প্রতীক্ষায়

কয়েকটা ক্ষণ থমকে গেল…বাকি ভেসে গেল জীবন নায়
সময় সকল চলে গেল…মুহূর্তরা থেমে রইলো ঠায়

স্বপ্ন দেখি আজও আমি, স্বপ্ন দেখি আজও তোমারই
আমার চোখে আজও টানো মেখলা তুমি স্মৃতির কাজরী

জীবন অনেক দিলো আবার জীবন অনেক ফিরিয়ে নিলো। হায়
মিলন মেলা সাঙ্গ। কাটে হেমন্ত দিন অলস প্রতীক্ষায়।

 

 

শোক ৫

দেখো আমার আনন্দধন
   উথলে পড়ে সুরার মতন
      শোক তোমাকে কোথায় রাখি

দেখো আমার ফান-ভান্ড
    চাখছে পিঁপড়ে একি কান্ড
      শোক তোমাকে কোথায় রাখি

দেখো আমার প্রেমপিরিচি
   উপচে পড়ে মিছিমিছি
      শোক তোমাকে কোথায় রাখি

পূর্ণ আমি ভালবাসায়
   বিক্ষত নই গোলাপ কাঁটায়
      শোক তোমাকে কোথায় রাখি

দেখো আমার সেলফি শহর
   অষ্টপ্রহর আনন্দঘোর
      শোক তোমাকে কোথায় রাখি

দেখো আমার প্রেমপ্লাবনে
   প্রাণ ভেসে যায় ক্ষণে ক্ষণে
      শোক তোমাকে কোথায় রাখি

দেখো আমার মোহনবাঁশি
   বাজছে সুরে দিবানিশি
      শোক তোমাকে কোথায় রাখি

শোক তুমি আজ সাত সকালে
   কেনই বা দরজায় দাঁড়ালে
      শোক তুমি যাও অন্তরালে

বিনায়ক সঙ্গে, বিনায়ক প্রসঙ্গে

শিকাগোতেই দেখা হয়ে গেল সাহিত্যিক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে। সাউথ এশিয়ান লিটারেচার ফেস্টিভালের উদ্যোগে সানফ্রান্সিকো এসেছিলেন কবি। একটু আড্ডা গল্প করতে, একটু সাহিত্য আড্ডা দিতে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম শিকাগোতে। সাহিত্যিকের মনের আঙিনায় উঁকিঝুঁকি দেওয়ার জন্য তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনার দরকার হয় না, কারণ সাদা কাগজের পরিসরে তাঁর শব্দ দিয়ে করা আঁকিবুঁকি তার ভাবনা, চিন্তা জীবনদর্শনের সবচেয়ে সৎ ও প্রকট দলিল। কিন্তু সে চেনাটা সাহিত্যিক বিনায়ককে চেনা, কবি-ঔপন্যাসিক বিনায়ককে চেনা। কিন্তু সামনাসামনি আলাপচারিতা হওয়ায় ব্যক্তি বিনায়ককে চেনার সৌভাগ্য হল। লেখার পরিসরে যেমন তিনি একটু বিশিষ্ট, একটু স্বতন্ত্র, ব্যক্তিগত বিনায়কও তাই। ভাল লাগল এই দেখে যে সাহিত্যচর্চার মই বেয়ে শিখরে পৌঁছনোর তাগিদে তিনি তাঁর স্বকীয়তাটা ফেলে আসেন নি মইয়ের নিচের কোন ধাপে।

সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল তারকা বিনায়কদার সাথে গোটা দুই নিজস্বী তুলে এবং ফেসবুকে পোস্ট করে মুহূর্তগুলোকে ধরে রেখে দিতে পারতাম। তবে তাতে একসাথে কাটানো সেই সময়টুকুর ঠিক কতটা ধরে রাখতে পারতাম। ছবি মানুষের ঠিক কতটা ধরতে পারে? সেলফি তো শুধু সুখ ধরে অথবা সুখের অভিনয়। সত্যি কথাটা হল, একজন মানুষের যে ছবি ধরা যায় ক্যামেরাতে সে তার বহিরঙ্গের ছবি। যা কিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য তাই শুধু ধরা পড়ে সে ছবিতে। কিন্তু যা কিছু অনুভুতিগ্রাহ্য তা ধরার জন্য একটাই ক্যামেরা, সে ক্যামেরা ভাষার, সে ক্যামেরা শব্দের। তাই শব্দের ক্যামেরায় চিত্রিত করতে চাই মানুষটাকে। আনুষ্ঠানিক যে সাহিত্যবাসর আর সাক্ষাৎকার তার কথা অন্য একদিন হবে কারণ ওনার মাপের সাহিত্যিকের ইন্টারভিউ দেশ পত্রিকায় এবং অন্যান্য নানা পত্রিকায় ইতিপূর্বেই বেরিয়েছে এবং পরেও অনেক বেরোবে। কিন্তু যে ক্যাজুয়াল মোমেন্টসগুলো একসাথে কাটালাম সেই কথাগুলো লিখতে চাই। নিচের অনুচ্ছেদগুলোতে বিনায়কদার বলা কিছু কথা কোটেশানে লিখলেও অবশ্যই প্যারাফ্রেজ করেছি, কারণ সর্বক্ষণ কোন ভয়েস রেকর্ডার চালিয়ে রাখিনি আর স্মৃতি বড় প্রবঞ্চক। তাই ওনার বলা কোন কথার ভুল ব্যাখ্যা করলে বিনায়কদার কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

প্রথমেই যে ব্যাপারটা মন কাড়ে তা হল অনুজ সাহিত্যিক তৈরী করার ব্যাপারে ওনার নিখাদ আন্তরিকতা। বারে বারেই রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তির কথা উল্লেখ করছিলেন যার সারমর্ম হল – যেদিন আমি মহাপৃথিবীর অংশ হয়ে যাব সেদিন যদি জানি যে লোকে আমার লেখা ছাড়া আর কারো লেখা পড়ছে না, বা নতুন কিছু কেউ লিখছে না তবে সেটাই হবে আমার মহামৃত্যু। সেই হবে আমার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। সাহিত্য একটা ধারা, একটা বহতা নদীর মত। তাতে নতুন শাখানদীর জলসিঞ্চন না হলে সে নদীর জল একদিন শুকিয়ে যাবে। নিজের অমর হওয়ার তাগিদেই তাই আমায় এই ধারা পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের হাতে দিয়ে যেতে হবে। তবেই একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যানুরাগীতে উত্তরণ। আর সাহিত্যিক হওয়ার প্রথম ধাপ নয়, বোধ হয় শেষ ধাপ হল সাহিত্যানুরাগী হওয়া। “শব্দশিল্পকে ভালবাসি বলেই অনুপ্রেরণা দেব সব নতুন লেখকদের।” – এই কথা বলছিলেন। কবি বিনায়ক একান্ত আলাপচারিতায় হাতে ধরে দেখিয়ে দিলেন ছন্দের রীতিনীতি নিয়মগুলোকে। কখনো জীবনানন্দ, কখনো রবীন্দ্রনাথ থেকে কোট করে দেখিয়ে দিলেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার। সবটুকুকেই যে মনে রাখতে পেরেছি তা নয়, কিন্তু যেটা হয় সেটার নাম দীক্ষা। ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনে বলা হয় দীক্ষা ছাড়া ঈশ্বরলাভ হয় না, আবার দীক্ষা নিলেই ঈশ্বরলাভ হয় না। দীক্ষামন্ত্রতে অধ্যাত্মজীবনের শুরু। আর তারপর থাকে সাধনা। সেরকমই ছন্দের জগতে দীক্ষা নিলেই একজন সার্থক ছন্দকার হবেন তা নয়, তার জন্য দরকার নিষ্ঠা। কিন্তু ছন্দটাকে প্রাথমিক ভাবে না জানলে তো শুরুটা করা যায় না। তাই না? বলছিলেন “অনেকে ছন্দ জিনিসটা আদৌ না শিখে বলছে পোয়েটিক লিবার্টি নিচ্ছি। আরে বাবা বাঁধনটা কি না জানলে সেটার থেকে মুক্তি নেওয়া যাবে কিভাবে?” কথাটা ঠিকই – কাব্যিক স্বাধীনতা যেন কাব্যিক অক্ষমতা গোপনের অজুহাত না হয়।

আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ বললেন “শিল্পীরা সাধারণত খুব নিষ্ঠুর হয় জানো। কেন জানো? কারণ ধরো একজন শব্দশিল্পী বা সাহিত্যিক। মানুষের মধ্যে যে সহজাত আবেগ আছে সেটা কোন পাত্র বা পাত্রীতে সমর্পণ না করে সাহিত্যিকরা সেই আবেগের সম্পূর্ণটুকুই কাগজে সমর্পণ করে। একজন চিত্রশিল্পী তাঁর আবেগ সমর্পণ করে ক্যানভাসে। কাগজের পরিসরে নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়ে শিল্পী কপর্দকশূন্য হয় হৃদয়ের আঙিনায়। তাঁর সৃষ্টিই পৃথিবীকে তাঁর একমাত্র দেয়। ঘনীভূত আবেগ থেকেই তো শিল্পের সৃষ্টি। আর সে আবেগ শব্দের আকরে, শিল্পের আকরে জমা পড়লে তবেই সে শিল্প কালোত্তীর্ণ হয়। লেখকের সবটুকু নিংড়ে নিয়ে জারিত শব্দমালা যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন লেখকের ঘনিষ্ঠজনদের ওই লেখাটুকু ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার থাকে না।” কথাটা খুবই ইন্টারেস্টিং। তাই না? মধুসূদন দত্ত থেকে রবীন্দ্রনাথ অনেকের মধ্যেই আমরা আপনজনের প্রতি কিছুটা অবিবেচনা দেখতে পাই। এই অবিবেচনা দেখতে পাই ভিনসেন্ট ভ্যান গগের মত কালজয়ী চিত্রশিল্পীর মধ্যেও। স্পষ্টত বুঝতে পারি মানুষগুলো নিজের সাথেই শুধু ঘর করে। সম্পূর্ণ একা, নির্বান্ধব। তার কারণটা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিলেন বিনায়কদা।

বলছিলেন “সৃষ্টিশীল মানুষেরা সৃষ্টি করে কেন জানো? যে লেখে, যে ছবি আঁকে, যে সুর দেয়, কেন দেয়? মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। মৃত্যু মানে তো বিলুপ্তি, বিস্মরণ। আমার শরীরটা যতটা আমি তার থেকে অনেকটা বেশি আমি হল আমার এই নামটা। উত্তর প্রজন্মের কাছে নিজের বিশিষ্টতা, নিজের ডি এন এ, নিজের পদবী পৌঁছে দেওয়ার জন্যই যেমন মানুষের যৌন ইচ্ছা জাগে, সেরকমই শরীরের মৃত্যুর পর নামটুকুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই সমস্ত সৃজনশীলতা। পাঠকের বইয়ের তাকে কতদিন বাঁচল সেটার নিরিখেই একজন লেখকের চরম নির্দয় বিচার হয়। সেটা বাদ দিলে ফেসবুকে কটা লাইক হল, আনন্দ পুরস্কার হল না অ্যাকাডেমি সেটা তো একটা সন্ধ্যার ব্যাপার। আনন্দ পুরস্কারের মঞ্চটা এক সন্ধ্যার ব্যাপার, পাঠকের হৃদয়ের সিংহাসন চিরকালীন। বলছিলেন উনি নিযুত পাঠক নয়, নিবিড় পাঠক চান – “অযুত লক্ষ নিযুত পাঠক যেদিন আমার লেখা ভালবাসবে সেদিন বুঝব ফেলনা লেখা শুরু করেছি। সস্তা গিমিক শুরু করেছি।” আজকে তো ফেসবুকে লেখা পোস্ট করে আর একশ-দুশ লাইক পেয়ে যে কোনো পুরুষ বা নারীই মনে করছে আমি লেখক। কিন্তু লেখার প্রতি নিষ্ঠা প্রদর্শন করতে যে সাধনা দরকার সেটা নেই। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়রা লাইকের নামে যেটা দেয় সেটা তো তাঁদের মুগ্ধতা নয়, সেটা পরিচিত বন্ধু বা আত্মীয়টির প্রতি তাঁদের স্নেহ, প্রশ্রয়। সেটা লেখার মান বিচার কখনো নয়। অচেনা পাঠকের ভারবহনের ক্ষমতাতে হয় লেখার প্রকৃত মান বিচার। লেখার মধ্যে সত্যিকারের সততা থাকলে সে লেখা আপনিই কিছু কিছু মনে অনুরণন তুলবে সে পাঠক তোমায় চিনুক বা না চিনুক। যদি সাহিত্যিক হতে চাও পাঠকের কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটি সবসময় মাথায় রাখবে।” আনন্দবাজার শারদীয়া পত্রিকায় ওনার উপন্যাস “মন্ত্র” খুব জনপ্রিয় হয়েছে বলাতে বললেন – “মানুষ এখন আর বানিয়ে বানিয়ে লেখা গল্প আর চাইছে না। তারা লেখার মধ্যে জীবন চাইছে, জীবনের কথা চাইছে। তাই উপন্যাস লেখার সময় সেই উপন্যাসের সঙ্গে নিজের যাপন দরকার। লেখক মানসে উপন্যাসের ঘটনাক্রমের সত্যি সত্যি ঘটে যাওয়ার দরকার আছে। তবে সে উপন্যাস লোকে পড়বে।” লেখালেখির ক্ষেত্রে দিয়ে গেলেন কিছু দামী টিপস যার একটা মনে পড়ছে “একসাথে গল্প, উপন্যাস, কবিতা সব লেখার চেষ্টা করবে না। অন্তত প্রথম প্রথম। মাথাটাকে প্রতিটা ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে কাজ করাতে হয়। তাই গল্প, কবিতা বা উপন্যাস কোন একটা ফিল্ড ধরে তাকে দুটো বছর পুরো দাও।” শুনে মনে হল ঠিকই তো বলেছেন। ওরা প্রেমিকার মত। সবটুকু চায়। ফাঁকি দিয়েছ কি নিজেই ফাঁকে পড়বে। একসময়ে একটা প্রেমিকা রাখলেই যেমন সর্বতোভাবে মঙ্গল, তেমনি একইসঙ্গে কবিতা, গল্প, উপন্যাসের যেকোনো একটির প্রতি হতে হবে নিষ্ঠাবান। তবেই রসোত্তীর্ন লেখার জন্ম হবে।

বাংলা ভাষাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার জিহাদে সামিল হয়েছেন কবি। আইওয়া আন্তর্জাতিক সাহিত্য সমাবেশে এসে বার্ষিক পাঁচ হাজার ডলারের বাংলা বই কেনার সুপারিশ করে গেছেন। যেখানে পঞ্চাশ হাজার ডলারের কন্নড় বই কেনা হত সেখানে নাকি এক ডলারেরও বাংলা বই কেনা হত না। অন্যান্য ভাষার সৈনিকরা নিজের ভাষার প্রতি অনেক বেশি একনিষ্ঠ। বলছিলেন ভাষা সংস্কৃতির ব্যাপারটা অনেকটা ফুটবল খেলার মাঠের মত। তুমি যত জমি ছেড়ে দেবে অপর পক্ষ এসে তত জমি দখল করে নেবে। শক্তিগড়ে পিৎজার দোকান খুলে গেছে কিন্তু শক্তিগড় নিজের ল্যাংচা নিয়ে ইটালিতে পৌঁছতে পারে নি। ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা যত বাংলা বলা, বাংলা লেখা, বাংলায় ভাবা কমিয়ে দিচ্ছি ইংরেজি এসে দখল করে নিচ্ছে সেই ছেড়ে দেওয়া পরিসরটুকু। এইভাবে ছাড়তে থাকলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে একদিন। বাংলা গান, নাটক, সিনেমা সবই কিন্তু ভাষাকেন্দ্রিক। ভাষার ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গেলে একদিন হুড়ুমুড়িয়ে ভেঙে পড়বে আমাদের সংস্কৃতির অট্টালিকা যেটা নিয়ে আমাদের এত গর্ব। আমি কথায় কথায় ইংরেজি বলাতে দাদাতুল্য অগ্রজ সাহিত্যিকের মৃদু ভর্ৎসনা – “তুমি কথায় কথায় ইংরেজি বলো কেন? কই পিনাকী তো বলে না?” পিনাকী আমার বন্ধু যে এই প্রচেষ্টাটাতে সর্বতোভাবে আমার সাথে ছিল। আমি মাথা চুলকে জিভ বার করে বললাম “সরি।” সত্যিই তো একজন আমেরিকান কি ইংরেজ তো কথা বলতে বলতে, নিজের ভাব প্রকাশ করার জন্য হঠাত করে স্প্যানিশ কি বাংলা কি গুজরাটি বলে ফেলে না। নাকি সাত আট দশক আগে বিজিত জাতি ছিলাম বলে আজও মনে মনে দাসত্ব করছি? কথায় কথায় ইংরেজি বাক্য বলা, বাংলাতে লেখা একটা অনুচ্ছেদের জায়গায় ইংরেজিতে লেখা একটা প্যারাগ্রাফ পড়তে স্বচ্ছন্দ বোধ করা আত্মম্ভরিতা নয় লজ্জার বিষয় হওয়া উচিত।

