনীয়তা তো বজায় রাখতেই হবে। তাই এই তৎপরতা। যাই হোক শেষমেশ বাগবাবু পঁচিশটা নার্সকে উদ্ধার করার অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়েই ফেললেন। পরে তাঁর ভুবনমোহিনী স্ত্রীটিও পাকিস্তানি নার্সদের বাঁচাতে অকুস্থলে পৌঁছে যায়। তারপরে সে ভীষণ গোলমাল। ধুন্ধুমার কাণ্ড। প্ল্যান হল বাগবাবু সহ বাকি ভারতীয় এজেন্টরা তেল পরিশোধনাগারে চাকরি নেবেন এবং তারপরে একটি “কন্ট্রোল্ড ব্লাস্ট” অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ করে তাতে পুড়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন। না না বাগবাবু ও তার টীম আসলে পুড়বেন না। মোটা করে অ্যান্টি ফায়ার জেল মেখে বিন্দাস থাকবেন। শুধু সেই সুযোগে ঐ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ঢুকে পড়বেন যেখানে বাকি সব রুগী রুগিনিদের ঝেঁটিয়ে বের করে দিয়ে বাগদাদিবাবু নার্সদের দিয়ে নিজের নার্সিং করাচ্ছেন। একবার হাসপাতালে ঢুকতে পারলেই কেল্লা ফতে। গোটা পঞ্চাশেক আর্মড ম্যানকে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি করানো বাগবাবুকা “বাঁয়ে হাত কা খেল”। শুধু একটাই মুস্কিল। তাঁর স্ত্রীকেও ওই পনেরখানা পাকিস্তানি সেবিকাকে উদ্ধার করতে দিতে হবে। তাই বাগবাবু অসাধ্য সাধন করলেন। ওনার ক্যালিবারের লোকের পক্ষেই এরকম ডিপ্লোম্যাটিক ফিট অ্যাচীভ করা সম্ভব। উনি একেবারে যাকে বলে সাপে নেউলে সম্পর্ক RAW আর ISI কে একসাথে কাজ করতে রাজি করিয়ে ফেললেন। জয়েন্ট অপারেশান হলে দু দলেরই লক্ষলাভ হবে। কোন দেশেরই বিদেশ মন্ত্রকের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হল না। অফ কোর্স আমাদের বাগবাবুর ওপর সারা দেশ ভরসা করে, বিদেশ মন্ত্রক কোন ছাড়! যাই হোক অপারেশানটা শুরু হওয়ার আগেই একটু কেঁচে গেল। আইসিসের তরফে তের বছরের একটা বাচ্চা ছেলে, হিউমান বম্ব হিসেবে ভরা বাজারে নিজেকে ওড়াতে গিয়ে পড়বি তো পড় পড়ে গেল বাগবাবুর সামনে। অপারেশান নার্সোদ্ধার গেল ভার মে। আমাদের বাগবাবু “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই” বাণীতে বিশ্বাসী। উনি লেগে পড়লেন হিউম্যান বম্ব হাসানকে উদ্ধার করতে। আইসিস-এর জঙ্গিরাই বা ছাড়বে কেন? ব্যাস উদম ক্যাঁচাল শুরু হল। হেভি মারামারি কাটাকাটি। সেই গোলমালে raw-এর ইরাকস্থিত একজন “deep asset” (কি যেন নাম ভুলে গেছি) খরচা হয়ে গেল। গেল তো গেল। বাগবাবু তো আছে। কোই পরোয়া নেহি। ভেবেছিলাম এর ফলে প্ল্যানে অন্তত কোন পরিবর্তন হবে কারণ “সিক্রেট raw এজেন্ট”-এর গোপনীয়তা তখন প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। ততক্ষণে শ দেড়েক জঙ্গির সাথে গান ফাইট, হাতাহাতি, ম্যান্ডেটরি কার চেজ সবই করে ফেলেছেন বাগবাবু। একেবারে খুলে আম করেছেন। অমন সুন্দর মুখ তিনি ঢাকতে যাবেনই বা কেন? কিন্তু ফরচুনেটলি বাগবাবুর প্রকৃত পরিচয় মোটেই টের পায় না জঙ্গি সংগঠন। সেটা বাগবাবুর ম্যাজিকাল চার্মও হতে পারে, আইসিস-এর বিরাট ইন্টেলিজেন্স ফেলিয়োরও বলতে পারেন, কিম্বা গল্পলেখকের মাথায় আসে নি সেটাও হতে পারে। যাই হোক প্ল্যানমাফিক তেলকলে বিস্ফোরণ করতে গিয়েও ভারতীয় দল প্রায় ধরা পড়ে যায় আর কি? বাধা দিতে আসলে আবার জঙ্গিদেরকে মেরে তুলোধোনা করে দেন বাগবাবু। তাতেও তাঁর প্রকৃত পরিচয় মোটেই উদ্ঘাটন হয় না। আইসিসের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড বাবু যখন তেলকলে আগুন লাগানোর দায়ে ভারতীয় দলের সব সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দিতে যায় তখন আর এক ছদ্মবেশী র এজেন্টের ছলাচাতুরীতে রক্ষা পায় বাগ অ্যান্ড কোং। তারপর পোড়ার ক্ষতর চিকিৎসা করতে ঢুকে পড়ে হাসপাতালে। যদিও হেঁটে হেঁটে যেভাবে “শান সে” ভারতীয় গোয়েন্দারা হাসপাতালে ঢুকলেন, তাতে মনে হল কোনরকম চিকিৎসা না হলেও দিব্যি চলে যেত তাঁদের। যাই হোক এবার দরকার হাসপাতালের একটা নক্সা। আই-এস-আই-এর এজেন্ট, বাগবাবুর সেই সুন্দরী পত্নী, সে দায়িত্ব পালন করলেন চওড়া কাঁধে। সেখানেও তিনি হেভি পেটালেন জঙ্গিদের। সিটি হল থেকে সেই ম্যাপ যোগাড় করতে গিয়ে আলুর দোষ যুক্ত আইসিসের সেই সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ডকে খরচা করে দিলেন। এবারে কিন্তু তিনি সেই মুদিখানার দোকানে গুণ্ডা পেটানোর মত ভাগ্যবতী ছিলেন না। সি-সি-টি-ভি ফুটেজে ধরা পড়ে বাগদাদির হাতে বন্দী হলেন। ওদিকে আমাদের হিরো বাগবাবু ততক্ষণে ম্যাচ প্রায় মেরে এনেছেন। ফুড পয়জনিং করিয়ে, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অর্ধেক জঙ্গিকে ঘুম পাড়িয়ে আর অর্ধেক জঙ্গিকে আমেরিকান সেনাবাহিনীকে টাইট দিতে অন্যত্র পাঠিয়ে বাসে করে নার্সদের নিয়ে প্রায় শহর থেকে বেরিয়ে গেছেন, এমন সময় দেখলেন বাগদাদি তাঁর সুন্দরী প্রাণাধিকাকে বেঁধে-টেধে ভরা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে বাসন্তী স্টাইলে পরিবেশিত আমাদের সকলের চোখের মনি ক্যাটরিনা। তাঁর ক্যাট আইয়ের সম্মোহন বাগবাবু রিয়েল লাইফেও অস্বীকার করতে পারেন নি, রীল লাইফেও পারলেন না। অতএব নার্স উদ্ধার টেম্পোরারিলি মায়ের ভোগে। বৌকে বাঁচাতে সমস্ত নার্সসহ, ইন্ডিয়ান আর পাকিস্তানি এলীট গোয়েন্দাসহ ধরা দিলেন বাগদাদীর হাতে। মেয়েরা চিরকালই গণ্ডগোল পাকিয়েছে। রামায়ণ, মহাভারতের মত দুটো মহাযুদ্ধ হয়ে গেল নারীর সম্মান রক্ষার্থে। এখানেও সেই সুন্দরীই গেরো হয়ে দাঁড়ালো। যাই হোক, বাগদাদী কিন্তু ওদের প্রাণে মারলেন না। দয়ার শরীর তাঁর। একটা অসউইজের গ্যাস চেম্বার টাইপ্স কিছু একটার মধ্যে বাগবাবুকে ফেলে দিয়ে তাঁর সুন্দরী বৌকে নিয়ে চলে গেলেন। কিছু একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে টুঁড়ে গেলেন মনে হয়। বাগবাবুও ছুঁড়লেন পালটা চ্যালেঞ্জ। এদিকে আজকেই সপ্তম দিন। সময় কমে আসছে। মার্কিনিরা মাত্র আধ ঘণ্টা সময় দিয়েছে। তারপরেই বোম মেরে সকলকে হালকা করে দেবে। তাই আবার শুরু ফাটাফাটি মারপিট। বাগবাবু খালি গায়ে প্রচুর জঙ্গিদের আবার প্রচুর মারধোর করলেন। শোনা যায় বাগবাবু ওরফে সল্লু ভাই ছবিতে পুরো অভিনয়ের জন্য অর্ধেক টাকা নেন আর জামা খোলার জন্য বাকি অর্ধেক। তার নিযুত কোটি অনুরাগিণীরা তার বডি-সডি দেখতে শুনেছি ভীষণ ভালবাসেন। সে অন্য কথা। শেষমেশ বাগ দাদা বাগদাদীকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেললেন। তারপর সব নার্স, হোস্টেজ সকলকে ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি এজেন্টদের হাতে দিয়ে বাগ দাদা গেলেন বৌকে বাঁচাতে। মার্কিনি মিসাইলের ধ্বংসলীলা শুরু হওয়ার মিনিট খানেক আগে ফাইনালি বাস ভর্তি সকলে সেফ জোনে পৌঁছে যান বাগবাবুকে ছাড়াই। সেখানে ইন্ডিয়ান পাকিস্তানি এজেন্টদের একেবারে গলাগলি মাখামাখি ভাব। ISI-এর এজেন্ট ভারতের পতাকা তুলছে, RAW-এর এজেন্টরা  পাকিস্তানি পতাকা তুলতে উৎসাহ দিচ্ছে – সে একেবারে জমে ক্ষীর। বাগবাবু এদিকে তাঁর ক্যাট-আই প্রাণাধিকাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন হাসপাতালের গোপন গহ্বরে। পরিচালক অবশ্যই বাগবাবুকে মেরে ফেলে আপামর ভারতবাসীকে চোখের জলে ভাসাতে চান নি। তাছাড়া প্রযোজকবাবু নিশ্চয়ই আর একটা “ব্লক ব্লাস্টার সিকুয়েল”-এর স্বপ্ন দেখছিলেন। তবে হুড়মুড় করে বোম পড়তে থাকা শহর থেকে বাগবাবু কিভাবে উদ্ধার পাবেন সেটা দেখানোর চাপ পরিচালক মশাই অবিশ্যি আর নেননি। ভালই হয়েছে। অলরেডি বাগবাবুর বিক্রম দেখে ফেলেছি প্রায় ঘণ্টা তিনেক। আরও দেখলে গুরুপাক হয়ে যেত। শুধু বছর ঘুরলে দেখা যায় সস্ত্রীক বাগবাবু অন্য এক ইউরোপিয়ান শহরে নদীর জলে পা ডুবিয়ে ফুর্তি করছেন। ছবি সমাপ্ত।

