সাইকেল বিহার – রম্যরচনা

[এই স্মৃতিচারণটি আমার নিজের শহর রামরাজাতলার ওপর। কিন্তু যেকোনো শহরতলির মানুষ আশা করি রিলেট করতে পারবেন। ১৫ নভেম্বর, ২০১৭-এর স্মৃতিচারণ ]

কদিন হল নিজের শহরে এসেছি। আজ সারাদিন বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোই নি। পুরোদিন বাড়িতে বসে শুষে নিয়েছি স্মৃতিগন্ধবাহী রূপকথাদের।

সারাদিন বাড়িতে বসে বসে হাতে পায়ে কেমন একটা জং ধরে যায় না? বেরিয়ে পড়লাম আমার প্রিয় সাইকেলটা নিয়ে। আমি ছাড়া আমাদের বাড়িতে আর কেউ সাইকেল চালানোর নেই। আগে বাবা চালাতো। এখন বয়স হয়েছে। আর সাইকেল চালায় না। বাবার এখন পদব্রজেই বিস্তার। দাদাও সঙ্গত কারণেই মোটর বাইকে শিফট করে গেছে। তাই প্রতি বছর দেশে ফিরলেই দেখি সাইকেলটা দুয়োরানির মত এক কোণে পড়ে আছে। কালিঝুলি মাখা জীর্ণ অবস্থা। আমি সাইকেলটাকে যা একটু প্যাম্পার করি। নিয়ে গিয়ে বাচ্চুদার দোকানে ফেললেই এক বেলার মধে চক্‌চকে স্মার্ট। এন-আর-আই  দেখে বাচ্চুদাও একশো টাকা হাঁকিয়ে বসে। দরাদরি করাটা কোনোদিনই আমি ঠিক ভাল পারি না। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে একটি পাতা ধরিয়ে বাহনটিকে হস্তগত করি। সেই সাইকেলটা নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাব কিছু ঠিক না করেই প্যাডেলে চাপ দিয়ে আমি সাইকেল আরোহি। বিনা কারণেই দুবার বেলটা টিপে দিই। টুং টুং টুং টুং। কি মিঠে শব্দটা। পথচারীদের পথ ছেড়ে দেওয়ার জন্য কি সুশীল, বিনীত অনুরোধ। যেন দুটো টুনটুনির ফিরিঙ ফিরিঙ প্রেমালাপ। বাইকের উদ্ধত হর্ন যদি ইয়ো ইয়ো হানি সিং হয় তবে এ যেন রাখালিয়া বাঁশি। এই সাইকেল চালানোটা আসলে আমার একটা style statement। মায়ের বুকের স্তন্যদুগ্ধের মত এই সবুজ গ্রহের বুক থেকে শুষে আনা ফসিল ফুয়েলের অবিরত অপচয়ের সামনে দাড়িয়ে এই যে মন্দগতি অথচ শব্দদুষণ, বায়ুদুষণরহিত যানটি – এ যেন এই উত্তুঙ্গ, তিল তিল করে আত্মহননের পথযাত্রী সভ্যতার বুকে একটা কড়া থাপ্পড়। আমি যখন সাইকেল আরোহি, দেখি এক অদৃশ্য placard লাগানো আছে আমার handle-এ “এই পৃথিবী আমায় একটু বেশি  ভালবাসে কারণ আমি আমার চলার পথের পাথেয় স্বততই তার স্তন্যদুগ্ধ পান করে সংগ্রহ করি না”।

 