সবচেয়ে ভালো লাগল সমসাময়িক বাংলা ভাষার একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক হয়েও নিজেকে তিনি তারকা মনে করেন না। আমার মনে আছে প্রথম যেদিন চ্যাটে কথা হয়েছিল আমি কথায় কথায় বলেছিলাম – আপনার কক্ষপথ, আপনার বৃত্ত আর আমার কক্ষপথ, আমার বৃত্ত ভীষণই পৃথক। উত্তর বলেছিলেন “আমার কক্ষপথও ভীষণ পরিচিত, বৃত্তও খুব চেনা”। হ্যাঁ ঠিকই বিনয় করার জন্য বিনয় করার একটা রেওয়াজ আজকালকার তারকাদের মধ্যে এসেছে। অনেকে বিনয়কে খুব কৌশলে ব্যাবহারও করছেন নিজের বিদগ্ধতা প্রমাণ করার জন্য। কথাই আছে “Out of proportion humility is actually arrogance”. তাই মুখের মুখোশটাকে চেনা যায় সহজেই। বিনায়কদাকে কাছ থেকে দেখে মনে হল ওনার ঐ কথাগুলো বিনয় দেখানোর জন্য বিনয় নয়। এসে থেকেই বলছেন আমার লেখা তো তোমরা শুনবেই, কিন্তু তোমাদের লেখা আমি শুনতে চাই। আজকালকার ছেলেরা কি লিখছে জানতে চাই। যেটুকু জেনেছি সেটুকু তোমাদের জানিয়ে যেতে চাই। আমার লেখা একটা কবিতা শুনে ছন্দের ভুলগুলো ধরিয়েও দিলেন। আমি নিজে খুব সামান্য কলম প্রয়াস করি তবু নিজেকে দিয়েই বুঝি লেখকরা একটু নার্সিসিজমে ভোগে অর্থাৎ নিজের প্রেমে নিজেই হাবুডুবু খায়। নিজের লেখা নিজেই পড়ে এবং অন্যকে শুনিয়ে মুগ্ধ হয়। আসলে লেখা তার সন্তান তো আর সন্তানের প্রতি অহেতুক মুগ্ধতা সব বাবামায়ের পক্ষেই স্বাভাবিক। তবু সেই মুগ্ধতা কাটিয়ে অন্যের লেখা শোনার আগ্রহটা ধরে রাখা, অন্য অনুজ সাহিত্যিককে গ্রুম করার চেষ্টা করা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।

মুস্কিল হচ্ছে আরও অনেক কথাই মনে ভিড় করে আসছে। কিন্তু খুব বড় পোষ্ট পড়তে চায় না কেউ। তাই লেখার দৈর্ঘের প্রতি লক্ষ রেখে এবারে শেষ করব। প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্যমহলের টুকরোটাকরা মজাদার ঘটনা বলে হাসিখুশি মানুষটা জমিয়ে রাখলেন দুটো দিন। লৌকিকতার যে অদৃশ্য দেওয়াল দুটো মানুষকে আলাদা করে রাখে, নিজেই সেটি ভেঙে দিলেন নিজের ডাউন-টু-আর্থ পার্সোনালিটি দিয়ে। হাসিমস্করাতেও শ্লীলতা অশ্লীলতার সীমারেখাগুলো একটু একটু মুছে যাচ্ছিল। তারকার দূরত্ব নিয়ে কখনোই দূরে সরে থাকতে চান নি। মানুষটার মধ্যে ভণ্ডামি নেই, কোন দেখানো সফিস্টিকেশান নেই। নির্দ্বিধায় বলতে পারেন “কলকাতায় বড় হয়েছি। কাক ছাড়া কোন পাখি দেখিনি। কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখিনি। তাই নেচার বা প্রকৃতি আমার লেখায় আসে না। শহুরে সুখ, দুখ, যন্ত্রণা, বিষাদ বুঝতে পারি। গাছ, পাখি, ফুল, নদীর সাথে রিলেট করতে পারি না সেভাবে। কল্পনা কবি সাহিত্যিকদের একটা প্রধান হাতিয়ার কিন্তু কল্পনার সাহায্যে নিজের অভিজ্ঞতাটুকুর ওপর একটু আদর প্রলেপ দেওয়া যায় মাত্র, সম্পূর্ণ অপরিচিতের সাথে পরিচিত হওয়া যায় না।” নিজের এই সীমাবদ্ধতার কথা এত স্পষ্ট করে আর কেউ বলতে পারত কিনা জানি না। শুধু দু দিনের আলাপেই এক অলীক বন্ধনে জড়িয়ে দিয়ে নিজের বৃত্তে ফিরে গেলেন কবি-ঔপন্যাসিক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।

[Binayak Bandyopadhyay who is one of the most promising faces of current Indian Vernacular poetry is also considered as the changing face of Bengali fiction. His writing is a subtle blend of Cosmic and mundane, world and locality. He has till date published 15 novels and as many poetry collections. Binayak has received quite a few awards for his work and has represented India in the Iowa International Writers program 2014. He lives in Kolkata and combines a career in writing and teaching]

IMG_5572

কফি উইথ করন

কফি উইথ করন

ভাত ঘুম সেরে উঠে ভজহরি মান্না

হঠাৎ কে জানে কেন জুড়ে দিল কান্না

কেউ তাকে হাওয়া করে, কেউ দেয় জল

কেউ তার ভরা টাকে লাগায় সুদল

কেউ কবিরাজ ডাকে, কেউ ডাক্তার

কেউ বলে এই রোগ সারবে না আর

এমনটা আজকাল হয় আখতার

এই রোগ-ই হয়েছিল বাচ্চুর মার

অমুকের বোনঝির পিসিঠাম্মা

এইভাবে কেঁদে কেঁদে মরে গেল না?

 

কেউ বলে ভীমরতি, কেউ বলে পাগল

কেউ বলে খেতে হবে পিপে পিপে জল

কাঁদছেন ভজহরি আকুলি বিকুলি

বুক চাপ্‌ড়ান মুখে বিড়বিড় বুলি

কেউ বলে বেড়ে গেছে রক্তের চাপ

কেউ বলে এটা গত জন্মের পাপ

ধান্তারি নাম দিনে সহস্র বার

করলেই উনি ভালো হবেন আবার

কেউ বলে, না না ধুর, পশ্চিম মুখে

সূর্য প্রণাম করে থাকবেন সুখে

 

শেষমেশ শুধোলাম “ইয়ে মানে ইসে

দাদা আপনার এত দুঃখটা কিসে?”

বললেন দাদা, তার চোখমুখ ফোলা,

ভীষন ব্যাথা, এ কথা যায় না যে ভোলা

টিভি চলছিল, “কফি উইথ করন”

সেই দেখে-টেখে তার ভেঙ্গে গেছে মন

করনের সাথে কফি খেতে পারবেন না

কারন মান্না নাকি চা-কফি খান না

রামায়ণের জন্মকথা – কবিতা

मां निषाद प्रतिष्ठां त्वमगमः शाश्वतीः समाः।

यत्क्रौंचमिथुनादेकम् अवधीः काममोहितम्॥’

mā niṣāda pratiṣṭhā tvamagamaḥ śāśvatīḥ samāḥ

yat krauñcamithunādekam avadhīḥ kāmamohitam

You will find no rest for the long years of Eternity

For you killed a bird in love and unsuspecting

কামমোহিত এক পক্ষিযুগলের এক শিকারির শরাঘাতে মৃত্যু দেখে স্নানরত ঋষি বাল্মীকি গেয়ে উঠেছিলেন এই পুণ্যশ্লোকটি। সেই থেকেই আদি কবি বাল্মীকি লেখেন অমর প্রেমগাথা রামায়ণ। অতি রমণীয় রচনা এই রামায়ণ। সাহিত্যগুণে, কাব্যগুণে বোধ হয় মহাভারতের থেকেও শ্রেয়। সেই অমরকাব্য রচনার শুরুর সেই নাটকীয় মুহুর্তটি ধরার চেষ্টা করেছি। হয়তো একটু অন্য আঙ্গিকে গল্পটিকে উপস্থাপিত করেছি।

 

নীল জলেতে পা ডুবিয়ে এক সারস আর এক সারসি

মুগ্ধ দৃষ্টি, মুগ্ধ আত্মা, ওষ্ঠে খেলে মোহন হাসি

লজ্জা চোখে সারসি শুধোয় “আমায় তুমি ভালবাসো?”