নাম দেখানোর সময় একটু নাচাগানা হল। ক্যাটরিনাদেবী সারা বছর ধরে দিনে শুধু দুটো করে লঙ্কা পোড়া খেয়ে অমন মোহিনী শরীর বানিয়েছেন, অমন লোভনীয় পাতলি কোমর বানিয়েছেন – তা ওনারও তো একটু সখ হতে পারে একটু গানের তালে কোমর দোলানোর। তাছাড়া নার্সরাও সব উদ্ধার পেয়ে গেছে। অতঃপর ঢিঙ্কা চিকা।

সব মিলিয়ে ভীষণই মনোরঞ্জক ছবি – টাইগার জিন্দা হ্যায়। শুধু টাইগারবাবু হেভি গান ফাইটের সময় একটু বুলেট প্রুফ টুফ পরে নিলে, আইসিস-এর একেবারে খোদ মুলুকে গিয়ে শুরু থেকেই হাঙ্গামা না মাচিয়ে আর একটু গোপনীয়তা অবলম্বনের চেষ্টা করলে এমনকি সন্ত্রাস সংস্থার প্রধান বাগদাদীবাবু যিনি কিনা মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার জন্য একেবারে “হাই ভ্যালু টার্গেট” তিনি যদি একেবারে খুলে-আম রাস্তায় না ঘুরতেন, একটু গোপনীয়তা অবলম্বনের চেষ্টা করতেন তবে হয়তো ছবিটা আরেকটু সহ্য করা যেত।      

****   

বাধ্যতামূলক সতর্কীকরণঃ যযাতির ঝুলির সব লেখাই শতাধিক বার ফেসবুকে শেয়ার হয় সেটা তো সুধী পাঠক বা প্রিয়দর্শিনী পাঠিকা নিচের ফেসবুক শেয়ার বাটন দেখে বুঝতেই পারছেন। এত অকুণ্ঠ ভালবাসা দেওয়ার জন্য পাঠক পাঠিকাকে যযাতির আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আপনিও শেয়ার করুন। কিন্তু শেয়ার করার আগে নিচের কমেন্ট বক্সে (বেনামী হোক বা নাম সহ) একটি মন্তব্য ছেড়ে যান যাতে যযাতি তার যজমানদের একটু চিনতে পারে। যযাতি তার ফেসবুক পেজের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। পোস্ট ভাল না লাগলে আপনাকে ছাড় দেওয়া হবে, কিন্তু ভাল লাগলে কমেন্ট না করে শুধু শেয়ার করলে যযাতির অভিশাপে (বিবাহিত হলে দাম্পত্য কলহজনিত কারণে আর অবিবাহিত হলে বাবা মার দাম্পত্য কলহজনিত কারণে) আগামী রবিবার রবিবাসরীয় লুচি তরকারি থেকে বঞ্চিত হবেন। 🙂 🙂