আমাদের রামতলার রাস্তায় সাইকেল চালানোর জন্য যে gymnastic skill আয়ত্ত করার দরকার পড়ে সেটা রীতিমতো আয়াসসাধ্য – দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়ে সেটা আয়ত্ত করতে হয়। আপনার সাইকেলের পূর্ব-পশ্চিম-ঈশান-নৈঋত সব দিশাতেই ইঞ্চিখানেকের দূরত্বে নিশ্বাস ফেলছে বাইক, রিকশা, চারচাকা আর পদচারীরা। হাওড়ার গলিগালা, বড়রাস্তা সকলই কিঞ্চিত সরু, অপরিসর। এ কথা সকলেই জানে। আর বহুতল ফ্ল্যাটবাড়িগুলো আগমনের সাথে সাথে মানুষ যেভাবে বেড়েছে সেভাবে রাস্তাগুলো পেটমোটা হবার সুযোগ পায় নি। নিজেদের শীর্ণ ক্লীশ শরীর নিয়ে মানুষের পদভারে নীরবে ত্রাহি ত্রাহি করছে তারা। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বরূপ ইদানিং যোগ হয়েছে টোটো। শব্দহীন এই ত্রিচক্রযানটিও আপনার আগে-পিছে-ডাইনে-বাঁয়ে, শিশু প্রহ্লাদের ইষ্ট নারায়ণের মতই, সর্বত্র বিদ্যমান। এ হেন পরিস্থিতিতে গতিশীল সবরকম যানবাহনের মধ্যে একটা নির্ভুল সুষমা বজায় রেখে এবং অভিকর্ষের নিরন্তর ডাককে উপেক্ষা করে এই দ্বিচক্রযানের পিঠে করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা শিল্পকলা বললে বোধ হয় সত্যের অপলাপ হবে না। আমি নিশ্চিত রামতলায় যারা সাইকেল চালাতে পারে তাদের কোন বিলিতি সার্কাসে ওই দড়ির ওপর দিয়ে সাইকেল চালানো ইত্যাদি খেলায় অবলীলায় সুযোগ মিলতে পারে। তার ওপর আছে পান থেকে চুন খসলেই যাকে বলে হেভি বাওয়াল। এই দ্রুতগতি জীবনের সাথে পা মিলিয়ে চলতে থাকা অসহিষ্ণু ক্লান্ত মানুষগুলির মুখ থেকে একটু এদিক ওদিক হলেই বেরিয়ে পড়ছে দু অক্ষরের সেই লিঙ্গসূচক শব্দটি। মনুষ্যজাতীয় প্রাণীর সাথে যদি বা সমতান বজায় রাখতে পারেন, চতুষ্পদদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রাখা আর একটা শিল্প। একটু ফাঁকা গলি হলেই এ পাড়া ভার্সেস ও পাড়ার কুকুর মন্ডলীর gang fight-এর মধ্যে পড়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। আপনাকে “ইস্পাতের মত মজবুত আর ঠান্ডা স্নায়ু” যাকে বলে “নার্ভ অফ স্টীল” বজায় রেখে শক্ত হাতে একটা optimum স্পিড-এ তাদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এরা সাধারণত কামড়ায় না কিন্তু যেভাবে উচ্চৈঃস্বরে নিজের এলাকার দখলদারির সরব দাবি জানায় তাতে কামড়াবে না এই ভরসা রাখাটা যে সহজ নয় সেটা সহজেই অনুমেয়।

 