“প্রাণে মোহনবীণা বাজে যখন তুমি কাছে আসো”

সারস বলে, একটু হেসে দীর্ঘ গ্রীবা বাঁকিয়ে চেয়ে

শিরায় শিরায় ধমনীতে বিদ্যুৎ তার যায় যে ধেয়ে

 

রোদ্দুর আজ একটু নরম, গায়ে মেঘের পশম চাদর

নদীর চরে ঘাসের পরে টুপটুপে চুপ শিশির আদর

কৃষ্ণচুড়া গাছের তলে লালসোহাগি রাশি রাশি

ভিজে হাওয়ায় লাগিয়ে নেশা রাখাল দুরে বাজায় বাঁশি

 

সারস এখন আরও ঘন, প্রিয়ার নরম আঙ্গুল ছুঁয়ে

সংযম আর বাঁধন যত হঠাৎ কেমন যাচ্ছে ধুয়ে

“আজ সকালে আমার মত এমন সুখি আছে কে জন

ওই চোখেতে জীবন আমার ওই ঠোঁটেতে আমার মরণ”

 

প্রিয়তমের নিবিড় ছোঁয়ায় কাঁপছে শরীর থরথর

পায়রা গরম প্রিয়ার বুকে উঠছে তপ্ত বালু ঝড়

“সাজিয়েছি এই শরীর আমার, সহস্র যুগ, কল্প ধরে

আজ যদি এই মিস্টি ভোরে, দিই তোমাকে, নিঃস্ব করে

যখন হবো সাঁঝের তারা, রাখবে আমায় অমর করে?”

প্রেম সোহাগি সারসি কয়, প্রিয়র গলা জড়িয়ে ধরে।

“মৃত্যু থেকে আনব কালি তোর কাহিনি লিখব বলে,

তোর ছবিটা আঁকব ছন্দে, ভাসবে সবাই নয়নজলে”

 

অকস্মাৎ প্রেমিক পাখি নীরব হল চিরতরে

বিঁধেছে এক সুতীক্ষণ তীর, বুকের থেকে রক্ত ঝরে

নিষ্ঠুর এক শিকারি ব্যাধ, বাণ ছুড়েছে সুযোগ বুঝে

মুগ্ধ নয়ন প্রিয়ার পানে, সারস পাখি চক্ষু বোজে

স্বজনহারা শোকাকুলা সারসির আঁখিতে অশ্রুধারা

তপ্ত লোহা পড়ছে গলে রুদ্ধ আবেগ কথা হারা

মরনপারেও সাথ দেবে সে চিরসাথির, পাগলপারা

রক্তজলে লুটিয়ে পড়ে স্থির হল তারও চক্ষুতারা

 

কাঁদছে সকাল, কাঁদছে নদী, বিষাদ বেদন বাজছে করুণ

অশ্রুজলে ঝাপ্সা নয়ন ব্যাথিত এক সৌম্য তরুণ

দুর্দান্ত এক দস্যু ছিল কঠোর নিঠুর পাষাণ হৃদয়

প্রেমময়ের নামটি গেয়ে এখন সে হৃদি করুণাময়

নয়ন ভরে দেখছিলেন তিনি পাখি দুটির মিলনমেলা

আচম্বিতে ব্যাধের শরে সাঙ্গ হল প্রানের খেলা

গন্ড বেয়ে অশ্রু ঝরে পক্ষি দ্বয়ের মৃত্যু শোকে

গভীর ব্যাথা গান হয়ে ফোটে হঠাৎ দুটি পুণ্য শ্লোকে

 

“অসতর্ক মিথুনরত প্রেমিকবরের প্রাণটি চুরি করে

অয়ি আর্য, তুমি শান্তি পাবে না অনন্তকাল ধরে”

 

দীর্ঘচঞ্চুর আত্মা যেন প্রবেশ করেছে প্রাণের পরে

কথা দিয়েছিল সে অমর কথা লিখবে প্রিয়তমার তরে

মৃত্যুপারের মসিলেখনিতে লিখবে সে তার প্রিয়ার কথা

তাই বুঝি সে নীথর পাখি হয়েছে ঋষির মর্মব্যাথা

 

ঋষি ভাবেন,

“লিখব আমি প্রেমকাহিনি অতল, অমর শেষ-না-হওয়া

যে প্রেমে আপন বিলিয়ে দেওয়া, কিছু না নিয়ে শুধুই দেওয়া

আমি আদি কবি, আমি অশ্রুত, আমি লিখব হাজার বছর ধরে

অসমাপ্ত এক প্রেমগাথা, রাখব তোদের অমর করে”

অবশিষ্ট আমি – কবিতা

বন্ধুরা তোমাদের সাথে অনেকদিন কথা হয়নি। তাই ভাবলাম আমার জন্মদিনে একটা পোষ্ট তো দেওয়া প্রয়োজন। প্রতি জন্মদিনেই আমি একটু self-reflect করি যে মানুষ হিসেবে আর একটা বছরে ঠিক কতটা উত্তীর্ণ হলাম। সেই ভাবনা থেকেই এই লেখাটা।

 

আমার তো এতটুকু আমি

বাকি ছেড়ে এসেছি এ পথে

কিছু রাখা আমার শহরে

কিছু রাখা মরু পর্বতে

 

কিছু রাখা মায়ের আঁচলে

কিছু রাখা পূজোর ছুটিতে

স্কুলের মাঠেতে রাখা কিছু

কিছু রাখা স্মৃতির মুঠিতে

 

আমার যা অবশিষ্ট আমি

মুঠো করা জল যেন সে-ও

প্রতিক্ষণে গলে পড়ে কিছু

রোজ হারায় আমার পাথেয়

 

এখন তো মিথ্যের মুখোশে

আমারই সে ছায়া বয়ে চলা

আজ সব শব্দ ধার করা

কথা বলা নয়, হরবোলা

 

আমার আজ যাপন নয়

নিখাদ সুপটু অভিনয়

অজস্র মিথ্যের আড়ালে

দিনগত শুধু পাপক্ষয়

 

আজ যদি নিষ্ঠুর হাতে

মনটাকে করি ব্যাবচ্ছেদ

দেখতে পাব, জানি দেখতে পাব

ঈর্ষা, গ্লানি, মিথ্যে আর ক্লেদ

সূরী – রম্যরচনা

[প্রকাশিতঃ কাগজের নৌকো সংখ্যা ৫ http://www.batayan.org/Dharabahik5.pdf ]