ত্রিয়া চরিত্রম

স্ববাবু মহারাজা যযাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন “প্রভু, মহামতি মনু লিখেছেন ‘ত্রিয়া চরিত্রম দেবা ন জানতি কুতঃ মনুষ্যঃ’ – হেঁ হেঁ তখন থেকেই বুঝি টাইপো অর্থাৎ কিনা typographical error-এর জন্ম। উনি নিশ্চয়ই “স্ত্রিয়া চরিত্রম” লিখতে গিয়ে ছড়িয়ে ফেলেছেন। তাই না?

মহারাজ যযাতি বললেন “না হে বৎস। কালি-কলম ইত্যাদি কি-বোর্ড দিয়ে প্রতিস্থাপিত হওয়ার আগে পর্যন্ত হতভাগ্য লেখকেরা বানান-টানান আর একটু সিরিয়াসলি নিত। ত্রিয়া মানে unnamedহল গিয়ে বুদ্ধি বা মতি। মতি তিনপ্রকার – গুর্মতি, মন্মতি আর দুর্মতি অর্থাৎ কিনা শুভ বুদ্ধি, নির্বুদ্ধি আর দুষ্ট বুদ্ধি। যেহেতু বুদ্ধি স্ত্রী-লিঙ্গাত্মক শব্দ, তাই কলিযুগে বাঙালি নামক ক্ষুরধার বুদ্ধিধর এক ধরনের প্রাণী এটিকে “স্ত্রীয়া চরিত্রম” করে নিয়েছে। বিয়ে-থা তো করেছ বৎস। তো বুঝতেই পারছ কথাটাকে “স্ত্রীয়া চরিত্রম” করে নিলেও সত্যের অপলাপ তেমন হয় না।”

তা যা বলেছেন স্যার। দেখুন না, দুগগা ঠাকুর দেখতে যাবে বলে আমার বেটার হাফ গোটা দশেক শাড়ি কিনে ফেললেন। জিগেস করলাম “পুজোর চারদিনে তো চারটেই শাড়ি লাগবে” – তাতে উত্তর দিলেন “আরে বাবা সকাল-সন্ধে পড়তে হবে না?” আমি বললাম “তাহলেও সর্বসাকুল্যে আটটা”। আমার স্ত্রী বললেন “বিসর্জন কবে হয় এখন তার ঠিক নেই। তাই দু-তিনটে বাফার শাড়ি রাখতে হবে না?”  বলুন স্যার এরপরেও যদি আমি বলি আমি আমার স্ত্রী-বুদ্ধি ইয়ে মানে আমার স্ত্রী-এর বুদ্ধির গতি এখনও বুঝতে পারিনি, কিছু ভুল বলা হবে স্যার?

যযাতি বললেন “ঠিক ঠিক। শাস্ত্র ছাড়, এই জন্যই কবিবরেরা বলে গেছেন – রমণীর মন বড় সাধনার ধন।” মানে নারীমন পেতে গেলে এবং বুঝতে হলে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে।    

“প্রভু, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বিচিত্রগতি কি তবে নারীদের মন?”

“তবে প্রভু, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বিচিত্রগতি কি তবে নারীদের মন?”

তার থেকেও বিচিত্রগতি হচ্ছে ইন্টার-ব্যালিস্টিক মিসাইল। কিম বাবু কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে কোরিয়া থেকে কুমায়ুন কিম্বা সাইবেরিয়া কি শিকাগো সফর করে। এই জন্যই বলিউডের কিং অব রোমান্স গেয়ে গেছেন “সফর কা হি থা ম্যায় সফর কা রাহা”। সে যাক। তবে এর থেকেও বিচিত্রগতি এক বস্তু আছে।

কি স্যার?

সেটি হল পাঠকের মন। আজ তোমার লেখা পড়ছে, কাল দুর-ছ্যা করবে। তাই ঠ্যাকায় পড়লেও কখনো পাঠককে ঠকাতে যেও না।

  

রবিবাসরীয়

happy-sunday-quotes-sunday-humorরবিবার সকালবেলা কোথায় সদ্য ভাজা গরম মুচমুচে চিঁড়ে ভাজার মত আবহাওয়া থাকবে, কোথায় শরতের মেঘের মত হালকা খুশি ভাসবে বাতাসে, মার্চ মাসের ভোরের মত না-গরম-না-ঠান্ডা একটা ফুরফুরে মেজাজ বাড়িতে ঘুর ঘুর করবে তা না, সকাল থেকে শ্রাবণের জলদ গম্ভীর আকাশের মত হাল বাড়ির। বৃষ্টি কখন নামে তার ঠিক নেই। ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ আছে। শমীক টিভিটা খুলে দেখবে কিনা সেই নিয়ে বেশ খানিক চিন্তা করে আপাতত না দেখাই ঠিক হবে ডিসিশান নিয়েছে। মোবাইল খুলে অফিসের মেল চেক করার নাম করে ক্রিকইনফো ডট কম থেকে লেটেস্ট স্কোরটা দেখে নিচ্ছে। আর মুখটা যারপরনাই গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছে। রবিবার দুপুরে একটু কচি পাঠার ঝোল খাবে বলে কাল থেকে মনের মধ্যে কাঠবিড়ালি টাইপস হালকা খুশি তিড়িক তিড়িক করে চড়ে বেড়াচ্ছিল। সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠেই বিল্টুর দোকান থেকে নিয়েও এসেছে। কিন্তু সেই মাংসের ব্যাগ রান্নাঘরের এক কোনায় পড়ে আছে। অনাদৃত। এতক্ষনে তাদের কড়াইতে পেয়াজ টোমাটোর কার্পেটে শুয়ে গরম তেলের জাকুজিতে হট বাথ নেওয়ার কথা। ছাল ছাড়ানো নুন মাখানো অবস্থায় পড়ে আছে মাংসের আলুরা। মানে যাদের মাংসের ঝোলে সিক্ত হয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনে রসনার মধ্যে অদ্ভুত সঙ্গীত সৃষ্টি করবার কথা ছিল। বাবাই বই-এর পাতা খুলে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। শমীক জানে তার এখন এক বিন্দুও পড়ায় মন নেই। চুপচাপ বসে বাড়ির সিচুয়াশানটা জাজ করার চেষ্টা করছে। কারণ এতক্ষনে তার বারোয়ারি তলার মাঠে বল পিটতে যাওয়ার কথা। এমনকি চারপেয়ে ভুলোও কি বুঝে বেশি ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই করছে না। আর এ বাড়ির হাইকমান্ড ওরফে হোমে মিনিস্টার ওরফে শমীকের স্ত্রী, অন্তরা, গম্ভীর মুখে বসে টিভিতে কি একটা সিরিয়াল দেখছে। চোখের কোনে একটু জল শুকিয়ে আছে। শমীক আড়চোখে একবার দেখে নিয়েছে। এটা সেই সিরিয়ালটা। একটা ভীষণ ভাল বউমা সংসারের সব কাজকর্ম বিনা বাক্যব্যয়ে করে ফেলছে। শাশুরি-ননদ সকলেই তার সাথে অত্যন্ত ঢ্যামনাগিরি করলেও বউমার সাত চড়ে মুখে রা নেই। দুদিন বাদে বাদেই তাকে গয়না চুরির অপবাদ দিলেও সে শুধু মাত্র সংসারের মঙ্গল চিন্তা করে। এমন সহমর্মিতার প্রতিমুর্তি দেখলে ভগবান বুদ্ধ-ও বোধ করি লজ্জা পেতেন। এমন ক্ষমার ক্ষমতা দেখে মেজাজ চটকে গিয়ে গান্ধিজীও বোধ হয় একটি চড় কষিয়ে দিতেন বউমাটিকে – মনে মনে ভাবে শমীক। নর্মাল দিনে সে সিরিয়াল চললে পাশ থেকে টিপ্পুনি কেটে থাকে। কিন্তু আজ সিচুয়েশান খুব চাপের। কি থেকে ঝামেলা শুরু হয় তার ঠিক নেই। তাই সে ক্রিক-ইনফোতে মনোনিবেশ করে আবার।