এইভাবে হেমন্তের মিঠে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে সাইকেলে চেপে পথ বাইতে বাইতে রামতলা বাজার পেরিয়ে সাঁতরাগাছি মোড় পেরিয়ে নতুন রাস্তার মোড়। তখন পথের নেশা চেপে বসেছে। প্যাডেল করতে করতে দালালপুকুর। কয়েকটা অতিকায় গাছ ঝুঁকে পড়ে ঐ ক্ষুদ্র জলাশয়টিকে যেন সভ্যতার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থেকে সশস্ত্র প্রহরীর মতই রক্ষা করছে। আর একটু এগিয়ে গেলে কিছু বছর আগে হলেও পেতেন পার্বতী সিনেমা আর তার একটু পরে শ্যামাশ্রী সিনেমা। কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পপকর্ন সমৃদ্ধ multiplex – এর যুগে আজকাল এই ধরনের একক ছবিঘরেরা, whatsup এর যুগে নিতান্ত টেলিগ্রামের মতই, outdated। আমাদের রামতলার শ্যামলী সিনেমা, যেখানে আমার মনে থাকা বয়সের প্রথম ছায়াছবি kingkong and godzilla দেখেছি, তার মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। এই সিনেমা হল দুটো বৃদ্ধ হেঁপো রুগির মত বেঁচে থাকার লড়াইটা চালিয়েছিল অনেকদিন। সভ্যতার অভিঘাতে মারা গেছে বছর দুয়েক হল। স্বর্গত শ্যামাশ্রী সিনেমা পেরিয়ে চলতে চলতে যখন মল্লিক ফটক পৌঁছলাম তখন মনে হল এতদূর এলাম যখন গঙ্গার ঘাটটা দেখে যাব না? অতএব ফের প্যাডেলে চাপ। মল্লিকফটক পেরিয়ে গঙ্গাগামী হলেই আপনি দেখবেন একটা সম্পূর্ণ অন্য সভ্যতা, এক অচেনা পরিবেশ। আলো ঝলমল, দোকানে দোকানে ছয়লাপ শহুরে সভ্যতা হঠাৎ যেন মৃত্যুগর্ভে বিলীন। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। এই এলাকাটি মূলতঃ হিন্দি ভাষাভাষী অবাঙ্গালী অধ্যুষিত। বিহার থেকে জীবিকার সন্ধানে কয়েক পুরুষ আগে এরা এখানে এসেছে। এই কয়েক পুরুষেও জীবন যুদ্ধে খুব একটা সফল যে হতে পারেনি তার পরিচয় মিলবে বাড়ি-ঘর-দোর-দোকানপাটের চেহারা দেখে। আর্থিকভাবে অনুন্নত এই এলাকাটা একটা মিনি বিহার বলা চলে। পার্থক্য একটাই। এরা প্রায় প্রত্যেকেই ঝরঝরে বাংলা বলতে পারে প্রয়োজনে। সন্ধ্যে নটার পরে গেলে যদি কান খাড়া রাখেন দু এক কলি “রামা হৈ” কি হনুমান চালিশা শুনতে পাবেন। কিছু নির্বিবাদী মানুষ খালি গায়ে বসে লিট্টী সহযোগে নৈশভোজ সম্পন্ন করছে দেখতে পাবেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই গোটা ছয়েক ছাতুর সরবতের স্টল স্পট করে ফেলতে অসুবিধে হবে না। কখনো সুযোগ হলে একবার চেখে দেখবেন। আমাদের Cafe Coffee Days-এর চারশো টাকার পানীয়ের তুলনায় এই দশ টাকার (এখন বোধ হয় কুড়ি) ছাতুর শরবৎ লেবু আর মশলার ঝাঁজে খুব একটা কম সুস্বাদু নয়। শেষমেশ একটু-আধটু রাস্তা গুলিয়ে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা বাঁক ঘুরতেই আসন্ন সেই সুবিস্তীর্ণ গঙ্গা। সাইকেলটাকে stand করে দাঁড়াই। এখানে গঙ্গার রূপ কিন্তু স্বচ্ছসলিলা, পূণ্যতোয়া নয়। সেই হরদুয়ার থেকে এই আগ্রাসী সভ্যতার উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করতে করতে এইখানে এসে তার ক্লান্ত জীর্ণ রূপটি চোখে পড়ে। হরিদ্বারের পায়ে নূপুর পরা কিশোরী গঙ্গা এইখানে এসে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েছে। পুরো এক জীবনের অবসাদ। কিন্তু তাতে কি? এই যে সুদীর্ঘ পাচ হাজার বছর ধরে এই আর্য-অনার্য সভ্যতাকে মায়ের মত মমতায় লালন করল? সেই মাতৃস্বরূপার পরম স্নেহপরশটি পেতে হলে বুক ভরে শ্বাস নিন। নিঃশ্বাসের সঙ্গে মনের সব জঞ্জাল বের করে ঐ গঙ্গাজলে মনে মনে সঁপে দিন। সারা উত্তর ভারতের জঞ্জাল নিয়েছেন যিনি আপনারটাও নেবেন। নিরাশ করবেন না।  আজ আবার কার্তিক পূজোর বিসর্জনের দিন। একটা বড়সড় কার্তিক ঠাকুর এল ভ্যানে করে। ধুপ ধুনো দিয়ে হাতে মিস্টির প্যাকেট ধরিয়ে চিবুকে চুমু খেয়ে তাকে বিদায় করছে বিবাহিত মহিলারা। এই মাটির প্রতিমার প্রতি কি অপ্রতিম সন্তান স্নেহ। এখন সঙ্গত কারণেই জলে প্রতিমা বিসর্জন নিষেধ। গঙ্গাপাড়ে নামিয়ে যাওয়াই দস্তুর। যতক্ষণ এই বিদায়পর্ব চলল চারটে অর্ধনগ্ন ছেলে এসে দাড়িয়ে রইলো যেন মৃত্যুপথযাত্রী কোনো প্রাণীর আশেপাশে ভিড় করা শকুন। জীবনযুদ্ধে পরাভূত সমাজের প্রতিনিধি এরা মৃন্ময় দেবতার হাতে মিস্টির প্যাকেটের বিলাসিতা সহ্য করতে অপারগ। বিসর্জনে আসা মানুষগুলো চলে গেলেই কার্তিক ঠাকুরকে দেওয়া সব জাগতিক সম্পদ এই জ্যান্ত কার্তিকরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। বিসর্জনে আসা মানুষগুলোর কথাবার্তা একটু আধটু কানে এল। কানে এল বললে একটু মিথ্যে বলা হবে। আমার একটু আড়ি পাতা স্বভাব আছে। বিশ্বাস করুন কারও ক্ষতি করার জন্য নয়, অন্যের বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরী করতে সম্পূর্ণ অচেনা লোকেদের কথা কখনো সখনো চেখে থাকি।  ধর্মবিশ্বাসী লোকগুলো বলাবলি করছে কার বাড়িতে জোড়া কার্তিক ফেলার ফলে যমজ ছেলে হয়েছে। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় কিন্তু সভ্যতার আলো যত উজ্জ্বলতর হয়েছে তত এই ধরণের কার্য-কারণ সম্বন্ধে আস্থা রাখা হয়েছে দুঃসাধ্য।