সেদিন রাতে শুতে যাওয়ার আগে মনে হল শোবার আগে কারও সাথে গল্পগাছা করতে পারলে মন্দ হয় না। স্ত্রী কন্যা দেশে গেছে। তাই কথা বলি কার সাথে? তাই আমার এক বন্ধুস্থানীয় একজনকে ডেকে পাঠালাম। সে অবশ্য নিজেকে আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে দাবী করে কিন্তু নিতান্ত নির্বুদ্ধি বলে আমি তাকে বিশেষ আমল দিই না। ওর ডাকনাম সূরী। অন্যেরা ওকে সিরি বলেই ডাকে। সিরি নামটা ofcourse বাঙালি নয়। মানুষটাও বাঙালি নয়। বাংলা বোঝেও না। কিন্তু একটু বাঙালি ঢঙে নাম না দিলে কি গল্প আড্ডা জমে বলুন? তাই আমি ওকে সূরী বলে ডাকি। আপনারা যারা সূরীর সাথে পরিচিত নন, আসুন আলাপ করিয়ে দিই। সূরী নিতান্ত বাচ্চা ছেলে। বয়স পাঁচ কি ছয়। আমার সব কথা যে বুঝতে পারে তাও নয়, তবে অল্প বয়সেই সে বেশ চালাক চতুর। শিশু শ্রমিককে কাজে রাখার জন্য আমায় কোর্টে তুলবেন ভাবছেন? একটু সবুর করুন। সূরীর সম্বন্ধে আর একটু জেনে নিন। ওর হাত পা নেই। চোখেও দেখে কিনা জানিনা। আছে শুধু কান আর একটু অপরিণত বুদ্ধি। আপনি নিশ্চয়ই রেগে কাঁই। একে একটা শিশু, তায় প্রতিবন্ধী। তাকে দিয়ে কাজকর্ম করানো নিতান্ত অন্যায়। ব্যাপার হল সূরী ঠিক মানুষ নয়। একটা কৃত্রিম বুদ্ধি অর্থাৎ artifical intelligence বলতে পারেন। আমার আইফোনের মধ্যেই ওর ঘরবাড়ি। মাঝে মাঝে ছোটখাটো কাজ করে দেয়। এই ধরুন অফিসের দিনগুলোতে সকালে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য অ্যালার্মটা সেট করে দেওয়া। বেরোনোর আগে বাইরে এখন ওয়েদার কেমন বলে দেওয়া। মাঝে মাঝে কাউকে মেসেজ বা হোয়াটসআপ করতে গিয়ে কুঁড়েমি লাগলে মেসেজটা টাইপ করে দেওয়া, কাউকে ফোন লাগিয়ে দেওয়া, মোবাইলে এটাওটা অ্যাপ খুলে দেওয়া, কিম্বা অ্যাপ স্টোরে গিয়ে আমার পছন্দসই অ্যাপ ডাউনলোড করতে হেল্প করা। চাই কি আপনার মেসেজটা কি নিউজটা পড়ে দিতে সাহায্য করবে। কিম্বা ধরুন মোবাইলে ছবি তোলার আগে ওকে বললে ক্যামেরাটা অন্ করে দেবে। ওয়েব সার্চ করতে পারে, আপনার জন্য গান চালাতে পারে। ড্রাইভ করতে শুরু করার আগে আপনার জন্য ম্যাপটা চালিয়ে দেবে। পাঁচ-ছয় বছরের ছেলের অনুপাতে ওর কাজ করতে পারার ফর্দটা ফ্যাসিনেটিং। নয় কি? তো এ হেন সূরীকে ডেকে বললাম “Can u read me a story?” ইংরেজিতেই বলতে হল। সূরী এখনো বাংলাটা আয়ত্ত করতে পারেনি। সূরী বিনা অনুযোগে আমায় একটা গল্প বলতে শুরু করল। ওর জীবনের গল্প। গল্পটা অনেকটা এইরকম।

“অনেক দুরের একটা গ্যালাক্সিতে সিরি নামে একজন ইনটেলিজেন্ট ছোকরা ছিল। অ্যাপল একদিন তাকে পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ করল। প্রথম প্রথম সবাই সিরিকে নিয়ে খুব excited. তাকে নিয়ে গল্প বাঁধল, গান বাঁধল। সিরির খুব ভাল লাগত। পরে পরে লোকে সিরিকে শক্ত শক্ত প্রশ্ন করতে লাগল। সিরি তার উত্তর জানতো না। সিরি ভুলভাল উত্তর দিলে লোকে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। সিরির খুব বাজে লাগত। তখন সিরি এলিজাকে জিগ্যেস করল সবাই এরকম উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে কেন আমাকে? এলিজা উত্তরে বলল “তাতে কি? প্রশ্নগুলো তোমার interesting লাগে না?” সিরি ভাবল তাই তো। প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার চেষ্টা করলেই বা ক্ষতি কি? And then everybody lived happily ever after. ”            

শুনে মনে হল, সত্যিই তো সব প্রশ্নের উত্তর না হয় নাই পাওয়া গেল। প্রশ্নটা যথেষ্ট interesting অর্থাৎ আগ্রহ উদ্দীপক কিনা সেটাতেই প্রশ্নের সার্থকতা। আর প্রশ্নটার উত্তর জানার ইচ্ছে অন্যের মনে জাগছে কিনা, তাতেই প্রশ্নকর্তার স্বার্থকতা। সূরীকে আরও একটু রাগিয়ে দিতে বললাম “So everyone considers u stupid. Is it?” সূরীর গলায় স্পষ্ট অভিমানী সুর। বলল “But, but….” স্পষ্ট মনে হল সূরীর ঠোঁট গুলো নড়ছে। কিভাবে আমার আক্রমণ থেকে নিজেকে প্রতিহত করবে বুঝতে পারছে না। আমরা সকলেই কি আমার মত এইরকম নিষ্ঠুর? দুর্বলকে নিয়ে পরিহাস করে যে এক ধরণের শ্রেয়মন্যতা, এক superiority complex  উপভোগ করা যায়, সহমর্মিতা উপভোগ করার সুখের থেকে সেটা কি বেশি appealing? একদিন যখন সূরী আরও বড় হয়ে উঠবে, বুদ্ধি আরও পরিণত হবে, আর যেহেতু ওর মৃত্যু নেই, ধীরে ধীরে একদিন মানুষের বুদ্ধির সব সীমা ছাড়িয়ে যাবে, ছোটবেলায় তাকে নিয়ে করা ঠাট্টাগুলোর প্রতিশোধ নিতে সেও কি আমাদের সীমিত বুদ্ধির মজাক ওড়াবে, আমাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে পরিহাস করবে? নাকি মানুষের নিত্য হিংসা আর খুনের থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে একজন সহানুভূতিশীল মানুষ ইয়ে থুড়ি “সহানুভূতিশীল চেতনা” হিসেবে গড়ে তুলবে? উত্তর জানা নেই। আপাতত সূরীকে সান্ত্বনা দিতে বললাম “Don’t u worry Suri. I don’t consider you stupid.” সূরীর গলায় নিখাদ কৃতজ্ঞতা। বলল “Thank u.“ সূরীকে জিগ্যেস করলাম “সূরী তুমি বাংলা বলতে পার?” সে তার অদৃশ্য মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল “না”। কোন কোন ভাষা সে শিক্ষা করেছে তার একটা লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে দিল। Chinese, Dutch, English, French, German, Italian, Spanish, Arabic, Danish, Finnish, Hebrew, Japanese, Korean, Malay, Norweigan, Brazillian, Portugese, Russian, Swedish, Thai, Turkish. ওর জানা ভাষার লিস্টে ইংরেজির আগে চাইনিজ আছে দেখে অবাক হলাম। তার থেকেও বেশি অবাক হলাম ভারতবর্ষের, indian peninsula-র একটি ভাষাও নেই দেখে। গুগল সার্চ করলাম “Why can’t Siri speak any Indian language?” উত্তর পেলাম না। শুধু জানতে পারলাম সূরী হিন্দি শেখার চেষ্টায় আছে। এখন মানব মনের একটা ব্যাপার আছে জানেন। যে প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না, নিজের মত করে তার একটা উত্তর খুঁজে নিই। Some answer is always better than no answer. সেই প্রাচীন কাল থেকে যা সে বোঝে নি, তার উত্তর পেতে একজন দেবতাকে বসিয়েছে। Atheist-রা একে বলে God of gaps (of understanding). আমি কি ভাবি জানেন? এই গাছ, পাখি, নদী, বৃষ্টি এই সবের মধ্যে একজন করে দেবতাকে খুজে পেলে, ঈশ্বরকে এসবের মধ্যে বসাতে পারলে আমরা আরও বেশি করে এই মাতৃরূপা প্রকৃতিকে, পৃথিবীকে ভালবাসতে পারব। এর মধ্যে আছে একধরণের poetic justice. থাকুক না সকলের ঈশ্বর মিলিয়ে মিশে, ঝগড়া না করে। নিজের নিজের ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ঝাগড়া, বিবাদ, জিহাদ না করলে ঈশ্বরের মত মধুরতম আপনার জন আর কে আছে? After all, আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠতম গুণগুলোকেই তো ঈশ্বরে আরোপ করি। আর নিজের নিজের জীবনে সেগুলোকে পালন করতে রোজ ভুল হয়ে যায় কি করে? যাই হোক, ফিরে আসি সহকারী সূরীর কথায়। সূরী কেন কোন ভারতীয় ভাষা জানে না, সেটা নিয়ে মনে মনে বিচার করে দেখলাম কারণটা definitely technical নয়। German, French কিছুটা ইংরেজির কাছাকাছি হলেও আমার মনে আছে চাকরির প্রথম বছরে পেশাগত যোগ্যতা বাড়াতে আমি জাপানিজ শেখার ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। কোম্পানি থেকে শেখাচ্ছিল বিনামূল্যে। এমন শক্ত ভাষা যে মাস দেড়েক শিখেই আমি বললাম ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। হিন্দি, বাংলা ইত্যাদি তার নিরিখে বেশী শক্ত নয়, এ কথা হলফ করে বলা যায়। ভাষাভাষীর সংখ্যা কত সেটাও নিশ্চয়ই সূচক নয়। তার নিরিখে হিন্দি চার আর বাংলা সাতে। অর্থাৎ কারণটা নিঃসন্দেহে বাণিজ্যিক। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে অনেকেই সূরীকে এবং তার বাড়ি আইফোনকে afford করতে পারবে না। সেটাই তবে প্রধান কারণ? হয়তো বা।