সকাল পর্যন্ত সব ঠিক-ই ছিল। ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাবাই এর সাথে অন্তরার “দাঁতটা মাজ না রে বাঁদর। দুধটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে না” টাইপস স্নেহ সম্ভাষণে বোঝা যাচ্ছিল একটা নর্মাল দিন। বাজারে যাওয়ার সময়েও অন্তরা বলল “একদম হাড়-ওলা মাংস আনবে না। আর শোনো মেটে নিয়ো তো।” শমীক বলল “কেউই যদি হাড়-ওলা মাংষ না নেয় তাহলে মাংসের দোকানদারদের এবার থেকে জেনেটিকালি মডিফায়েড বোনলেস পাঁঠা প্রোডিউস করার কথা ভাবতে হবে”। এটা শমীকের প্রি-ডিফেন্স। সে জানে সে যতই চেষ্টা করুক না কেন ঠিক হাড়ওলা মাংসই তার কপালে জুটবে। অন্তত অন্তরার সেরকমই বক্তব্য হবে। অন্তরা নিজে গিয়ে নিয়ে আসলে মাংসের গুণমান, কোয়ালিটি ইত্যাদি ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের মত ঝকঝকে হয়ে যায় কেমন করে একটা। এই অব্দি সব ঠিক ছিল। বাজার থেকে ফিরে শুনলো কেস গড়বড়। অন্তরার তার কেটে গেছে। কেমন একটা তড়িৎপৃষ্ট মুখ। কি না সকালের ডেইলি এফ বি ডায়েট করতে গিয়ে অন্তরা দেখেছে ওর মা চন্দ্রানির এফবি স্ট্যাটাস

“শঙ্কুর পা মচকে গেছে। হাড় ভেঙ্গেছে কিনা জানা যাবে ডাক্তার দেখালে। ফীলিং স্যাড।”

শঙ্কু অন্তরার বাবার নাম। তখন থেকেই অন্তরার ভীষন দুশ্চিন্তা। দুবার ফোনও করেছে। কিন্তু মা ফোন ধরে নি। নিশ্চয়ই এখন ডাক্তার-হসপিটাল-নার্সিং হোম করছে। শমীক মনে মনে ভাবে, ভদ্রলোক আর দিন পেলেন না। থেকে থেকে এই রোব্বার সকালেই পা মচকালেন। এর জন্য মৃত পাঁঠা ওনাকে কোন দিন ক্ষমা করবে না। সোমবার কি মঙ্গল বার করে পা মচকালে বিশাল মহাভারত অশুদ্ধ হত? আর শাশুড়ি মার বলিহারি। সামান্য পা মচকেছে তাতে ঘটা করে স্ট্যাটাস আপডেট দেওয়ার দরকার কি? ডাক্তার দেখিয়ে পা ভেঙ্গেছে জেনে দিলে তাও একটা কথা ছিল। সব সময় মেয়েদের বাবা-মারাই বেশি স্মার্ট হয় কেন শামীক বোঝেনা। শত শত বার চেষ্টা করেও নিজের বাবা-মাকে স্মার্ট ফোন ধরাতে পারেনি। রোব্বার এই এগারটা নাগাদ দ্বিতীয় বার কফি খায় সে। অনেক চেষ্টা করেও কফিটা অন্তরার মত বানাতে পারে না। বিবাহোত্তর জীবন যে মেয়েরা  “জিনিয়াস” হয় এটা শমীক সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করে। কিন্তু আজ অন্তরার হাতের কফি তো দুরের কথা, নিজেও যে বানাতে যাবে, সেটাতেও ভরসা পাচ্ছে না। হঠাৎ যদি “আমার বাবার পা ভেঙ্গেছে তোমার কোন মাথা ব্যাথাই নেই” শুরু করে দেয় তাহলে নিজেকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে প্রবল মাথা ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা। এই সময় বিরাট কোহলি না খেলে রাহুল দ্রাবিড় খেলাই ভাল। বল আসলেই ডট। ডট। ডট। লম্বা খেলতে হলে দু একটা ওভার মেডেন ছাড়তেই হয়।

এই সময় বিরাট কোহলি না খেলে রাহুল দ্রাবিড় খেলাই ভাল। বল আসলেই ডট। ডট। ডট। লম্বা খেলতে হলে দু একটা ওভার মেডেন ছাড়তেই হয়।

এমন সময় ফোনটা এল। অন্তরার মায়ের ফোন।

কি রে ফোন করেছিলি নাকি? দু-তিনটে কল দেখলাম

বাবা এখন কি করছে? আমি তো চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।।

কি আবার করবে? যা করে এই সময়। বিন্দাস শুয়ে আছে। আর আমার হয়ে গেছে বাঁশ।

ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছ কখন?