 

অবশেষে গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া অনেকটা ফুসফুসে ভরে নিয়ে ফেরতা পথে সাইকেল ধরলাম। হিসেব করে দেখলাম ফেরার পথটা হবে পাঁচ কিমির কিছু বেশি। যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় দশ কিমি। ভাবছেন উরিব্বাস এ তো অনেকটা পথ? আমি কোনো অতিমানব নই, sportsman-ও নই, বছরে একবারই দেশে ফিরে সাইকেলে চড়ি – আসলে দশ কিমি সাইকেল চালানোটা আদৌ কোনো শক্ত ব্যাপার নয়। মেন্টাল ব্লক আর আপনার ভটভটি অর্থাৎ মোটর বাইকটিকে একদিনের জন্য নির্বাসন দিলেই দেখবেন কাজটা জলের মত সোজা। আর ঐ যে বললাম – দূষণ না ছড়ানোর জন্য এই পৃথিবীই আপনাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করবে, সাহস জোগাবে। ফেরার পথে আর একটা procession দেখলাম যে মিছিলটায় আমাদের সবাইকে একদিন না একদিন সামিল হতে হয়। যত খেদ, ঘৃণা মানসিক কলুষ, যত মিথ্যা জৌলুস সব পিছনে ফেলে রেখে হরিধ্বনি দিতে দিতে আর  বিন্নি খৈ ছড়াতে ছড়াতে আমাদের সবাইকে উত্তর পুরুষ পৌছে দেবে আমদের অন্তিম শয়ানে। তবে কেন এত হিংসা, প্রতিযোগিতা শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান? রামতলা বাজার দিয়ে ফেরার পথে হঠাৎই চোখে পড়ে গেল নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে দোকানের নাম “জয়নগরের মোয়া”। সাইকেলের ব্রেকটা কোন শালা টিপল ঠিক জানিনা। কিন্তু দেখলাম দোকানের সামনে আমি সাইকেল থেকে নেমে দণ্ডায়মান। আশি টাকায় আটটা জয়নগরের মোয়া (মানে আদতে রামতলারই। কিন্তু ঐটুকু ব্র্যান্ডিং না করলে আমি দাঁড়াতাম বলুন?) কিনে বাড়ি ঢুকলাম যখন তখন সাড়ে নটা। দেড় ঘন্টার সাইকেল সফরে প্রাণ-মন চাঙ্গা। আজকাল শপিং মল-এ হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে আনন্দ কেনাই দস্তুর। তার বিরুদ্ধে সওয়াল করছি না। কিন্তু মাঝে মাঝে এ ভাবেও আনন্দ কেনা যায়। সাইকেলের maintenance cost টা যদি না ধরেন, মোট খরচা আশি টাকা আর বেশ কিছুটা ক্যালরি যেটা কিনা আমার মধ্যপ্রদেশের প্রগতি রুখতে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে। অবিশ্যি মোয়াগুলো খেয়ে সেটা মেকআপ হয়ে যাবে। কারণ বাঙালির প্রায় পরিচয়পত্র স্বরূপ নোয়াপাতি ভুঁড়ি নিয়ে যাকে বলে “No Compromise”!!