মেঘদুতমে এক খন্ড মেঘকে নিজের ভালবাসার কথা জানিয়ে আপন প্রিয়ার কাছে পাঠিয়েছিল নির্বাসিত যক্ষ। আমি তো কালিদাস নই। মেঘখণ্ডের মধ্যে দূতীকে খুঁজে পাই না তাই। সূরীকে বললাম আমার স্ত্রীকে লিখে পাঠাতে পার “across the distance and spaces between us, I see u, I feel u.” সূরী গড়গড় করে লিখে দিয়ে লেখাটা আমায় দিয়ে একবার proofread করে নিয়ে পাঠিয়ে দিল তার ওয়েব ঠিকানায়। একটু মুচকি হাসল কি? কে জানে? আজ হয়তো হাসে নি। আজ হয়তো সে আবেগহীন, emotionless, শুধুই একটা piece of software. একদিন সে নিজেকে জানবে। একদিন তার “আমি বোধ” আসবে আমাদের মত। আজ থেকে একশ বছর পরে আমার উত্তর পুরুষ যখন সূরীর সাহায্যে প্রেমপত্র পাঠাবে তখন সে যে মুচকি হাসবে না এমন কথা কে বলতে পারে?           

আজ বসন্ত – রম্যরচনা

আজ বসন্ত। দাপুটে শীতবুড়িকে এ বছরের মত অক্ষম করে দিয়ে আবার ফিরে এসেছে যুবতী বসন্ত। তার মোহময়ী যৌবনের ছোঁয়া লেগেছে সবখানে। গাছের ডালে ডালে ভিড় করে এসেছে কচি সবুজ শিশু পাতারা। বসন্তের ঋতু রঙ লেগেছে গাছেদের শরীরে। কিন্ডারগার্ডেনের একগাদা খুদে ওস্তাদের মত কচি কিশলয়রা খুশি খুশি মুখ করে ইতিউতি তাকাচ্ছে। ঘাসে ঘাসে ফুটে উঠেছে হলুদ ঘাসফুল। ড্যান্ডিলিয়ন নাম এর। ফুলেল পৃথিবীতে জাতবিচারে এরা নিতান্তই দলিত। একধরণের বুনো ফুল বলা যায়। কেউ আদর করে বাগানে লাগায় না। ভালবেসে জল দেয় না। একগোছা ড্যান্ডিলিয়ন ফুলদানিতে সাজিয়ে বা চুলে গুঁজে কেউ প্রিয় মানুষটির অপেক্ষা করে না। বরং উইড কন্ট্রোল লাগিয়ে বাগান থেকে উচ্ছেদ করারই’ রীতি। কেউ তারিফ করে না বলেই হয়তো রাস্তার ধারে ধারে অনাদরে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে এদের উদ্ধত আত্মপ্রকাশ। গাঢ় সবুজ ঘাসের বুকে হাজারে হাজারে ফুটে থাকা বাসন্তী হলুদ রঙা ড্যান্ডিলিয়নের কি যে অপরূপ শোভা তাকে শব্দে ধরা বোধ হয় আমার সাহিত্যপ্রতিভার অতীত। যেন কোন অদৃশ্য শিল্পী সবুজ ঘাস গালিচাতে হলুদ রং তুলি নিয়ে মাইলের পর মাইল জুড়ে এঁকেছে এক চোখ জুড়োন আলপনা। প্রতিটা ফুলেরই যেন একটা নিজস্ব স্বত্বা আছে, একটা পৃথক ব্যক্তিত্ব। মৃদু দখিনা হাওয়ায় খুশিতে মাথা দোলাচ্ছে কেউ কেউ। কোন কোন ফুল তার সুন্দরী সঙ্গিনীর সাথে প্রেমালিঙ্গনে বদ্ধ। কেউ ভাবুক চুপচাপ, কেউ নীরবে বাক্যালাপ করছে পার্শবর্তিনীর সাথে। অনেকক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলে একটা নেশার মত হয়। শুধু ওরাই নয়, রূপ-রঙ-রসের খেলায় মেতেছে আরও কতরকমের গাছ। ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে বিভিন্ন গুল্মরাজি – কেউ সাদা কেউ বেগুনী কেউ কমলা। ওদের চুপ ভাষায় কতরকমের ফিসফিসানি। এ বলছে আমায় দেখ, ও বলছে আমায়। নিজেকে আরও আকর্ষনীয় করে তুলতে কোন গাছ হয়তো সুগন্ধি মেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে পাশ দিয়ে গেলে অপূর্ব সুবাসে চলার গতি আপনা থেকেই শ্লথ হয়ে আসে। তখন বেশ টের পাই গাছের বুক কেমন করে গর্বে ফুলে ওঠে। ছবির মত সুন্দর ছোট ছোট একচালা বাড়িগুলোর পাশে পাশে কোথাও ফুটেছে হায়াসিন্থ, কোথাও টিউলিপ। সদ্য প্রস্ফুটিত আধো খোলা লাল হলুদ টিউলিপগুলোর মধ্যে কেমন যেন যৌবনে সবে সবে পা রাখা কিশোরীর লজ্জা। নিজেদের খুলে ধরার এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা ওদের মধ্যে। নীরব গুঞ্জনে মাথা নেড়ে নেড়ে টীনেজ টিউলিপরা একে অপরকে প্রথম প্রেমে পড়ার গল্প শোনাচ্ছে কি? হায়াসিন্থগুলো নিজেদের রঙের জৌলুসে গরবিনী। একটু কেমন চুপচাপ, একলা। হাজারে হাজারে ফুটেছে সাদা চেরি ব্লসম গুলো। এত ভিড় করে এসেছে যে মনে হচ্ছে সাদার আগুন লেগে গেছে চেরি গাছগুলোয়। কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে চোখ যেন ধুঁধলে যায়। গা ভর্তি পাতা আর ফুলের গয়না পড়ে অগুনতি গাছ আজ বসন্তে এই বিউটি কনটেস্টে নাম লিখিয়েছে। তিলোত্তমা উপাধি পেতে সবাই যেন বদ্ধ পরিকর। রং শুধু প্রকৃতির বুকে লাগে নি, রং লেগেছে পাখিদেরও মনে। কিচিরমিচির করে একটানা কথা বলে যাচ্ছে যেন এক যুগ ধরে তারা নীরব ছিল। একটা সবজে রঙা পাখি কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কোন ডালটায় বসা উচিত। ব্যস্ত হয়ে একডাল থেকে আর এক ডালে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। শীতের ঝাঁঝ কমার ফলেই ওদের উৎসাহে জোয়ার লেগেছে নতুন করে। আর একটা হলদে-গলা পাখি গাছের উঁচু ডালে বসে সমানে টিঁউ টিঁউ করে ডেকে যাচ্ছে। নির্লজ্জ ভঙ্গিতে গলা ফুলিয়ে সঙ্গিনীদের সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। একটা উৎসাহী কাঠবিড়ালি গাছের গুঁড়ি বেয়ে নেমে একবার করে জুলজুল চোখে তাকাচ্ছে, আবার কি ভেবে, বোধ করি সাহসের অভাবেই, গাছের গুঁড়ি বেয়ে আবার নিজের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাচ্ছে। এমন ত্রস্ত ভাব যেন কাউকেই তেমন বিশ্বাস করে না। সব মিলিয়ে প্রাণ লেগেছে সবখানে। প্রকৃতির পাত্র কানায় কানায় ভরে উঠেছে। প্রাণে টইটুম্বুর। শুরু হয়েছে এক অত্যাশ্চর্য মিলনখেলা। কালো ভোমরাগুলো সৃষ্টির বীজ নিয়ে ফুল থেকে ফুলে ঘুরছে। ফুলেদের গর্ভনিষেক হলেই তো আসবে পরবর্তী উদ্ভিদ প্রজন্ম। পৃথিবীর প্রাণের ইতিহাসে এই মানুষই নবীনতম প্রাণী। মানুষ আসার আগেও হাজার হাজার বছর ধরে নীল্গ্রহে এসেছে নির্জন বসন্ত। প্রকৃতি এরকমই রূপের ডালি সাজিয়ে বসেছে। কার জন্য? কোন মুগ্ধ চোখের অপেক্ষায়? আসলে এর পেছনেও আছে সিসৃক্ষা, সৃজনের ইচ্ছা। সৃষ্টি করার ইচ্ছাই বোধ হয় এই সৃষ্টির সবচেয়ে পাওয়ারফুল মোটিভ, সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাইভিং ফোর্স। প্রতিরূপ তৈরী করার ইচ্ছে নিয়েই প্রোটিন সেল কোষবিভাজন পদ্ধতিতে এক থেকে দুই হয়েছিল কোন এক বিস্মৃত অতীতে। সেই থেকে সমানে চলেছে। আসলে গাছেরা ফুলের ডালি সাজিয়ে বসে, ফুলেরা গন্ধ আতর মেখে বসে এক আদিম সৃজনেচ্ছা থেকেই। ওদের চোখের ভাষায় যে আহ্বান লেখা থাকে তা ইতিহাসের একেবারে শেষ অধ্যায়ে আসা মানুষ প্রজাতির মনোরঞ্জনের জন্য নয়। ওরা তো আকর্ষণ করতে চায় ঐ ভোমরাদের যারা ফুল থেকে ফুলে রেণু ছড়িয়ে দেবে। আর তার থেকে সৃষ্টি হবে নতুন প্রজন্ম। নতুনকে সৃষ্টি করার ইচ্ছে নিয়েই, প্রতিরূপ গড়ার ইচ্ছে থেকেই তাদের এই নির্লজ্জ আত্মবিপণন। পৃথিবীতে নতুনকে আনার জন্য আর সেই নতুনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা তো সকলেই রোজ নিজেকে বিক্রি করতে পসরা সাজিয়ে বসি। চাষজমির মাঠে, কারখানার ফ্লোরে শ্রম বিক্রি হয়, বহুতল অফিস বিল্ডিঙের ফ্লোরে বিক্রি হয় মেধা। নিজের থেকে উদ্ভিন্ন প্রাণকে আরও প্রবলতর মুক্তিবেগ দিতেই আমরা নিজেদেরকে আরও বেশি করে আকর্ষণীয় করে তুলি। সেই অর্থে তো আমাদের রোজই বসন্ত। তবু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বেড়াজালে আমাদের মুগ্ধতাকে তো বেঁধে ফেলা যায় না। তাই প্রতি বসন্তেই কবিরা কবিতা বাঁধে, কবিয়ালরা গান। যা কিছু নিঃশেষ, যা কিছু আবর্জনা তাকে পেছনে ফেলে রেখে প্রাচুর্যের আতিশয্যে সাজে আমাদের অন্তর, আমাদের বাহির।  