দেখি দু-এক দিন পরে নিয়ে যাব। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।

এখনো নাও নি? তুমি কি গো? পড়ল কি করে?

সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল। ওটা তো ওরকমই। সারাক্ষণ ফুটছে।

এই বয়সে বাবা লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। বাবার কি ভীমরতি হল নাকি?

তোর বাবা কেন নামবে? নামছিল আমার নতুন সোনামোনাটা। ও তুই বোধ হয় একে দেখিস নি। মাস খানেক আগে একদিন রাস্তায় দেখলাম ডাস্টবিন ঘাঁটছে। খেতে না পেয়ে রোগা। গায়ে ঘা। আমি তো জানিস-ই পশুপ্রেমী। এই সব দেখলেই চোখে জল চলে আসে। তা কুকুরটাকে বাড়ি আনলাম। সবে খাইয়ে, ভেটেরিনারি ডাক্তার দেখিয়ে একটু সুস্থ করে তুলেছি, আজকে দেখ না পড়ে গিয়ে পা টা মচকে বসে আছে। লেংড়ে হাঁটছে। আমার কপাল। সারা জীবন অন্যদের সেবা শুশ্রুষা করেই গেল।

ঊফফ মা। এইটা ঘটা করে এফবি আপডেট দিয়েছ?

কেন? তুই দিস না। শমীকের জন্মদিনে একই ঘরে থেকেও এফ বি তে “হ্যাপি বার্থ ডে মাই লাভ” দিস না? তুই দিলে সেটা ফেসবুক স্ট্যাটাস আর আমি দিলে আদিখ্যেতা?

আঃ মা ঝগড়া কোরো না তো! কিন্তু তুমি শেষে বাবার নামে কুকুর পুষেছ? বাবার সাথে তোমার ঝগড়া-টগড়া এইভাবে পাবলিক করার কোন দরকার ছিল?

বাবার নামে কেন পুষতে যাব? ওই নামের একটা মানুষকে সামলাতেই সারা জীবন হিমসিম খেয়ে গেলাম। আবার আর একটা? আমি পাগল নাকি? ওর নাম তো রেখেছি বঙ্কু। আমাদের ছেলের মতই তো। তাই তোর বাবার নামের সাথে মিলিয়েই রাখলাম।

ঊফফ মা। তুমি না? মানে কিছু বলার নেই। তাহলে এফবি তে দিয়েছ কেন শঙ্কুর পা ভেঙ্গে গেছে বোধ হয়।

ও শঙ্কু লিখেছি বুঝি। ওটা বঙ্কু হবে। এই ফোনটাও বলিহারি? আগে ব্যাবহার করা ওয়ার্ড ফট করে রিপ্লেস করে দেয়।

অন্তরা মায়ের সাথে আরও কিছু ঝগড়া করে ফোন রাখল। মুখে হাসি ফুটেছে। টিভিতে তখন সেই সুপারলক্ষী বৌটি পরাধীন ফ্রান্সের সেই কিংবদন্তী কৃষককন্যা জোন অব আর্ক-এর মত তার শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কোন এক দুষ্টু লোককে শাস্তি দিতে যুদ্ধ যাত্রা করেছে। রিমোটের একটা বাটনের আঘাতে সে ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে যায়। অন্তরা এবার রান্নাঘর মুখো। শমীক স্পষ্ট দেখতে পায় ব্যাগ-এর মধ্যে থাকা মাংসের টুকরোর মুখ উজ্জল হয়। মনে হচ্ছে দুটো-আড়াইটের মধ্যে মাংসের ঝোলটা দাঁড়িয়ে যাবে। বাবাইও সুযোগ বুঝে বলে ওঠে “মা আমি খেলতে যাই?” ভুলো লাফিয়ে সোফায় উঠে রাজার বেটা ঘুগনিওলার মত বসে পড়ে। শমীকও রিমোটটা নিয়ে টিভিটা চালিয়ে ফেলে। ম্যাচের বাকিটা এবার আরাম করে সোফায় বসে টিভিতেই দেখা যাবে। কোহলি ততক্ষণে পিটিয়ে ম্যাচটাকে প্রায় মেরে এনেছে।

ওভারশুট ডে

শোচনীয় সিচুয়েশানে শ্যামবাজারের শ্যামলা
বলল হেঁকে “আর পারিনে, এবার তোরা সামলা।
মরবি তোরা মরবি এবার, এবার পাবি অক্কা
সারা বছরের রসদ তোদের আগাস্ট মাসেই ফক্কা?

এই গ্রহ যা দিতে পারে এক বছরের খাবার
খিদে তোদের এতই যে সব আগাস্ট মাসেই সাবাড়?
তেল পোড়ানো কমাতে হবে যতই বলি তোদের
শুনবি না গরিবের কথা। দেখ ফলাফল জেদের –
এক শতাব্দীতে মানুষ ডাবল কিন্তু বলে রাখি
আটান্ন পার্সেন্ট হয়েছে মাছ আর পশু পাখি
বৃষ্টিবাদলা কমছে ক্রমেই চেঞ্জ হচ্ছে ক্লাইমেট
এ চললে ঠিক লোপ পাবে সব মানুষ, বাঁদর, প্রাইমেটস

আমিষ খাওয়া কমা, তোরা তেল পোড়ানো কমা
নয়তো আর এক শতক শেষে কাঁদবি “ছেড়ে দে মা”
বাঁচতে চাস তো কন্ট্রোল কর কার্বন এমিশান
নয়তো এ রেলগাড়ি পৌঁছবে শেষের ইস্টিশান
এই পৃথিবী বাঁচাবো আমরা – আয়নার সামনে
প্রতিজ্ঞা কর। আজ বছরের ওভারশুট ডে”

★★★

সব শুনেটুনে বলল সবাই লোকটা বোধ হয় পাগল
নয় মাওয়িস্ট নয়তো নেতা কিম্বা নিছক গাড়োল

“Living within the means of one planet is technologically possible, financially beneficial, and our only chance for a prosperous future”

We used all resources that we will be able to replenish throughout the year by August 2, this year. August 2 is the overshoot day for this year.

https://www.cnbc.com/2017/08/02/its-earth-overshoot-day-weve-used-more-resources-than-nature-can-regenerate-in-2017.html

সকাল থেকে জরুরি অবস্থা ঘোষনা করা হয়েছে। পথ ঘাটে অবস্থা ভাল না। মাঝে মাঝেই বিপক্ষ সৈনিকের ভারি বুটের টহলদারির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হাতে সেই মোক্ষম অস্ত্র। লোহার শেকলের মত তার ধাতব শব্দ শুনলে বাঘা বাঘা ডাকাবুকো কমরেডদেরও হৃৎকম্প হয়। রৌনক ঘরে খিল দিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। ফেসবুকে হোয়াটস-আপে বিভিন্ন কমরেড বন্ধুদের ধরা পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। রক্তের অক্ষরে লেখা হচ্ছে এক একটি নাম। মাঝে মাঝেই অন্য পক্ষের সৈনিকেরা বিভিন্ন দড়জায় নাড়া দিয়ে দেখে যাচ্ছে কেউ ছাড়া পেয়ে গেল না তো। রৌনক দুরু দুরু বুকে ইষ্টনাম জপ করতে থাকে “ভগবান, এ যাত্রায় আমায় বাঁচিয়ে দাও। পুরো আগামী বছর কারও দিকে মুখ তুলে তাকাব না। মা কালির দিব্যি!!!” ঘড়ির কাঁটা বলছে সন্ধে আটটা। আরও ঘণ্টাচারেক চলবে বিপক্ষের কুচকাওয়াজ। এই সময়টুকু underground থাকতে পারলে তবেই এ যাত্রায় পার পাবে রৌনক…..