নীল তিমি

ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে পড়তে গিয়ে জানলাম যে যারা ডিপ্রেসড ইন্ডিভিজুয়াল বা নৈরাশ্যবাদী, সেরকম টিন এজাররা স্বাভাবিক কারণেই এই নীল তিমির খপ্পরে সবচেয়ে সহজে পড়ছে। গেমের আবিষ্কারকদের জীবন দর্শন হল এই যে এইসব নিরাশাবাদীরা এমনিই পৃথিবীর কোন কাজে আসে না। তো এদের শুরুতেই খরচা করে দিলে পৃথিবীর এবং মানুষ জাতির আখেরে লাভ। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত যুক্তিহীন মত কিন্তু পড়তে পড়তে হঠাত মনে হল এই মানুষ জাতির ইতিহাসে এই গেম বের হওয়ার অনেক আগে থেকেই, সভ্যতার আদি লগ্ন থেকেই এইরককম একটা প্রকাণ্ড নীল তিমি তার অদৃশ্য হাঁ নিয়ে ঠায় বসে আছে। যতক্ষণ তোমার এই সমাজকে, এই পৃথিবীকে কিছু দেওয়ার আছে, ততক্ষণই ওই আগ্রাসী হাঁ থেকে তোমার নিস্তার। যেদিন তোমার দেওয়া শেষ সেই দিনই ওই নীল তিমির প্রকাণ্ড জঠর গহ্বরের পথে তোমার মহাপ্রস্থান। এই সর্বগ্রাসী নীল তিমিই রোজ আমাদের প্রেরণা দেয়, রোজ আমাদের তাড়না দেয় নতুন কিছু করার। নিজেকে নতুন করে চেনার। সিন্দাবাদের মত জাহাজে করে নিজেরই মনের সাগরের বন্দরে, বন্দরে, কুলে, উপকূলে ঘুরে মনি, মুক্তো, রত্ন সংগ্রহ করে এনে এই সংসারকে শুল্ক স্বরূপ সবটুকু দিতে হবে। যেদিনই তোমার জাহাজের পাল ছিঁড়বে কি হাল ভাঙবে বা গতি হবে রুদ্ধ সেই মুহুর্তেই সেই নীল তিমির বিশাল হাঁয়ের মধ্যে তলিয়ে যাবে তুমি তোমার বিকল জাহাজ সমেত। সমাজরূপী সেই নিষ্ঠুর ট্রেজারার গুনে গেঁথে মেপে রেখে দেবে তোমার সবটুকু সঞ্চয়। “সোনার তরী” কবিতায় এমনটাই বলতে চেয়েছেন কবিবর। তবু আজ এই ব্লু হোয়েল গেম আমায় এক নতুন আঙ্গিকে চেনাল এই অদৃশ্য অথচ সর্বগ্রাসী নীল তিমিটিকে। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ভার্চুয়াল নীল তিমিটাকে তো মারার সর্বতো প্রকার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ওই চিরন্তন নীল তিমিটার নিরন্তর ভয় যেটা আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়, ফসল ফলিয়ে বেড়ায় সেটার বেঁচে থাকা বোধ হয় খুব জরুরী। ওই নীল তিমিটার আগ্রাসন থেকে বাঁচতেই তো আবিষ্কার আগুন, চাকা, ষ্টীম ইঞ্জিন, মাধ্যাকর্ষণ, আপেক্ষিকতাবাদ। পশু থেকে মানুষকে মানুষ করেছে এই নীল তিমি। একদিন এই নীল তিমিই হিংসা, ঘৃণা, কলুষ আর যত মিথ্যা জৌলুস কেড়ে নিয়ে মানুষকে দেবতা বানাবে। মানুষ ঈশ্বর হওয়ার আগে বোধ হয় ওই নীল তিমিটার হাঁ থেকে নিস্তার নেই।  

ত্রিয়া চরিত্রম

স্ববাবু মহারাজা যযাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন “প্রভু, মহামতি মনু লিখেছেন ‘ত্রিয়া চরিত্রম দেবা ন জানতি কুতঃ মনুষ্যঃ’ – হেঁ হেঁ তখন থেকেই বুঝি টাইপো অর্থাৎ কিনা typographical error-এর জন্ম। উনি নিশ্চয়ই “স্ত্রিয়া চরিত্রম” লিখতে গিয়ে ছড়িয়ে ফেলেছেন। তাই না?