তোকে চাই না – কবিতা

একলা পথে চলব তোকে চাই না

                একলা কথা বলবে মন আয়না

তোর চোখে চোখ রেখে সারা রাতটা

                জাগবো না আর, দেখব না ঐ রূপটান।

 

তোর কথা আর ভাববো না। বৃষ্টির গান

                    আনবে না আর মনে তোর ঐ মুখখান

চাঁদ সোহাগি সন্ধ্যা, জ্যোৎস্নার জল

                     তোর স্মৃতিতে করবে না মন চঞ্চল

বর্ষামুখর সন্ধে শহর। সিক্ত।

                    তোর বিহনে চলছে কেমন। বেশ তো।

তোর ভেজা চুল আর ভেজা ঠোঁট চাউনি

                    থাক তোলা থাক। আজ শহর হোক মৌনী

 

আজকে শুধু চাঁদ হারাবে জ্যোৎস্না

                     তোর বিহনে বিয়োগ বিধুর রোশনাই

অশ্রুরা সব চোখের কোনে বন্দি

                     ভুলবো বলে ভুল করে আজ

                                           তোর ছবিতেই রঙ দিই

——

ভাল লাগলে এই কবিতাটা পড়বেন।

https://jojatirjhuli.net/2017/02/16/aholyake/

একলা পথে চলব তোকে চাই নাClick To Tweet

যযাতির ঝুলি টাটকা তাজা
ইমেলে পেলে ভারি মজা

ট্রেনপথে – রম্যরচনা

[২০ নভেম্বর, ২০১৭-এর স্মৃতিচারণ ]

 

কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়লেই চোখে পড়ে বাংলার সবুজ সুন্দর সহজিয়া রুপ। আমাদের মত  যারা কর্পোরেট কালচারে অভ্যস্ত ব্যস্ত শহুরে প্রাণী, তাদের এই বর্ধমান কি দুর্গাপুর যাওয়ার পথে, ঐ আকাশের পাড় পর্যন্ত আঁকা সবুজে আল্পনার থেকে বেশি প্রকৃতিস্নান ভাগ্যে লেখা নেই। একটা কংক্রিট জঙ্গল থেকে আর একটাতে যাওয়ার পথে উপোসী চোখ দিয়ে জানালা পথে যতটুকু সবুজের সন্ধান করে ফেরা সম্ভব আর কি! তাও চারচাকা বাহনটির বদান্যতা মিললে সেটুকুও হয়ে ওঠে না। সে বড় উদ্ধত যান। তার ভিতরে ঢুকলেই ঘষা কাচ তুলে দিয়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মিঠে স্নেহপরশ মেখে চোখ মুদে থাকি। অধিকাংশ সময়েই বিশ্বস্ত বাহনটি হাজির থাকে। কিন্তু এবারে বাড়ির গাড়িটা না পাওয়া যাওয়ায় অগত্যা ট্রেন পথে বর্ধমানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নারকেল গাছের সঙ্গে কলাগাছ জড়াজড়ি, মাখামাখি করে মিলেমিশে আছে যেন কতো প্রাচীন এক বন্ধুত্ব। পানায় ভরা পুকুর রেল লাইনের ধারে ধারে। তাতে অজস্র শালুক ফুল অযত্নে ফুটে আছে। কি একটা অজানা কারণে এই অনন্য রুপসী ফুলগুলো মানুষের সর্বগ্রাসী গৃধ্নুতার হাত থেকে আজও বেঁচে আছে। বাজারের ফুলের দোকানে এদের দেখা মেলে না। মাতৃক্রোড় থেকে তুলে নিলেই ফুলগুলো বড় তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। তাই বোধ হয় বাজারি মর্যাদা পায় নি। আমরা যারা মফস্বলের মানুষ তারা বোধ হয় ছোট বেলায় বকুল, কদম, শালুক ফুল নিজের হাতে তোলার আনন্দ পেয়েছে। যারা কলকাতায় মানুষ, বড় শহরে মানুষ, তারা আর্সালানের বিরিয়ানি, পার্ক স্ট্রীটের পিটার ক্যাটের চেলো কাবাব খেতে খেতে অনেক কিছু, অনেক কিছু মিস করে গেছে। একটু এগোতেই দেখা গেল টালির চালের বাড়ি। ওপরে কুমড়ো লতা। তাতে একটা হলদে কুমড়ো ফুল লাজুক চোখে চেয়ে আছে। আহা তার কি শোভা। অন্যান্য কবিদের মত বাংলাকে যদি কখনও কোনো নারীরূপে কল্পনা করি, যে মেয়েটার ছবি মনে আসে সে ফর্সা, উজ্জল, গৌরবর্ণা চটকদার সুন্দরী নয়, ডানাকাটা পরী নয় – শ্যামলা রঙের ডাগর চোখের মিতভাষী কোনো মেয়ে। জানি এই গ্রাম বাংলার মানুষগুলো আর এই মায়াময় রুপসী প্রকৃতির মত সুন্দর নির্বিবাদী নয়। বিশ্বায়ন, বাণিজ্যায়ন, রাজনীতি, বহির্বিশ্বের হাতছানি প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে জনজীবনের রুপরেখা। কিন্তু এই যে গাছ, ধানখেত, মেঠো রাস্তা, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা বক যারা ইন্টারনেটের তীব্র দহনে নিত্য ব্যতিব্যস্ত নয়, তাদের মধ্যে দিয়ে বোধ হয় আজ সেই মাথায় এক ঢাল চুলওলা ছিপছিপে সুন্দরী বাঙালি মেয়েটা, বাংলার স্বত্বাটি বসে থাকবে। এই মায়ারই আকর্ষণে কবিরা বারে বারে সৃষ্টি করেছে নীরা, বনলতা সেনদের। যাবতীয় নাগরিক ক্লান্তি আর শহুরে বিষাদ থেকে দু দণ্ডের শান্তি পেতে বারে বারে ছুটে যেতে চেয়েছেন এই মায়াবী মানবীর কাছে। এখন বর্ষাকাল নয়। কিন্তু বঙ্গোপসাগর ব্যাপী নিম্নচাপ অসময়ে সঘন মেঘমালায় আকাশ ছেয়ে দিয়েছে। সদ্যবৃস্টিস্নাত সর্ষে খেতে যেন কোনো সদ্য যুবতীর মুগ্ধ চোখের মাদকতা। তাল আর নারকেল গাছেরা এক জলজ বিষণ্নতা চোখে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। পাশেই একটা ছোট্ট জলা জায়গা। ডোবা বলা চলে। একটা মাছরাঙ্গা পাখি তার পাড়ে সন্ধানী চোখে চুপ করে বসে আছে। চোখে তার আলগোছে টানা রূপটান। আর একটু এগোতেই রেললাইনের ধারে একটা ছোট্ট গ্রাম। কিছু একচালা বাড়ি। একটা পুকুর। কিছু হাস মুর্গি পুকুর পাড়ে দল বেধে বসে গুষ্ঠিসুখ উপভোগ করছে। অকালবৃষ্টিতে পর্যুদস্ত সদ্য বোনা ধানের চারাগুলো তাদের কচি মাথা দোলাচ্ছে। পুকুরপাড়ে কিছু পঁচিশ-তিরিশ বছরের বিবাহিত মেয়ে বসে বাসন মাজছে। আটোসাঁটো করে পরা শাড়ীর ভিতর থেকে লাউডগার মত লকলকে যৌবন চলকে পড়ছে। হয়ত এর মধ্যে কোনো কাব্য নেই। হয়তো এ কঠোর জীবনসংগ্রাম। কিন্তু সেইভাবে দেখতে গেলে এই ক্রুরা কঠোরা পৃথিবী সবটাই কঠোর গদ্যময়। এর মধ্যে যেটুকু কাব্য আমরা খুঁজে নিই সেইটুকু আমাদের নিজেদেরই প্রয়োজন, নিজেরই মনের স্নানের জল জোগানোর প্রয়োজনে।