★★★

আজ রাখী পূর্ণিমা…

কলকাতায় ভেনিস

ঘুমের মধ্যে বললেন এসে হরি
“এবার তোমায় যেতে হবে। চলো হে তাড়াতাড়ি”
আমি বললাম “হে প্রভু আপনার পায়ে পড়ি
আমায় কেন যেতে হবে এখুনি যমের বাড়ি?
কি দোষ আমার? আমি কি চুরি করি?
নাকি আমি election লড়ি?
নাকি আমার খাটের তলায় হাজার টাকার নোটের ছড়াছড়ি?
যদি কোনো মেয়ের জন্যও শপিং করি সেও তো আমার বৌ নয় শ্বাশুড়ি।
আমি তো বিনয়ী শান্ত, আমার নয়তো পায়াভারি
দোষের মধ্যে যা একটু মেয়েদের ঝারি মারি
তাও যদি সে হয় ডানা-কাটা পরী
– এগুলো তো কোনো দোষ নয় আহামরি।
তা…আমি এই কান মলছি আমায় ছেড়ে দিন মাইরি
আমি সামান্য মানুষ, আমি আদার ব্যাপারি
কেন আমায় গোটাতে হবে পাততাড়ি
সাততাড়াতাড়ি?
কি দোষে শেষ station-এ আমার রেলগাড়ি?
কতো লোকের কেচ্ছা কাহিনী অগণ্য। কাঁড়ি কাঁড়ি।
কতো লোকের কোটি টাকার চোরাকারবারি
গরীবের রক্ত খায় আর করে মন্ত্রীর তাঁবেদারি
তবে কেন যাবার সময় হল শুধু আমারই?”

স্মিত হেসে বললেন পদ্মনাভ হরি
“আমার কাজ তো পালন, পাগলা, আমি থোড়ি না মারি
তোর জন্য এনেছি দেখ mercedes গাড়ি
চল তোতে-আমাতে ঘুরে আসি টালিগঞ্জ ফাঁড়ি
প্রয়োজনে এই গাড়ি হতে পারে submarine – ডুবুরি
বর্ষায় ভীষণ ভিজে কলকাতা এখন vintage ভেনিস নগরী
জমা জল নিয়ে নেতারা খেলুক চু কিত কিত, হোক আম্পায়ার রেফারী
তুই রেডি হয়ে নে। ডোন্ট ডু দেরী।
তোতে আমাতে করে আসি চল বন্যা সাফারি” 🙂 🙂

নীড়ে ফেরা

অরিত্র মোবাইলে দেশের খবর পড়তে পড়তে চায়ের কাপটায় লম্বা চুমুক লাগায়। আজ মনটা তার বেজায় খুশি খুশি। শিরায় উপশিরায় ধমনিতে যেন একটা গঙ্গাফড়িঙ তির তির করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোটবেলায় অ্যানুয়াল পরীক্ষার শেষ দিনে পরীক্ষা দিয়ে আসার পর যেমনটা হত।  এই সবে লং ডিস্ট্যান্স ফোনটা শেষ করেছে সে। ডীলটা পাকা হয়ে গেল। অনেক পুরুষ ধরে বিশুদ্ধ কলকাতাবাসী সে। তার কোন ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ঢাকা শহর থেকে গুটিয়ে বাটিয়ে কলকাতা চলে এসেছিল। বাসা বিনিময় করেছিল কোন এক তাহের আলির সঙ্গে। অরিত্রকেও যে সেইরকমই একটা কান্ড করতে হবে কে জানত। কিন্তু ঠাকুরের কৃপায় পাওয়া গেছে একজনকে। ভদ্রলোকের নাম বিনিত আগরওয়াল। মাড়োয়ারি। কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না প্রথমে। ব্যাটা বানিয়া বলছিল

“আপনার বাড়ি আমার পসন্দ আছে কিন্তু ওখানে গিয়ে হামি বেবসা জমাতে না পারলে আমার কি হোবে” এই সব। অরিত্র ওকে অনেক স্তোকবাক্য দিয়েছে।

“আপনার কাপড়ের দোকান এখানে রমরম করে চলবে। অনেক ঘর বাঙ্গালি আছে। অর্থাৎ কিনা শাড়ির ব্যাবসা চলতে বাধ্য। সেরম কোন শাড়ির দোকানও এখানে নেই। আপনি কলকাতা থেকে শাড়ি কিনে আনবেন আর এখানে তিন গুন দামে বিক্কিরি করবেন। এক বছরের মধ্যে আপনার বৌয়ের গলায় শেকলের মত মত মোটা সীতাহার বাঁধা। একদম অচলা লক্ষী আপনার বাড়িতে” ইত্যাদি।

ব্যাটা তাও গাঁইগুই করে। শেষমেষ ব্রহ্মাস্ত্রটা ছাড়ে অরিত্র। সঙ্গে সঙ্গে রাজি বিনিত। চায়ে আর এক চুমুক লাগিয়ে ঈপ্সিতাকে ডাকে সে। “ও গো শুনছো, পাকা কথা হয়ে গেল। আসছে বছরের মাঝামাঝি করে বিনিত-এর চৌরঙ্গির বাড়িটার পজেশান পাচ্ছি। আর এ বাড়িটা ওর। কদ্দিন পরে কলকাতা ফিরব..উফফ ভাবতেই পারছি না। প্যাকিং-ট্যাকিং চালু করো।”

এখন থেকে কি? দেরি আছে তো।

কই আর দেরি। যেতে সময় লাগবে না?