মহারাজ যযাতি বললেন “না হে বৎস। কালি-কলম ইত্যাদি কি-বোর্ড দিয়ে প্রতিস্থাপিত হওয়ার আগে পর্যন্ত হতভাগ্য লেখকেরা বানান-টানান আর একটু সিরিয়াসলি নিত। ত্রিয়া মানে unnamedহল গিয়ে বুদ্ধি বা মতি। মতি তিনপ্রকার – গুর্মতি, মন্মতি আর দুর্মতি অর্থাৎ কিনা শুভ বুদ্ধি, নির্বুদ্ধি আর দুষ্ট বুদ্ধি। যেহেতু বুদ্ধি স্ত্রী-লিঙ্গাত্মক শব্দ, তাই কলিযুগে বাঙালি নামক ক্ষুরধার বুদ্ধিধর এক ধরনের প্রাণী এটিকে “স্ত্রীয়া চরিত্রম” করে নিয়েছে। বিয়ে-থা তো করেছ বৎস। তো বুঝতেই পারছ কথাটাকে “স্ত্রীয়া চরিত্রম” করে নিলেও সত্যের অপলাপ তেমন হয় না।”

তা যা বলেছেন স্যার। দেখুন না, দুগগা ঠাকুর দেখতে যাবে বলে আমার বেটার হাফ গোটা দশেক শাড়ি কিনে ফেললেন। জিগেস করলাম “পুজোর চারদিনে তো চারটেই শাড়ি লাগবে” – তাতে উত্তর দিলেন “আরে বাবা সকাল-সন্ধে পড়তে হবে না?” আমি বললাম “তাহলেও সর্বসাকুল্যে আটটা”। আমার স্ত্রী বললেন “বিসর্জন কবে হয় এখন তার ঠিক নেই। তাই দু-তিনটে বাফার শাড়ি রাখতে হবে না?”  বলুন স্যার এরপরেও যদি আমি বলি আমি আমার স্ত্রী-বুদ্ধি ইয়ে মানে আমার স্ত্রী-এর বুদ্ধির গতি এখনও বুঝতে পারিনি, কিছু ভুল বলা হবে স্যার?

যযাতি বললেন “ঠিক ঠিক। শাস্ত্র ছাড়, এই জন্যই কবিবরেরা বলে গেছেন – রমণীর মন বড় সাধনার ধন।” মানে নারীমন পেতে গেলে এবং বুঝতে হলে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে।    

“প্রভু, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বিচিত্রগতি কি তবে নারীদের মন?”

“তবে প্রভু, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বিচিত্রগতি কি তবে নারীদের মন?”

তার থেকেও বিচিত্রগতি হচ্ছে ইন্টার-ব্যালিস্টিক মিসাইল। কিম বাবু কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে কোরিয়া থেকে কুমায়ুন কিম্বা সাইবেরিয়া কি শিকাগো সফর করে। এই জন্যই বলিউডের কিং অব রোমান্স গেয়ে গেছেন “সফর কা হি থা ম্যায় সফর কা রাহা”। সে যাক। তবে এর থেকেও বিচিত্রগতি এক বস্তু আছে।

কি স্যার?

সেটি হল পাঠকের মন। আজ তোমার লেখা পড়ছে, কাল দুর-ছ্যা করবে। তাই ঠ্যাকায় পড়লেও কখনো পাঠককে ঠকাতে যেও না।

  

হতচ্ছাড়া

Office যাওয়ার আগে নিত্যনৈমিত্তিক একটি ঘটনাকে এই মজার ছড়াটায় একটু ধরার চেষ্টা করেছি। আপনাদের সকলের জীবনেই এটি কখনো না কখনো ঘটেছে। তাই আশা করি relate করতে পারবেন।


মোবাইল মহাশয় বড়ই সদাশয়,
যখন দরকার হয়, ডাকলেই দিয়ে দেয় সাড়া
মানিব্যাগ হতচ্ছাড়া, যদি করেছ কাছছাড়া,
লুকোচুরি খেলে তবে তারা
অফিস যাওয়ার কাল, সক্কাল সক্কাল,
হন্যে হয়ে তারে খুঁজি
এর থেকে সোজা করা, সোনার হরিণ ধরা
ট্রেন খানা মিস হল বুঝি
ঘড়ি ঘড়ি দেখি ঘড়ি, বাড়িঘর মাথায় করি,
কেমনে পাইব তার দেখা
হাত পা-ই হল নাকি, নেই কোথা খোঁজা বাকি,
নাকি শেষে মেলে দিল পাখা
বৈঠকখানা ঘুরে খুঁজি তাকে অন্তপুরে,
স্নানঘরে যাই তারপরে
বুঝি বা হারাল তবে, “কার্ড গুলো কি যে হবে”,
বুক ভয়ে দুরু দুরু করে
শেষমেশ খুঁজেখাজে, সোফার গদির খাঁজে
পেয়ে তারে সুখে গান গাই
“নয়ন সমুখে প্রভু থেকো, নয়নের কভু
মাঝখানে নিয়ো নাকো ঠাঁই”