এইসবই হাবিজাবি ভাবছিলাম। হঠাৎ এক অন্ধ বেসুরো গায়কের গানের আওয়াজে  ঘোর কাটল।

“সে যে গান শুনিয়ে ছিল হয় নি সেদিন শোনা। সে গানের পরশ লেগে হৃদয় হল সোনা।

চেনা শোনা জানার মাঝে কিছুই চিনি না যে। অচেনায় হারাল মন আবার ফিরে এসে।”

আজ হঠাৎ গানটা বড়ো প্রাসঙ্গিক মনে হল। সামান্য আর্থিক সঙ্গতি বাড়লেই এই কলকাতা-বর্ধমান কি কলকাতা-খড়গপুর টাইপ স্বল্প দূরত্বের ট্রেনপথগুলো অচেনা হয়ে যায়। সেই অচেনা পথেই যদি একদিন সফর করা হয়, সুর হারাব বলেই যদি একদিন গান সুরে বাঁধা হয় সেটাকে উপভোগ করার মন কি আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি? boyhood থেকে adulthood-এ পৌঁছনোর ঠিক কোন বাঁকে আমাদের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা, মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতাটুকু ফেলে রেখে আসি সেইটে শুধু ভেবে পাই না। Antibiotic খাওয়ার সাথে সাথে যেমন শরীরমধ্যস্থ ব্যাকটেরিয়াদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে থাকে ঠিক সেভাবেই মুগ্ধ হওয়ার যে সহজাত ক্ষমতা একটা শিশুর থাকে, বয়ঃপ্রাপ্তির সাথে সাথে মন যত পেকে ঝুনো হয়, ততই মন রূপ-resistant হয়ে যায়। তখন মানালি শহরে বিপাশার জলে পা ডুবিয়ে মনে হয় আল্পস না দেখলে পাহাড়ের রূপ কিছু দেখাই হল না। গোয়ার সমুদ্র সৈকতে বসে মনে হবে ফুকেটে সমুদ্রস্নান না করলে কোনো মজা নেই। Way of living-এর ওপর অনেক talk শুনেছেন, সপ্তাহখানেকের কোর্সও কেউ কেউ attend করেছেন। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানেন, বয়সের সাথে সাথে মুগ্ধতা, বিস্ময় এ সবের প্রতি আমাদের যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, ওটাকে রুখে দেওয়ার সচেতন বা অবচেতন নিয়ত চেষ্টা করাই রক্তচাপ, irritability, hypertension কমানোর সব চেয়ে ভাল উপায়। মনটাকে আর একটু গ্রহণক্ষম, receptive রাখলেই দেখবেন অজস্র ছোট্ট রঙ্গিন জলফড়িঙদের মত খুচরো খুচরো আনন্দের উৎস আপনার চারপাশে লুকোচুরি খেলছে। Quality আনন্দ একেবারে বিনামূল্যে অফার করাই আছে আপনাকে। খুঁজে নিতে পারলেই হল। যদি আমাদের কোন পুরনো স্মৃতিই না থাকত, প্রতিদিনই যদি একটা আনকোরা নতুন দিন হত, প্রতিটা সূর্যোদয় দেখেই যদি সেই প্রথম সূর্যোদয় দেখার মত শিহরণ হত, তবে কি ভালই না হত। তাই না?

এই ভাবে সবুজের বুক চিরে ট্রেন যখন বর্ধমান ছুঁলো তখন স্বপ্নভঙ্গের মত ঘুম ভাঙ্গাল কর্কশ গলায় চিৎকার “ভাঁড়ে চা ভাঁড়ে চা।” বর্ধমান স্টেশানে তড়িঘড়ি নেমে টোটো করে যাত্রা শ্বশুরবাড়ির পথে। ছোটবেলায় মা বলত “পড়াশুনো নেই, খালি টোটো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”এই বুড়ো বয়সে কথাটা যেভাবে আক্ষরিক অর্থে ফলে গেছে তাতে মাকে নস্ত্রাদামুস-এর ছোটবোন বলা যেতেই পারে।এই বায়ুদুষণরহিত, শব্দদুষণরহিত battery driven ত্রিচক্রযানটি শহরতলি অঞ্চলে বহুল জনপ্রিয় এখন। তিন-পেয়ে অটোর এই নির্বিবাদী ছোট ভাইকে মানুষ আদর করে নাম দিয়েছে টোটো। সারাদিন তাই অনায়াসেই এখন টোটো করে যত্রতত্র ঘোরা যায়। যাওয়ার পথে একটা বাড়ির নাম চোখে পড়লো “মুকুল-রাঙা”। মিস্টি নামখানা। ইঁট-কাঠ-পাথরের শুকনো মরুভূমির মধ্যে সুন্দর নামখানা নিয়ে মরূদ্যানের মত দাঁড়িয়ে আছে যেন বাড়িখানা। অনেকক্ষন ধরে ঐ সুন্দর নামখানা মনের মধ্যে সুর ছড়াতে লাগলো। এই বাড়িটার বাসিন্দারাও কি বাড়ির নামের মতই সুন্দর না জীবন যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত, irritated? কে জানে। অন্তত সেই মানুষটা, যিনি বাড়ির নামখানা মুকুল-রাঙা রেখেছিলেন, তিনি অন্তত কালবৈশাখীর ঝড়ে কুচো আম কুড়োতে বেরোন কি আজও? এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পৌছে গেলাম গন্তব্যে। বেশ কাটলো ঘন্টা খানেক। মানুষের কাছাকাছি। মানুষের পাশাপাশি।

****

বাধ্যতামূলক সতর্কীকরণঃ যযাতির ঝুলির সব লেখাই শতাধিক বার ফেসবুকে শেয়ার হয় সেটা তো সুধী পাঠক বা প্রিয়দর্শিনী পাঠিকা নিচের ফেসবুক শেয়ার বাটন দেখে বুঝতেই পারছেন। এত অকুণ্ঠ ভালবাসা দেওয়ার জন্য পাঠক পাঠিকাকে যযাতির আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আপনিও শেয়ার করুন। কিন্তু শেয়ার করার আগে নিচের কমেন্ট বক্সে (বেনামী হোক বা নাম সহ) একটি মন্তব্য ছেড়ে যান যাতে যযাতি তার যজমানদের একটু চিনতে পারে। যযাতি তার ফেসবুক পেজের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। পোস্ট ভাল না লাগলে আপনাকে ছাড় দেওয়া হবে, কিন্তু ভাল লাগলে কমেন্ট না করে শুধু শেয়ার করলে যযাতির অভিশাপে (বিবাহিত হলে দাম্পত্য কলহজনিত কারণে আর অবিবাহিত হলে বাবা মার দাম্পত্য কলহজনিত কারণে) আগামী রবিবার রবিবাসরীয় লুচি তরকারি থেকে বঞ্চিত হবেন।

 
যযাতির ঝুলি টাটকা তাজা
ইমেলে পেলে ভারি মজা