হুমম। তুমি যখন এ শহরে বাড়ি কিনছিলে তখনই বারণ করেছিলাম। বলে ছিলাম “কিনছ তো। কিন্তু এরম একটা ধরধরা গোবিন্দপুরে গিয়ে থাকতে পারবে তো কলকাতা ছেড়ে?” তখন তো কত জ্ঞান দিলে। “ইপ্সু, আমরা হবো গিয়ে আর্লি অ্যাডপ্টার। সব থেকে বেশি সুবিধে আমরা পাবো। সব থেকে বেশি লাভ আমাদের হবে।” হ্যানা তানা।

কি করবো? তখন তো এই নতুন শহরে কেউই আসতে চাইছিল না বলে জলের দরে জমি বাড়ি বিক্কিরি করছিল। লোভে পড়ে…

তো বছর তিনেকও তো হয়নি আমরা এখানে এসেছি। এর মধ্যে তোমায় কি ভুতে কামড়ালো যে ফিরে যেতে হচ্ছে? কি খারাপটা আছে এ শহরে শুনি?

কিছুই খারাপ নেই। সেইটাই সবচেয়ে বড় কারণ ইপ্সু।

সত্যিই তো নেই। চব্বিশ ঘন্টা ইলেক্ট্রিসিটী, জলের সমস্যা নেই, গ্রসারি টসারি অর্ডার করলেই হোম ডেলিভারি

২৪ ঘন্টা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, আউট অফ দি ওয়ার্ল্ড চিকিৎসা ব্যাবস্থা – যোগ করে অরিত্র।

তারপর মে মাসের প্যাচপেচে গরম নেই। আগাস্ট সেপ্টেম্বর-এর রাস্তা উপচানো জল কাদা নেই।

ঠিক ঠিক। সবই ভাল। কিন্তু এ শহরে কোন খবর নেই ইপ্সু। ঘটনা নেই। দিন নেই রাত নেই। শহরের নাম শুনলেই মনে হয় জেলখানা। কোনদিন শুনেছ কোনো শহরের নাম হয় হান্ড্রেড অ্যান্ড টু?

তা বলতে পারো। হ্যাঁ, এখানে ফুচকা নেই। গড়িয়াহাটে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা শাড়ির দোকান নেই। চেৎলার মোড়ের মাছের বাজারের চিতল মাছ নেই।

তারপর এখানে সাউথ সিটি মল নেই, রাস্তার ধারের এগ রোল নেই, হাত বাড়ালেই দীঘা মন্দারমুনি নেই, পাটায়া-ফুকেট এর হলিডে প্যাকেজ নেই। নাহ, এখানে থাকা চলে না। এখানে মেড়োই ঠিক আছে।

কিন্তু মানালে কি করে ভদ্রলোককে? উনি তো বেঁকে বসেছিলেন।

আরে ব্যাবসায়ি মানুষ। ছাড়তেও পারছিল না। ওর দু কামরার বাড়ির বদলে আমি আমাদের এখানের বিশাল বাগান বাড়ি দিচ্ছি।

তবুও তো আসতে চাইছিলেন না।

একটা মোক্ষম অস্ত্র ছাড়লাম। বিনিত কাত।

কি বললে?

বলে দিলাম এখানে সরকার ইনকাম ট্যাক্স নেয় না।

এ বাবা, তুমি না যাতা এক্কেরে।

মিত্থে তো বলিনি। এখানে সব ট্রান্সাকশানই ডিজিটাল। তাই প্রতিটা টাকা হস্তান্তরেই ট্যাক্স কেটে নেয়। কিন্তু সেটা বলিনি ওকে। ট্যাক্স দিতে হয় না জেনে খুশি খুশি রাজি হয়ে গেল।

মনটা এখন আমারও বেশ খুশি খুশি লাগছে বুঝলে। আজ রাতে শেফ ইপ্সিতার হাতে তোমার জন্য বেনুদির চিকেন কষা।

বাহ। কিন্তু আমাদের বেরোতে হবে এই মাসেই। সাত মাসের পরে আর এয়ার ট্রাভেল করতে দেয় না। তোমার তো এখন তিন মাস চলছে।

ঠিক বলেছ। সেটা ভেবে দেখিনি। যেতে এখন কিরম সময় লাগছে?

ক্রেয়োজেনিক ইঞ্জিনে তিন মাস। মেসোজেনিক-এ দুই। কিন্তু ভাড়া ডাবল প্রায়।

যাক ভালই হল। আমার পেটে থাকা মিস্টুকে আর এম-বি-সি-ই হতে হল না।

সেটা কি?

Mars Born Confused Earthian!!

হ্যাঁ। সিরিয়াসলি। এই মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকে না। চলো এই আনন্দে আজ আমরা লুডো খেলি। জড়িয়ে ধরে অরিত্র ইপ্সিতাকে।

এই কি হচ্ছে। মিস্টু আছে না?  ছাড়ো। আর সিটি ১০১ এ  যে বাড়িটা কিনলে?

ওটা তো পচিশ-শো-পচিশের রিসেশানে কিনেছিলাম। কলকাতা থেকে ওখানে এখন তিন দিনেই যাওয়া যায় আজকাল। সামার হোম করে রেখে দেব। “এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব সেই চাঁদের পাহাড়” গাইতে গাইতে বেরিয়ে পড়লেই হল। পরে যদি দেখি তেমন যাওয়া-টাওয়া হচ্ছে না ভাড়া দিয়ে দেব। চলো এখন আমরা বেনুদিকে পাকড়াই।

ঈপ্সিতা রান্না ঘরের দিকে যায়। অরিত্র চায়ে চুমুক দিতে দিতে গুনগুনিয়ে গায়

“মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকে না।…সিন্ধু ঘোটক থাকে না…”

“মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকে না।…সিন্ধু ঘোটক থাকে না…”

index

সেল্ফি স্বরূপ

selfie

স্ব-বাবু মহারাজ যযাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মহারাজ এই যে দিন-রাত অনবরত সকলের মুখে একটাই শব্দ শুনতে পাচ্ছি। “সেল্ফি”। এটি কি রূপ? এটি খায় না অঙ্গে মর্দন করে?”

মহারাজ যযাতি বললেন –

উত্তম প্রশ্ন বৎস। খুবই রুচিকর আর আকর্ষণীয় এই বস্তু। ইহার পেছনে ইতিহাসও অতি মনোরঞ্জক। ধরাধামে কলিকালে এক ধরনের প্রাণির উদ্ভব হয়েছে যারা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করে। আকৃতিগত ভাবে মানুষদের সাথে সাদৃশ্য থাকলেও বাকি সকলই ভীষণরকম বিসদৃশ। আসল মানুষ যেখানে ফুল, পাখি, গাছ, পাহাড়, নদী দেখতে ভালবাসত এই মনুষ্য-সদৃশ জীব শুধু নিজেদেরই দেখতে ভালোবাসে। আমার অনুমান এরা বেদান্তের “আত্মানং বিদ্ধি” অর্থাৎ “নিজেকে জানো” এই মহান শ্লোকটির অনুসারি। তাই এরা নিজেকে জানার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন কোণ থেকে, বিভিন্ন আঙ্গিকে নিজেকে দেখতে উৎসাহী। এই নতুন প্রজাতির মানুষকে উত্তরমানব বা প্রায়-মানব বলা হয়। নিজেকে জানার এই ইচ্ছা এদের মধ্যে ক্রমে ক্রমে প্রবল থেকে প্রবলতর এবং অনধিক্রম্য হয়। প্রথম প্রথম এরা নিজেকে দেখার সাধ পুর্ণ করতে চিত্রকরকে দিয়ে নিজেদের চিত্রিত করাতো। অর্থাৎ নিজের ছবি আঁকাত। কিন্তু সে অতি সময় সাপেক্ষ ও ব্যায়-বহুল বলে বেশিরভাগ প্রায়-মানবকেই আয়ানায় নিজের মুখ দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হত। পরে এরা এদের উর্বর মস্তিষ্ক খাটিয়ে এক ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলে যার নাম “চিত্র বন্দি যন্ত্র”। অর্থাৎ এটা এক ধরণের ছবি ধরার ফাঁদ। এই অত্যাশ্চর্য যন্ত্রের সাহায্যে যে কোন দৃশ্যকে ফাঁদে ফেলে বাক্স-বন্দি করা যায়। কোন কিছুর দিকে এই যন্ত্র তাক করে একটি বোতাম টিপলেই ব্যাস। সুড় সুড় করে সে দৃশ্য এসে বাক্সের মধ্যে ঢুকে যাবে, সাথে সাথে বাক্সের দরজা বন্ধ আর ছবি বাক্স-বন্দি। সে ছবি তখন বাক্সের মধ্যে যতই ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার করুক না কেন, বাক্স থেকে বেরোনর কোন পথ নেই।

কোন কিছুর দিকে এই যন্ত্র তাক করে একটি বোতাম টিপলেই ব্যাস। সুড় সুড় করে সে দৃশ্য এসে বাক্সের মধ্যে ঢুকে যাবে, সাথে সাথে বাক্সের দরজা বন্ধ আর ছবি বাক্স-বন্দি। সে ছবি তখন বাক্সের মধ্যে যতই ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার করুক না কেন, বাক্স থেকে বেরোনর কোন পথ নেই।

কিন্তু প্রথম প্রথম সে যন্ত্র আয়তনে বৃহৎ হওয়ায় নিজের দিকে তাক করে বোতাম টেপার সুবিধে হত না। তখন সাগরে, পাহাড়ে জাদুঘরে, বাজারে সর্বত্র যেকোন চেনা-অচেনা-অর্ধচেনা লোক দেখলেই এই প্রায়-মানবদের বলতে শোনা যেত “দাদা, আমার একটা ছবি তুলে দিন না” বলে তার অনুমতির অপেক্ষা না করেই সেই ছবি বন্দি করার কলটা তার হাতে তুলে দিয়ে হাসিমুখে, ঘাড় বেঁকিয়ে বিভিন্ন নৃত্য বিভঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ত। এই ভাবেই কিছুকাল ধরে এরা নিজেকে দেখার এবং জানার তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল। কিন্তু অপরের সাহায্যের প্রয়োজন থাকায় সর্বতোভাবে নিজেকে জানতে পারছিল না অর্থাৎ যথেস্ট পরিমাণে নিজের ছবি তুলতে পারছিল না এবং তদহেতু অবসাদে ভুগছিল। ক্রমে ক্রমে এই যন্ত্র ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে একটি আঙ্গুর ফলের মত ছোট হল। এবং প্রায়-মানবদের আর এক আবিষ্কার দুরভাস যন্ত্রের মধ্যে স্থান পেল। তখন ঐ যন্ত্র নিজের দিকে তাক করেও নিজের চিত্র বাক্স-বন্দি করা সম্ভব হল। তখন প্রায়-মানবেরা সর্বপ্রকারে নিজেকে জানতে প্রয়াসী হল। সময়-অসময়, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় এরা নিজেদের পানে ঐ যন্ত্র তাক করে নিজেদের ছবি তুলতে লাগল। ইহাই “সেল্ফি”। অন্যের সাহায্য ব্যাতিরেকে নিজের স্বরুপ উদঘাটন করতে পেরে ইহাদের আনন্দের অবধি থাকল না। তখন মন্ত্রিমশাই থেকে মুচি-কসাই, টাটা-বিড়লা থেকে গরিব চা-ওয়ালা, রাজনীতিকার থেকে চোর পকেটমার, রাজা-গজা থেকে ভুমিহার প্রজা, কেস্ট-বিস্টু থেকে পটল, কেয়া, মিস্টু সকলেই ঘুমনোর সময়টুকু ছাড়া সর্বক্ষন সেল্ফি তুলতে থাকল।

তখন মন্ত্রিমশাই থেকে মুচি-কসাই, টাটা-বিড়লা থেকে গরিব চা-ওয়ালা, রাজনীতিকার থেকে চোর পকেটমার, রাজা-গজা থেকে ভুমিহার প্রজা, কেস্ট-বিস্টু থেকে পটল, কেয়া, মিস্টু সকলেই ঘুমনোর সময়টুকু ছাড়া সর্বক্ষন সেল্ফি তুলতে থাকল।

এমনকি কিছু কিছু প্রায়-অতিমানব গতিমান ট্রেন-এর সামনে বা উঁচু ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে সেল্ফি দ্বারা নিজেকে জানার প্রয়াস করে হাসি মুখে প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হল না। শুধু তাই নয়, ইহারা এই পর্বত প্রমাণ সেল্ফি বা নিজস্বি সকলকে ইহাদের আর একটি আবিষ্কার আন্তর্জালের মাধ্যমে মুহুর্তের মধ্যে মর্তলোকের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে একই সাথে এরা সকল ভুভাগে দৃশ্যমান হল। এবং এক ধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সবাই একে অপরকে অপূর্ব সুন্দর কিম্বা সুন্দরী বলে বাহবা দিয়ে নিজেদের আত্মগরিমা পুনঃ পুনঃ উজ্জীবিত করতে থাকল। তখন প্রায়-মানবেরা স্বোহম অর্থাৎ “আমিই সেই ব্রহ্ম” সেই পরম বোধে উত্তীর্ণ হয়ে আত্মজ্ঞানী হল। সচ্চিদানন্দের কৃপায় সৎ অর্থাৎ নিজের অস্তিত্বকে জানান দিতে নিজের চিৎশক্তি অর্থাৎ ইচ্ছাশক্তির সহায়তায় সেল্ফি আবিষ্কার করে এই প্রায়-মানবেরা আনন্দ লাভ করল এবং অনন্ত-আনন্দ-কারণ-সাগরে নিমজ্জিত হল।